Alapon

মীর নিসার আলী তিতুমীরঃ সাম্রাজ্যবাদীদের আতংক এবং স্বাধীনতাকামীদের স্বপ্নের নায়ক

“তিতুমীর” নামটি তেতো হতে উৎপত্তি হলেও তা ব্রিটিশদের জন্য সত্যিকার অর্থেই তেতো ছিল। উনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে বিশের দশকে একটানা দশ বছর ব্রিটিশদের উপর নীল আতংক হয়ে পুরো উপমহাদেশে একটি নাম ছড়িয়ে পড়ে। সেই নামটি হচ্ছে সৈয়দ মীর নিসার আলী তিতুমীর। সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ ও তাদের গোলাম জমিদারদের নিকট তিতুমীর আতংকের নাম হলেও, বাংলার আপামর স্বাধীনতাকামী জনগণের নিকট বিখ্যাত বাশেরকেল্লার প্রতিষ্ঠাতা এই তিতুমীর ছিলেন স্বপ্নের নায়ক। বাংলার মুসলিমদের নিকট তিতুমীর নামটি হয়ে উঠে আশার প্রদীপ এবং স্বাধীনতার এক অনন্য প্রতীক।


সৈয়দ মীর নিসার আলী তিতুমীর
২৭ জানুয়ারী ১৭৮২ একটি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তৎকালীন বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলনের এই নায়ক। বয়স ১৮ যখন ছুই ছুই, আগেই তিনি কুর’আনে হাফেজ হন, সেই সাথে হাদীসের উপর বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠেন। তিনি একই সাথে তিনটি ভাষা বাংলা, আরবী এবং ফার্সি ভাষায় দক্ষ ছিলেন।


তিতুমীর নামকরণঃ ছোট্ট মীর নিসার আলী শিশুকালেই এক জটিল রোগে আক্রন্ত হন। সেই রোগের প্রতিষেধক হিসেবে তাকে দেয়া হয়েছিল একধরণের তেতো ঔষধ। বাচ্চারা তো দূরের কথা বয়স্ক লোকেরাও এই ঔষধের কথা শুনলে একশ হাত দূরে থাকতো। সকলেই ভাবছিল যে ছোট্ট এই ছেলেকে কীভাবে এই ঔষধ খাওয়ানো যায়??
হয়তো ছোটকালেই কাঠিন্যের সাথে পাঞ্জা লড়ার স্বপ্ন দেখেছিল এই শিশুটি। সবাইকে অবাক করে দিয়ে টানা দশ-বারো দিন সেই তেতো ঔষধ সেবন করেছিল মীর নিসার আলী এবং সে বেশ আন্দদের সাথেই তেতো জিনিস খেত। সেই থেকে বাড়ির লোকরা আদর করে তেতো ডাকতো। নামের প্রথম শব্দ ‘মীর’ এর সাথে তেতো যোগ করে সকলেই তাকে তিতুমীর নামেই ডাকতে থাকে।


স্বাধীনতাকামী আন্দোলনঃ ব্রিটিশরা তখনও থিতু হয়ে বসতে পারেনি বাংলার মসনদে। কিন্তু ছল-চাতুরী, কূট-কৌশল এবং তাবেদারী যোগ্যতা সম্পন্ন হিন্দু জমিদারদের দ্বারা অত্যাচার নীপিড়নের পাহাড় চাপিয়ে দেয় বাংলার জনগণের উপর বিশেষ করে মুসলিমদের উপর। যুবক তিতুমীর পড়ালেখা শেষ করে তিনি মক্কায় যান। সেখানে তিনি দেখা করেন উপমহাদেশের বিশিষ্ট সংস্কারক সাইয়্যেদ আহমদ বেরলভির সাথে। এরপর ১৮২১ সালে সাইয়্যেদ বেরলভির সাথে মক্কা, মদীনা, ইরাক, ইরান, সিরিয়া, মিশর, আফগানিস্তান সফর করেন এবং তৎকালীন বিশ্বের মুসলিম নেতৃবৃন্দের সাথে সাক্ষাত করেন এবং বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেন। বেরলভী রহ এর সাথে তার এই সফর তাকে ব্যাপক অভিজ্ঞতা প্রদান করেন। মুসলিম বিশ্বের তৎকালীন সমস্যা ও সম্ভাবনা এবং একজন মুসলিমের কর্তব্য কী হতে পারে সে সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা লাভ করেন সেই সফরে। অতঃপর তিনি দেশে ফিরে আসেন।


হাজী শরিয়াতুল্লাহর দ্বারা পূর্বেই ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন দানা বেধে উঠেছিল। হাজী শরীয়াতুল্লাহ ছিলেন সংস্কারক। অনেকের কাছেই তিনি ছিলেন আধ্যাত্মিক নেতা। কিন্তু বাংলার মুসলিমদের প্রয়োজন ছিল একজন সেনাপতির, একজন সিপাহসালারের। তাদের দরকার ছিল একজন জেনারেলের যে কিনা সম্মুখে থেকে নেতৃত্ব দিবে মুসলিমদের। সিপাহসালারের সেই শূন্যস্থান পূরণ করেন সৈয়দ মীর নিসার আলী তিতুমীর।
বাঁশেরকেল্লা

জমিদার, মহাজন ও নীলকরদের বিরুদ্ধে এক দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলেন তিনি। কিন্তু প্রয়োজন ছিল নতুন কিছু করার। প্রতিরোধের সময় শেষ এখন প্রতি আক্রমণের সময়। তিতুমীর স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। ১৮২৫ সালে তিনিই সর্বপ্রথম সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করেন।


তিতুমীরের প্রতিরোধের আগুন ছড়িয়ে পড়ে পুরো বাংলায়। মুসলিমদের উপর হিন্দু জমিদারদের আরোপিত দাড়ির খাজনার বিরুদ্ধে তিনি তীব্র প্রতিবাদ করেন এবং ব্রিটিশ তাবেদার হিন্দু জমিদার কর্তৃক মসজিদের উপর আরোপিত করের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেন। বাংলার হিন্দু জমিদারদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রতিরোধ শুরু হয়। জমিদারদের সাথে তিতুমীরের সংঘাত-সংঘর্ষ শুরু হয়। তিতুমীরের এ প্রতিরোধকে দমন করতে সে সময়ের প্রভাবশালী জমিদাররেরা নিজেদের সবকিছু নিয়ে তিতুমীরের উপর আক্রমণ করে। তাদের সম্মিলিত আক্রমণকে তিতুমীর ধুলোর সাথে মিশিয়ে দেন তার অসাধারণ দক্ষতা ও অপরিসীম বীরত্ব দিয়ে। জমিদারদের পরাজিত করে তিনি চব্বিশপরগণা, নদীয়া ও ফরিদপুর জেলার কিছু অংশব্যাপী একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। স্বাধীনতাকামী ৪-৫ হাজার যুবককে নিয়ে নারিকেলবাড়িয়ার বাশেরকেল্লায় প্রতিরোধ করে গড়ে তুলেছিলেন। ১৮৩১ সালের ২৩শে অক্টোবর বারাসাতের কাছে নারিকেলবাড়িয়ায় নিজের পরিকল্পনায় বাঁশের কেল্লা তৈরি করেন। তিতুমীরের অনুসারীর সংখ্যা দাড়িয়েছিল প্রায় ১৫ হাজার যারা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে তিতুমীরের পাশে ছিল এবং সর্বাত্মক সহায়তা প্রদান করেছিল।
বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম পদক্ষেপ এর মাধ্যমেই সূচিত হয়।


স্বাধীনতা যুদ্ধ ও শাহাদাত বরণঃ হিন্দু জমিদারেরা ব্রিটিশদের সাথে মিলে তিতুমীরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আসে। প্রথম যুদ্ধ করতে আসে ইংরেজ সেনাপতি আলেকজান্ডার। সাথে পাইক, বরকন্দাজ প্রায় ৭৫০ জন। ইংরেজদের হাতে বন্দুক ও তৎকালীন সময়ের আধুনিক অস্ত্র অপরদিকে তিতুমীরের বাহিনীর হাতে সড়কি, বল্লম ও তীরন্দাজ বাহিনী ও তাদের অব্যর্থ নিশানা। তিতুমীরের কাছে সবচেয়ে বড় যে অস্ত্র ছিল তা হচ্ছে ঈমানদীপ্ত একটি অন্তর। যে অন্তর গোলামীর জিঞ্জিরকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিতে সদা জাগ্রত। যে অন্তর মৃত্যুভয় কী জিনিস তা জানে না। মৃত্যুকে তার দিল খেলা মনে করে, শাহাদাতের তামান্নায় ভরপুর ছিল যার কলিজা সেই তিতুমীরের সৈন্যরাও এর ব্যতিক্রম ছিল না। মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও ঝাপিয়ে পড়েন ইংরেজদের বিরুদ্ধে।
তীব্র যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধে ইংরেজ পক্ষের বহু সৈন্য প্রাণ হারায়। ইংরেজ সেনাপতি আলেকজান্ডার যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে প্রাণে রক্ষা পান।


১৮৩১ সালের ১৯ নভেম্বর, যুদ্ধের ক্ষত শুকানোর পূর্বেই তিতুমীরের বিরুদ্ধে দ্বিতীয়বার যুদ্ধে আসে লেফট্যেনেন্ট কর্নেল স্টুয়ার্ট। সাথে নিয়ে আসে ১০০ অশ্বারোহী, কামানে সজ্জিত ৩০০ পদাতিক বাহিনী। কর্নেল বিশাল এই সুসজ্জিত বাহিনী নিয়ে তিতুমীরের বাঁশেরকেল্লা ঘিরে ফেলে। অপরদিকে তিতুমীরের বাহিনীর নিকট ছিল বাঁশের তৈরী অস্ত্র, লাঠি এবং গুটিকয়েক তলোয়ার।
যা ছিল তাই নিয়েই তিতুমীর ঝাপিয়ে পড়েন ইংরেজদের বিরুদ্ধে। কিন্তু আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত ব্রিটিশ বাহিনী এবং কামানের গোলার সামনে প্রতিরোধ বেশিক্ষণ টিকতে পারেনি। যুদ্ধরত অবস্থায় শাহাদাত বরণ করেন বাংলার বীর সিপাহসালার তিতুমীর এবং তার অগণিত সহযোদ্ধা।
তিতুমীরের সুদক্ষ সেনাপতি গোলাম রসুল ব্রিটিশদের হাতে বন্দী হন। পরবর্তীতে তাকে ফাসি দিয়ে শহীদ করা হয়। সেই সাথে ৩৫০ জন অনুসারীরকে জেলে প্রদান করা হয়।


আজ বাংলার সেই অঘোষিত সেনানায়কের ১৮৭ তম শাহাদাত বার্ষিকী।
মহান এই বীর আমাদেরকে দেখিয়ে গেছেন কিভাবে সাম্রাজ্যবাদী শোষক শ্রেণীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হয়। তিনি আমাদেরকে দেখিয়ে গেছেন পরাধীন হয়ে বেঁচে থাকার মধ্যে কোন সম্মান ও মর্যাদা নেই। অন্যের গোলামী ও পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙ্গে মানবতার জন্য জিহাদ করে মৃত্যুবরণ করা অনেক বেশী সম্মানের।
তাইতো আজও তাকে স্মরণ করে আমাদের মত লাখোকোটি তরুণ!!
হে মহান বীর আপনি মৃত্যুবরণ করেননি, মৃত্যুবরণ করেছে তৎকালীন তথাকথিত বিজয়ীরা ও তাদের দালাল দোসররা।
আল্লাহ আপনাকে জান্নাতের সর্বোচ্চ স্থান দান করুন।
আমীন।

পঠিত : ২২৯৯ বার

মন্তব্য: ০