Alapon

হযরত উমর রা.-এর জীবনী পঠন এবং আমার উপলব্ধি ...

ঈদের ছুটিটা বেশ লম্বাই পেয়েছিলাম। প্রায় ১০ দিনেরও বেশি। ছুটিটা আমার জন্য একটু বেশিই মনে হচ্ছিলো। এ সুযোগে বিরাট একটা বই পড়ে ফেললাম। বইটি ছিল পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ শাসক, যার অধীনে প্রায় অর্ধবিশ্ব শাসিত হয়েছে মুসলিম বিশ্বের খলিফা আমিরুল মুমিনীন উমর ইবনুল খাত্তাবের জীবন নিয়ে আরব স্কলার ড. আলি মুহাম্মাদ সাল্লাবি রচিত দুই খন্ডের জীবনী গ্রন্থটা পড়ে শেষ করলাম।
এই বইটি পড়তে গিয়ে কখনো হয়েছি আনন্দিত, কখনো হয়েছি রোমাঞ্জিত আর কখনোবা নিজের অজান্তেই কেদে ফেলেছি।হযরত উমরের এই জীবনী পড়তে গিয়ে কখনো কখনো এমন একটা অনুভূতি কাজ করেছে যার সঙ্গে আমি আগে কখনোই পরিচিত ছিলাম না। যেমন, কোনো একটি ঘটনা পড়ে হাসি পাচ্ছিল আবার কান্নাও পাচ্ছিল।
খলিফা উমরের সময়কালে মুসলিম বাহিনীর সাথে পারস্যের বাহিনীর যুদ্ধ হয়। সেই যুদ্ধে পারস্যের বাহিনী পরাজিত হয় এবং তাদের সেনা প্রধান হরমুজান গ্রেফতার হয়। হরমুজান মুসলিম সেনাপ্রধানকে অনুরোধ করেন তাকে যেন আমিরুল মুমিনীন উমর ইবনুল খাত্তাবের কাছে প্রেরণ করা হয়। এবং সে খলিফার দেওয়া বিচারদন্ডই মাথা পেতে গ্রহণ করবেন।
মুসলিম সেনাপ্রধান তার অনুরোধ রাখলেন এবং এক প্রতিনিধি দলের সাথে হরমুজানকে খলিফার কাছে মদীনায় পাঠিয়ে দিলেন। প্রতিনিধি দল মদীনায় পৌছে যখন খলিফার বাড়িতে খোজ করল, তখন বাড়ি থেকে জানানো হল তিনি মসজিদে গেছেন।কুফা থেকে একদল প্রতিনিধি এসেছে তিনি তাদের সাথে দেখা করতে গেছেন। তারা মসজিদে গিয়ে দেখল, সেখানে কোনো প্রতিনিধি দলও নেই আমিরুল মুমিনীনও নেই। যখন তারা মদীনার বাজারে খলিফার খোজ করতে বের হল, তখন খেলারত একদল শিশু বলল, আপনারা কি আমিরুল মুমিনীনকে খুজছেন?
প্রতিনিধি দল বলল, হ্যা!
তখন শিশুরা জবাবে বলল, ‘আমিরুল মুমিনীন নিজের জুব্বা বালিশ বানিয়ে মসজিদের ডান দিকে শুয়ে ঘুমুচ্ছেন!
কূফার দলটি দেখা করতে আসলে আমিরুল মুমিনীন সেই জুব্বা পরে তাদের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন। তারপর সেই জুব্বাকেই বালিশ বানিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন।’
হরমুজানকে যখন মসজিদে নিয়ে যাওয়া হল তখন হরমুজান প্রশ্ন করল, কোথায় খলিফা?
জবাবে তারা বলল, এই ঘুমন্ত ব্যক্তিই আমাদের খলিফা উমর ইবনুল খাত্তাব।
তখন হরমুজান অবাক হয়ে বলল, তারা নিরাপত্তারক্ষি এবং দ্বাররক্ষিরা কোথায়?
জবাবে তারা বললেন, খলিফার কোনো নিরাপত্তা রক্ষি বা দ্বাররক্ষি নেই।
তখন হরমুজান বলল, তাহলে তো তিনি একজন নবী!
তখন উপস্থিত ব্যক্তিরা জবাবে বললেন, ‘তিনি নবী নন; কিন্তু নবীদের মতো সৎকর্মশীল।’
জীবনের শেষ দিন অবধি তিনি এভাবেই জীবন যাপন করেছেন।
আমিরুল মুমিনীন উমর ইবনুল খাত্তাবের জীবনী নিয়ে বলতে গিয়ে আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শায়খ ড. মুহাম্মাদ ফাহহাম বলেন, উমর তার জীবনে যে সফলতা অর্জন করেছেন, তা থেকে তার রাজনৈতিক বুৎপত্তি এবং বহুমুখী প্রতিভার সাক্ষর স্পষ্ট।তিনি তার শাসনামলে যেভাবে বিভিন্ন সমস্যা সাফল্যের সাথে মোকাবেলা করেছেন, সে দৃষ্টান্ত বর্তমান যুগেও অনেক সমস্যার সমাধানে পথ দেখায়।
হযরত উমরের জীবন নিয়ে বলতে গিয়ে শায়খ আলি আত-তানতাভি বলেন, আমি যতই উমর রা. এর জীবনী পড়ি ততই তার প্রতি মুগ্ধ হই। আমি মুসলিম- অমুসলিম নির্বিশেষে অসংখ্য মনীষীর জীবনীর পড়েছি। তাদের অনেকে ছিলেন চিন্তার দিক থেকে মহান, কিংবা বাকপটুতায় বিশেষ গুনসম্পন্ন, সদাচারণে কিংবদন্তি অথবা সম্পদ ও বংশমর্যাদার দিত থেকে উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন। কিন্তু উমর রা. এর মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের সকল দিককে আমি পেয়েছি। তিনি চিন্তা, আচরণ এবং বাগ্মিতায় ছিলেন বিশেষভাবে দক্ষ। যদি আমরা সর্বশ্রেষ্ঠ আইনবিদ এবং পণ্ডিতদের একটি তালিকা তৈরী করি, তবে উমর রা. সে তালিকার শীর্ষে অবস্থান করবেন। যদি তার গুনের মাঝে প্রজ্ঞা ছাড়া আর কিছুই না থাকত তবুও তিনি একজন মহান বক্তি হিসেবে বিবেচিত হতেন। যদি আমরা বক্তা ও বাগ্মিদের একটি তালিকা তৈরী করতাম তবে উমর রা. তালিকার প্রথম স্থানে অবস্থান করতেন। একইভাবে সুদক্ষ আইন প্রনয়নকারী, সামরিক নেতা অথবা সফল প্রশাসকদের একটি তালিকা যদি আমরা তৈরী করতাম তবে উমর রা.প্রত্যেকটিতে প্রথমস্থানে থাকতেন। যদি আপনি এমন একজন মহানব্যক্তিকে অধ্যয়ন করতে চান যিনি একাধিক রাষ্ট্র জয় করে সেখানে গৌরবময় ইতিহাস রচনা করেছেন, যিনি পৃথিবীতে সত্য ও ন্যায়ের একটি উত্তরাধিকার সূত্র রেখে গেছেন, তাহলে আপনি উমর রা. এর চেয়ে মহান আর কাউকে খুঁজে পাবেন না।
শুধু মুসলিম স্কলাররাই উমর রা. এর জীবন সম্পর্কে জানতে পেরে বিষ্মিত হন না। প্রাচ্যের অনেক স্কলাররা উ. উমর রা. এর জীবনী পড়ে বিষ্মিত হয়েছে।সেই বিষ্ময় প্রকাশ করতে গিয়ে উইলিয়াম নুর বলেন- সরলতা ও কর্তব্যনিষ্ঠা উমরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নীতি। তার প্রশাসনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যগুলোর একটি ছিল, কোনো রকম পক্ষপাতহীণতা। তিনি দায়িত্বশীলতার সত্যিকার অর্থ জানতেন। ন্যায়বিচারেও তিনি কোনোরূপ ছাড় দিতেন না। নিয়োগ প্রদানের সময় কোনো পক্ষপাতিত্ব করতেন না। অপরাধীদের সরাসরি শায়েস্তা করার জন্য তার সাথে একটি লাঠি রাখতেন। এ লাঠি অন্য যে কারও তরবারির চেয়ে শক্তিশালী ছিল। অথচ একই সাথে তিনি ছিলেন একজন হৃদয়বান ব্যক্তি, যার করুণার উদাহরণের বহু ঘটনা রয়েছে। বিশেষত বিধবা ও অনাথদের প্রতি তিনি ছিলেন সত্যিই দয়াশীল।
ড. মাইকেল হার্ট বলেন- উমরের অবদানের প্রভাব ছিল অপরিসীম। মুহাম্মাদ সা. এর পর ইসলাম বিস্তারের ক্ষেত্রে তার নাম প্রথমে আসবে। ইসলাম আজ যতো বিস্তৃতভাবে পরিচিত তার অবদান ছাড়া তা সম্ভবপর হতো না।
হযরত উমরকে বলা হতো ফিতনা এবং ইসলামের মাঝে দেয়াল। যতোদিন উমর রা. বেঁচে ছিলেন ততদিন ইসলাম ও মুসলিমদের মাঝে কোনো ধরণের ফিতনা দানা বাঁধতে পারেনি। কিন্তু যখনই উমর রা. মহান রবের ডাকে সাড়া দিয়ে পরপারে পাড়ি জমালেন তারপর থেকে একের পর এক ফিতনা মুসলিম বিশ্বকে গ্রাস করে ফেলল। এবং এই অবস্থা কেয়ামত অবধি চলবে।
উমর ইবনুল খাত্তাব নামটি শুনলেই দুটি চিত্র চোখের সামনে ভেসে ওঠে। একটিতে লাঠি হাতে প্রচন্ড কঠোর এক খলিফা। অন্যদিকে রাতের আধারে এতিম অসহায়দের জন্য নিজ পিঠে খাবার বহনকারী দয়াবান খলিফা। হায় বড় আফসোস জাগে, যদি উমরের যুগ পেতাম কিংবা আমার দেশের শাসক যদি উমর রা. এর মত কেউ হতো! নির্যাতিত এই মুসলিম বিশ্বের জন্য একজন উমরের বড়ই প্রয়োজন। কিন্তু যে উমর চলে গেছে সেই উমর তো আর কখনো জমিনের বুকে ফিরে আসবে না।

পঠিত : ১৮৯৬ বার

মন্তব্য: ০