Alapon

মিন্দানাও দ্বীপপুঞ্জে নতুন সূর্যের আত্মপ্রকাশ


পুর্ব এশিয়ার ফিলিস্তিন খ্যাত মরো অঞ্চলের(মিন্দানাও, সুলু এবং পালাওয়ান অঞ্চলকে একত্রে মরো বলা হয়) নির্যাতিত মুসলিম জনগোষ্ঠীর জন্য আজ নতুন এক সূর্যের উত্থান হয়েছে।
মরো ইসলামিক লিবারেশন ফ্রন্টের পতাকা

আজ রেফারেন্ডামে বিজয় অর্জিত হওয়ার মাধ্যমে বাংসামরো একটি স্বায়ত্বশাসিত রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে।
বাংসোমোরো’ ফিলিপিনি শব্দ। এর অর্থ ‘মরো জাতির দেশ।’
শতবছর ধরে নিপীড়িত এই জনপদের রয়েছে দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস। স্পেনিশ, ব্রিটিশদের পর ওরা সংগ্রাম করছে ফিলিপিন সরকারের বিরুদ্ধে নিজেরদের অধিকার আদায়ে জন্য। মিন্দানাওয়ের মুসলমানরা স্বাধীনতার জন্য এখনো লড়াই করছে খ্রিষ্টান ফিলিপিন সরকারের সাথে। সরকার এতদিন ধরে মিন্দানাওকে নামমাত্র স্বায়ত্তশাসন দিয়ে রেখেছিল। দ্বীপ শাসন করত কেন্দ্র থেকে। যার দরুন মুসলিমরা তাদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত থেকে যায়। যুগের পর যুগ ফিলিপিন সরকার কর্তৃক শোষিত হয়ে আসছে মরোর জনগণ।
অবশেষে আজ ২১ শে জানুয়ারী ২০১৯ এক ঐতিহাসিক দিনের সাক্ষী হয়ে আছে।
ফিলিপিন সরকারের সাথে চুক্তি অনুযায়ী আজ বাংসামরোকে একটি স্বায়ত্তশাসিত রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে।
ইতিহাস
১৩১০ সালে ফিলিপিনের সুলু দ্বীপে আগত মুসলিম ব্যবসায়ী এবং সুফিদের মাধ্যমে এ অঞ্চলে ইসলামের আগমণ ঘটে। পরবর্তীতে তারা সেখানে স্থানীয়ভাবে বসবাস শুরু করেন এবং ইসলামের প্রচার ও প্রসারে আত্মনিয়োগ করেন। ১৩৪০ সালে একজন সুফি দরবেশের উদ্যোগে সুলু দ্বীপপুঞ্জে প্রথম মসজিদ প্রতিষ্ঠিত হয়। চতুর্দশ শতাব্দীর শেষের দিকে ইসলামের ব্যাপক প্রসার ঘটে এবং 'সুলু সালতানাত' প্রতিষ্ঠিত হয়।
ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম দিকে সুলুর নিকটবর্তী মিন্দানাও দ্বীপে ইসলামের প্রসার ঘটে। পরবর্তীতে ভারত ও পারস্য থেকে মুসলমানরা ফিলিপিনে গমন করেন। এভাবে ধীরে ধীরে ইসলাম একটি শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

ঠিক সে সময় ইউরোপীয়ানরা চারিদিকে কলোনী তৈরীতে ব্যস্ত। স্পেনিয়ার্ডরা ১৫৭৮ সালে ফিলিপিনের মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। দীর্ঘ যুদ্ধের পর ১৫৯৬ সালে মিন্দানাওয়ের স্পেনিয়ার্ড শাসক মুসলিমদের হাতে নিহত হয়। এর কিছুকাল পর ডাচ ও স্পেনিয়ার্ডরা যৌথভাবে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। যৌথ শক্তির সামনে মুসলিমদের প্রতিরোধ ভেঙ্গে পড়ে। অতঃপর ১৬৩৭ সালে মিন্দানাও এবং ১৬৩৮ সালে সুলুর পতন ঘটে। তারপর ফিলিপিনে কায়েম হয় সাদা চামড়াধারী শোষকদের কর্তৃত্ব।
১৯৪৯ সালে ফিলিপিন স্বাধীনতা লাভ করে। কিন্তু মুসলিমদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয়নি। স্বাধীনতার পরপরই মুসলিমরা তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে একটি পৃথক মুসলিম রাষ্ট্রের দাবি করে। কিন্তু ম্যানিলা সরকার অস্বীকার করে। অন্যদিকে বিদ্রোহ দানা বাধলে ফিলিপিন সরকারের সাথে মুসলমানদের সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হয়।
মুক্তির উপায় যখন সশস্ত্র সংগ্রামঃ(ভাঙ্গন, পতন এবং উত্থান)
মরো মুসলিমরা তাদের স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু করে ১৯৭০ সালে। পরবর্তীতে নূর মিশৌরির নেতৃত্বে ১৯৭২ সালে গঠিত হয় ‘মরো ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট’(MNLF)। আন্দোলন ক্রমান্বয়ে তীব্র আকার ধারণ করে। ফিলিপিন সরকার মুসলিমদের অধিকার দেয়ার বদলে চালায় অত্যাচারের স্টিমরোলার। আজ পর্যন্ত ১ লক্ষ ২০ হাজারের অধিক মুসলিম তাদের জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন নিজেদের অধিকারের জন্য।
সম্মিলিত আন্দোলন ফিলিপিন সরকারকে চাপের মুখে ফেলে দেয়। এক পর্যায়ে দিশেহারা হয়ে পড়ে সরকার। পরিস্থিতি পাল্টাতে চালে নতুন একটি চাল। সরকারের ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ নীতির কারণে স্বাধীনতাকামীরা দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে।
নূর মিশৌরির নেতৃত্বে স্বাধীনতাকামীদের এক অংশ ফিলিপিন সরকারের সাথে কিছু ক্ষতি সত্ত্বেও আপোষের সিদ্ধান্ত নেয়। অপরদিকে স্বাধীনতাকামীদের অপর অংশ সরকারের বিরুদ্ধে তাদের সংগ্রাম অব্যাহত রাখে। হাশিম সালামাতের নেতৃত্বে গঠিত হয় ‘মরো ইসলামিক লিবারেশন ফ্রন্ট’(MILF)।
নূর মিশৌরি ম্যানিলা সরকারের সাথে ১৯৯৬ সালে এক শান্তিচুক্তি সম্পাদন করেন। ফলে মিন্দানওয়ের চারটি অঞ্চলে মুসলমানদের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। নূর মিশৌরি সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
অপরদিকে ‘মরো ইসলামিক লিবারেশন ফ্রন্ট’ নূর মিশৌরির এই পদক্ষেপের সাথে একমত না হয়ে সশস্ত্র লড়াই অব্যাহত রাখে। তাদের দাবী ছিল পূরো মুসলিম অঞ্চলে স্বায়ত্বশাসন প্রতিষ্ঠা হবে। কিন্তু সরকারের সাথে মাত্র ৪ টি অঞ্চলের চুক্তি হওয়ায় এই মতপার্থক্যের সৃষ্টি হয়।
মিন্দানাওয়ের শক্তিশালী একটি স্বায়ত্তশাসন প্রক্রিয়ায় জন্য ‘মরো ইসলামিক লিবারেশন ফ্রন্ট' ১৯৯৬ সাল থেকেই সর্বোচ্চ ভূমিকা পালন করে আসছে।
মরো ইসলামিক লিবারেশন ফ্রন্ট সংগঠনটির প্রধান হলেন হাজী মুরাদ ইব্রাহীম
ESAM আয়োজিত কনফারেন্সে পৃথিবীর বিভিন্ন মুসলিম সংগঠের নেতৃবৃন্দ ও ছাত্র প্রতিনিধিদের সাথে হাজী মুরাদ
Moro Islamic Liberation Front এর এই আপোষহীন নেতা বাংসামরো জনগণের আশার প্রদীপ। তার আপোষহীনতা এবং দৃঢ় মনোবলের ফলাফল আজকের বাংসামরোর স্বায়ত্বশাসিত সরকার।।
অনেকেরই পূর্ব ধারণা যে- রেফারেন্ডাম হ্যাঁ জয়যুক্ত হলে এবং সবকিছু ঠিক থাকলে তিনিই হবেন পরবর্তী বাংসামরো সরকারের রাষ্ট্রপ্রধান।
তুরস্কের ইসলামী আন্দোলন মিল্লি গুরুশ এবং মরো
তুরস্কের মানুষের কাছে মরো শব্দটিই অপরিচিত ছিল। প্রফে.ড.নাজমুদ্দিন এরবাকানের মাধ্যমে তুর্কিরা জানতে পারে মরোতে তাদের মুসলিম ভাইয়েরা নির্যাতিত। কেউ পাশে না থাকলেও, আশেপাশের কোন দেশ সাহায্যের হাত না বাড়ালেও শুধুমাত্র একটি আন্দোলন হয়ে মরোকে সব ধরণের সহায়তা করা চাট্টিখানি কথা নয়।
Moro Islamic Liberation Front এর আপোষহীন নেতা হাজী মুরাদের সাথে মরো সম্পর্কে জিজ্ঞেস করার পর জবাবে বলেছিলেন- তুরস্কের মিল্লি গুরুশ(ইসলামী মুভমেন্ট) আমাদের জন্য যা করেছে এবং এখনো যা করছে এই ঋণ আমরা কখনো শোধ করতে পারব না। একটি ভাঙ্গা দেশকে পুনরায় গঠনের জন্য সেই ৮০ এর দশক থেকে অকাতরে বিলিয়ে দিচ্ছে এই আন্দোলন। মরোর নিপীড়িত মুসলিম অঞ্চল থেকে ছাত্রদেরকে তার্কিতে এনে শিক্ষার ব্যবস্থা করে দিয়ে একটি উত্তম ভবিষ্যতের দ্বার উন্মোচন করেছে মিল্লি গুরুশ। যখন তাদেরকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে সকলে সম্বোধন করতো তখন মুসলিম ভাই হিসেবে মিল্লি গুরুশই আমাদেরকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিল।
নাজমুদ্দিন এরবাকান হোজাকে দেখি নাই। তার প্রচেষ্টার কথা জীবন্ত এই কিংবদন্তীদের কাছ থেকে শুনি, অনুধাবন করি।
মরো নিয়ে বর্তমানে সাদেত পার্টির প্রধান তেমেল হোজার(উস্তাদ) ভূমিকা দেখেই অনুধাবন করা যায় মিল্লি গুরুশ উম্মাহর প্রতি কী রকম আন্তরিক। অর্থনৈতিক, সামাজিক, ডিপ্লোমেটিক সব ধরণের সহায়তা করে আসছে শুধুমাত্র উম্মাহ কেন্দ্রিক চিন্তাভাবনা থেকে।
তুরস্কের ইসলামী দল সাদেত পার্টির প্রধান তেমেল কারামোল্লাওলুর সাথে হাজী মুরাদ

দেশে থাকতে কখনো মরো এর নামে কোন সংগঠনকে একটা বিবৃতি পর্যন্ত দিতে শুনি নাই। অথচ মরো আমাদের অতি নিকটেই।
অপরদিকে সুদূর ১১ হাজার কি.মি দূরে অবস্থিত তার্কির ইসলামী আন্দোলন মিল্লি গুরুশ যারা সেই ৮০ এর দশকে ক্ষমতা না থাকা সত্ত্বও মরো এর জন্য কাজ করে যাচ্ছে। নিজেদের সামর্থ্য ক্ষুদ্র হওয়ার পরেও ওরা নিজেদের সর্বোচ্চ দিয়ে কাজ করে গিয়েছে পর্দার আড়ালে।

একজন নাজমুদ্দিন এরবাকান, একজন তেমেল কারামোল্লাওলুর বড়ই প্রয়োজন আমাদের দেশে, যারা কিনা উম্মাহর জন্য কিছুটা হলেও চিন্তা করবে।
স্বপ্ন দেখি মিল্লি গুরুশের মতো একদিন বাংলার মুসলিমরা নিপীড়িত কোন মুসলিম জনগোষ্ঠী সাহায্য চাওয়ার পূর্বেই যতটুকু সামর্থ্য আছে ততটুকুই পুজি নিয়ে তাদের পাশে দাঁড়াবে ।
রেফারেন্ডামের হ্যাঁ বিজয়ে সুবিধা অসুবিধাঃ
১- বাংসামরোতে #শরীয়া_আইন চালু হবে।
২- স্বায়ত্বশাসিত সরকার জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হবে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে ৮০ জন সংসদ সদস্য বিভিন্ন এলাকা থেকে নির্বাচিত হবেন। পরবর্তীতে সংসদ সদস্যরা CM কে নির্বাচিত করবেন এবং CM মন্ত্রীসভা গঠন করবেন।
৩- রাজস্বের ৭৫ ভাগ স্বায়ত্বশাসিত সরকার ব্যবহার করতে পারবে। একই সাথে আগামী দশ বছর ফিলিপিন সরকার প্রত্যেক বছর স্বায়ত্বশাসিত এই সরকারকে ৫ বিলিয়ন ডলার সাহায্য প্রদান করবে যা মরো অঞ্চলের পূনর্গঠনের জন্য ব্যয় করা হবে।
উল্লেখ্য, মরো অঞ্চল ফিলিপিনের সবচেয়ে দারিদ্র্য-নিপীড়িত অঞ্চল। এ অঞ্চলের বর্তমান আয় মাত্র ১.২ বিলিয়ন ডলার। যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম।
তবে রেফারেন্ডামে বিজয়ের ফলে- সরকারি রাজস্ব কর, ফি, চার্জ, এবং প্রাকৃতিক সম্পদসমূহে আরোপিত করের ৭৫ শতাংশ স্বায়ত্বশাসিত সরকারের কাছে থাকে। পূর্বে তা ছিল ৭০ শতাংশ।
৪- বাংসামরো সরকারের আওতায় থাকবে মিন্দানাও অঞ্চল, Basilan, Lanao del Sur, Sulu, এবং Tawi-Tawi অঞ্চল। পূর্বের চেয়ে বর্তমান চুক্তির আওতায় স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চলের আয়তন বৃদ্ধি পাবে।
৫- বিজয়ের ফলে বর্তমান চুক্তি অনুযায়ী, বাংসামরো সরকার তার অঞ্চলের অভ্যন্তরীন পানির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ এবং সংরক্ষণ সপূর্ণভাবে নিজের হাতে রাখতে পারবে। কেন্দ্রীয় সরকার এখানে কোন হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।
কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে বাংসামরো সরকার Department of Energy এর সাথে যৌথভাবে কাজ করবে।
বাংসামরোর খনিজ সম্পদের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যায়ের সকল কিছুই স্বায়ত্বশাসিত সরকারের কাছে যাবে।
শুধুমাত্র জীবাশ্ম জ্বালানী এবং ইউরেনিয়াম দুই সরকার সমানভাবে ভাগ করে নিবে।
মরো ইসলামিক লিবারেশন ফ্রন্ট

৬- Moro Islamic Liberation Front এর বর্তমান সৈন্যসংখ্যা ৩০ হাজার। মুসলিম যুবকদের নিয়ে তৈরীকৃত এই মিলিটারী ভেঙ্গে দিতে হবে চুক্তি অনুযায়ী।
৭- বাংসামরোতে বসবাসরত জনগোষ্ঠীকে স্বীকৃতি দেয়া হবে।
----------------------------------------------------------
ইনশাআল্লাহ বাংসামরো সরকার গঠিত হবে কয়েকদিনের মধ্যে।
মুসলিম উম্মাহ বুকভরা আশা নিয়ে তাকিয়ে আছে মরোর জনপদের দিকে।

উম্মাহর সদস্য হিসেবে একটাই প্রত্যাশা- শুধুমাত্র তুরস্কের নির্দিষ্ট কোন সংগঠন নয় বরং দেশ হিসেবে তুরস্ক এবং সকল মুসলিম দেশ যেন ওদেরকে একটি শক্তিশালী ভীত স্থাপনে সহায়তা করে।
মিন্দানাও দ্বীপপুঞ্জ এক নতুন সূর্যের অপেক্ষায়...

পঠিত : ৩১২৭ বার

মন্তব্য: ০