Alapon

জেনারেল এরশাদের অন্তর্ধান এবং জাতীয় পার্টির পরিণতি...

আমার জন্মস্থান ও বেড়ে ওঠা উত্তরবঙ্গের রাজধানীখ্যাত রংপুরে। জন্ম এবং বেড়ে ওঠার সুবাধে, সেইসাথে জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এই অঞ্জলের মানুষরা তুলনামূলক সরল। সোজা বাংলায় অনেক বেশি বোকা। আমার চোখে গোটা বাঙালি জাতিটাই বোকা। তাদের মিষ্টি কথায় খুব সহজে ভুলিয়ে রাখা যায়।। সেই ভুলে যাওয়ার প্রবণতার দিক দিয়ে রংপুরের মানুষরা আরও কিছুটা এগিয়ে রয়েছে।

যাইহোক, স্বাধীনতার পর থেকে আজ অবধি এই এলাকাটি অবকাঠামোগত উন্নয়নের দিক দিয়ে পিছিয়ে রয়েছে। জেনারেল জিয়ার হত্যাকান্ডের পর জেনারেল এরশাদ যখন দেশের ক্ষমতা দখল করল, তখন গোটা দেশের মানুষ শংকিত হলেও রংপুরের মানুষরা কিছুটা হলেও আশাবাদি হল। তারা ভাবল, এইবার আমাদের এলাকার সন্তান দেশের ক্ষমতা পেয়েছে। নিশ্চয়ই মঙ্গা পিড়িত রংপুরকে সচ্ছল রংপুর বানাতে এরশাদ সাহেব কোনো কার্পন্য করবেন না।

কিন্তু সাধারণ জনতার ‘আশা’ আজীবন দুরাশাই হয়। এরশাদ সাহেব রংপুরের মানুষের আশান্বরূপ তেমন কিছুই করলেন না। জনতা ভেবেছিল, এরশাদ সাহেব হয়ত শতবর্ষী কারমাইকেল কলেজকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করবেন। রংপুরের জনগন আর কিছু পাক না পাক, এরশাদ সাহেবের কাছে একটি বিশ্ববিদ্যালয় চেয়েছিল। রংপুরের মানুষ কারমাইকেল কলেজকে কারমাইকেল বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে দেখতে চেয়েছিল। কিন্তু রংপুরের মানুষের সেই স্বপ্ন আজ দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। এরশাদ সাহেব তো করেন-ই সেই সাথে কোনো সরকারই কারমাইকেলকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করেনি।

কিন্তু তারপরও পিছিয়ে পড়া রংপুরের যতটুকু অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে, তার সবটাই হয়েছে জেনারেল এরশাদের হাত দিয়ে।

এরশাদ সাহেব ক্ষমতা ছাড়ার আগ দিয়ে গোটা দেশের চক্ষুশূলে পরিণত হলেন। রংপুরের মানুষরা পিছিয়ে রইল না। তার নিজ এলাকা রংপুরেও তার বিরুদ্ধে মিছিল হল, কূশপত্তলিকা দাহ করা হল। অবশেষে, প্রেসিডেন্ট এরশাদ ক্ষমতা ছেড়ে কারাগারে আবাস গড়লেন।

তিনি বেশ কিছুদিন কারাগারে বন্দি থাকার পর, রংপুরের মানুষ তার প্রতি দরদ অনুভব করতে লাগল। তারা বন্দিত্ব তাকে রংপুরের মানুষের নেতা বানিয়ে দিল। তখন রংপুরের মানুষ আবেগের চোটে বলত, ‘হামার এরশাদ’!

তারপর রংপুরে আস্তে আস্তে এরশাদের মুক্তির জন্য আন্দোলন হতে থাকে। সেই আন্দোলনের জন্য না হলেও, পরবর্তি সময়ে এরশাদ সাহেব জেল থেকে মুক্তি পান। তার এই জেলে বন্দি থাকাই তাকে রাজনৈতিক নেতা বানিয়ে দেয়। রংপুরের মানুষের রাজনৈতিক নেতা। রংপুরের আপামর সাধারণ জনতা, রাজনীতি বলতে শুধু এরশাদের জাতীয়পার্টি আর মার্কা হিসেবে লাঙল চিনতো। যার কারণে রংপুরে এরশাদের জাতীয় পার্টির একক দূর্গ গড়ে উঠেছিল।

কিন্তু সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে যার জুড়ি মেলা ভার সেই এরশাদ নিজের দোষে রংপুরের মানুষের ভালোবাসা হারাতে শুরু করলেন। ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহিন নির্বাচনে এরশাদ যখন আওয়ামীলীগকে সমর্থন দিলো, তখন রংপুরে তার দলের অবস্থা আইসিইউতে অবস্থানকারী রোগীর মত হল। তারপর এরশাদ নিজেই যখন শেখ হাসিনার বিশেষ দূত হল এবং তার দলের নেতারা একটি অবৈধ সরকারের অংশীদার হল তখনই মূলত রংপুরে জাতীয় পার্টির কফিনে শেষ পেরেক পড়েছে।

দেশের রাজনীতির সার্বিক অবস্থার জন্য এরশাদ যেমন অনেকটা দ্বায়ি, তেমনি তার নিজের দলের এই মৃত্যু দশার জন্য এরশাদ নিজেই দ্বায়ি। এরশাদ তার পড়ন্ত যৌবনে ‘জাতীয় পার্টি’কে রংপুরের মানুষের কাছে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন। তিনি আজ মৃত্যুশয্যায়। সেই সাথে তার দলটারও মৃত্যুশয্যা অবস্থা বলা যায়। খুউব সম্ভবত পৃথিবীর বুক থেকে জেনারেল এরশাদের অন্তর্ধানের সাথে সাথে, দেশের রাজনীতির ময়দান থেকে তার রাজনৈতিক দল ‘জাতীয় পার্টিরও স্থায়ী অন্তর্ধান ঘটবে।

ব্যক্তি নির্ভর রাজনৈতিক দলগুলোর শেষ পরিণতিটা এমনই হয় হয়ত...

পঠিত : ৩৩৯৮ বার

মন্তব্য: ০