Alapon

সরকারের গুরুত্ব দেয়া দরকার মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে

দেশে মানসিক রোগীর সংখ্যা অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। বাড়েনি চিকিৎসা সেবার পরিধি। প্রতি এক লাখ মানুষের জন্য চিকিৎসক রয়েছেন শূন্য দশমিক ৫০ জন। স্বাধীনতাপূর্ব সময়ে এ দেশে মানসিক রোগীর জন্য ৫০০ শয্যার একটি হাসপাতল ছিল। স্বাধীনতার প্রায় অর্ধশতাব্দী পরে দেশে মানসিক রোগীর চিকিৎসায় যুক্ত হয়েছে ২০০ শয্যার একটি হাসপাতাল। দেশের জনসংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি, আর মানসিক রোগী বেড়েছে জ্যামিতিক হারে।

সংশ্লিষ্টদের মতে, দেশে বর্তমানে প্রতি ৫ জনে একজন কোনো না কোনোভাবে মানসিক রোগে আক্রান্ত। অথচ রোগীপ্রতি বরাদ্দ মাত্র ৪৪ পয়সা। অন্যদিকে এ রোগের প্রতি দেশের মানুষ ও সরকারের উদাসীনতা, এ সংক্রান্ত চিকিৎসকদের যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা না থাকা ইত্যাদি কারণে বাড়ছে না বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও সেবার পরিধি। সম্প্রতি মানসিক রোগীর চিকিৎসায় অধিদফতর প্রতিষ্ঠায় প্রণীত খসড়া নীতিমালা মন্ত্রিসভায় পাস হয়েছে। কিন্তু এ নীতিমালা বাস্তবায়ন হলে মানসিক চিকিৎসার ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, চিকিৎসকদের বাদ দিয়ে আমলা দিয়ে অধিদফতর পরিচালিত হলে ফলপ্রসূ হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।

এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ যুগান্তরকে বলেন, একটা সময় মানসিক স্বাস্থ্যের পরিধি অনেক ছোট ছিল। তাই সেবার পরিধি বাড়েনি। অদূর ভবিষ্যতে সেবার পরিধি বাড়ানো হবে।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের পরিসংখ্যান অনুয়ায়ী দেশে প্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যে ১৬ দশমিক ১ ভাগ মানসিক রোগে ভুগছেন। এছাড়া উদ্বেগাধিক্যতে (অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডার) ৮ দশমিক ৪, বিষণœতায় (ডিপ্রেসিভ ডিজঅর্ডার) ৪ দশমিক ৬, গুরুতর মানসিক রোগে (সাইকোসিস) ১ দশমিক ১ এবং মাদকাসক্তিতে (ড্রাগ এডিকশন) শূন্য দশমিক ৬ ভাগ লোক ভুগছেন।

এদিকে প্রাপ্তবয়স্কদের চেয়ে শিশু-কিশোরদের মধ্যে মানসিক রোগে আক্রন্তের হার আরও বেশি। পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১৮ বছরের কম বয়সী শিশু-কিশোরদের মধ্যে ১৮ দশমিক ৪ ভাগই মানসিক রোগে আক্রান্ত। এছাড়া এ বয়সী শিশুদের ৩ দশমিক ৮ ভাগ মানসিক প্রতিবন্ধী, ২ ভাগ মৃগিরোগে আক্রান্ত এবং শূন্য দশমিক ৮ ভাগ মাদকাসক্ত।

প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, দেশে প্রতি এক লাখ মানুষের জন্য চিকিৎসক আছেন শূন্য দশমিক ৫০ জন। এর মধ্যে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ (সাইকিয়াট্রিস্ট) ২২০ জন। অর্থাৎ প্রতি লাখ মানুষের জন্য শূন্য দশমিক ১৩ জন। একইভাবে ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ৫০ জন- অর্থাৎ প্রতি লাখ মানুষের জন্য শূন্য দশমিক শূন্য তিনজন। সাইকিয়াট্রিক সোস্যাল ওয়ার্কার রয়েছেন মাত্র ৭, অকুপেশনাল থ্যারাপিস্ট মাত্র ৩ জন।

জানা গেছে, মানসিক চিকিৎসক তৈরিতে প্রথম প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয় ১৯৭২ সালে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে ‘ওটিএইচএম’ শীর্ষক এ প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৫ সালে দেশের প্রথম মেন্টাল হেলথবিষয়ক ডিপ্লোমা প্রশিক্ষণ কোর্স চালু হয়। ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনসের অধীনে (বিসিপিএস) এ সংক্রান্ত এফসিপিএস কোর্স চালু হয়। বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ তৈরিতে এমডি ও এমএস কোর্স পরিচালিত হচ্ছে।

দেশে ২০০৯ ও ২০০৫ সালে সর্বশেষ যে জাতীয় সমীক্ষা দুটি হয়েছে তার ফলাফল অনুযায়ী, প্রতি পাঁচজনের মধ্যে অন্তত একজন কোনো না কোনো মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত। অথচ দুটি বিশেষায়িত মানসিক হাসপাতালসহ সব মিলিয়ে দেশে রয়েছে মোটে ৭০০-এর মতো শয্যা। দেশে রয়েছে ২০০-এর সামান্য বেশি মানসিক রোগ চিকিৎসক, আর ৫০ জনের মতো ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট। ২০০৫ সালের জাতীয় বাজেট পর্যালোচনা করে দেখা যায়, স্বাস্থ্য খাতে প্রতি ১০০ টাকা বরাদ্দের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য খাতের জন্য থাকে মাত্র ৪৪ পয়সা।

এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মুহিত কামাল যুগান্তরকে বলেন, মানসিক রোগী আগের তুলনায় বেড়েছে। শুধু ২০১৬ সালেই বেড়েছে ১৬ শতাংশ। এক সময় মাদক সেবন মানসিক রোগ হিসেবে বিবেচিত হতো না। এখন এটি জটিল মানসিক রোগ। তিনি বলেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজসহ দেশের বড় ৮টি মেডিকেল কলেজে মানসিক রোগ বিভাগে কোনো অধ্যাপকের পদ নেই। বছরে ১২ থেকে ১৫ জন করে মানসিক চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ তৈরি হলেও তাদের পদায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না। এমনকি শূন্য পদের বিপরীতেও নিয়োগ হচ্ছে না।

৩ জানুয়ারি মানসিক স্বাস্থ্য সেবায় একটি অধিদফতর গঠনের বিধান রেখে ‘মানসিক স্বাস্থ্য আইন’র খসড়া নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। ১৯১২ সালের একটি আইনকে হালনাগাদ করে নতুন আইন করা হচ্ছে।

মানসিক চিকিৎসাসংক্রান্ত সমস্যা কাটিয়ে উঠতে স্বাস্থ্য বাজেটের কমপক্ষে ৫ শতাংশ এ খাতে বরাদ্দের দাবি জানান জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, সরকারি-বেসরকারি সব মেডিকেল কলেজে মানসিক রোগ বিভাগের অধীনে কমপক্ষে ১০টি শয্যা বরাদ্দ রাখতে হবে। এসডিজি অর্জন করতে হলে মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দিতে হবে।

পঠিত : ৭৪০ বার

মন্তব্য: ০