Alapon

ইতিহাসের পুনরাবৃত্তিঃ মিল্লি গুরুশ(রেফাহ, ফজিলত) ও আজকের জামায়াতে ইসলামী...

উসমানী খিলাফাতের পতনের পর তুরস্কের প্রকৃতিতে ইসলামের আবহাওয়ার সুবাতাস নিয়ে এসেছিল প্রফে.নাজমুদ্দিন এরবাকান কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত তুরস্কের ইসলামী আন্দোলন #মিল্লি_গুরুশ।।
প্রতিষ্ঠার পরপরই ৫ বছরের মাথায় মিল্লি গুরুশের রাজনৈতিক দল মিল্লি সালামেত পার্টি ১১% ভোট নিয়ে কোয়ালিশন করে ক্ষমতায়। তুরস্কের আপামর জনতার কাছে জায়োনিস্ট ইহুদীদের পরিচয় করানো। ইসলামী শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ও প্রচার, দেশকে উন্নয়নের চরমে নিয়ে যাওয়া, সুদূরপ্রসারী ফলাফল বিবেচনায় নিয়ে একের পর এক ফ্যাক্টরী প্রতিষ্ঠা। ৪ বছরের কোয়ালিশনে ২০০ এর বেশি ভারী ফ্যাক্টরী প্রতিষ্ঠা করা। জুতার ফ্যাক্টরী থেকে শুরু করে ট্যাংক বানানোর ফ্যাক্টরী। সকল কিছুতে তার্কিকে স্বয়ং-সম্পূর্ণ করে তুলতে কাজ করা। ৭৪-৭৮ সালের কোয়ালিশনের ক্ষমতায় সাইপ্রাস বিজয়, সেসময়েই সম্পূর্ণ দলীয় উদ্যোগে সরকারকে ব্যবহার করে এককভাবে ২ মিলিয়ন অর্থাৎ ২০ লক্ষ মানুষের কাজের সৃষ্টি!!!!!!!!!!!
মোটকথায় এক বিপ্লব সৃষ্টি হয় পুরো তুরস্কে।
এরপর মিল্লি গুরুশের রাজনৈতিক পার্টি মিল্লি সালামেতকে নিষিদ্ধ করা হলে ১৯৮৩ সালে গঠন করা হয় রেফাহ পার্টি।। মিল্লি গুরুশের পূর্বের তাজা স্মৃতি মানুষের মানসপটে বিদ্যমান ছিল। তাই বিরোধীদল হতে বেশি সময় নেয় নি রেফাহ পার্টি।
আর এসময়ই রেফাহ পার্টিতে আগমন আব্দুল্লাহ গুল, হালের এরদোয়ান এবং বুলেন্ত আরিঞ্চ দের। ১৯৯১ সালে রেফাহ পার্টি তখন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। মিল্লি গুরুশ কর্তৃক পূর্বে সাইপ্রাস বিজয় ও জায়োনিস্ট এবং আমেরিকা বিরোধী মিল্লি গুরুশের সুস্পষ্ট অবস্থানের কারণে বৈদেশিক ও দেশীয় অনেক চাপের মুখে পড়তে হয় মিল্লি গুরুশকে তথা রেফাহ পার্টিকে।
রেফাহ পার্টি বিরোধীদল হওয়া সত্তেও যখন বসনিয়াতে ২৬ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র ও ত্রাণ সাহায্য প্রেরণ করে এবং নির্যাতিত মুসলিম জনপদের পাশে দাড়াতে শুরু করে বিশেষ করে ফিলিস্তিন বিষয়ে, তখনই আমেরিকা ও ইসরাঈল ইসলামী আন্দোলন মিল্লি গুরুশকে ভাঙ্গার জন্য যারপরনাই প্রচেষ্ঠা শুরু করে।
উল্লেখযোগ্যভাবে সেসময় দুজনের নাম সামনে আসতে থাকে। আব্দুল্লাহ গুল ও পেছনের কলকাঠির নায়ক এরদোয়ান। দুজনই ১৯৯১ সাল থেকে আমেরিকান এম্বেসীর সাথে যোগাযোগ শুরু করেন দলের অনুমতি ব্যাতীত গোপনেই। এরদোয়ান যখন আমেরিকান এম্বেসীতে যান তখন তাকে এম্বেসডর বলেন- "আমরা আপনার মতোই দুঃসাহসী, সুদর্শন ও সুবক্তা কাউকে খুজছিলাম আলোচনার জন্য।"
পার্টির ভেতরে গ্রুপিং সৃষ্টি, শৃংখলা ও আদর্শ বিরোধী অবস্থানের কারণে মডারেটপন্থী আব্দুল্লাহগুল ও এরদোয়ানকে পার্টি থেকে এবং আন্দোলন থেকে বহিস্কারের দাবী নিয়ে প্রফেসর এরবাকানের কাছে আসেন কেন্দ্রীয় নেতারা।
তখন প্রফে.এরবাকান তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলেন- "তোমাদের ভাইয়েরা জাহান্নামের দিকে অগ্রসর হচ্ছে, আর তোমরা কিনা তাদেরকে সেদিকেই ঠেলে দিচ্ছ???"
"ওরা ইসলামকে নিয়ে হীনমন্যতায় ভুগছে, ওদের দৃষ্টিতে ইসলামী কখনো জয়ী হতে পারবে না। তাই তারা সেক্যুলারিজমের দিকে ঝুকছে, ইসরাঈলের সাথে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। তাদেরকে সেই রাস্তা থেকে ফিরিয়ে আনা তোমাদের কর্তব্য।।"
এরপর আর কেউ এবিষয়ে কথা বলেনি।। ১৯৯৬ তে যখন ক্ষমতায় আসল রেফাহ পার্টি তখন আব্দুল্লাহগুল বারংবার আমেরিকার শর্তসমূহ মেনে নেয়ার জন্য বিভিন্নভাবে বুঝাতে ব্যার্থ হয়ে নিরাশ হয়ে পড়ে।
পরবর্তীতে যখন রেফাহ পার্টি নিষিদ্ধ হয় এবং মিল্লি গুরুশ তার নতুন রাজনৈতিক দল ফজিলত পার্টি চালু করে। প্রফে.এরবাকান তখন জেলে। এই সুযোগে তখন সবাইকে চমকে দিয়ে রেজাই কুতানের বিপরীতে ফজিলত পার্টির প্রধান হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বীতায় আসে আব্দুল্লাহ গুল।।
প্রফে এরবাকানকে স্বৈরাচারী মনোভাব সম্পন্ন হিসেবে অভিযুক্ত করেন আমেরিকার সাথে সমঝোতা না করার কারণে। এরপর দলীয় সমাবেশে প্রকাশ্যে বলে যে-
"ন্যায়ভিত্তিক অর্থব্যবস্থা(ইসলামী অর্থব্য্যবস্থা) কখনো সম্ভব নয়, ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র (ইসলামী রাষ্ট্র) কখনো সম্ভব নয়, ইসলামী ইউনিয়ন এক অলীক কল্পনা। ইসরাঈলের বিরুদ্ধে সরাসরি অবস্থান নেয়া বাতুলতা ছাড়া আর কিছু না। ইউরোপ আমেরিকার বিরুদ্ধে কথা বলে আমরা কখনোই ক্ষমতায় যেতে পারব না। তাই আমাদের মডারেট হওয়া উচিৎ। ইসরাঈলের ব্যাপারে যথাসম্ভব নমনীয় হওয়া উচিৎ। দলের মধ্যে ইসলামের চর্চা কমিয়ে নিয়ে আসতে হবে। সেক্যুলারিজমের অধীনে আমাদের কাজ করে যেতে হবে। আমাদেরকে লিবারেল হতে হবে। "
পরবর্তীতে যখন তারা ইসলামী আন্দোলন মিল্লি গুরুশ থেকে বের হয়ে যায় তখন এরদোয়ান এই বলে বের হয় যে-
১। আমি আজ থেকে ইসলামি আন্দোলনের আদর্শকে ছুঁড়ে ফেললাম।
২। ইসরাইল হবে আমাদের কৌশলগত বন্ধুরাষ্ট্র।
৩। ইউরুপিয়ান ইউনিয়নের সদস্য হওয়ার জন্য আমাদের সকল প্রচেস্টা অব্যাহত থাকবে।
৪। সেক্যুলার-লিবারেলিজম এর ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালিত হবে।
এর পরপরই অবিশ্বাস্যভাবে সকল মিডিয়ার সাপোর্ট নিয়ে বর্তমান সময়ের প্রখ্যাত ইহুদী ব্যবসায়ী জর্জ সারোস ও গুলেনের আর্থিক সহযোগিতায় ক্ষমতায় আসে একে পার্টি।।
---------------------------------------------
আজ একই সুরে ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক সাহেব ও উনার সাথের অনেকেই বলছেন ইসলামী রাষ্ট্র সম্ভব নয়।
আব্দুল্লাহ গুলের মতোই উনি বলছেন সেক্যুলারিজমের আওতায় ইসলামী মূল্যবোধের আলোকে দল গঠন করা।
উনি একে পার্টির আদলে একটি দল গঠনের পরামর্শ দিচ্ছেন।
তাদের দৃষ্টিতে "ভারতের বিরোধীতা করা জামাতের বড় ভুলগুলোর একটি।"
তুরস্কের ইসলামী আন্দোলনের দুঃসময়ে ফজিলত পার্টি ভেঙ্গে নতুন দল গঠনের চেষ্টা করা হয়েছিল আজও একই ভাবে জামায়াতে ইসলামীর শৃংখলার বাহিরে গিয়ে দল ভাঙ্গার চেষ্টা করছেন ভারতের প্রতি নমনীয় ব্যক্তিবর্গ।।
তাই উনার পদত্যাগ পত্রের আজকের কথাগুলোতে তেমন অবাক হই নি।
এখন কথা হচ্ছে ভারতের ব্যাপারে নমনীয় হলেই কী ক্ষমতায় যাওয়া সহজ হয়ে যাবে??? ক্ষমতায় গিয়ে ভারতকে সুবিধা দিয়ে দেশের উন্নয়ন কী এতো সস্তা?? ভারতের সবচেয়ে বিশ্বস্ত বঁধু আওমীলীগ যেখানে ফারাক্কা ও তিস্তার বিষয়ে সুরাহা করতে পারে নি সেখানে অন্যরা কীইবা করতে পারবে???
তার উপর আরেকটি কথা হচ্ছে তুরস্ক থেকে মডেল আমদানি করলে একথা প্রথমে ভাবতে হবে যে- মিল্লি গুরুশ প্রথমে ক্ষমতায় ছিল। ক্ষমতা থেকে নামার ৩ বছরের মাথায় এরদোয়ানরা নতুন দল করতে সক্ষম হয়েছে কেননা তারা সকলেই ক্ষমতাসীন দলে ছিল। ক্ষমতাসীন দলকে আন্তর্জাতিকভাবে দমনের জন্য ভাঙ্গনের প্রয়োজন ছিল জায়োনিস্টদের। যার দরুন ইহুদী লবির কাছ থেকে সর্বোচ্চ সাপোর্ট পেয়েছে একেপি। আমেরিকাও তাদের পক্ষে ছিল। আর আমেরিকা না জেনে কারও পক্ষে সাফাই গায় না। তাই একেপি তার প্রতিষ্ঠার মাত্র ২ বছরের মাথায় এককভাবে ক্ষমতায় যেতে সক্ষম হয়েছে।
এখন বাংলাদেশের বিবেচনায় ভারত কখনোই আওমীলীগ ব্যাতীত অন্য কাউকে অগ্রাধিকার দিবে না।
আপনারা ভালোভাবেই জানেন যে আপনাদের নেতাদের ফাসি আওমীলীগ দেয় নি, দিয়েছে ভারত। কেন দিয়েছে সেটাও স্পষ্ট।
ভারতীয় আধিপত্যবাদ বিরোধী অবস্থানই একমাত্র কারণ।
ঠিক সেখানেই শুধুমাত্র ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য ভারতীয় আধিপত্যবাদ বিরোধী অবস্থান থেকে সরে আসা এবং বাংলাদেশের আলোকে বিবেচনা না করে একেপির হঠকারী ফর্মুলা নিজের দেশে প্রয়োগ করা বুদ্ধিবৃত্তিক দেউলিয়ার নামান্তর।
পরীক্ষার হলে কোন ছাত্রের নিজ থেকে প্রশ্নের উত্তর করার সামর্থ্য না থাকলে, সে সর্বোচ্চ নকলই করতে পারে।
সদ্য প্রয়াত আল মাহমুদ(আল্লাহ তাকে জান্নাতের সর্বোচ্চ স্থান দান করুন) বলেছিলেন-
"আমরা সমাজতন্ত্র কায়েম করতে চাইছিলাম,কিন্তু আল্লাহ আমাদেরকে দিয়ে ইসলামের খেদমত করিয়েছেন।"
অথচ আপনারা ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী হতে চাচ্ছেন তাও আবার সেক্যুলারিজমের আওতায়।
ইহা নিতান্তই কমেডীয় দারিদ্র্যতা।
মনে রাখবেন ভারতীয় আধিপত্যবাদ বিরোধী অবস্থান থেকে সরে যাওয়া মানে নিজের স্বকীয়তাকে বিক্রি করে দেয়া। বাংলাদেশ আজ টিকে আছে একটি সংগঠনের কারণেই।
তাদের নেতাদের রক্তের উপর এই বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে আছে। তাদের রক্তে দাবী হচ্ছে দেশকে ভারতীয় আধিপত্যবাদ থেকে মুক্ত করে একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা উপহার দেয়া।
এখানে কোন শর্টকাট নেই। এখানে আমাকে আপনাকে সেই আদর্শের স্কেল দিয়েই দাগ টানতে হবে।
কিন্তু আদর্শের স্কেলই যদি বাকা হয় তাহলে আমার আপনার পক্ষে কখনোই সোজা দাগ টানা সম্ভব নয়...

পঠিত : ২৬৫৩ বার

মন্তব্য: ০