Alapon

যে গাড়িটা বদলে দিল ভারতের রাজনৈতিক মানচিত্র

ভারতে অহরহই দেখা যায় একটা স্কুটার কিংবা মোটরাসাইকেলে পুরো পরিবার একসাথে চলছে। স্বামী-স্ত্রী, সাথে দুই তিনটে সন্তান। এই বিষয়টা ছিলো ঝুঁকিপূর্ণ। তাই দেখে টাটা গ্রুপের কর্ণধার রতন টাটা ভাবছেন তিনি সর্বসাধারণের জন্য একটা গাড়ি বানাবেন। অর্থাৎ তিনি একটা 'পিপলস কার' বানাবেন।

যেন ভারতের স্বল্প আয়ের মানুষের গাড়ি কেনার স্বপ্নটা পূরণ হয়। কাউকে আর যেন মোটরসাইকেলে পুরো পরিবার নিয়ে উঠতে না হয়। তিনি এমন একটা গাড়ি বানাতে চাচ্ছিলেন যার দাম এক লক্ষ টাকার বেশি হবে না। তিনি তার এই স্বপ্নের কথা জানিয়েছেন ২০০৩ সালে। তিনি আরো বলেন, এটি হবে অটোমোবাইলের জগতে একটি বিপ্লব। টাটা তাদের ইতিহাসে সবচেয়ে বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে।


রতন টাটা

এরমধ্যে ডিজাইনের কাজ চলছে। পাক্কা তিনবছর লেগে গেলো টাটা-ন্যানোর একটি ডামি তৈরি করতে। ২০০৬ সালে পশ্চিমবঙ্গে তখন ৩৪ বছর ধরে বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আছে। তখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। ঠিক সেই সময়েই রতন টাটা ঠিক করলেন তার ড্রিম প্রজেক্ট 'টাটা ন্যানো কার'-এর কারখানা তিনি পশ্চিমবঙ্গেই স্থাপন করবেন। রাজ্যে ২০০০ কোটি টাকা ইনভেস্ট হবে, কর্মসংস্থান হবে ইত্যাদি ভেবে রাজ্য সরকারও তাদের আমন্ত্রণ জানালেন।

বাম সরকার তাকে গাড়ির কারখানার জন্য কলকাতা থেকে পঞ্চাশ মাইল দূরে শিঙুরে ১০০০ একর যায়গা দেবে বলে ঠিক করল। সাধারণত, যেসব যায়গা চাষাবাদের জন্য উপযুক্ত নয় এবং অনুর্বর সেসব যায়গাতেই শিল্প কারখানা করার জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়। কিন্তু বাম সরকার এমন জমি কারখানা করার জন্য টাটা গ্রুপকে দিতে চেয়েছিলো যেগুলো কৃষি উপযোগী ছিলো এবং সেখানে কারখানা হলে আশেপাশের কৃষি জমি গুলো ক্ষতির সম্মুখীন হবে। শত শত বছর ধরে যে মানুষগুলো শিঙুরের কৃষি জমির উপর নির্ভর করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করছিলো সেই মানুষগুলোকেই উচ্ছেদের পরিকল্পনা করা হচ্ছিলো বিনিয়োগের নামে। খুব স্বাভাবিকভাবেই শিঙুরের স্থানীয় মানুষের মধ্যে একটা সুপ্ত ক্ষোভ জেগে উঠছিলো।


সিঙ্গুর কৃষি জমি রক্ষা আন্দোলন

ঠিক এই সুযোগটাকেই কাজে লাগালেন তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। "মা, মাটি ও মানুষ" এই স্লোগান তুলে তিনি শিঙুরের স্থানীয় জনগণের সুপ্ত ক্ষোভ আগ্নেয়গিরিতে রূপান্তর করলেন। কৃষি জমি রক্ষা আন্দোলন পুরো পশ্চিমবঙ্গে ছড়িয়ে পড়ল। যার ফলস্বরূপ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হয়ে উঠলেন পশ্চিম বাংলার কৃষকশ্রেনির আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। যে মেহনতি মানুষদের পুঁজি করে এতদিন বাম সরকার ক্ষমতায় ছিলো সেই মেহনতি মানুষ নিজেদের ভরসা হিসেবে খুঁজে পেলো মমতাকে। একইসাথে বুর্জোয়া ও ধনীর দালাল হিসেবে চিহ্নিত করলো বাম সরকারকে।



অন্যদিকে মোদি তখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী। তার টার্গেট তখন গুজরাট ছেড়ে আরো বড় কিছুর দিকে। মোদি পশ্চিমবঙ্গের এই সমস্যাকে পুঁজি করলেন। যে জমি পশ্চিমবঙ্গ দিতে ব্যর্থ হলো সে জমি দেয়ার পরিকল্পনা করলো গুজরাট। নরেন্দ্র মোদি বুঝতে পারলেন এটাই সুযোগ। শিঙুর আন্দোলনের জেরে তখনো কারখানা নির্মানের আলো নেভেনি। মোদি তখন একটি সাহসী সিদ্ধান্ত নিলেন। 
মোদি রতন টাটাকে মেসেজ দিয়েছিলো ওয়েলকাম টু গুজরাট, লিভ ওয়েস্টবেঙ্গল।


রতন টাটা, নরেন্দ্র মোদি ও টাটা ন্যানো

এরপর মাত্র ৭২ ঘন্টা। ৭২ ঘন্টায় মোদি রতন টাটার জন্য সবকিছুর ব্যবস্থা করে দিলেন। এই ৭২ ঘন্টায় তিনি লঙ্কাকান্ড বাধিয়ে ফেললেন। মোদি এই সময়ের মধ্যে জমি, বিদ্যুৎ, আইনী জটিলতা নিরসন, কর মওকুফ, একটা ফোর লেন হাইওয়ে আর ৯ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে দিলেন রতন টাটাকে।

নরেন্দ্র মোদি বুঝেছিলেন তিনি যদি পশ্চিমবঙ্গের সমস্যা মিটিয়ে দিতে পারেন তবে তার জীবনে একটা বিপ্লব হয়ে যাবে। ব্যবসায়িক মহলে চালু হয়ে যাবে মোদি ব্যবসাবান্ধব, বহু ব্যবসায়ী গুজরাটে আসবে একই সাথে মোদির উপর আস্থা রাখবে। আবার রাজনৈতিক মহলে রটে যাবে মোদি আসলেই কাজের লোক। যেকোনো সমস্যা মিটিয়ে দেয়া তার কাছে তুড়ি মাত্র।

মোদি যা ভেবেছেন তাই হয়েছে। এর মধ্যেই ভারতে মোদি ওয়েব শুরু হয়েছে যা রূপান্তর হয়েছে মোদি ম্যাজিকে। তার এই ম্যাজিক আচ্ছন্ন করেছে পুরো ভারতকে যার ফলশ্রুতিতে তিনি আজ প্রধানমন্ত্রী।

অন্যদিকে এই ন্যনো গাড়িটাকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে বিতাড়িত করে হিরো হয়েছেন মমতা। বাম সরকার জনগণের কাছে ভিলেন হয়ে রইলো। ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ২৯৫ টি আসনের মধ্যে ২২৬ টি আসন দখল করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেত্রীত্বে তৃণমূল কংগ্রেস-জাতীয় কংগ্রেস জোট বামফ্রণ্টকে পরাজিত করে পশ্চিমবঙ্গ সরকার গঠন করে।

এবার আবার গাড়ির দিকে ফেরা যাক।

টাটা প্রতিষ্ঠানের ন্যানো গাড়ির বাজার এখন নাই বললেই চলে। ২০১৮ সালে সব মিলিয়ে শ'খানেক গাড়িও বিক্রি করতে পারেনি টাটা। বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে না। এ পরিস্থিতিতে ন্যানো নিয়ে ভিন্ন চিন্তাভাবনা করছে প্রতিষ্ঠানটি। যেকোনো সময়ে এর উৎপাদন বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে আভাস দিয়েছে টাটা।

গাড়ির জগতে টাটা দাপটের সাথে চললেও ন্যানো গাড়ি ছিলো একটি লস প্রজেক্ট। এর মূল কারণ হলো ওদের সেলিং পয়েন্ট। ওরা ২০০৩ সালেই ঘোষণা দিয়েছে এটা তারা এক লাখে বিক্রি করবে। কিন্তু এক লাখে দাম রাখতে গেলে গাড়ির সুবিধা থাকে না। জনগণ গাড়ি বলতে গাড়িই কিনতে চায়, স্কুটার কিংবা মোটর সাইকেল নয়।

বেস ন্যানো গাড়ি এক লাখে ছাড়তে সক্ষম হয়েছিলো টাটা। কিন্তু সেখানে নিরাপত্তা ঝুঁকি ও অন্যান্য অনেক সুবিধা অনুপস্থিত ছিলো। সে সুবিধাগুলো নিতে গেলে আবার দাম যাচ্ছে বেড়ে। আরেকটি বড় সমস্যা ছিলো এই গাড়ির পার্টস পাওয়া যায় না। দাম কমাতে গিয়ে এই গাড়ির সকল পার্টস নিজের মতো করে সাজাতে হয়েছে টাটাকে।

সবমিলিয়ে আর চালানো যাচ্ছে না টাটা ন্যানোকে। এই বছরের জানুয়ারিতে টাটা ঘোষণা দেয় ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ন্যানো গাড়ির উৎপাদন এবং বিক্রি বন্ধ করে দেবে তারা। পুরো বিষয়টা ছিলো একটি লস প্রজেক্ট এবং অবিবেচনাপ্রসূত।

কথা ছিলো একটি বিপ্লব হবে অটোমোবাইলের জগতে। কিন্তু বিপ্লবটা হয়ে গেলো রাজনীতিতে। টাটা ন্যানো গাড়ির জগতে ভূমিকা না রাখতে পারলেও ভারতের রাজনীতির মানচিত্র পরিবর্তন করে দিয়েছে।

পঠিত : ৩২৮৭ বার

মন্তব্য: ০