Alapon

মগজ ধোলাই...

সজীব ভাইয়ের রেজাল্ট হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় বা চাকরির রেজাল্ট নয়, স্কলারশীপ পাওয়ার রেজাল্ট। যুক্তরাজ্যের কোনো এক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কলারশীপের জন্য আবেদন করেছিলেন।

যেদিন আবেদন করেন, সেদিন রাতে আমি তার বাসায় অনাহুত অতিথি হিসেবে উপস্থিত হই। ভেবেছিলাম অন্যান্য দিনের মত সেদিনও বলবেন,- ‘এতো রাতে তুই ক্যান!
বুয়া আসে নাই অতএব ভাত নাই। আমি কষ্ট করে রান্না করেছি। তোর জন্য কোনো ব্যবস্থা নাই। আমার পেটে রাজ্যের ক্ষুধা, নো শেয়ারিং!’

কিন্তু তিনি এসব কিছুই বললেন না। আমাকে অবাক করে দিয়ে বললেন, ‘ভাই, বহুদিন পরে আসলি! তুই আজ না আসলে তোকে অবশ্যই ফোন দিতাম। শোন, ইউকে তে স্কলারশীপের এপ্লাই করেছি। আমার জন্য খাস করে দোয়া করবি কিন্তু। আমার মনে হচ্ছে তুই দোয়া করলে কাজ হতে পারে।’

তখন বেশ ভাব নিয়ে বলেছিলাম, ‘দোয়া না হয় করলাম, কিন্তু তাতে আমার কী লাভ?’
তিনি আরও নরম সুরে লুতুপুতু গলায় বললেন, ‘তুই আমাকে ভাই বলে ডাকিস। তোর ভাই ইউকে তে পড়তে যাবে। এর চেয়ে বড় লাভ আর কী চাইস বল?’
তাকে বললাম, ‘এইসব মন ভুলানি কথাবার্তায় কাজ হবে না। চান্স পেলে সুলতানস ডাইন-এ খাওয়াতে হবে। বল রাজি? রাজি থাকলে আমিও দোয়া করতে রাজি।’

বেচারা আমাকে অবাক করে দিয়ে রাজি হয়ে গেল, আর সাথে সাথে আমারও টেনশন বেড়ে গেল। সেদিন রাতে একসাথে এশার নামাজ আদায় করে সজীব ভাইকে বললাম, ‘ভাই, মনে হচ্ছে আমার দোয়া কবুল হবে না। অতএব সুলতানস ডাইনের চুক্তি বাতিল!’
তিনি নাকো নাকো সুরে বললেন, ‘এমন বাজে কথা তোর মুখে আসল ক্যামনে! আমারতো মনে হচ্ছে, এই শালা তোর জন্যই আমি স্কলারশীপটা পাবো না।’

রেজাল্টের পর দেখা গেল সত্যি সত্যি ইউকে তে তার স্কলারশীপটা হয়নি। তারপরও কাচ্চি খাওয়ার লোভে সজীব ভাইয়ের বাসায় গেলাম। তিনি দরজা খুলে আমাকে দেখার সাথে সাথে বললেন, ‘অ্যাই অপেয়া, মুখ পঁচা, তুই আমার বাসায় আসছিস ক্যান? বাইর হ, তুই এক্ষুণি আমার বাসা থেকে বাইর হ!’

তিনি আমাকে প্রায় ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়ার চেষ্টা করলেন। কিন্তু আল্লাহপাক আমাকে একখানা শরীর দান করেছেন। সজীব ভাই তার শুকনো লিকলিকে শরীর নিয়ে আমার এই ছোটখাটো হাতির শরীরের ওপর সামান্য বলও প্রয়োগ করতে পারলেন না। অতঃপর তার বিছানায় পা এলিয়ে বসে পড়লাম।

পেটে প্রচন্ড ক্ষুধা। ওজন টা দিন দিন বেড়েই চলেছে। কিন্তু যতোই ওয়েট নিয়ন্ত্রন করতে চাই ততই যেন ক্ষুধা বেড়ে যায়। তার ফ্রিজ এবং রান্না ঘর তন্ন তন্ন করে খুঁজে শুধু শুকনো মুড়ি আর কাঁচা মরিচ পাওয়া গেল। তারপর একখানা কাঁচা মরিচ আর মুড়ির টিন নিয়ে বসে গেলাম।

আমার মুড়ি খাওয়া দেখে সজীব ভাইয়ের রাগটা যেন আরও কিছুটা বেড়ে গেল। রাগে গজ গজ করতে করতে গালি দিতে শুরু করলেন। তিনি গালি দেওয়াতে সামান্য বিরতি দিলে বললাম, ‘ভাই বিরিয়ানী খাবো।’ এ কথার সাথে সাথে বিরতি ভঙ্গ করে আবারও গালি দিতে শুরু করলেন।

এভাবে কিছুক্ষণ চলার পর বাসাটাতে রাজ্যের নীরবতা নেমে এল। নীরবতার প্রতি আমার এক ধরণের প্রেম থাকলেও সেদিন প্রেমটা যেন কাজ করছিল না। তারপর তার বাসা থেকে চলে আসার জন্য পা বাড়ালাম।

তখন সজীব ভাই বললেন, ‘যাচ্ছিস কোথায়? আজ থেকে যা না! মনটা খারাপ লাগছে। তুই থাকলে ভালো লাগবে।’
আমি বললাম, ‘আজ তোমার বাসাটার-ই মন খারাপ। এই বাসায় এখন যে থাকবে তারই মন খারাপ হবে। তার চেয়ে আমি একটা বিশেষ জায়গায় যাচ্ছি। এখানে বসে থেকে মন খারাপ করার কোনো মানে হয় না।’

সজীব ভাই গায়ে টি-শার্ট জড়াতে জড়াতে বললেন, ‘কোথায় যাচ্ছিস, চল আমিও যাই।’

রিক্সায় উঠে বললাম,‘ঢাকা মেডিকেল চলেন।’
সজীব ভাই জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকালেন এবং বললেন, ‘ঘটনা কী?’
ঘটনা কিছুই না। ভয় পেতে ইচ্ছে করছে, তাই মর্গে যাবো। ঐ দিকটার পরিবেশটাই কেমন ভুতুড়ে। একদিন দুপুর বেলা গিয়েছিলাম, কী মনে হয়েছিল জানো?
সজীব ভাই চোখ বড় বড় করে বললেন, ‘ কী রে...?’
মনে হচ্ছিল আমি যেন জ্বীনের নগরী কোহেকাফে চলে এসেছি। সে কথা ভাবলে আমার শরীরটা এখনও শিওরে ওঠে!

রিক্সা থেকে নামার পর আমরা মর্গের দিকে কিছুটা পথ এগুতে থাকি। তারপর একসময় থেমে যাই এবং সজীব ভাইকে বলি, ‘ভাই, এতো রাতে ওদিকে যাওয়া ঠিক হবে না। অন্ধকারে আবার কিনা কি বের হয়! তোমার ইচ্ছে করলে যাও, আমি যাবো না। আমার কেমন যেন ভয় করছে।’ এ কথা বলে পিছন ফিরে হাটা শুরু করলাম।

কিছুদূর যাওয়ার পর সজীব ভাইও আমার সাথে হাটাহাটিতে যোগ দিলেন। তাকে বললাম, ‘জগন্নাথ হলের লুচি আর ডালটা ভালোই লাগে, চলেন খাই!’

লুচি খেতে খেতে সজীব ভাই বললেন, ‘তুই ইচ্ছে করেই এসব করলি, তাই না?’
না বুঝার ভান করে বললাম, ‘কোন সব?’
এই যে মর্গে নিয়ে গেলি তারপর মাঝ রাস্তা থেকে চলে আসলি। এসব কি আমাকে বিভ্রান্ত করার জন্য...? স্কলারশীপ না পাওয়ার কষ্ট ভুলানোর জন্য...?

আমি খাওয়া শেষ করে বললাম, ‘বিলটা দিয়ে আসো। আমি একটু হাটি।’

রিক্সায় করে ফেরার সময় সজীব ভাইকে প্রশ্ন করলাম, ‘সত্যি করে বলতো, তোমার মনে কী এখনো স্কলারশীপ না পাওয়ার সেই কষ্টটা ঘুরপাক খাচ্ছে?’
তিনি হাসি হাসি মুখ করে বললেন, ‘না রে! মনের ভিতরে কোহেকাফ নগরী আর মর্গের রহস্য ঘুরপাক খাচ্ছে! হা...হা...হা...’

তার কথা শুনে আমি হাসলাম, খুব হাসলাম। তাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে চলে আসার সময় সজীব ভাই বললেন, ‘শোন জিবরান, আমি যদি মেয়ে হতাম তাহলে অবশ্যই তোর প্রেমে পড়তাম। কিন্তু তোকে বিবাহ করতাম না। কারণ, তোদের মত ছেলেদের সাথে প্রেম করতে বিরাট মজা। কিন্তু সংসার করতে বিরাট প্যারা...’


পঠিত : ১৯৬৮ বার

মন্তব্য: ০