Alapon

১৯ শে রমজান- বাংলা বিজয়ের ইতিকথা ও শিক্ষাঃ

ইতিহাস জানান দেয় যে- গুপ্ত আমলে বাংলাদেশে আর্য ব্রাক্ষ্মণ্যবাদীদের দোর্দন্ড প্রতাপ শুরু হয়। আর্য ভাষা ও সংস্কৃতির স্রোত প্রবল বেগে আছড়ে পড়ে বাংলার জমিনে। কিন্তু এ জমিনের মানুষ ঐতিহাসিকভাবেই প্রতিবিপ্লবী। ব্রাক্ষ্মণ্যবাদী ধর্ম ও সংস্কৃতির অনাচারের বিরুদ্ধে। জনগণের আন্দোলনের তোড়ে এই বাংলা থেকে আর্য রাজত্ব ভেসে গিয়েছিল। অবশ্য এ আর্য বিরোধী সংগ্রাম পুরো ভারতবর্ষেই ছিল কিন্তু বাংলা মুলুকে বরাবরের মতোই এই আন্দোলন ছিল সবচেয়ে তীব্র।
এক শতাব্দী পর আসে পাল বংশের শাসনামল। পাল আমলে ব্রাক্ষ্মণ্যবাদীরা রাজ্যের সাথে সমানতালে চলতে থাকে প্রায় চারশ বছর এবং ধীরে ধীরে ব্রাক্ষ্মণ্যবাদ পুরো বাংলাকে প্রায় কুক্ষীগত করে নিয়েছিল। মানুষের জীবনধারা সমূলে পালটে দিয়েছিল। এই ব্রাক্ষ্মণ্যবাদীদের হাত ধরেই পাল শাসনামলের অবসান ঘটে এবং সেন বংশের শাসনামল শুরু হয়।
এই সেন আমলেই পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে নিকৃষ্ট কাজটি সম্পন্ন হয়। ব্রাক্ষ্মণ্যধারায় পুরো বাংলাদেশে কুলীনপ্রথাভিত্তিক বর্ণাশ্রমবাদী সমাজের ভিত রচনা করা হয় এই সময়েই।
বর্ণাশ্রম প্রথা আপাদমস্তক চালু হল বাংলার মাটিতে। মানুষের মধ্যে বৈষম্যের সর্বোচ্চ উদাহরণ সৃষ্টি করা হল।
উৎপত্তি হলো ছত্রিশ জাতের।
পটভূমি রচনা
সেন-বর্মণ যুগের ব্রাক্ষ্মণ্যবাদী সামাজিক ও সংস্কৃতিক নিপীড়ন এবং অর্থনৈতিক শোষণের বাংলার মানুষ যখন অতিষ্ঠ সেই ক্রান্তিকালে মজলুম এই জনগণের পাশে এসে দাড়ান ইসলাম প্রচারক, আলেম, সুফী ও মুজাহিদগণ। একদিকে যখন ব্রাক্ষ্মণ্যবাদীদের নির্যাতন চরম শিখরে উপনীত হয়েছিল অন্যদিকে সেই নির্যাতনকে ছিড়ে-খুড়ে ইসলামের সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের বাণী গুঞ্জরিত হচ্ছে বাংলার আনাচে কানাচে। ইসলাম প্রচারকগণ নিপীড়িত জনগণকে সংগঠিত করে ব্রাক্ষ্মণ্যবাদীদের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ান বিক্রমপুরে, পুন্ড্রবর্ধনে, রামপুর বোয়ালিয়াতে(রাজশাহী)। মূলত ১০ ও ১১ শতক থেকে অসহায় দলিত মানুষের কানে ইসলামের মুক্তিবাণী সুবাতাস বইয়ে দিচ্ছিল, মুক্তির উচ্ছাস ছড়িয়ে পড়েছিল গৌড় থেকে চট্টগ্রাম এবং সিলেট থেকে মঙ্গলকোট পর্যন্ত।
ব্রাক্ষ্মণ্যবাদ মানুষের মধ্যে যে নিকৃষ্ট কৃত্রিম বৈষম্যের সৃষ্টি করেছিল, ইসলামের সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের বাণি ছিল তার বিরুদ্ধে প্রকাশ্য বিদ্রোহের ধ্বনি। ১২ শতকের শেষ নাগাদ বাংলার প্রায় প্রতিটি বিখ্যাত শহর, বন্দর এবং দেশের অভ্যন্তরের বিখ্যাত প্রসিদ্ধ গ্রামে-গঞ্জে সত্য ও মিথ্যা, হক ও বাতিল এবং ইসলাম ও কুফরের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে যায়। তৎকালীন দীর্ঘ এই দ্বন্দ্বে মানুষের কাছে সত্যের চেহেরা একদম সুস্পষ্ট হয়ে উঠে।
পদ্মা, মেঘনা, সুরমা ও যমুনার চারপাশে এক নীরব বিপ্লবের ঢেউ ফুলে ফেপে বেড়ে উঠতে থাকে। আর্যদের বৈদিক ও পৌরাণিক ধর্মের আগ্রাসণ ও আর্যদের তৈরীকৃত বর্ণপ্রথা যা কিনা সে অঞ্চলের আদিম বাসিন্দাদেরকেই অচ্ছুৎ হিসেবে বিবেচিত করেছিল সেই প্রথা ও ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বাংলার অধিবাসীরা হাজার বছর ধরে যে প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে তুলেছিল, ইসলামের সাম্যের বাণী তাদের সেই দ্রোহাত্মক চেতনাকে আরও বেগবাণ করে তুলে ভিন্ন এক সংগ্রামের জন্ম দিয়েছিল। বাংলা মুলুকের অধিবাসীদের কাছে ইসলামের প্রচারকগণ পরিণত হন তাদের মুক্তি সংগ্রামের মহানায়ক রূপে। তাদের গড়ে তোলা মসজিদ, মাদ্রাসা, খানকাগুলো ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক মতবিনিময়ের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয় এবং এসকল প্রত্যেকটি জায়গা মুক্তি সংগ্রামের একেকটি অভেদ্য দুর্গ হিসেবে পরিচিত পেতে থাকে।
বাংলা বিজয়
ইসলাম প্রচারক, আলেম ও মুজাহিদগণ মজলুম জনগণকে সাথে নিয়ে তাদের মুক্তির লক্ষ্যে ব্রাক্ষ্মণ্যবাদী সেন-রাজত্বের বিরুদ্ধে সংগ্রাম অব্যাহত রাখার কারণে পুরো বাংলাদেশে ইসলামের প্রতি জনসমর্থন ব্যাপক আকারে বাড়তে থাকে। অত্যাচারের বিরুদ্ধে সীসা ঢালা প্রাচীরের মতো মুসলিম আলেম ও মুজাহিদরা যে দৃষ্টান্ত পেশ করেছিলেন তার দরুন ইসলামের প্রতি বাংলা মুলুকের প্রতিটি মজলুম মানুষের নৈতিক একটি সমর্থন আপনা-আপনিতেই চলে এসেছিল। তখনও তারা ইসলাম গ্রহণ করেনি কিন্তু অধিকারের দাবীতে যারা তাদের পক্ষে লড়েছিল তাদেরকে পরম বন্ধু হিসেবেই আপন করে নেয় আমাদের দেশের মানুষ। পূর্বের বাংলা মুলুক ও বর্তমান বাংলাদেশের মানুষের সেই দৃঢ় জনসমর্থনের উপর ভিত্তি করেই ক্ষুদ্র একটি বাহিনী নিয়ে বিজয়াভিযান পরিচালনা করার প্রেরণা পেয়েছিলেন ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী। #১২০৫_সালের_১৯_শে_রমজান মার্চ মাসে সম্পন্ন হয় সেই ঐতিহাসিক বিজয়। উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে সে সময় নির্যাতিত বৌদ্ধরা মুসলিমদেরকে বিজয়াভিযানে সাহায্য করেছিল এবং বিজয়ের পর বখতিয়ার খিলজীকে অভিনন্দিতও করেছিল তাদেরকে জুলুমের নাগপাশ থেকে উদ্ধারের জন্য। বিজয়ের এক শতাব্দীর মধ্যে পুরো বাংলা মুলুক ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নেয়।
আমরা ইতিহাসকে ইতিহাসের মতো বিবেচনা না করে অনেকটা কল্পিত উপন্যাসের মতো অধ্যয়ন করি। ফলাফল- সমাজব্যবস্থা পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখি ঠিকই কিন্তু তা চাই চোখের পলকে।
ইতিহাস বখতিয়ার খিলজীকে স্মরণ করবে সদা সর্বদা বাংলা বিজয় করার জন্য কিন্তু বাংলা বিজয়ের পূর্বে কয়েক শতাব্দী ব্যাপী প্রতিরোধ সংগ্রাম ও জনগণের অধিকার আদায়ের যে আন্দোলন সেটাকেই সর্বাগ্রে রাখতে হবে।
মনে রাখতে হবে, বখতিয়ার খিলজী হচ্ছেন জমীনের সোনালী ধান মানে ফলাফল। কিন্তু এই বাংলার মাটি প্রস্তুত করেছিলেন ইসলামের প্রচারকরা, আলেমরা। তারা মাটিকে উপযোগী করে গড়ে তুলেছিলেন, বীজ বপন করেছিলেন, পরিচর্যা ও পরম আনন্দে এর যত্ন নিয়েছিলেন যার সুফল হিসেবে আজও আমরা মাথা উচু একথা বলতে এক মুহুর্তের জন্যও দ্বিধাবোধ করিনা--
"মুসলিম আমি, সংগ্রামী আমি, আমি চির রণবীর,
আল্লাহকে ছাড়া কাউকে মানিনা, নারায়ে তাকবীর... "
আমাদের বাংলার ইতিহাস হচ্ছে মিথ্যার বিরুদ্ধে সত্যের সংগ্রাম, আমাদের ইতিহাস হচ্ছে বাতিলের বিরুদ্ধে হক্বের সংগ্রাম, আমাদের ইতিহাসের পথ হচ্ছে শত বাধা শৃংখলকে মাড়িয়ে নব সভ্যতা বিনির্মাণের ইতিহাস।
ইতিহাস প্রেরণা দেয়, ইতিহাস আলপনা আঁকার অনুভূতি সৃষ্টি করে, ইতিহাস অনুপ্রেরণা ও স্বপ্নের প্রাসাদ তৈরী করে। ইতিহাস অধিকার আদায়ের কথা বলে। ইতিহাস জুলুমের বিরুদ্ধে সুউচ্চ কন্ঠের প্রতিবাদ চায়। ইতিহাস জালিমের থাবাকে গুড়িয়ে দিতে শিক্ষা দেয়। ইতিহাস চায় আবারও এই জাতি জেগে উঠুক। ঘুমন্ত সিংহের গর্জনের ন্যায় আবারও তাদের তাকবীর ধ্বনিতে কেপে উঠুক বাতিলের প্রাসাদ। ইতিহাস চায় পৃথিবীর বিখ্যাত মুসলিম জাতি যেন এই বাংলার জমীনে একটি ন্যায়-ভিত্তিক সমাজব্যবস্থা নির্মাণ করুক যা এক নতুন সভ্যতার গোড়াপত্তন করবে...
[সূত্র- আমাদের জাতিসত্তার বিকাশধারা]

পঠিত : ১৩৪৭ বার

মন্তব্য: ০