Alapon

কেমন ছিলো মক্কা বিজয়?

পৃথিবীর সূচনা থেকে আজ পর্যন্ত অনেক যুদ্ধ হয়েছে। যুদ্ধে একদল বিজয়ী হয়েছে আরেক দল পরাজয়কে বরণ করে নিয়েছে। এসব যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন দিগ্বিজয়ী মহানায়কেরা।

হিটলার, সম্রাট আলেকজেন্ডার আর নেপোলিয়ান বেনাপোর্টের বিজয় অভিযানগুলো ছিল রক্তপাতের ইতিহাস, মানুষ মারার মূলমন্ত্র। কিন্তু মহানবী হযরত মোহাম্মদের (সা.) মক্কা বিজয় ছিল সম্পুর্ণ ব্যতিক্রম ঘটনা। রক্তপাতহীন এক মহাবিজয়। অষ্টম হিজরির ১৯-২০ রমজানে মক্কা বিজয় হয়।

মক্কা অভিযানের আগে আল্লাহ তায়ালা রাসূলকে (সা.) বিজয়ের আগাম সংবাদ দিয়েছিলেন। পবিত্র কোরআনুল কারিমের ভাষায়, ‘যখন আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে সাহায্য ও বিজয় আসবে; তখন আপনি দেখবেন মানুষ দলে দলে আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করছে। তখন ‘হে নবী!’ আপনি আপনার মালিকের প্রশংসা করুন এবং তারই কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন। অবশ্যই তিনি তওবা কবুলকারী পরম ক্ষমাশীল’ (সূরা আন নাসর)।

রাসূল (সা.) মক্কার নিকটে গিয়ে ১৬ রমজান তাঁবু গাড়লেন। রান্নার জন্য আলাদা আলাদা চুলার ব্যবস্থা করলেন, যাতে করে শত্রুর মনে ভয় সৃষ্টি হয়ে যায়। মক্কায় প্রবেশের জন্য রাসূল (সা.) মুসলমান সৈন্যদের চারটি ভাগে বিভক্ত করে দিলেন। প্রথম ভাগের দলনেতা ছিলেন হযরত যুবায়ের (রা.)। দ্বিতীয় দলের দলনেতা ছিলেন হযরত আবু উবায়দা (রা.)। তৃতীয় দলের নেতা ছিলেন হযরত সা’দ বিন উবাদা (রা.)। চতুর্থ দলের দল নেতা ছিলেন হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা.)।

১৭ রমজান হযরত আব্বাস (রা.) আবু সুফিয়ানকে বন্দি করে রাসূলের (সা.) সামনে পেশ করলে আবু সুফিয়ান রাসূলের (সা.) হাতে ইসলাম গ্রহণ করেন।

মক্কায় প্রবেশ: ২০ রমজান রাসূল (সা.) খালিদ বিন ওয়ালিদকে নির্দেশ দিলেন, তুমি পেছন দিক থেকে মক্কায় প্রবেশ করবে, কাউকে হত্যা করবে না, কারো ওপর অস্ত্র প্রয়োগ করবে না। রাসূল (সা.) বিনা বাধায় সাদা ও কালো পতাকা নিয়ে সামনের দিক থেকে মক্কায় প্রবেশ করেন। তিনি উচ্চস্বরে সূরা আল ফাতাহ তিলাওয়াত করছিলেন। তাঁর মধ্যে ছিলো বিনয় ও নম্রতা। রাসূলের (সা.) সেজদাবনত মস্তক যেন উটের কুঁজ পর্যন্ত স্পর্শ করছিলো।

কিন্তু খালিদ বিন ওয়ালিদের কাফেলার ওপর কুরাইশদের তীর বর্ষণের ফলে তিনজন মুসলমান শাহাদাতবরণ করেন। প্রতিউত্তরে খালিদ বিন ওয়ালিদের আক্রমনে কুরাইশদের ১৩ জন লোক নিহত হয়। রাসূল (সা.) বিষয়টি জানতে পেরে খালিদের কাছে এর কৈফিয়ত চাইলে তিনি বিস্তারিত বর্ণনা দেন।

নিরাপদ অঞ্চল ঘোষনা: সব ধরণের রক্তপাত, ক্ষয়ক্ষতি ও জানমালের নিরাপত্তা বিধানে রাসূল (সা.) নিরাপদ ও সংরক্ষিত অঞ্চল ঘোষনা করেন। তিনি বলেন, (১) যারা আপন ঘরের দরজা বন্ধ করে থাকবে তারা নিরাপদ, (২) যারা আবু সুফিয়ানের ঘরে আশ্রয় নেবে তারা নিরাপদ এবং (৩) যারা কা’বা ঘরে আশ্রয় নেবে তারাও নিরাপদ।

কা’বা ঘরে প্রবেশ: রাসূল (সা.) কা’বা ঘরে প্রবেশ করে প্রথমে মূর্তিগুলো সরানোর নির্দেশ দিলেন। তখন কা’বা ঘরে ৩৬০টি মূর্তি ও কা’বার দেয়ালে অসংখ্য চিত্র অঙ্কিত ছিলো। এসব কিছুই নিঃশেষ করা হলো। অতঃপর রাসূল (সা.) তার সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে কা’বায় দু’রাকাত সালাত আদায় করেন।

মক্কায় বিজয় সমাবেশ: মক্কা বিজয়ের পরদিন ২১ রমজান বিশ্বনেতা হযরত মুহাম্মদের (সা.) নেতৃত্বে এক জনসমাবেশের আয়োজন করা হয়। মক্কার সকল নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ এতদিন যারা মুসলমানদের গালাগালি করেছে, মারধর করেছে, তাদের ঘরবাড়ি থেকে বিতাড়ন করেছে, লুটপাট করেছে, মুসলমানদের সম্পত্তি দখল করে নিয়েছে, রাসূলের (সা.) চাচার কলিজা চিবিয়ে খেয়েছে, রাসূলকে (সা.) হত্যার ষড়যন্ত্র করেছে, মক্কা থেকে হিজরত করতে বাধ্য করেছে তারাসহ সর্বস্তরের মানুষ এ সমাবেশে উপস্থিত ছিল। মহানবি (সা.) এ সব শত্রুদের হাতের কাছে পেয়েও ছেড়ে দেন।

মক্কায় সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা: জন্মভূমি মক্কা হতে বিতাড়িত হওয়ার ৭ বছর ৩ মাস ২৭ দিন পর বিজয়ী বেশে পুনরায় মক্কায় ফিরে এলেন মক্কার শ্রেষ্ঠ সন্তান বিশ্ব মানবতার মুক্তিরদূত, নবীকুল শিরোমণি, শেষনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)। বিনা যুদ্ধেই মক্কার নেতারা তাঁর নিকটে আত্মসমর্পণ করেন। এতদিন যারা রাসুল (সা.) ও তার অনুসারিদের শত কষ্ট দিয়েছেন, অত্যাচার করেছেন আজ হাতের কাছে পেয়েও তিনি তাদের থেকে কোন প্রতিশোধ গ্রহণ করেননি। সবাইকে উদারতা ও ক্ষমার চাদরে ঢেকে দিয়ে বললেন, ‘আজ তোমাদের উপর আমার কোন অভিযোগ নেই, তোমরা মুক্ত’।

রাসূলের (সা.) এ ভাষণ শুনে আর তার আচরণ দেখে সমবেত সবাই ঘোষণা করলেন, সত্যি আপনি আল্লাহর নবী; আপনি কোন দেশ বিজয়ী সাধারণ বীর যোদ্ধা বা বাদশা নন।

মক্কা বিজয়ের পর পরাজিত শত্রুর প্রতি মোহাম্মদ (সা.)-এর আচরণ ও তার ভাষণ পৃথিবীর ইতিহাসে এক বিরল ও নজিরবিহীন ঘটনা। যা আজকের বিশ্ব ব্যবস্থায় মানবিক সমাজ গঠনে এবং ভ্রাতৃত্ব পুনঃস্থাপণ ও জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে এক অনুপম, অনুকরণীয় ও অনুস্মরণীয় দৃষ্টান্ত হতে পারে।

আল্লাহ তায়ালার ঘোষণা হচ্ছে, ‘যে ব্যক্তি ধৈর্য ধারণ করে এবং মানুষকে ক্ষমা করে দেয়, সে যেন জেনে রাখে, অবশ্যই এটা হচ্ছে সাহসিকতার কাজসমূহের মধ্যে অন্যতম’ (সূরা আশ শুরা: ৪৩)।

পঠিত : ৪৫৮০ বার

মন্তব্য: ০