Alapon

সভ্যতা বিনির্মাণ ও প্রাসঙ্গিক ভাবনাঃ

যুবক বিশ্বাস করতো- আবারও এক সোনালী সভ্যতার আগমণ ঘটবে। এ বিশ্বাসকে আকড়ে ধরে সে পথে নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে সে যুবক। সাথে সঙ্গী হিসেবে পেয়েছে কিছু সাথী। যারা উম্মাদ তবে যোগ্য, যারা নির্ভীক তবে দয়ালু, যারা বাতিলের প্রতি নির্মম তবে মজলুমের সেবক।
যেকোন কিছু করার পূর্বে প্রথমে তা বিশ্বাস করতে হয়। যখন বিশ্বাস দৃঢ় হয় কেবল তখনই বিশ্বাস কাজে পরিণত হয়।
আমাদের স্বপ্ন নতুন এক সভ্যতা বির্নিমান করা, নতুন একটি দুনিয়া প্রতিষ্ঠা যেখানে জুলুমের লেশমাত্র থাকবে না। আমাদের স্বপ্নই আমাদের বিশ্বাস।
কিন্তু আমাদের বলা হয়- "তোমরা গুটিকয়েক লোক কিই বা করবে?? পুরো পৃথিবীর প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নতুন একটি আদালতময় ব্যবস্থার উত্থান এতো সহজ নয়।"
কিন্তু বক্তা একথা ভুলে যান যে- বর্তমানের এই সভ্যতা ৩০০ বছর পুর্বেও এতো শক্তিশালী ছিল না। ৪০০ বছর পূর্বে ওরাই পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত সিস্টেমকে পরিবর্তনের প্রচেষ্টায় নেমেছিল পুরো পৃথিবী শাসনের স্বপ্ন নিয়ে। ৫০০ বছর পূর্বে নিজেদের মধ্যকার সংঘাতের মধ্যেই মশগুল ছিল। আর ১৩০০ বছর পূর্বে সভ্যতা বলতে কিছুই ছিল না ওদের।
বৃটিশরা উপমহাদেশে তাদের ২০০ বছরের শাসনামলে আমাদের ঐতিহ্যময় সভ্যতাকে গুড়িয়ে দিয়েছে। রেখেছে নামে মাত্র কিছু ঐতিহ্য যেগুলো না রাখলেই নয়। সেই বৃটিশদের ইতিহাসের দিকে যদি আমরা একটু তাকাই তাহলে কী দেখতে পাই???
একটু ইতিহাসের দিকে চোখ বুলিয়ে নেই।
সপ্তম শতাব্দীর Anglo Saxon ইংল্যান্ড এবং এর পরের ইংল্যান্ডের অবস্থা কী ছিল সেসম্পর্কে ধারণা থাকা প্রয়োজন।
ঐতিহাসিক La Face এবং Rombo কর্তৃক লিখিত World History এবং অন্যান্য ঐতিহাসিকগণের কাছ থেকে জানা যায়ঃ তৎকালীন ইংল্যান্ডের জীবনমান ছিল বর্তমান আফ্রিকান দেশগুলোর চেয়েও নিম্নতর। ইংল্যান্ড ছিল সেসময়ের কয়েকটি দরিদ্র দেশসমূহের মধ্যে একটি। এক কথায় অজ্ঞতার শীর্ষে, বন্যতার নিম্নস্তরে এবং বর্বরতার উচ্চশিখরে অবস্থান করছিল ইংল্যান্ড। ঘরসমূহ অমসৃণ পাথরকে কাদার মিশ্রণ দিয়ে একত্রিত করে তৈরী করা হত। ঘরের মেঝও কাদা দিয়ে সমান করা হতো অর্থাৎ কাদা দিয়েই মেঝ বেষ্টন করা হত। ঘরগুলো ছিল অতিমাত্রায় ছোট এবং ঘরের ভেন্টিলেটর ও জানালাগুলো ছিল খুবই সংকীর্ণ, দরজা ছিল ভঙ্গুর এবং গোয়াল ঘরও ছিল অসম্পূর্ণ। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে যে, মানুষ তাদের গবাদি পশুর সাথে পাশাপাশি ঘুমাতো। জমি ছাড়া একমাত্র সম্পদ ছিল গবাদি পশু।
বিভিন্ন ধরণের রোগ এবং প্ল্যাগের প্রাদুর্ভাবে গনহারে মৃত্যু হত। বসবাসের ক্ষেত্রে মানুষ এবং পশুর মধ্যে কোন পার্থক্য ছিল না। যার প্রমাণ হিসবে লন্ডন এবং প্যারিসে গ্রামাঞ্চলে নির্মিত সেই ঘরগুলো আজও দাঁড়িয়ে আছে। যেগুলো খড় এবং কাঠের সাথে কাদা মিশ্রিত করে তৈরী করা হয়েছিল। তাদের না ছিল কোন দরজা না ছিল জানালা।
মোটকথা, তৎকালীন ইংল্যান্ডে কৃষির অবস্থা ছিল বেহাল। বিশুদ্ধ পানি ছিল সোনার হরিণ এবং চিকিৎসা ছিল আকাশের চাঁদ যার দরুণ মানুষ মৃত্যুমুখে পতিত হত এবং সেই সাথে দুর্ভিক্ষ ছিল স্বাভাবিক এক প্রাত্যহিক ঘটনা।
ঠিক ১০০০ বছর পর সেই বৃটিশদের সূর্য যেন অস্তমিত হয় না।
বর্তমানে বিশ্ব নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে এই লন্ডন থেকেই যারা কিনা এককালে পৃথিবীর সভ্য জাতির পর্যায়ই পড়তো না।
অপরদিকে ৭ম থেকে ১০ম শতাব্দী, এসময়ে আমাদের তথা মুসলিমদের সভ্যতার দিকে তাকান...নামের মাঝেই আভিজাত্যের এক ছাপ পাওয়া যায়। আমাদের সভ্যতা ছিল যেকোন সময়ের তুলনায় শ্রেষ্ঠ। মানবিক মর্যাদা এবং মানুষের অধিকার রক্ষায় আমাদের সভ্যতা ছিল অতুলনীয়...


আমাদের সভ্যতাসমূহ-
১- মধ্যপ্রাচ্যের মদীনা মুনাওয়ারাঃ সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র
২- বাগদাদ এবং শামঃ শিল্প সাহিত্যে
৩- ইউরোপেরঃ কর্দোভা, সিভেল্লে, আন্দালুসিয়াঃ জ্ঞান বিজ্ঞান স্থাপত্য

৪- মধ্য এশিয়ারঃ তাশখন্দ, বুখারা, কাশগড়
৫- এশিয়া মাইনরেঃ কনিয়া, কায়সেরী, বুরসা
৬- উত্তর আফ্রিকারঃ কায়রো মারাকেশ
৭- আফ্রিকারঃ মালি সভ্যতা
৮- আফগানিস্তানেরঃ গজনী
৯- ভারতীয় উপমহাদেশেরঃ সিন্ধু, দিল্লি এবং


এবং সর্বশেষ-
১০- তৎকালীন সময়ের পৃথিবীর ২৭% বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণকারী একমাত্র অঞ্চল, সভ্যতার শীর্ষে অবস্থানকারী অন্যতম একটি অঞ্চল, দুনিয়ার তাবত ধনী ব্যক্তিগণ যে অঞ্চলে পণ্য তুলতে পারলে নিজেদের ধন্য মনে করতো, ভারতীয় উপমহাদেশের বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র, সুজলা সফলা নদীমাতৃক আমাদের এই সোনার বাংলাদেশ।
তারপরও আমাদের জাতি কেন যেন অন্যের দেখানো পথকে নিজেদের পথ ভেবে নেয়। নিজেরা একটি ঐতিহ্যময় সভ্যতার ধারক-বাহক হওয়া সত্ত্বেও কোন মোহে ক্যাপিটালিস্ট সিস্টেমের পাজলের মধ্যে নিপতিত হচ্ছি?? আর সেখানে ঘুরপাক খেতে কেনই বা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছি?? বিবেককে বিসর্জন দিয়ে জুলুমবাজ সিস্টেমের হিস্যা হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছি যার জন্য সামান্য লজ্জাবোধও হচ্ছে না উলটো এর বদলে শোষনের সিস্টেমের হিস্যা হয়ে গর্ব অনুভব করছি। নিজ থেকে স্রোতের বাইরে কিছু করার প্রয়াস আমাদের দ্বারা কেন যেন হচ্ছে না।
আর যখনই স্রোতের বিপরীতে কেউ কিছু বলবে কেউ কিছু করার জন্য উৎসাহ দিবে তখনই ৯৯% মানুষ সে কথাকে তাচ্ছিল্যের সাথে উড়িয়ে দিবে। হাসি এবং ঠাট্টা-তামাশার ছলে স্রোতের বিপরীতে দাঁড়ানো ব্যক্তিকে ভিলেন বানাবে কিন্তু ঠিক একই সাথে নিজেদের দুর্বলতা ও অজ্ঞতাকে যুগ শ্রেষ্ঠত্ব হিসেবে জাহির করবে।
দুনিয়াকে বদলানোর জন্য উম্মাদ এবং কলিজা সম্পন্ন কিছু লোকের প্রয়োজন। তার জন্য প্রয়োজন বিবেক এবং চিন্তাশীল একটি মননের অধিকারী হওয়া।
সে লক্ষ্যে প্রাথমিক পদক্ষেপ হচ্ছে নিজের সাধ্যানুযায়ী পরিবর্তনের প্রচেষ্টা করা। যৌথভাবে না হোক এককভাবে।
পরিবর্তনের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো নতুন কিছু নয়। বিবেকবান লোক সর্ব যুগেই বিদ্যমান ছিল। রাসূলের জামানার একটি উদাহরণ--
সকলেই জানি, জাহেলী যুগে আরবে কন্যাসন্তানকে জীবন্ত দাফন করা ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। এরকম একটি বিকৃত মানসিকতার রীতি সেযুগে প্রচলন ছিল এবং কেউ এর বিরুদ্ধে কোন শব্দ পর্যন্ত করতো না। তারপরও সমাজে কিছু লোক ছিল যারা বিকৃত মানসিকতা সম্পন্ন কদর্য এই রীতির বিরুদ্ধে ছিল।
তাবারাণির বর্ণনামতে, কবি ফারাযদাকের দাদা 'সা'সা ইবনে নাজীয়াহ আল মুজাশি' রাসূল (সাঃ) কে জিজ্ঞেস করেন- "হে আল্লাহর রাসূল! আমি জাহেলী যুগে কিছু ভালো কাজ করেছি। এর মধ্যে একটি হচ্ছে- আমি ৩৬০ টি মেয়েকে জীবিত কবর দেয়া থেকে রক্ষা করেছি। তাদের প্রত্যেকের প্রাণ বাচানোর বদলে দুটি করে "উট" বিনিময় মূল্য হিসেবে প্রদান করেছি। আমি কী এর প্রতিদান পাব??
জবাবে রাসূল(সাঃ) বলেন- তোমার জন্য পুরস্কার রয়েছে এবং সে পুরস্কার হচ্ছে, আল্লাহ তোমাকে ইসলামের নিয়ামত দান করেছেন।
চিন্তা করুন, জাহেলী যুগে তিনি ইসলামের দাওয়াত পাননি সেসময়ে। এরকম অজ্ঞতার যুগে ৩৬০ জন মেয়েকে উদ্ধার করেছেন জীবন্ত কবর দেয়া থেকে। তাও একজনও নিজের মেয়ে নয়। অপরের মেয়ে, যার সাথে তার কোন সম্পর্কই নেই। তার উপর সেসময়ের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ উট!! এর বিনময়ে। একটি নয় দুটি নয় ৭২০ টি উট!!! প্রদান করেছেন মেয়েগুলোকে বাচানোর জন্য।
বর্তমানে একেকটি ল্যাম্বর্গিনি গাড়ির সাথে সেসময়ের উটকে তুলনা করলে ল্যাম্বর্গিনির মূল্যও কম পড়বে উটের তুলনায়।
তৎকালীন প্রেক্ষিতে, নিজের ৭২০ টি উট!! তথা সবকিছু বিসর্জন দিয়ে মেয়েগুলোকে বাচানোর কোন মানে ছিল না সেসময়কার সমাজের দৃষ্টিতে। সমাজ তাকে উম্মাদ বলেছে, পাগল বলেছে। কিন্তু তিনি বিশ্বাস করেছিলেন, প্রচেষ্টাও চালিয়েছিলেন। তার এই প্রচেষ্টা বিফলে যায় নি। তার স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত হয়েছে কয়েক বছরের ব্যবধানে।
বর্তমান সময়ে আমাদের জাতির সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হচ্ছে- "আমরা বিশ্বাস করতেই জানি না যে, আমরা নতুন একটি সভ্যতা গড়ে তুলতে পারব।"
যদি বিশ্বাসই করতে না পারি তাহলে কীভাবে কাজ করব?? বলা হয়ে থাকে- বিশ্বাসে মিলায় বস্তু। বিশ্বাস খুব সুদৃঢ় একটি ভিত্তি। বিশ্বাসই আমাদের স্বপ্ন দেখায় এবং সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে শিখায়। আর এই বিশ্বাসকে যদি তাচ্ছিল্য করে বলা হয় ইউটোপিয়ান, তাহলে ইউটোপিয়ানই ভালো।


পৃথিবীতে রাসূল (সাঃ) এর চেয়ে বড় ইউটোপিয়ান কেউই হতে পারবে না। আমরা তার অনুসারী মাত্র...
আল্লামা ইকবালের কবিতা দিয়ে শেষ করছি--


জ্ঞান তোমাদের ঢালটি হেন, প্রেমটি যেন অসি করে,
দরবেশ আমার! খেলাফতই জগজ্জয়ী করবে তোরে।
তাকবীরানল আল্লাহ বিনা সবকে দেবে ভস্ম করে,
তদবীরই শ্রেষ্ঠ উপায় সত্য মুসলমানের তরে।
নবীর কথা মানলে সবে খোদাকেও তখন পাবে,
জগৎ কী ছাড়! লাওহে কলম সবই তখন তোদের হবে।।

পঠিত : ৮২৮ বার

মন্তব্য: ০