Alapon

এটা কি আসলে মানবাধিকার কমিশন নাকি ধর্ষকাধিকার কমিশন?

সাধারণত বাংলাদেশের মানবাধিকার কমিশন অন্ধ-বধির হয়ে থাকে। এরা কিছু দেখে না, কিছু শুনে না। কিন্তু নোয়াখালীর ঘটনায় তাদের নতুন রূপ মিলেছে। তারা এখন ধর্ষকদের পক্ষে নেমেছে। ভিকটিমদের জবানবন্দী উপেক্ষা করে নিজেদের মত রিপোর্ট দিয়েছে। নোয়াখালীর সুবর্ণচরে চার সন্তানের জননীকে ধর্ষণ ও নির্যাতনের সত্যতা খুঁজে পেলেও মানবাধিকার কমিশন বলছে পূর্ব শত্রুতার জেরে ওই ঘটনা ঘটেছে৷ কিন্তু কমিশনের প্রতিবেদনের সাথে মিলছে না নির্যাতিতার বক্তব্য৷ মানবাধিকার কমিশনের তদন্ত কমিটি বলছে, এ ঘটনায় তারা কোনো রাজনৈতিক কারণ খুঁজে পায়নি৷

ঘটনার শিকার নারী এবং মামলার বাদি তাঁর স্বামীর বরাত দিয়ে তদন্ত কমিটি বলছে, তাঁরাই তাঁদের পূর্ব শত্রুতার জেরের কথা বলেছেন৷ ভোট দেয়ার ঘটনা বা রাজনৈতিক কারণ এর পেছনে নেই৷ স্বামী-স্ত্রীর জবানবন্দির কথা উল্লেখ করে তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘‘একাদশ সংসদ নির্বাচনে ধানের শীষে ভোট দেওয়া বা ভোট দেওয়ার কারণে এ ঘটনা ঘটেছে বা আসামিরা আওয়ামী লীগের কর্মী হওয়া বা আওয়ামী লীগের কোনো কর্মীর মাধ্যমে ওই নারীকে মারপিট ও ধর্ষণের শিকার হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায় না৷''

কিন্তু তদন্ত প্রতিবেদনে তাঁদের বরাত দিয়ে ‘পুর্ব শত্রুতার' বিষয় উল্লেখ করা নিয়ে আপত্তি জানিয়েছেন ধর্ষণের শিকার নারী ও তাঁর স্বামী৷ তারা  দু'জনই বলেছেন, ‘‘ধানের শীষে ভোট দেয়ার কারণেই স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা রুহুল আমিনের নির্দেশে ধর্ষণ এবং নির্যাতনের ঘটনা ঘটানো হয়৷ আমরা তদন্ত কমিটির কাছেও একই কথা বলেছি৷ পূর্ব শত্রুতার কোনো কথা বলিনি৷''

গত ৩০ ডিসেম্বর একাদশ সংসদ নির্বাচন শেষ হওয়ার পর গভীর রাতে এই ধর্ষণ এবং নির্যাতনের ঘটনা ঘটে৷ বিষয়টি সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ হলে ব্যাপক তোলপাড় হয়৷ ৩১ ডিসেম্বর এ ঘটনায় মামলা দায়ের হয়৷ পুলিশ এখন পর্যন্ত সুবর্ণচর উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ও সাবেক ইউপি সদস্য রহুল আমিনসহ ১১ জনকে গ্রেপ্তার করেছে৷ এর মধ্যে পাঁচ জন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছেন৷

ধর্ষক আওয়ামী নেতা রুহুল আমীন। পুলিশ এজাহারে মূল পরিকল্পনাকারীর নামই বাদ দেয়।

এর আগেও বিভিন্ন মিডিয়ার কাছে ‘ধানের শীষে ভোট দেয়ার কারণেই' ধর্ষনের শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছিলেন ওই নারী এবং তার স্বামী৷  নির্যাতিতা পুরো ঘটনা তুলে ধরেন এভাবে, ‘‘আমি দুপুর ২টার দিকে ভোট দিতে গিয়েছি৷ জসিম ভাই নৌকায় ভোট দিতে বলেন৷ কিন্তু আমি ধানে ভোট দিতাম৷ এরপর আমাকে সবার সামনেই ভোট দিতে বলে৷ কিন্তু আমি তা না করে গোপন কক্ষে গিয়ে ধানে ভোট দিই৷ এরপর জসিম, জুয়েলসহ আরো কয়েকজন গিয়ে বলে রাতে খবর আছে৷ ওই সময় রহুল আমিন ছিল কিনা আমি দেখিনি৷ তবে এরা সবাই রুহুল আমিন বাহিনীর৷''

তদন্ত কমিটির কাছে পূর্ব শত্রুতার কথা বলেছেন কিনা জানতে চাইলে নির্যাতিতার স্বামী বলেন, ‘‘অনেকেই এসেছেন, আমার বক্তব্য নিয়েছেন৷ কারা তদন্ত কমিটি, তা আমি জানিনা৷ তবে সবার কাছেই আপনাকে যা বলেছি সেই একই কথা বলেছি৷ পূর্ব শত্রুতার কথা বলিনি৷ পূর্ব শত্রুতার কারণে নয়, ধানের শীষে ভোট দেয়ার কারণেই রুহুল আমিনের নির্দেশে আমার ওপর নির্যাতন হয়৷''

পূর্ব শত্রুতা কখনো ছিল কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘চার বছর আগে ছিল৷ তা তখনই মিটমাট হয়ে যায়৷ আর পূর্ব শত্রুতার কারণে নির্যাতন করলে, কিছু হলে তো চার বছর আগেই হত৷'' ৩০ ডিসেম্বর পাংখারবাজার ১৪ নম্বর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ধানের শীষে ভোট দেয়ায় ওই নারীকে হুমকি দেয়া হয়৷ আর  রাতেই বাড়িতে ঢুকে ধর্ষণ এবং নির্যাতন করে দুর্বৃত্তরা৷

ধর্ষণের শিকার নারীর স্বামী বলেন, ‘‘আমিতো আর ভোট দেয়ার সময় ছিলাম না৷ ওই সময় যা হয়েছিল তা আমি আমার স্ত্রীর কাছ থেকে শুনেছি৷ সে আমাকে বলেছে ধানের শীষে ভোট দেয়ায় তাঁকে হুমকি দেয়া হয়৷ আর রাতে তো আমাকে বেঁধে, আমার সামনেই ধর্ষণ করা হয়৷ আমি তদন্ত কমিটির কাছেও একই কথা বলেছি৷ পূর্ব শত্রুতার কোনো কথা বলিনি৷''

তাহলে মামলার এজাহারে কেন ধানের শীষে ভোট দেয়ার কারণ বলা হয়নি, পূর্ব শত্রুতার কথা কেন বলেছেন? এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘আমি মৌখিকভাবে পুরো ঘটনা বলেছি৷ পুলিশ এজাহার লিখেছে৷ এজাহার লিখে আমাকে পড়েও শোনায়নি৷ শুধু আমাকে বলেছে সই কর৷ তারা আমার কথা এজাহারে না লিখে তাদের মতো এজাহার বনিয়েছে৷'' তিনি আরো অভিযোগ করেন, ‘‘আমি রহুল আমিনসহ ১২ জনের নাম বলেছি অভিযুক্ত হিসেবে৷ কিন্তু পুলিশ রহুল আমিনসহ ৩ জনের নাম বাদ দিয়ে ৯ জনকে এজাহারে আসামি করে৷'' অবশ্য সারাদেশে সোশ্যাল মিডিয়ায় আওয়ামী নেতা রুহুম আমিনের নাম ও ছবি প্রকাশ হওয়ায় চাপের মুখে পুলিশ পরে তাকে সন্দেহজনক আসামি হিসেবে আটক করে৷

এর জবাবে সুবর্ণচর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নিজাম উদ্দিন বলেন, ‘‘বাদি সঠিক কথা বলছেন না৷ আর এজাহার না দেখে তাঁর অভিযোগ সম্পর্কে আমি এখন কিছু বলতে পারবো না৷ মামলাটি এখন ডিবি তদন্ত করছে৷''

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক

মানবাধিকার কমিশনের তদন্ত কমিটি পূর্ব শত্রুতার জেরের কথা বললেও কী সেই পূর্ব শত্রুতা তা উল্লেখ করেনি প্রতিবেদেন৷ ধর্ষণের শিকার নারী ও তার স্বামীর এই বক্তব্যসহ এইসব বিষয় তুলে ধরে কমিটির আহ্বায়ক আল মাহমুদ ফায়জুল কবীরের কাছে জানতে চাইলে তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি৷ তিনি বলেন, ‘‘আমরা প্রতিবেদন দিয়েছি, এখন কমিশন মূল্যায়ন করবে৷ এ নিয়ে কমিশন চেয়ারম্যান বলতে পারবেন৷''

পুলিশের নিজের ইচ্ছেমত লিখা এজাহার ও নির্যাতিতার স্বামীর বরাত দিয়ে মিথ্যে বলে মানবাধিকার কমিশন মানবতার বড় লংঘন করেছে। এটা কি আসলে মানবাধিকার কমিশন নাকি ধর্ষকাধিকার কমিশন? কাজী রিয়াজুল হকদের কাজ কি ধর্ষকদের রক্ষা করা?

পঠিত : ১২৬১ বার

মন্তব্য: ০