Alapon

কবি ফররুখের অনুবাদ প্রতিভা

আজ ১০ জুন। আজ থেকে ১০১ বছর পূর্বে জন্মেছিলেন বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাব্য প্রতিভার অধিকারী কবি ফররুখ আহমদ। তাঁর ১০১ তম জন্মদিন উপলক্ষে আমরা কবির কাব্য প্রতিভা ছাড়াও অন্য  একটি প্রতিভা নিয়ে আলোচনা করবো। 

ফররুখ আহমদ (১৯১৮-১৯৭৪) বাংলা সাহিত্যের একজন মৌলিক প্রতিভাধর ও স্বভাবকবি হিসেবে তাঁর সৃষ্টির বিভিন্ন দিক নিয়ে সন্তোষজনক আলোচনা হলেও তাঁর প্রতিভার একটি উজ্জ্বল দিক বরাবরই উপেক্ষিত ও অনালোচিত থেকে গেছে। ফররুখ-প্রতিভার সে উজ্জ্বলতম দিকটি হলো তাঁর অনুবাদ-প্রতিভা। অন্য সমালোচক ও গবেষকরা তো বটেই, ফররুখ-অনুরাগী সমালোচক ও গবেষকরাও এদিকটি নির্মমভাবে এড়িয়ে গেছেন! সবচেয়ে বিস্ময়কর হলো, স্বকালের শ্রেষ্ঠ সমালোচক আবদুল মান্নান সৈয়দ (১৯৪৩-২০১০), যিনি ফররুখ-অনুরাগী সমালোচক ও গবেষকদেরও অন্যতম, তিনিও ফররুখের অনুবাদ-প্রতিভা সম্পর্কে তেমন কোনো আলোচনা করেননি। ফররুখকে নিয়ে তাঁর গভীরাশ্রয়ী গবেষণাগ্রন্থ ‘ফররুখ আহমদ : জীবন ও সাহিত্য’-এ ফররুখের গ্রন্থপঞ্জির তালিকায় ‘কোরআন-মঞ্জুষা’ ও ‘ইকবালের নির্বাচিত কবিতা’র নামটুকু শুধু উল্লেখ করেছেন, কিন্তু তাঁর অনুবাদ-প্রতিভা বা শক্তি-স্বাতন্ত্র্য নিয়ে কোনো আলোচনাই করেননি। ব্যতিক্রম শুধু মোহাম্মদ মাহ্ফুজউল্লাহ্। তিনি ‘বাংলাকাব্যে ফররুখ আহমদ : তাঁর শক্তি ও স্বাতন্ত্র্যের স্বরূপ’ গ্রন্থে ফররুখের অনুবাদ নিয়ে দীর্ঘ দু’টি প্রবন্ধ লিখেছেন : ‘আল-কোরআনের অনুবাদে ফররুখ আহমদের অবদান’ (পৃ. ২৮১-২৯২) এবং ‘ইকবাল-কাব্যের অনুবাদক ফররুখ’ (পৃ. ২৯৩-৩০৩)। এছাড়াও তিনি ফররুখ-অনূদিত ‘ইকবালের নির্বাচিত কবিতা’র ১৬ পৃষ্ঠাব্যাপী দীর্ঘ ভূমিকায়ও ফররুখের অনুবাদ সম্পর্কে কিছু আলোচনা করেছেন।

এ বিষয়টিতে সমালোচকদের অবহেলা ও উপেক্ষায় আমাদের বিস্ময়ের কারণ হলো, ফররুখের অনুবাদ গুণে-নৈপুণ্যে, মূলানুগতায়-বিশ্বস্ততায়, বিদেশি রূপকল্পের দেশী রূপায়ণে, ভিনভাষী চিত্রকল্পের নিজভাষিক চিত্রায়নে মৌলিক সৃষ্টির মহিমায় মণ্ডিত। শব্দে-ছন্দে, মূলের মর্ম-মেজাজ রূপায়ণে, বলার ভঙ্গিতে-সঙ্গীতে, উপমা-রূপকের স্বদেশীকরণে, চিত্রকল্পের নিজ পরিবেশীয় পরিবেশনে তাঁর অনূদিত কবিতা যেন তাঁরই রচিত কবিতা। মৌলিক রচনার মতোই গাঢ়বদ্ধ ও প্রাণবান। অনুবাদপনার ফেনায়িত জলাশয়ে পরিণত হয়নি তাঁর অনূদিত কবিতাসমগ্র।

২.
ফররুখের অনূদিত কবিতা মৌলিকভাবে দু’ধরনের : কোরআন করিমের অংশবিশেষ এবং ইকবালের কিছু নির্বাচিত কবিতা। উভয় প্রকারের অনুবাদে ফররুখের প্রখর প্রতিভা প্রতিফলিত হয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি স্ফুরিত হয়েছে ইকবালের কবিতার অনুবাদে। আমাদের দেশে ইকবাল-কাব্যের অনুবাদ আরও অনেকে করেছেন। কিন্তু ফররুখ ইকবালি মানসিকতার কাছাকাছি হওয়ার কারণে তাঁর অনুবাদ আবেগবলিষ্ঠতায় সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে। ইকবালের বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘আসরারে খুদি’র অনুবাদ আমাদের আরেক শক্তিমান কবি সৈয়দ আলী আহসানও করেছেন। কিন্তু ফররুখের সৃজনী ক্ষমতায় তাঁর অনুবাদ এক নবসৃষ্টির মহিমা লাভ করেছে। উপমা ও রূপপ্রতীকসমৃদ্ধ একটি কবিতার অনুবাদ দেখা যাক—
“দুরন্ত দস্যুর মত যখন প্রোজ্জ্বল সূর্য হানা দিল শর্বরীর ’পরে
আমার ক্রন্দনধারে শিশির সঞ্চিত হল গোলাবের মুখ,
নার্গিসের ঘুমঘোর মুছে নিল মোর অশ্রুকণা,
উজ্জীবিত তৃণদল উল্লাসে ছড়ায়ে যায়
আমারি একাগ্র আবেগে।”
অথবা
যদিও কণিকা আমি তবু জানি খরপ্রভা সূর্য সে আমারি,
সহস্র ঊষার দীপ্তি সংগোপন মোর বক্ষ মাঝে,
জামশীদের পাত্র হতে উজ্জ্বল আমার ধূলি জানে সংজ্ঞা তার
জন্ম যে নেয়নি আলো ধূলিরুক্ষ ধরিত্রীর বুকে।
শিকার করেছে মোর চিন্তাধারা সেই হরিণীকে। (আসরারে খুদির সূচনা খণ্ড, ইকবালের নির্বাচিত কবিতা)
এসব কবিতা পড়তে পড়তে মনে হয় না যে, আদৌ এগুলি কোনো কবির কবিতার অনুবাদ। বরং এগুলি ফররুখের নিজের কবিতার মতো সংহত, প্রাণবান ও সাঙ্গীতিক ধ্বনিতে অপরূপ। এটাই ফররুখ-অনুবাদের গতি ও শক্তির প্রমাণ।
অনুবাদও কবিতা হতে পারে—সে কথা হয়তো অনেকে মানবেন না। তবু মেনে নিয়েছেন কোনো কাব্যরসিক। কেন মেনেছেন? উত্তর একটাই—তা হলো, তাদের অনুবাদও মূল বাংলা কবিতা হয়ে উঠেছে। যাদের শিল্পীহাতের জাদুস্পর্শে অনুবাদও মৌলিক কবিতা হয়ে উঠেছে, তাদের একজন হলেন কবি ফররুখ আহমদ। বিশেষ করে ইকবালের কবিতা-অনুবাদের ক্ষেত্রে। দেখা যাক,
দেখ এই ঘনঘটা, বর্ষণ মুখর মেঘ/দেখ এই অবিশ্রান্ত শ্রাবণী বাদল,
আকাশের এ গম্বুজ-শব্দহীন আবহমণ্ডল,/এ পাহাড়, এ সমুদ্র, বালিয়াড়ি—এ মরুতল,
নিয়ন্ত্রিত হবে এরা তোমারি শাসনে। (ইকবালের নির্বাচিত কবিতা, পৃ. ১)
গোধূলি-মগ্ন মেঘ ছুঁয়ে যায় খাড়া পাহাড়ের উঁচু কপাল,/সূর্যাস্তের রক্তাভা যেন বাদাখশানের হীরক লাল।
সহজ-সরল কৃষাণ কুমারী গেয়ে যায় এক আতশী গান,/হৃদয় তরীর পথে যৌবন যেন উচ্ছল বিপুল বাণ।
(ইকবালের নির্বাচিত কবিতা, পৃ. ১৮)

৩.
বাংলা সাহিত্যের প্রায় সকল মৌলিক প্রতিভাধর কবি অনুবাদ করেছেন বিশ্বসাহিত্যের কোনো না কোনো দিকপাল কবির কবিতা। এমনকি যুগস্রষ্টা ও যুগদ্রষ্টা কবিরাও বাদ যাননি। তাই দেখা যাচ্ছে : রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, বুদ্ধদেব বসু, শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদও অনুবাদ করেছেন ভিনভাষার কবিতা। ফররুখও দূরে থাকেননি সাহিত্যের এই গুরুত্বপূর্ণ আঙ্গিক থেকে।

তবে মনে রাখতে হবে, বিশ্বসাহিত্য থেকে অনুবাদ করার ক্ষেত্রে সকলের প্রেরণা ও প্রেক্ষাপট কিন্তু এক ও অভিন্ন নয়। বরং বহুধাবিভিন্ন ও বিচ্ছিন্ন। ফররুখ কেন ইকবালকে অনুবাদ করতে গেলেন? সেই প্রশ্নের উত্তর তো গবেষকরা দিয়েছেন বলে আমার জানা নেই। সামান্য ইঙ্গিত করেছেন যারা, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন : ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, সৈয়দ আলী আহসান, মনিরউদ্দীন ইউসুফ, মোহাম্মদ মাহ্ফুজউল্লাহ্। এছাড়াও ফররুখ নিজেও ‘ইকবাল প্রসঙ্গ’ প্রবন্ধে সেদিকে কিছুটা ইঙ্গিত করেছেন। প্রবন্ধটির উপজীব্য বিষয় যদিও ইকবালের শ্রেষ্ঠকাব্য ‘আসরারে খুদি’র আলোচনা, তবু তিনি সংক্ষিপ্ত ভূমিকা হিসেবে ইকবাল-অনুবাদের প্রয়োজনীয়তা ও প্রাসঙ্গিকতার দিকে ইঙ্গিত করেছেন। তাঁর সেই ভূমিকা থেকে কিছু উদ্ধৃতি পাঠকের সামনে হাজির করছি।

“বিশ শতকের সর্বশ্রেষ্ঠ দার্শনিক ও তামাদ্দুনিক কবি হিসেবে সকল দিগন্তবাসীর অভিনন্দন পেলেও আল্লামা ইকবালের কবিতা—দুয়েকটি জনপ্রিয় (এবং নিম্ন স্তরের) কবিতা ছাড়া বাংলা ভাষায় ইকবালের বিশাল কাব্যভাণ্ডার পাঠক সাধারণের কাছে এক রকম অবরুদ্ধ বললে অত্যুক্তি করা হয় না।… ইকবালের যে বিশাল কাব্য-সম্পদ শিক্ষিত বাঙালির কাছে অনধিগম্য হয়ে রয়েছে সেই অপরিচিত মঞ্জুষার সঙ্গে বাঙালি পাঠকের পরিচয় নিবিড়তরো করাতে হ’লে মুসলিম লেখক সমপ্রদায়কে এদিকে আরও অনেক বেশি মনোযোগী হতে হবে।… একথা অনস্বীকার্য যে, ইকবালের বিপ্লবী-চিন্তার অগ্নি-স্ফুলিঙ্গেই ভারতীয় মুসলিমের মনে আজাদীর স্বপ্ন-বহ্নি মেঘের মতো পক্ষ বিস্তার করেছে। আমাদের রাজনৈতিক ঝাণ্ডাবাহীর দল প্রয়োজন মতো ভুলে গেলেও লেখক সমপ্রদায়কে মনে রাখতে হবে একথা।” (ফররুখ রচনাবলী, প্রথম খণ্ড, [বাংলা একাডেমীর পক্ষ থেকে] আহমদ পাবলিশিং হাউস, ঢাকা, ১৯৭৯।)

এছাড়াও দেশ-জাতি-ধর্ম-মানবতা, সর্বোপরি বাঙালির জন্য ইকবাল যে কত প্রাসঙ্গিক ও অপরিহার্য—সে কথা ফররুখ ব্যক্ত করেছেন কখনও কথায়, কখনও কবিতায়। সঙ্গত কারণেই নিজের শ্রেষ্ঠ কাব্য ‘সাতসাগরের মাঝি’ ইকবালকে উত্সর্গ করেন।

৪.
বাংলা ভাষায় অনেকেই ইকবালের কবিতার অনুবাদ করেছেন। তাদের মধ্যে খ্যাত ও প্রতিষ্ঠিত কয়েকজন হলেন : ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, গোলাম মোস্তফা, মোহাম্মদ সুলতান, আশরাফ আলী খান, অমিয় চক্রবর্তী, মীজানুর রহমান, বেনজীর আহমদ, আবদুল কাদির, সুফিয়া কামাল, আবু যোহা নুর আহমদ, ওহীদুল আলম, আ.ন.ম বজলুর রশীদ, তালিম হোসেন, আহসান হাবীব, ফররুখ আহমদ, আবুল হোসেন, সৈয়দ আলী আহসান, মুফাখখারুল ইসলাম, আবদুর রশীদ খান, মনিরউদ্দীন ইউসুফ, সৈয়দ আবদুল মান্নান, সৈয়দ আলী আশরাফ, শঙ্খ ঘোষ, সত্য গঙ্গোপাধ্যায়, আবদুল মান্নান তালিব, আমীনুল ইসলাম, হাসনাইন ইমতিয়াজ, মতিউর রহমান মল্লিক, রূহুল আমীন খান, আবদুস সাত্তার, মোহাম্মদ মাহ্ফুজউল্লাহ্, আল মুজাহিদী, গোলাম সামদানী কোরেশী, ফারুক মাহমুদ, নিয়ামাল বাসির, মুহাম্মদ ঈসা শাহদী এবং আরও অনেকে।

ইকবালের বিভিন্ন কবিতার অনুবাদ বিভিন্নজনে করেছেন বিভিন্ন ঢঙে, বিভিন্ন আঙ্গিকে। উল্লিখিত অনুবাদকদের মধ্যে আশরাফ আলী খান, গোলাম মোস্তফা, মোহাম্মদ সুলতান, ফররুখ আহমদ, মনিরউদ্দীন ইউসুফ, সৈয়দ আবদুল মান্নান, সৈয়দ আলী আহসান, সত্য গঙ্গোপাধ্যয়, শঙ্খ ঘোষ, অমিয় চক্রবর্তী ও আবুল হোসেনের অনুবাদই বেশি সফল ও প্রসাদগুণসম্পন্ন হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন সমালোচকগণ।

কবিতার অনুবাদ জটিলতম কাজ, তা যদি আরও কাব্যে হয়, তা হলে আরও জটিলতর—একথা সর্বজনমান্য। তবে এ-জটিল কাজটি আনন্দস্রাবীও বটে। কবিতার অনুবাদ সম্পর্কে একেকটি গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব হলো, অনুবাদক ও মূল কবি সমচেতনার না হলে, অনুবাদ পঙ্গু ও ভঙ্গুর হয়। শুধু কবিতা কেন, গদ্যেরও, এমনকি কোনো শিল্পেরই অনুবাদ হতে পারে না, বলে মত ব্যক্ত করেছেন কেউ কেউ। একটি সাধারণ বাক্য ও একটি সাদামাঠা গদ্যের অনুবাদও যেখানে দুরূহ, সেখানে কবিতার অনুবাদ কী করে সম্ভব? কবিতা—যেখানে কণ্ঠের মৃদুতম কম্পনও গাঁথা থাকে এবং অযুত অনুষঙ্গ এসে ভিড় করে : বর্ণ-ভূগোলের, নারী-নিসর্গের, ইতিহাস ও পুরাণের। এ অসম্ভবতা বা জটিলতমতার কারণেই কেউ কেউ একটু পাশ কাটিয়ে, কিঞ্চিত্ তির্যক ভঙ্গিতে বলেছেন, কবিতার অনুবাদ যদি সম্ভব হয়ও, তবে তা একমাত্র করতে পারেন আরেক কবিই।

কেন ও কীভাবে ফররুখের অনুবাদ প্রায় সকল অনুবাদকের অনুবাদকে ছাড়িয়ে গেছে, তার সংক্ষিপ্ত অথচ যৌক্তিক আলোচনা করেছেন আমাদের দু’জন কৃতবিদ্য ও লব্ধপ্রতিষ্ঠ সমালোচক : প্রয়াত নজরুল গবেষক শাহাবুদ্দীন আহমদ— ‘ইকবালের শ্রেষ্ঠ কবিতা’ গ্রন্থের ভূমিকায়। আরেকজন মোহাম্মদ মাহ্ফুজউল্লাহ্—ফররুখ আহমদকৃত ‘ইকবালের নির্বাচিত কবিতা’ গ্রন্থের ভূমিকায়। প্রয়াত নজরুলগবেষক শাহাবুদ্দীন আহমদ বলেন, ‘আসরারে খুদির তিনি (ফররুখ) যে অনুবাদ করেছেন, তিনি ব্যতীত সে রকম অনুবাদ করার ক্ষমতা বাংলা কাব্যে তাঁর সমকালে আর কারও ছিল না—নির্দ্বিধায় সে কথা উচ্চারণ করা যায়’। (‘ইকবালের শ্রেষ্ঠ কবিতা’ ভূমিকা দ্রষ্টব্য)

ফররুখের অনুবাদ ও ইকবাল-কাব্যের অন্যান্য অনুবাদগণের অনুবাদের তুলনামূলক আলোচনা করতে গিয়ে কবি-সমালোচক মোহাম্মদ মাহ্ফুজউল্লাহ্ বলেন, ‘ইকবাল-কাব্যের অনুবাদে ফররুখ আহমদের দক্ষতার পরিচয় তুলনামূলক বিচারে এবং এই স্বল্পপরিসরে দেওয়া সম্ভব নয়, তবুও, কয়েকটি উদাহরণ থেকেই বোঝা যাবে, ইকবালের আদর্শের অনুবর্তী, প্রতিভাধর কবি ফররুখ আহমদের সৃজনীক্ষমতায়, অনুবাদও কতখানি নবসৃষ্টির মহিমা লাভ করেছে।… অনুবাদগুলির পাশাপাশি সংস্থাপন এবং তুলনামূলক পাঠে এটাই স্পষ্ট হয় যে, ফররুখ আহমদের অনুবাদের মতো এতটা সংহত ও সুন্দররূপে, উপমা-চিত্রকল্পের সমবায়ে এমন প্রাণময়তা ও গতিশীলতা, আর কারও ভাবান্তরে মূর্ত হয়নি। বরং অনেকের অনুবাদে জড়তা এবং ক্লিষ্টতাই অনুভবযোগ্য।’— (ইকবালের নির্বাচিত কবিতা, ভূমিকা দ্রষ্টব্য।)

ইকবাল-কাব্যের বিভিন্ন অনুবাদ পাশাপাশি রেখে তুলনামূলক পাঠে একথা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, ফররুখের অনুবাদের মতো উপমা-চিত্রকল্পের যৌথায়নে এমন প্রাণময়তা ও গতিশীলতা আর কারও অনুবাদে মূর্ত হয়নি। ফররুখ আহমদের ভাষা ও ছন্দদক্ষতা, সৃজনক্ষমতা ও কল্পনাপ্রতিভা তাঁর অনুবাদকে নতুন সৃষ্টির মহিমা দান করেছে। উদাহরণ দেখা যাক,
‘‘ওঠো-দুনিয়ার গরীব ভুখারে জাগিয়ে দাও।/ধনিকের দ্বারে ত্রাসের কাঁপন লাগিয়ে দাও।
করো ঈমানের আগুনে তপ্ত গোলামি খুন/বাজের সমুখে চটকের ভয় ভাঙিয়ে দাও।
ঐ দেখ আসে দুর্গত দীন-দুঃখীর রাজ;/পাপের চিহ্ন মুছে দাও, ধরা রাঙিয়ে দাও।
কিষাণ-মজুর পায় না যে মাঠে শ্রমের ফল,/সে মাঠের সব শস্যে আগুন লাগিয়ে দাও। (ইকবালের নির্বাচিত কবিতা)
এ কবিতাগুলোকে কি অনুবাদ বলে মনে হয়? এগুলি মৌলিক কবিতার মতো পাঠকদের চিত্তে অনুরণন জাগায়, আঘাত হানে চেতনায়। অনুবাদের ক্ষেত্রে এটা বড়ই সার্থকতা।

ইকবাল-কাব্যের অনুবাদের ফররুখ আহমদের স্বাতন্ত্র্য আরও উজ্জ্বলভাবে ধরা পড়ে তাঁর কবিতা-নির্বাচনে, অনূদিত কবিতায় শব্দ ও ছন্দ ব্যবহারে, উপমা-উেপ্রক্ষায়, শব্দের সমশ্রেণিতা রক্ষায়। দেখা যাচ্ছে, সাধারণত অন্যান্য অনুবদক যেসব কবিতা অনুবাদ করেছেন, ফররুখ সম্পূর্ণ ভিন্নতর কবিতা অনুবাদ করেছেন। আবার তাই বলে ইকবালের শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলো বাদ দেননি। যেমন, ‘শেকোয়া’, ‘জওয়াবে শেকোয়া’, ‘কর্ডোভার মসজিদ’, ‘জিবরীল ও শয়তান’। ফররুখ নিজের মৌলিক কবিতার ক্ষেত্রে যেমন শব্দব্যবহারে অত্যন্ত সংযত ও সতর্ক, তেমনি অনুবাদেও।

তাই দেখা যাচ্ছে, ইকবাল-কাব্যের এমন কিছু শব্দ যেগুলো ইকবাল ব্যবহার করেছেন সম্পূর্ণ ভিন্নব্যঞ্জনায় এবং যেসব শব্দ প্রায় পরিভাষায় পরিণত হয়েছে, সেসব শব্দ ফররুখ বাঙলায়িত না করে হুবহু রেখে দিয়েছেন। যেমন : শাহীন, ইনকিলাব, খোদার ফরমান, আলমে বারজাখ, মর্দে মোমিন, মোনাজাত, হারীর, রোজ-ই-আজল, ইশক, সাকী, ফিতরাত (স্বভাব) এবং এ ধরনের আরও অনেক শব্দ। এসব শব্দের বাংলায়ন ফররুখ অবশ্যই করতে পারতেন। কিন্তু করেননি। কেন? তিনি ভালো করেই জানতেন, এগুলোর বাংলা অর্থ লিখলে ইকবালের মূলভাব ও ব্যঞ্জনা একেবারেই হারিয়ে যাবে এবং তাই হয়েছে অনেকের অনুবাদে তাই।

এছাড়াও ইকবাল কাব্যের অনুবাদে ফররুখ আহমদের শক্তি ও স্বাতন্ত্র্যের বেশ কিছু দিক রয়েছে, যেগুলো এত অল্পপরিসরে আলোচনা করা সম্ভব নয়। এ সংক্ষিপ্ত আলোচনার মাধ্যমে কিছুই না হোক, অন্তত কবির প্রতিভার এক উজ্জ্বলতম দিকের প্রতি পাঠক-গবেষকদের দৃষ্টি টানা হলো।

পঠিত : ৪৩২১ বার

মন্তব্য: ০