Alapon

ভারতে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের বিজয়ে বাংলাদেশে প্রভাব

ভারতের লোকসভা নির্বাচনে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা অগ্রিম ধারণা দিয়েছিলেন যে, এই নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি তথা এনডিএ জোট জিতবে, কিন্তু গত বারের তুলনায় তাদের আসন সংখ্যা কমে যাবে। কিন্তু নির্বাচনী ফলাফলে দেখা গেলো সম্পূর্ণ উল্টো। বিজেপির আসন সংখ্যা কমেনি, বরং বেড়েছে। গতবারে তারা পেয়েছিল ২৮২টি আসন। এবার তারা পেয়েছে ৩০৩টি আসন। অর্থাৎ এককভাবে শুধুমাত্র বিজেপিরই আসন সংখ্যা বেড়েছে ২১টি। 

রাজনৈতিক পন্ডিতরা ধারণা করেছিলেন যে, বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ এবারও নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে। কিন্তু তাদের গতবারের তুলনায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা কমে যাবে। কিন্তু নরেন্দ্র মোদি এবার খেলেছেন ২টি তাস। একটি হলো হিন্দুত্ব। আর একটি হলো পাকিস্তানের বিরুদ্ধে হামলা তথা কাশ্মীর তাস।

নির্বাচনী প্রচারণার পূর্বাহ্নে বেকারত্ব, রুপি ডিমানিটাইজেশন প্রভৃতি কারণে বিজেপির জনপ্রিয়তা কমে যায়। এছাড়া হিন্দুপ্রধান ৫টি রাজ্য, যেগুলোকে ভারতের হার্টল্যান্ড স্টেট বলা হয় সেগুলোর বিধান সভা নির্বাচনে বিজেপি হেরে যায়। ঐ দিকে উত্তর প্রদেশে বহুজন সমাজবাদী পার্টির মায়াবতী এবং সমাজবাদী পার্টি অখিলেশ যাদব  ঐক্যজোট গঠন করেন। এর ফলে ধারণা করা হয় যে উত্তর প্রদেশ এবং হার্টল্যান্ড স্টেটসমূহে বিজেপির আসন অনেক কমবে। কিন্তু কাশ্মীরের ঘটনা সমস্ত রাজনৈতিক হিসাব নিকাশকে লণ্ডভণ্ড করে দেয়। 

নির্বাচনের আগে কাশ্মীরের স্বাধীনাত সংগ্রামীরা গেরিলা আক্রমণ করে ভারতের ৪২ জন আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্যকে হত্যা করে। মোদি দেখেন যে নির্বাচনের আগে এটিই তার জন্য একটি সুবর্ণ সুযোগ। তিনি পাকিস্তানের অভ্যন্তরে বিমান হামলা করেন এবং সারা দেশব্যাপী তীব্র পাকিস্তান বিরোধী জিগির তোলেন। ভারতীয়রা ১৯৪৭ সালের পর থেকেই প্রবলভাবে পাকিস্তান বিরোধী। সুতরাং তারা মনে করেন যে, মোদির মতো শক্ত মানবের হাতেই ভারতের নিরাপত্তা সুরক্ষিত। আর এই কারণে জনগণ সাময়িকভাবে বেকারত্ব এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক সমস্যা ভুলে গিয়ে স্ট্রং ম্যান মোদির পেছনে জমায়েত হন।  

ভারত ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্বজাধারী। আর বাংলাদেশের আওয়ামী সেক্যুলার শিবির সেই ধর্মনিরপেক্ষতার জয়গানে মুখর। বাংলাদেশে ইসলামের কথা বলা হলেই বলা হয় মৌলবাদী। কিন্তু ভারতে যখন হিন্দুত্বের কথা বলা হয় তখন তারা সেটাকে মৌলবাদী বলে না। কিন্তু এই নির্বাচনে দেখা গেলো, হিন্দু মৌলবাদ ভারতকে তো গ্রাস করেছে বটেই, হিন্দুত্বের আগ্রাসী থাবা থেকে মুসলিম বান্ধব মমতা ব্যানার্জিও নিজেকে রক্ষা করতে পারেননি। গতবারে তাঁর তৃণমূল পশ্চিমবঙ্গে যেখানে পেয়েছিল ৩৪ টি আসন, এবার সেখানে মমতা পেয়েছেন ২৫টি আসন। অর্থাৎ হিন্দুত্ববাদ পশ্চিমবঙ্গে উদারপন্থী মমতার নিকট থেকে কেড়ে নিয়েছে ৯টি আসন।    

ভারতে বিজেপির এই বিশাল বিজয় বাংলাদেশের ওপর কতখানি প্রভাব বিস্তার করবে? এই প্রশ্নটি এখন একশ্রেণীর রাজনীতিক দল এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মাথায় ঘোরাফেরা করছে। এখনও কেউ ঝেড়ে কাশছেন না। তবে বর্ষীয়ান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. রওনক জাহান  বিবিসির কাছে তার মতামত খোলামেলা ব্যক্ত করেছেন। ভারতের লোকসভা নির্বাচনে হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি যে ব্যাপক বিজয় পেয়েছে, তা বাংলাদেশের জন্য চিন্তার কারণ হতে পারে বলে মনে করেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রওনক জাহান।

নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পর বিবিসি বাংলাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক রওনক জাহান বলেন যে, বহু বছর ধরে উপমহাদেশে ভারতের পরিচিতি ছিল ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির একটি মডেল হিসেবে। তবে তিনি মনে করেন যে ভারতে পরপর দুটো নির্বাচনে বিজেপির জয় বাংলাদেশের সেক্যুলার রাজনীতি যারা করতে চায়, তাদেরকে চিন্তায় ফেলবে।

অধ্যাপক জাহানের মতে, বাংলাদেশ সরকার চাইবে ভারত সরকারের সাথে সম্পর্ক ভালো রাখার। কিন্তু ভবিষ্যতে সে সম্পর্ক কোন দিকে যাবে, সেটি নির্ভর করছে বিজেপি সরকারের মনোভাবের ওপর। রওনক জাহান বলেন, ভারতে যদি সেক্যুলার রাজনীতি না চলে এবং তারা যদি আমাদের চারদিকে বিদ্বেষের রাজনীতি নির্বাচনে জেতার জন্য আরম্ভ করে দেন, তখন সরকারের পক্ষে সে জিনিসটা ম্যানেজ করা আরো অসুবিধা হবে। হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি ভারতে যেভাবে দিনকে দিন শক্তিশালী হচ্ছে, তার প্রভাব বাংলাদেশের উপরে থাকবে বলে অনেকে মনে করেন। কারণ বাংলাদেশকে ঘিরে থাকা ভারতের রাজ্যগুলোতে এবারের নির্বাচনে বিজেপি বেশ ভালো ফলাফল করেছে।

ভারতে দক্ষিণপন্থী রাজনীতির উত্থান হলে, বাংলাদেশ সরকার চাইলেও  ভারতের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা সম্ভব নাও হতে পারে? - এমন এক প্রশ্নে তেমন আশংকা একেবারে উড়িয়ে দেননি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রওনক জাহান। তিনি বলেন, ভারত বাংলাদেশের বৃহৎ প্রতিবেশী। বাংলাদেশের সব সরকারই চাইবে যে ভারতের সাথে সুসম্পর্ক বজায় থাকুক। তবে বাংলাদেশের সরকারকে দেশের জনগণের মনোভাবের দিকেও দৃষ্টি দিতে হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন। প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশ কোন কনসেশন বা ছাড় পাচ্ছে না বলে মনে করেন অধ্যাপক জাহান। এ ক্ষেত্রে তিস্তা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে ভারতের অনাগ্রহকে একটি বড় উদাহরণ হিসেবে তিনি মনে করেন।

সাম্প্রতিক বছরে ভারতের আসাম রাজ্যে নাগরিকত্ব যাচাই প্রক্রিয়ায় বলা হয়েছে যে ৪০ লাখ মানুষ অবৈধভাবে সেখানে বসবাস করছে, যাদের বেশিরভাগ মুসলমান। বিভিন্ন সময় বিজেপির সিনিয়র নেতারা বলেছেন যে অবৈধভাবে যারা আসামে বসবাস করছেন, তাদের বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়া হবে। নির্বাচনের প্রচারণার সময় বিজেপি পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে আসামের মতো নাগরিকত্ব যাচাইয়ের কাজ পশ্চিমবঙ্গেও তারা করতে আগ্রহী।

তাদের নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থের জন্য মুসলমানদের উপরে কিংবা বাঙালিদের উপরে তারা যে ধরনের শ্লোগান ব্যবহার করছেন, এগুলো হলে আমাদের সাধারণ মানুষ তো খুব বিক্ষুব্ধ থাকবে। কিন্তু আমাদের সরকার তো কখনোই চাইবে না ভারতের সাথে সম্পর্ক বিরূপ হোক। কিন্তু আমাদের দেশের মানুষের সেন্টিমেন্টকে তো তাদের দেখতে হবে। এ বিষয়টি বাংলাদেশে সরকারের জন্য এখন একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে বলে মনে করেন এই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী। ভারতে বিজেপি যদি মুসলিম-বিরোধী কথাবার্তা জোরালো করে, তাহলে সে বিষয়টি বাংলাদেশের ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য সুযোগ  তৈরি করবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

এই নির্বাচন সম্পর্কে আমাদের নতুন করে কিছু বলার নাই। যিনি যত কথাই বলুন না কেন ভারতীয় জাতীয়তাবাদ যে হিন্দু জাতীয়তাবাদ সেটিই ২০১৪ ও ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হলো।

পঠিত : ৩৩২৬ বার

মন্তব্য: ০