Alapon

শতাব্দীকালের প্রতিরোধ যুদ্ধ অতঃপর হতাশা

সিরাজের পতন অতঃপর মীর কাসিমের প্রতিরোধ যুদ্ধের অবসান হলে ইংরেজরা শুধু মাত্র শোষণ এবং এদেশের সম্পদ লুণ্ঠনের মধ্যে তাদের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখেনি। তাদের সহযোগী, তাদের জুনিয়ার পার্টনার বর্ণবাদী হিন্দুদের সহযোগিতায়ই মুসলমানদের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভাঙলো। অতঃপর শিক্ষা সংস্কৃতি সভ্যতা সবকিছু থেকে বঞ্চিত করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখল। একদিকে বৃটিশদের বিমাতাসুলভ আচরণ, নীলকরদের অত্যাচার অন্যদিকে হিন্দু জমিদারদের শোষণ ও অত্যাচারে এদেশের মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়ল।

মুসলমানরা চাকুরি হারাল, আয়মা লাখেরাজ সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হল। লক্ষাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ায় সমগ্র জাতি ঘোর অন্ধকারে নিমজ্জিত হল। বিলাতী বস্ত্রে ছেয়ে গেল দেশ। লক্ষ লক্ষ তাঁতী হল কর্মহীন। লবণ ব্যবসা চলে গেল ইউরোপীয়দের হাতে। নীলকরদের অত্যাচারে সর্বসান্ত হল কৃষকরা। খাজনা আদায়ের ভার দেয়া হল হিন্দুদের। জমিদার হয়ে বসল হিন্দুরা। অর্থনীতির সব সেক্টর থেকে মুসলমানরা হল বিতাড়িত।

এই সর্বহারা মুসলমানরা পরাধীনতার ঘোর অন্ধকারে তাদের হারানো ইতিহাস ঐতিহ্য হাতড়ে ফিরল। দেখল তাদের সব কিছু ধ্বংস স্তূপের নীচে চাপা পড়ে আছে। সেখান থেকে পুনরুদ্ধারের উদ্যোগ নিল। দেখল ঔপনিবেশিক শক্তি এবং তাদের ব্রাহ্মণ্যবাদী সহযোগীরা বিঘ্নের পাহাড় হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। নিপীড়নের মধ্য দিয়ে নিষ্পেষিত জনগণের প্রতিরোধ শক্তি দানা বেধে উঠল। ক্ষমতার দ্বন্দ্ব পরিণত হল গণ প্রতিরোধে। সিরাজের পতন পর্যায়ে যে জনগণ ছিল প্রতিক্রিয়াহীন সে জনগণ স্বাধীনতা সংগ্রামে সম্পৃক্ত হল।

যারা সবকিছু চাওয়া পাওয়ার বাইরে অবস্থান করছিল সেই ফোকরা গোষ্ঠি সংঘবদ্ধ হল এবং এগিয়ে এলো প্রতিরোধ যুদ্ধে। হৃত স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের জন্য জানবাজি রাখতে তৈরি হল। ইতিহাসে যেটা পরিচিত ফকীর বিদ্রোহ নামে। শুধুমাত্র বাংলায় স্থানীয়ভাবে বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। ত্রিশটি বছর বিদ্রোহে বর্ণবাদী হিন্দুরা ছিল ঔপনিবেশবাদী বৃটিশদের সর্বাত্মক সহযোগী। তাদের প্ররোচনায় কোন নিপীড়নকারী হিন্দুদের কোন একটি অংশও স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নেয়নি। এককভাবে মুসলিম জন গোষ্ঠী স্বাধীনতা সংগ্রামে একটানা একশ বছর ‘বিরামহীন ভাবে লড়াই করেছে।

ফকির বিদ্রোহ থেকে মুজাহিদ আন্দোলন সবখানে ছিল মুসলমানদের সক্রিয় ভূমিকা। শুধুমাত্র ভারত কাঁপানো সিপাহী বিদ্রোহে ঝাঁসীর রানী লক্ষ্মীবাই এবং তাতিয়া তোপি এবং অবাঙালী সিপাহীরা বিদ্রোহে যোগ দিলেও বাঙালী বাবুরা এ বিদ্রোহে থেকে দূরেই শুধু অবস্থান করেনি তারা সিপাহী বিপ্লবের সময় ইংরেজদের সার্বিকভাবে সহযোগিতা করে নিজেদের ঔপনিবেশিক দালাল হিসেবে চিহ্নিত করেছে। স্বার্থপর শিখরা সিপাহী বিপ্লবের সময় স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগদানের কথা চিন্তা করেনি। তারাও ব্রাহ্মণ্যবাদী চক্র এবং বাঙালী বাবুদের মত ভারতে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে ছিল শংকিত। একজন বাহাদুর শাহর পরিবর্তে একজন ডাল হৌসীর প্রয়োজন ছিল তাদের কাছে অনেক বেশী।

‘ভারত উপমহাদেশে সিপাহী বিপ্লবের প্রচন্ড ঝড়কে চোখ বন্ধ করে উপেক্ষা করেছে শিখ ও কোলকাতা কেন্দ্রিক হিন্দু এলিট গোষ্ঠী বর্ণ হিন্দু ও তার প্রভাবিত বাঙালী হিন্দুরা। এরা ঝড়ের ঝাপটা থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য ইংরেজদের পক্ষপুটের নিবিড় আশ্রয়ে নিরাপদ অবস্থান নিল। যখন ঢাকার পথে গাছের ডালে ডালে মুক্তিকামী স্বাধীনতা সংগ্রামীদের লাশ ঝুলছিল তখন কোলকাতার বাবুদের ঘরে ঘরে চলছিল বিজয়ের মহোৎসব।

যখন সমস্ত উপমহাদেশের মুসলমান ও সংশ্লিষ্ট অবাঙালী হিন্দুদের বুক বিদীর্ণ হচ্ছিল বন্দুকের গুলিতে তখন কোলকাতায় আতসবাজী দিয়ে বিজয়ী বৃটিশদের জানান হচ্ছিল সাদর অভিনন্দন। যখন মুসলিম রমনীদের চোখে নতুন করে ঝরছিল স্বজনহারা বেদনার অশ্রু তখন কোলকাতার হিন্দুকূল বধূরা উলুধ্বনি দিয়ে জানাচ্ছিল সম্ভাষণ। যখন লালবাগের ভাঙা কেল্লায় রক্তাক্ত সিপাহীরা আর্তনাদ করছিল তখন নির্মিত হচ্ছিল বাবুদের জন্য ইংরেজদের বিশেষ উপহার কোলকাতা বিশ্ব বিদ্যালয়।

সিপাহী বিপ্লবের প্রজ্জ্বলিত শিখা যখন ছড়িয়ে পড়েছে উপমহাদেশের সর্বত্র তখন ইশ্বর গুপ্ত সম্পাদিত সংবাদ প্রভাকর পত্রিকায় তৎকালীন বাঙালী অর্থাৎ হিন্দু সমাজের উদ্দেশ্যে উপদেশ প্রদান করে বলা হয়- ‘হে বাঙালী মহাশয়েরা এ বিষয়ে আপনাদের যুদ্ধ করিতে হইবে না। আপনারা শুধু একান্ত চিত্তে কেবল রাজপুরুষদের মঙ্গলার্থে সাস্ত্রায়ন করুন। 
 
সিপাহী বিপ্লবের আগুন স্তিমিত হল। মুক্তিকামী সিপাহী ও জনতার লাশ মাড়িয়ে ইংরেজ সেনাপতি দিল্লীতে প্রবেশ করলে কোলকাতায় বয়ে যায় আনন্দের বন্যা। হিন্দু মানস উল্লসিত হয়ে ওঠে। পণ্ডিত গৌরী চন্দ্র সম্পাদিত সম্বাদ ভাস্মর পত্রিকায় মন্তব্য করা হয়- ‘হে পাঠক সকল উদ্বাহু হইয়া পরমেশ্বরকে ধন্যবাদ দিয়া জয়ধ্বনি করিতে করিতে নৃত্য কর’। 

কোলকাতার বাবুরা বৃটিশদের এতখানি আস্থাভাজন হয়েছিলেন যে, সমগ্র ভারতের ১৪টি শহরে সামরিক আইনের এবং ঔপনিবেশিক নিপীড়নের স্টীম রোলার অব্যাহত ভাবে চললেও কোলকাতা সামরিক আইনের আওতার অন্তর্ভুক্ত ছিল না। এছাড়াও বাংলার বাইরে বাঙালী হিন্দুদের গৃহে ‘ক্যালকাটা বাবুজ’ লেখা থাকলে সেটাও জুলুম মুক্ত নিরাপদ গৃহ হিসেবে বিবেচিত হতো।

ডক্টর আনিসুজ্জামানের মন্তব্যে বলা হয়েছে- সিপাহী বিপ্লবের সমস্ত দায়িত্বটা কিন্তু ভারতীয় মুসলমানদের ঘাড়ে এসে পড়েছিল। দেশে এবং বিলেতে শাসক মহলে এ ধারণা সৃষ্টি হয়েছিল যে, মুঘল শাসনের পুনঃ প্রতিষ্ঠার জন্য মুসলমানরা এ বিদ্রোহ ঘটিয়েছিলেন। শাস্তিমূলক ব্যবস্থার মোটা অংশই তাদের ভাগ্যে জুটেছিল। 

১৮৫৭ সালের ২১ সেপ্টেম্বর ইংরেজ কর্তৃক দিল্লী দখলের পরদিনের বিবরণ দিয়েছেন জনৈক ইংরেজ- ‘আমাদের সৈন্যগণ নগরে প্রবেশ করার পর নগর প্রাচীরের মধ্যে যাকে পেয়েছে তাকেই বেয়নেটের আঘাতে হত্যা করেছে। কোন কোন বাড়ীতে চল্লিশ পঞ্চাশ জন লুকিয়েছিল। এ থেকে বোঝা যায় তাদের সংখ্যা বেশ ছিল। এরা বিদ্রোহী নয় শহরের অধিবাসী মাত্র।’

সিপাহী বিপ্লবের মর্মান্তিক পরিণতির পর মুসলমানদের পুনরুত্থান ও স্বাধীনতার আকাঙ্খা একেবারে স্থিমিত হয়ে পড়ে। স্বাধীনতাকামীদের যারা বেঁচে ছিলেন তারা বনে বাদারে অথবা নিভৃত পল্লীর অপরিচিত পরিবেশে স্থান নিলেন শুধু মাত্র ক্ষুদ কুড়ো দিয়ে জাবিকা নির্বাহের জন্য। নৈরাশ্য হতাশা ও নীরব কান্নায় গুমড়ে মরছিল সমগ্র মুসলিম জনগোষ্ঠী। হিন্দু বেনিয়া ও বৃটিশদের প্রতিশোধ স্পৃহা এবং তাদের বৈরী নীতি মুসলমানদেরকে অধঃপতনের দোর গোড়ায় নিয়ে এল। পাশাপাশি হিন্দু জনগোষ্ঠীর সৌভাগ্য আকাশ চুম্বী হয়ে উঠল। মুসলমানদের শুধুমাত্র দীর্ঘশ্বাস ছাড়া কোন অবলম্বনই অবিশষ্ট রইল না। 

মুসলমানদের পুনরুত্থান প্রয়াসের শেষ আলোটা যখন সিপাহী বিদ্রোহের বহ্নি শিখা হয়ে দপ করে নিভে গেল তখন থেকে শুরু হল সত্যিকার হিন্দু রেঁনেসা। মুসলমানদের শাসক জাতি থেকে কড়ির কাঙালে পরিণত করা পর্যন্ত যে সময়টুকু লেগেছিল এই দীর্ঘ সময় ধরে বৃটিশ তোষণের মধ্যদিয়ে হিন্দু জনগোষ্ঠী তাদের শক্তি সুসংহত করে। উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে প্রকৃত পক্ষে হিন্দু রেঁনেসার সূচনা হয়। সিপাহী বিপ্লবোত্তরকালে কোম্পানীর বদলে রাজকীয় শাসনের সবটুকু সুফল হিন্দুদের ভাগ্যে জুটে। তখনো মুসলমানরা নতুন করে পরাজয়ের হীনমন্য মানসিকতা নিয়ে হতাশা আর দুর্ভাগ্যের শেষ প্রান্তে এসে আশা নয় শুধুমাত্র আশঙ্কার ঘোর তমসায় আচ্ছন্ন। মুসলিম বিদ্বেষ ঘৃণা আর প্রতিহিংসার ভিত্তির ওপর গড়ে ওঠে হিন্দু রেঁনেসার ইমারত।

মুসলমানরা যখন জ্ঞান বিজ্ঞান সাহিত্য সংস্কৃতির অঙ্গন থেকে পরিত্যক্ত হয়ে অজ্ঞানতা ও অন্ধত্বের অথৈ সমুদ্রে আবর্তিত হচ্ছিল তখন হিন্দু জনগোষ্ঠী জ্ঞান-বিজ্ঞান সাহিত্য সংস্কৃতির নিত্য নব নব উপত্যকা পেছনে ফেলে দশ দিগন্তে পাখা মেলে এগিয়ে চলছিল। ডক্টর এম এ রহিম লিখেছেন- ‘উনবিংশ শতাব্দীর মধ্য ভাগ থেকে হিন্দু সমাজের ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের সূচনা হয় এবং ইহার উপর ভিত্তি করে তাদের রাজনৈতিক জাতীয়তার উত্থান হয়।

এ বিষয়ে ডক্টর আর সি মজুমদার লিখিয়াছেন, প্রাচীন ভারতের ইতিহাস কৃষ্টির ওপর ভিত্তি করিয়া ভারতীয় জাতীয়তাবাদ ও হিন্দুদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট গড়িয়া উঠিয়াছে। জাতীয় পত্রিকা নামক সাময়িকীর মাধ্যমে রাজ নারায়ণ বসু ও কবি গোপাল মিত্র হিন্দু জাতীয়তাবাদের বানী প্রচার করেন। ইশ্বর চন্দ্র গুপ্ত, রঙ্গলাল বন্দোপাধ্যায় হেম চন্দ্র, নবীন চন্দ্র প্রমুখ কবিগণ তাদের রচনার মধ্য দিয়ে হিন্দুদের হিন্দু জাতীয়তাবাদের আদর্শে উদ্বুদ্ধ করেন।

পরবর্তী পর্যায়ে বঙ্কিম চন্দ্র থেকে রবীন্দ্র নাথ পর্যন্ত অনেকেই হিন্দু রেঁনেসা সমুন্নত করার বিশেষ লক্ষ্যে সক্রিয় ছিলেন। প্রত্যেকের মধ্যে  ছিল মুসলিম বিদ্বেষ ও বৃটিশ তোষণ। যেমন আনন্দ মঠে বিসি চ্যাটার্জী সংলাপ আকারে লিখেছেন- আমরা রাজ্য চাহিনা কেবল মাত্র মুসলমানরা ভগবান বিদ্বেষী বলিয়া তাহাদের সবংশে নিপাত করিতে চাই ইত্যাদি।

হিন্দুদের এই মুসলিম বিদ্বেষ ও ঘৃণার উচ্ছাস মুসলমানদের মধ্যে অতি ধীরে হলেও চেতনার উন্মেষ ঘটাতে থাকে। অত্যন্ত ধীর গতিতে মন্দ মন্থরে মুসলমানরা শিক্ষাঙ্গনের দিকে পা বাড়াতে থাকে। মুসলমানদের মধ্যে অগ্রগামী ও চিন্তাশীল উদ্যোক্তা মুসলমানদের আড়ষ্টতা ভাংবার উদ্যোগ নেয়। ১৮৬৩ সালে কোলকাতার মোহমেডান লিটারারী সোসাইটি, ১৮৭৭ সালে কোলকাতার সেন্ট্রাল ন্যাশনাল মোহামেডান এ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সময় থেকেই মুসলমানদের মধ্যে দেখা যায় সংঘবদ্ধ হবার প্রয়াস।

১৮৮৩ সালে মুসলিমস সুহৃদ সমিতি গঠিত হয়। এই ভাবে মুসলমানরা একদিকে শিক্ষাঙ্গনে হাটি হাটি পা পা করে পদচারণা শুরু করে অন্যদিকে সমিতি সোসাইটি গঠন করার মধ্যদিয়ে রাজনীতি সচেতন হয়ে উঠে।

তথ্যসূত্রঃ 
বইঃ Behind The Nyth of 3 Million লেখক- কে এম আমিনুল হক   

পঠিত : ১৫৮৯৪ বার

মন্তব্য: ০