Alapon

কেন আমি মনে করি আওয়ামী লীগ আরও ১০-২০ বছর ক্ষমতা ধরে রাখতে সক্ষম হবে

আমরা সবাই এ নিয়ে বহু আলোচনা করেছি কিভাবে হাসিনা ক্ষমতা ধরে রাখছে? পুলিশ-র‍্যাব দিয়ে, মিডিয়া কন্ট্রোল করে, বিরোধী দলকে দমন পীড়ন, উন্নয়ন ইত্যাদি ইত্যাদি......... কিন্তু এর বাইরে আরও কিছু পয়েন্ট আছে।

অনেকেই হিসাব করছে প্রাকৃতিক সম্পদ হীন, ব্যাংক আর রিজার্ভের টাকা দেশ থেকে পাচার করে দিয়ে, ইনফ্লেশান বেড়ে, কোটি কোটি টাকা দিয়ে প্রশাসনকে পালতে পালতে যেদিন হাসিনার টাকশাল দুর্বল হবে সেদিন অর্থনৈতিক পতনের মাঝ দিয়ে হাসিনার বিদায় হবে। এন্যালিটিক্যাল এসব কনক্লুশানের সাথে আমি কিছুটা একমত হলেও পুরাপুরি একমত না।

অধুনিক বিশ্বে প্রতিটি ফ্যাসিস্ট সরকারের আন্তর্জাতিক পৃষ্ঠপোষক আছে। এদের কেউই কেবল ইন্টার্নাল শক্তিতে দীর্ঘদিন ক্ষমতা ধরে রাখে না। এসব পৃষ্ঠপোষক ফ্যাসিস্ট সরকারকে অর্থনৈতিক, সামরিক, বিভিন্ন লজিস্টিক্যাল সাপোর্ট দিয়ে তাদের ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখে।

১) আমেরিকা আর সৌদি আরব ছিল ইরাকের সাদ্দামের পৃষ্ঠপোষক, ১০ বছর তারা সাদ্দামকে দিয়ে ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিয়েছিল। এরপর সাদ্দাম কুয়েত দখল নিলে আমেরিকার বন্দুক আর সৌদি ক্রোধ সাদ্দামের উপরে এসে পড়লে অবশেষে সাদ্দামের পতন হয়। শিয়া কিংবা কুর্দি কারো বিপ্লবই সাদ্দামকে ক্ষমতা থেকে নামাতে পারে নাই, নামাতে পারে নাই আমেরিকার অর্থনৈতিক অবরোধ। সেই অবরোধে যখন ইরাকে ৫ লাখ শিশু ওষুধের অভাবে, অপুষ্টিতে, অনাহারে মারা যায়, সাদ্দাম তখন তার দালানের পর দালান তুলে উন্নয়ন দেখায়। সাদ্দামের গ্রহণযোগ্যতা আর তার প্রতি ইরাকীদের ঘৃণা দিন দিন বাড়লেও, সাদ্দামকে গদিচ্যুত করতে পারে নাই তার দেশের মানুষ। অবশেষে আমেরিকা নিজে যুদ্ধ করে সাদ্দামকে ক্ষমতাচ্যুত করে। (যদিও আমি মনে করি দ্বিতীয় বুশের এই সিদ্ধান্তই মুলত মধ্যপ্রাচ্যের এখনকার সব যুদ্ধের জন্য দায়ী, তবে সাদ্দাম ওয়াজ এ রুথলেস ডীক্টেটর, হি নিডেড টু গো)।

২) একই ভাবে সিরিয়ার বাশার আল আসাদের পৃষ্ঠপোষক রাশিয়া আর ইরান। দুর্বল অর্থনীতির সিরিয়া ৬ বছর ধরে তার মাটিতে গৃহযুদ্ধ, একই সাথে অন্যন্য দেশের সাথে প্রক্সি যুদ্ধ করে , ৫৪ লাখ লোককে দেশত্যাগ করতে বাধ্য করে। এরপরও আসাদ বাইরের সহায়তায় দিব্যি এখন পর্যন্ত ক্ষমতায় টিকে আছে। আসাদের কারাগারে লাখ খানেক আসাদ বিরোধী মানুষ বিভিন্ন অমানবিক অত্যাচারে জর্জরিত। যুদ্ধের সময় যা ইচ্ছা তাই করা যায় ( জেনেভা কনভেনশান থাকলেও) বিধায় বিরোধী লোকজনকে আসাদ বাহিনী এখন সোজা গুলি করে মেরে কারাগারাগুলো খালি করার সংবাদ এসেছে রিসেন্টলি। তারপরেও সব দেশ এখন দামস্কাসে একে একে এমব্যাসি খোলার পরিকল্পনা করছে। সিরিয়ার অর্থনীতির বারোটা বাজলেও, রাশিয়া-ইরান তাকে টিকিয়ে রেখেছে। আর এখন সৌদি আরব , আরব আমিরাত ইত্যাদি দেশও সিরিয়ার অর্থনীতিতে টাকা ঢেলে তার উন্নয়নে শামিল হতে যাচ্ছে ।

৩) অধুনা কালের আরেক বড় ফ্যাসিস্ট মিশরের জেনারেল সিসি, যাকে ইসরায়েল, সৌদি আরব, আরব আমিরাত, আমেরিকা মিসরের ফেয়ার ডেমোক্র্যাটিক নির্বাচনে নির্বাচিত মর্সিকে ক্ষমতাচ্যুত করে ক্ষমতায় বসতে সাপোর্ট করে। সিসির কারাগারে এখন ৬০ হাজার বিরোধী দলের কর্মী এবং তাদের সাপোর্টারেরা। সিসির ক্ষমতা এখন এমন পর্যায়ে গেছে যে সে ইসরায়েলিদের সাথে মিলে পরিকল্পনা করে তার দেশে মিলিটারি রেইড মারে, মুলত আইসিস বিরোধী এসব রেইডে মরে মুসলমান। মুসলমানেরা এখন ইসরায়েলের সাথে নিজ দেশের সরকারের এমন দহরম মহরমে আগের মতন ক্ষেপে না। সিসির অর্থনীতির মুল পৃষ্ঠপোষক সৌদি আরব-আরব আমিরাত-আমেরিকা।

৪) এবার আসি চীনের বেলায়। তারা নিজ দেশে ১০ লাখের মতন মুসলমানকে ডিটেনশন ক্যাম্পে রেখে তাদের জীবন থেকে ইসলাম মুছে দিতে চাচ্ছে, সকল প্রকার মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে এখানে, কিন্তু যেহেতু তারা অন্যান্য মুসলিম দেশে হেভিলি ইনভেস্ট করছে তাই যাদের উইঘুরদের পক্ষ নিয়ে প্রতিবাদ করার কথা ছিল তারা সব চুপ। এই চুপ করাদের লিস্টে আছে পাকিস্তান, তুরস্ক, ইরান পর্যন্ত। একইভাবে চীনের সাপোর্ট পাচ্ছে মিয়ানমার। আর রবার্ট মুগাবেকে সাপোর্ট করেছিল চীন।

৫) মুগাবের জিম্বাবুয়ের অর্থনীতি দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে হাইপার ইনফ্লেশানে ভুগেছিল। মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে ছিল দ্রব্যমূল্য, কিন্তু মুগাবে ঠিকই ৩০ বছর ক্ষমতায় ছিল। তাদের প্রাকৃতিক খনিজ সম্পদ থাকলেও করাপশান আর মিসম্যানেজমেন্টের দরুন সেই আয় রাজস্ব ভান্ডারে না ঢুকে ঢুকেছিল মুগাবের আশেপাশের, বিশেষত তার পরিবারের সদস্যদের পকেটে। তাই রাষ্ট্র চালাতে একসময় মুগাবে জোর করে কেড়ে নেয় দেশটির সাদাদের জমিজমা। সেসব জমি বিক্রি করে তার পোশ্য বাহিনির ক্ষুদা মেটায়। আরও কিছু বছর পার করে মুগাবে। এরপর দেশটিতে আসা শুরু করে চীনের উন্নয়নের ইউয়ান । ২০১০ সাল থেকে চীনের সহায়তায় জিম্বাবুয়ের জিডিপি বৃদ্ধির হার প্রায় ডবল ডিজিট ছুই ছুই , এই বৃদ্ধির গ্রাফ খাড়া উপরের দিকে সোজা। এই অবস্থায় মুগাবের পরিবার যখন করাপশানের চূড়ান্ত সিমাও পার করে দেয়, ক্ষমতা পুরা পরিবারকেন্দ্রিক হয়ে যায়, তখন দেশটির মিলিটারির হস্তক্ষেপে মুগাবের পতন হয়। তবে ইতিমধ্যে পার হয়ে যায় ৩০ টি বছর।

এবার আসেন বাংলাদেশের দিকে।

বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ না থাকলেও আছে জনসম্পদ, যাদের ঘামে ঝরা বৈদেশিক মুদ্রা আর গার্মেন্টস এবং অন্যান্য রপ্তানির বিশাল আয়ে দেশের সরকার আর প্রশাসন চলে। এই দুই খাতে যদি কোন কারনে আর্টিফিসিয়াল ধ্বস নামে, আর যার কারনে সামনে বিরাট অর্থনৈতিক ঝামেলায় পড়লে হাসিনা মুগাবের মতন দেশের যাদের আছে তাদেরটা জোর করে কেড়ে নিয়ে কয়েক বছর সরকার চালাতে পারবে, এটলিস্ট তার প্রশাসন তো দিব্যি চালাতে পারবে। তখন হাসিনার থাবা পড়বে দরবেশ থেকে শুরু করে ইয়াবা বদিদের টাকার উপর। এরকম নিজেদের কারো টা কেড়ে নিয়ে রাষ্ট্র চালানোর উদাহরনে আছে সৌদি যুবরাজ এমবিএস পর্যন্ত।

এর উপর আছে চীনের মতন দেশ, যারা মুগাবেকেও টাকা দিয়ে জিম্বাবুয়ের চরম অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সময়ে উন্নয়নের প্রকল্পের আওতায় বিলিওন্স এন্ড বিলিওন্স অফ ইউয়ান ঢেলে মুগাবের ক্ষমতার হাত পাকাপক্ত করেছিল।

বাংলাদেশ চীনের বানিজ্য বেল্ট আর রোড ইনিশিয়েটিভে প্রাইমারি না হলেও সেকেন্ডারি ইম্পরট্যান্ট জিও লকেশানে আছে। অতএব চীন-মিয়ানমার-বাংলাদেশ ইকোনমিক বেল্টে ঢুকাতে পারলে আর বঙ্গোপসাগরে ডিপ সী পোর্ট বসাতে পারলে, ভারতকে চীন তার দক্ষিণপূর্ব দিক থেকে সারভেইলেন্সের আওতায় এনে ফেলবে। এসব বিবেচনায় শেখ হাসিনা রাজি হলেই চীন হাসিনার অর্থনৈতিক মন্দার দিনে তার হাতকে পাকাপোক্ত রাখার জন্য অনেক টাকা ঢালবে। আর সেভাবে হাসিনা দিব্যি আরও মিনিমাম ১০-২০ বছর টিকে যাবে। আর চীনের চড়া সুদের ইন্সটল্মেন্ট শোধ করতে বাড়িয়ে দিবে মানুষের উপর আয়কর। অথবা চীনের কাছে ছেঁড়ে দিবে সমুদ্র বন্দর, বা দেশের পার্বত্য কোন অঞ্চল।

মোট কথা আগামী ২০ বছর হাসিনা বেচে থাকলে তার ক্ষমতায় টিকে থাকার এখনও অনেক অপশান আছে। তাই অর্থনীতি দিয়ে হাসিনার সহসা বা আগামী ৫ বছরে পতনের থিওরিতে আমি বিশ্বাসী নই। তার পতন হতে হবে অন্য উপায়ে বা প্রাকৃতিক নিয়মে। হাসিনা পরবর্তী আওয়ামী লীগের হিসাব হবে ভিন্ন। আফটার অল জয় ইজ নট হাসিনা, তবে ববি সিদ্দিকি ইজ এ ডিফারেন্ট কেইস।

পঠিত : ৯০৪৪ বার

মন্তব্য: ০