Alapon

জিয়ার স্বৈরাচারী কলাকৌশল প্রায় ৪০ বছর পর তার দলের বিরুদ্ধেই দারুণভাবে প্রয়োগ হলো

অনেকেই শেখ হাসিনাকে ইউনিক স্বৈরাচার বলে থাকেন। তবে আমার জানামতে তিনি ইউনিক নন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে হাসিনার যা কার্যক্রম তা তিনি ধার করেছেন বাংলাদেশের ২য় স্বৈরাচার জিয়াউর রহমানের কাছ থেকে। দেখুন মিলাতে পারেন কিনা?

দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয় ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৯ সালে অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল জয় লাভ করে। তারা জাতীয় সংসদের ৩০০টি আসনের মধ্যে ২০৭টি আসন লাভ করে। মোট ভোট সংগৃহীত হয়েছিল ৫১.৩%। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ (মালেক) ৩৯, আওয়ামী লীগ (মিজান) ২, জাসদ ৮, মুসলিম লীগ ও ডেমোক্রেটিক লীগ ২০, ন্যাপ (মোজাফ্ফর) ১, বাংলাদেশ জাতীয় লীগ ২, বাংলাদেশ গণফ্রন্ট ২, বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল ১, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক আন্দোলন ১, জাতীয় একতা পার্টি ১ ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ১৬টি আসনে জিতেন।

১- জিয়াউর রহমান বিরোধী দলগুলোকে নির্বাচনে অংশ গ্রহনের জন্যে মাত্র ৪০ দিনের নোটিশ এবং ২৩ দিনের প্রচারনার সুযোগ দেওয়া হয়। সেই ২৩ দিনেও ছিল সেনাবাহিনীর তৈরি করা অনেক নিয়মের বাঁধা এবং কথায় কথায় আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ ও গ্রেপ্তার। 
২০১৮ সালের নির্বাচনে আপনারা নিজেই তা প্রত্যক্ষ করেছিলেন।

২- অন্যের প্রচার বন্ধ থাকলেও জিয়াউর রহমানের উন্নয়নের প্রচার চলতে থাকে। নিজের নির্বাচনী প্রচারণার জন্যে সরকারি প্রশাসন যন্ত্রকে পুরোপুরি কাজে লাগান তিনি। ছোট ছোট নাটিকা, গান প্রচার হতে থাকে মিডিয়াগুলোতে। টিভি- রেডিও এবং সংবাদপত্রকেও বাধ্য করা হয় বিরোধী দলগুলোর বিরুদ্ধে অপপ্রচারের জন্যে। জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে বলতে পারে এমন কোন মিডিয়া ছিল না।

এবারো সেইম ঘটনা ঘটেছিলো। যদিও এই প্রচারণায় হাসিনা খুব বেশি সুবিধা করতে পারেনি কারণ এখন সোশ্যাল মিডিয়া আছে। জিয়াউর রহমান ফেসবুক না থাকার সব সুবিধা পেয়েছিলেন সেসময়।

৩- জিয়া কর্তৃক ঘোষনাকৃত প্রেসিডেন্সিয়াল অডির্ন্যন্স ১৯৭৮ অনুযায়ী "সেই ব্যাক্তি প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দীতা কর‌তে পারবেন না, যিনি সরকারী চাকুরি থেকে বেতন গ্রহন করে থাকেন । অর্থাৎ সংবিধান অনুযায়ীও জিয়াউর রহমান প্রেসিডেন্ট প্রার্থীও হতে পারেন না কারণ ঐ সময়ে তিনি সামরিক বাহিনীর গুরুত্বপুর্ন পদে অধিষ্ঠিত থেকে বেতন গ্রহন করতেন ।

জিয়াউর রহমান এই সব বাধা কাটিয়ে ওঠার জন্যে ২৯শে এপ্রিল ১৯৭৮ সালে ত্রয়োদশতম সংশোধনী পাস করান । 
(১) চীফ মার্শাল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীর কমান্ডার ইন চীফ হবেন এবং তিনি প্রত্যক্ষভাবে বা তার বাহিনী প্রাধনের মাধ্যমে এই সব বাহিনী নিয়ন্ত্রন, নির্দেশনা ও পরিচালনা করবেন।
(২) চীফ মার্শাল এখন থেকে বেতনভোগী সরকারী কর্মকর্তা হিসেবে বিবেচিত হবে না।
কিন্তু ১৯৭৮ সালের ২রা মে নমিনেশন জমা দেবার আগেও এমনকি নির্বাচনের দিন পর্যন্ত সরকারী কাজপত্র অনুযায়ী তিনি চীফ অব আর্মী স্টাফ এর মত বেতন ভুক্ত চাকুরিতে বহাল ছিলেন এবং এইটা ছিলো সংবিধান অনুযায়ী নিয়ম বহির্ভুত এবং অবৈধ।

এছাড়া জিয়াউর রহমান ১৯৭৯ সালে অদ্ভুতভাবে কয়েকটি গেজেট নোটিফিকেশন ইস্যু করেন । ২৮শে ফেব্রয়ারী ১৯৭৯ সালে গেজেট নোটিফিকেশন নং ৭/৮/ডি-১/১৭৫-১৬০; অনুযায়ী তিনি নিজেকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদে উন্নীত করেন। ৯ই এপ্রিল ১৯৭৯ সালে গেজেট নোটিফিকেশন নং ৭/৮/ডি-১/১৭৫-২৭০; অনুযায়ী আগের নোটিফিকেশন বাতিল করে আবার নতুনভাবে নিজেকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদে উন্নীত করেন যা ২৮শে এপ্রিল ১৯৭৯ সালে কার্যকর হবে।

আবার ৯ই এপ্রিল ১৯৭৯ সালে অন্য একটি নোটিফিকেশন নং ৭/৮/ডি-১/১৭৫-২৭১; অনুযায়ী তিনি নিজেকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদ থেকে অবসর গ্রহন করান, যা কার্যকর হবে ২৯-৪-১৯৭৮ সালে। এর দ্বারা তিনি আইন দ্বারা বুঝাতে চেয়েছেন তিনি নির্বাচনের সময় অসামরিক, অবৈতনিক ও বেসরকারি মানুষ ছিলেন। আদতে তা সঠিক নয়। জিয়া হাসিনাকে শিখিয়ে দিয়েছিলেন আইন শুধু বিরোধী দলের জন্য, সরকারি দলের জন্য নয়।

হাসিনা, তার মন্ত্রীরা ও তার এমপিরা সরকারি বেতনভোগী হলেও তাদের মনোনয়ন অবৈধ হয় না। অবৈধ হয় বিএনপি প্রার্থীদের। ইলিয়াস আলীর স্ত্রী ঢাকা ভার্সিটি থেকে অবসর নিলেও একই নিয়ম অনুযায়ী তিনি নির্বাচন করতে পারেন নি। পারেননি এভাবে অনেকেই। উপজেলা চেয়ারম্যানদের অনেকেরই প্রার্থীতা বাতিল হয় একই কারণে।

৪- প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের ব্যবহার করার ক্ষেত্রে জিয়াউর রহমান ছিলেন আদর্শ। ১ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অর্থাৎ মুজিবের ৭৩ সালের নির্বাচনে অনেক অনিয়ম হলেও মুজিব প্রিসাইডিং অফিসারদের ব্যবহার করেননি। তিনি ভোট লুটপাট করার জন্য তার দলের লোকদের লেলিয়ে দিয়েছেন। তারা ব্যালট বাক্স তুলে নিয়ে পরিস্থিতি নষ্ট করে ফেলেছিলো। সারাবিশ্ব দেখেছিলো মুজিব কতটা স্বৈরাচারী হতে পারে!

কিন্তু জিয়া অতটা বোকা ছিলেন না। তার নির্বাচন ছিলো শান্তিপূর্ণ। তিনি মূলত দলীয় কর্মীদের ব্যবহার না করে সরকারি কর্মকর্তাদের অর্থাৎ প্রিসাইডিং অফিসার ও রিটার্নিং অফিসারদের ব্যবহার করেছিলেন। তারাই তাকে ভোট দিয়ে জয়লাভ করিয়ে দিয়েছে। ২য় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেও জিয়া তার ব্যাপারে জনগণের আস্থা আছে কিনা তা যাচাইয়ের জন্য একটা হ্যাঁ/না ভোট করেছিলেন। সেখানে তার পক্ষে ৮০% সমর্থন দেখানো হয়। সেসময় তিনি প্রথম সরকারি অফিসারদের দিয়ে নিজের পক্ষে ভোট করিয়ে নিয়েছেন।

আবার ২য় জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তিনি একই পলিসি এপ্লাই করেছিলেন। তার পথ ধরে এরশাদও একইভাবে তার পক্ষে নির্বাচন করিয়ে নিয়েছেন। আমার নানা ২য়, ৩য়, ৪র্থ ও ৫ম নির্বাচনে প্রিসাইডিং অফিসার ছিলেন। তিনিও এই ব্যাপারে সাক্ষ্য দিয়েছেন।

হাসিনা ২০১৮ সালে একই পদ্ধতি ব্যবহার করে নিজের পক্ষে ভোট কাস্ট করিয়ে নিয়েছে।

৫- তারকাদের নিজের পক্ষে ব্যবহার ছিলো জিয়ার অন্যতম অস্ত্র। তিনি তারকাদের নানান সম্মাননা প্রদান করতেন। তাদের নিয়ে নৌ-বিহারে যেতেন। পক্ষে থাকলে তাদের আর্থিক সহযোগিতা দিতেন। নির্বাচনের সময় নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যবহার করেছেন। হাসিনাও এবার জিয়ার অনুসরণ করে তারকা ব্যক্তিদের তার নির্বাচনী প্রচারে ভূমিকা রেখেছেন। এই ব্যাপারে আমি প্রথম জানতে পারি আল-মাহমুদের একটি প্রবন্ধে। আল-মাহমুদ প্রথমে জিয়াবিরোধী থাকলেও পরে টাকা, নৌ-বিহার তাকে জিয়ার পক্ষে নিয়ে এসেছিলো।

হাসিনাও এবার নাটক-সিনেমা, খেলাধুলা ও সোশ্যাল এক্টিভিস্টদের পয়সা ও বিভিন্ন সুযোগ সুবিধার বিনিময়ে তার পক্ষে কাজে লাগিয়েছেন।

জিয়াউর রহমানের স্বৈরাচারী কলাকৌশল প্রায় ৪০ বছর পর তার দলের বিরুদ্ধেই দারুণভাবে প্রয়োগ হলো।

পঠিত : ৩১৪৬ বার

মন্তব্য: ০