Alapon

ইফা ডিজি সামীম আফজালের দুর্নীতির হালচাল

গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ইফার ডিজি পদে বহাল থেকে সামীম আফজাল অনেকটা মহিরূহে পরিণত হয়েছিলেন। তার অগাধ ক্ষমতা ও লাগামহীন স্বেচ্ছাচারিতার কাছে সবাই হার মানছিল। কিন্তু সম্প্রতি তিনি বুঝে ফেলেছেন পরিস্থিতি ভালো নয়, তাই সম্ভবতঃ নিজের অপকর্ম চাপা দিতে গিয়েছিলেন আগারগাঁওয়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কার্যালয়ে। সরকারি ছুটির দিন নিজ কার্যালয়ে যান, গিয়ে সংশ্লিষ্ট ও ঘনিষ্ঠজনদের জানিয়েছিলেন, তিনি পদত্যাগ করার জন্য এসেছেন। কিন্তু এক পর্যায়ে নিজ দফতর থেকে বেশ কিছু ফাইল তার গাড়িতে ওঠানো হয়। খবর পেয়ে ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তার দফতর ঘিরে রাখেন। পরে ইফা বোর্ড অব গভর্নরসের সদস্য মিজবাহুর রহমান চৌধুরীসহ তিনজন কর্মকর্তা গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। সরিয়ে ফেলার জন্য সামীম আফজালের গাড়িতে ওঠানো ফাইল ফেরত এনে লকারে রাখা হয়। বলা হয়, ৪০টির মতো ফাইল সরানোর চেষ্টা করেছিলেন সামীম আফজাল।

ওই রাতেই মিজবাহুর রহমান চৌধুরী পদত্যাগ করার জন্য সামীম আফজালকে পরামর্শ দেন। ইফা কার্যালয়ে বসে পদত্যাগের ব্যাপারে সম্মতি দিলেও পরে ভোল পাল্টানোর চেষ্টা করেন, তিনি চুক্তিভিত্তিক কর্মকর্তা তাই পদত্যাগের কিছু নেই, সরকার চুক্তি বাতিল করলেই তিনি চলে যাবেন এমন অবস্থান নেন। অনেকেরই ধারণা, পদত্যাগ করলে তিনি চুক্তির সুবিধাগুলো পেতেন না তাই দাবার চাল চেলেছিলেন যেন সরকারই চুক্তি বাতিল করে। এতে তাকে চুক্তির ভেতরে যেসব আর্থিক সুযোগ-সুবিধা দেয়ার কথা রয়েছে তা দেয়ার ক্ষেত্রে একধরণের বাধ্যবাধকতায় পড়তে পারে সরকার। সামীম আফজালের ব্যক্তিগত কর্মকর্তাও নিকটজনদের জানিয়েছেন, তার পদত্যাগ করার দরকার কী! তিনি মন্ত্রীও নন এমপিও নন যে পদত্যাগ করবেন। সরকার চুক্তি বাতিল করলেই তো চলে। 

সামীম আফজাল ১৯৮৩ ব্যাচের বিসিএস এর একজন বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা। সে সময় জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন ছিল না, তাই তিনি বিসিএস এর মাধ্যমে সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করেন এবং চাকরি পান বিচার বিভাগ অর্থাৎ জজ হিসেবে। তার নিজের সরকারি অর্থাৎ বিচার বিভাগীয় চাকরির বয়সসীমা শেষ হয়েছে। তিনি সেখান থেকে অবসরে গেলেও ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক পদে আছেন চুক্তির জোরে। তবে পদত্যাগের দাবি জোরালো হলে দৌঁড়ঝাপ শুরু করেন, ইফার বোর্ড অব গভর্নরস, বিভিন্ন প্রকল্পের পরিচালকসহ ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তাদের কাছে নিজ পদে থেকে যাওয়ার আগ্রহের কথা জানান এবং সেজন্য তাদের সহায়তাও চান। তবে কেউই তার দিকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেননি, উপরন্তু পরিচালকরা এক জরুরি বৈঠক করে সামীম আফজালকে সসম্মানে বিদায় নেয়ার পরামর্শ দেন। সামীম আফজালের অনুগত, বিশ^স্ত ও সুবিধাভোগী পরিচালকরাও এই বৈঠকে যোগ দেন, এমনকি এ সংক্রান্ত একটি লিখিত প্রস্তাবনায় তারা স্বাক্ষরও করেন। এর কারণও আছে। মহাপরিচালক সামীম আফজাল চুক্তিভিত্তিক কর্মকর্তা, অন্যদিকে এরা ইসলামিক ফাউন্ডেশন তথা ধর্ম মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী চাকরিজীবী। সামীম আফজাল বিদায় নিলেও তাদের এই প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে হবে, সামীম আফজালের পক্ষে অবস্থান নিয়ে কেউই নিজেদের কালো তালিকাভ’ক্ত করতে চাননা কিংবা সহকর্মীদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করতেও চান না, তাই তারা কেউই সামীম আফজালের ডুবন্ত তরীতে বসে থাকতে রাজি নন। তারা নিরাপদে নেমে গেছেন এবং রং বদলাতে শুরু করেছেন, বলা যায় সামীম আফজাল এখন তার ডুবন্ত তরীতে একা। তবে এমন পরিস্থিতিতেও সরকারের উচ্চ পর্যায়ের হস্তক্ষেপে সামীম আফজাল আপাতত স্বপদেই বহাল থাকছেন। সর্বশেষ গত ২২ জুন শনিবার অনুষ্ঠিত ইফার বোর্ড অব গভর্নরসের সভার পর ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ মো. আবদুল্লাহ এমনটিই জানিয়েছেন। কিন্তু সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এতো কিছুর পরও সামীম আফজালকে এ পদে বহাল রাখা হলে সংস্থাটির দ্রুতই অবনতি ঘটবে এবং পরে সেই পরিস্থিতি সামাল দেয়া মুশকিল হয়ে পড়বে।

ইসলামী ফাউন্ডেশনের এমন কোন কাজ, কর্মসূচি বা প্রকল্প নেই যাতে দুর্নীতির থাবা বসাননি সামীম আফজাল। সামীম আফজাল শুধু দুর্নীতির জন্যই নয় বিতর্কিত তার আচার-আচরণের জন্যও, এমনকি খোদ সরকারি দলের অঙ্গসংগঠন থেকেও তার অপসারণের দাবি উঠেছিল। কিন্তু সবকিছুকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সামীম আফজাল নিজের পদে বহাল থেকে গেছেন।

সরকারি তহবিল তছরুপ
সামীম মোহাম্মদ আফজাল শুধু দুর্নীতি করেন না, তিনি দুর্নীতির জাল বিছিয়ে রেখেছেন। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের যে কোন কর্মসূচি বা প্রকল্প মানেই তার পকেট ভরার ব্যবস্থা। তার বিরুদ্ধে একটি বড় অভিযোগ, সরকারি তহবিল তছরুপ করার। সরকারি যে কোন প্রকল্পের অব্যয়িত অর্থ সরকারি কোষাগারে ফেরত দেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সামীম আফজাল এসব বাধ্যবাধকতার ধার ধারেন না। মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রমের অব্যয়িত অর্থ ফেরত দিতে প্রতিটি জেলায় চিঠি দেয়া হয় ইসলামিক ফাউন্ডেশনের অর্থ শাখা থেকে। ওই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয় থেকে ১ কোটি ৭০ লাখ টাকা, চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয় থেকে ১ কোটি ১১ লাখ টাকা ফেরত আসে। অন্যান্য বিভাগ ও জেলা কার্যালয় থেকেও টাকা ফেরত আসে। সামীম আফজাল এই টাকা সরকারি কোষাগারে ফেরত না দিয়ে সুকৌশলে ব্যক্তিগত একাউন্টে সরিয়ে নেন। এ ঘটনা ২০১৫ সালের, তবে সামীম আফজাল প্রতি অর্থ বছরেই এভাবে সরকারি অর্থ আত্মাসাৎ করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। রাষ্ট্রীয় অর্থ আত্মাসাতের এমন ধারাবাহিক নজির সম্ভবতঃ সরকারের আর কোন মন্ত্রণালয় বা দফতরেরই নেই। এক বছরে দু’টি বিভাগ থেকেই যদি প্রায় তিন কোটি টাকা ফেরত আসে, এভাবে দেশের সবগুলো বিভাগের টাকা ফেরৎ আসলে তার পরিমাণ কত হবে? আর যদি ১০ বছর বা তারও বেশি সময় ধরে কম-বেশি এই হারে তিনি অর্থ লোপাট করে থাকেন তাহলে তিনি সরকারের কত টাকা আত্মসাৎ করেছেন তা খতিয়ে দেখতে দুদকের বিশেষ টিম দরকার পড়বে এমনটাই মনে করেন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের অনেক কর্মকর্তা।

তবে সে সব কর্মকর্তাদের মুখে কিছু বলার সুযোগ নেই, কেন না সামীম আফজালের অবৈধ কাজের সুবিধাভোগীর সংখ্যাও নেহায়েৎ কম নয়, তার বিরুদ্ধে কোনো কথা বললে কোথায় বদলি হয়ে চলে যেতে হবে তাই বা কে জানে? তার মন যুগিয়ে না চললে চাকরিও হারাতে হতে পারে, সম্প্রতি এমন ঘটনা ঘটেছেও, অবশ্য সে বদলি সামীম আফজালের গলার কাটা হয়ে উঠতে পারে এমনটাও বলছেন অনেকে। 
নিয়োগে সামীম আফজালের তুঘলকি কারবার!

সরকারি কর্মকর্তা হলেও ইসলামিক ফাউন্ডেশনের অনেক কর্মকর্তাই এ প্রতিষ্ঠানে দায়িত্ব পালন করাকে ইসলামের খেদমত করার সুযোগ হিসেবেই দেখেন।। কিন্তু এদিক থেকে ব্যতিক্রম সামীম আফজাল। তিনি এ প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করছেন অর্থ লুটপাটের হাতিয়ার হিসেবে। নিয়োগ, পুণঃনিয়োগ, যাচাই-বাছাইকরণসহ সব পর্যায়গুলোকেই সামীম আফজাল কাজে লাগান নিজের পকেট ভারী করার জন্য।

তেমন কোন অভিযোগ না থাকলে মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রমে জড়িত জনবল বদল করা হয় না, এর কারণ হচ্ছে এই কার্যক্রম হচ্ছে সমাজসেবার মতো। একজন ব্যক্তি দীর্ঘদিন কাজ করে এই কার্যক্রমকে সমাজ ও মানুষের কাছে পরিচিত ও জনপ্রিয় করে তোলেন, দায়িত্ব পালনে ধারাবাহিকতা থাকলে যে উদ্দেশ্যে সরকার এ কর্মসূচি নিয়েছে তা বাস্তবায়ন করা অনেক সহজ হয়। সামীম আফজাল ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক হওয়ার পর একনেক বৈঠকে এ সংক্রান্ত নীতিমালায় পুনঃনিয়োগের ক্ষেত্রে যাচাই-বাছাইয়ের শর্ত জুড়ে দিয়ে তা পাশ করিয়ে আনেন। সামীম আফজাল এই যাচাই-বাছাইয়ের শর্তকে কাজে লাগিয়ে নিয়োগ ও ছাটাইয়ের ক্ষেত্রে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরি করেন। রাজনৈতিক রং লাগিয়ে অনেককে বাদ দেন এবং টাকার বিনিময়ে সেসব স্থানে নিয়োগ দেন। এ কাজ সামীম আফজাল করেন নিজের অতি বিশ্বস্ত ও কাছের লোকদের দিয়ে। বাদ দেয়ার ভয় দেখানো, নিয়োগ অব্যাহত রাখার লোভ দেখানো, ভিন্ন মতাবলম্বী কিংবা সরকারবিরোধী রাজনৈতিক পরিচয় দিয়ে হয়রানির হুমকি দিয়ে এ প্রকল্পের শত শত ব্যক্তিকে হয়রানি করেন তিনি। আবার এসবের কিছুই হবে না যদি সামীম আফজালের পকেটে কড়ি পড়ে। অভিযোগ থাকলেও তাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে নিয়োগ নিশ্চিত করেন সামীম আফজাল ও তার ঘনিষ্ঠজনেরা। নতুন নিয়োগের ক্ষেত্রে অনেক সময় নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের একমাত্র টাকা দেয়া ছাড়া আর কোন যোগ্যতাও থাকে না। শুধু তাই নয়, এক্ষেত্রে যিনি বেশি টাকা দিয়েছেন নিয়োগের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পেয়েছেন তিনিই।

ব্যক্তিগত কাজ করানো ও নিজের সেবার জন্যও সামীম আফজাল লোক নিয়োগ করেন সরকারি টাকায়, এসব নিয়োগে তিনি কোন নিয়ম নীতির ধার ধারেননি। এমনসব পদে প্রথমে সম্মানির ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়া হলেও পরে তাদের বেতন স্কেলে নিয়োগ চূড়ান্ত করা হয়। কেয়ারটেকার, ট্রেইনারের মতো পদগুলোতে নিয়োগের ক্ষেত্রে সামীম আফজাল শুধু দুর্নীতিই করেননি, স্বজনপ্রীতিও করেছেন। প্রয়োজনীয় যোগ্যতা না থাকলেও বায়তুল মোকাররম মসজিদের ইমাম পদে নিয়োগ দেয়া হয় তার এক ভাগিনাকে, ভাগ্নিকে নিয়োগ দেয়া হয় সহকারি পরিচালক পদে, পরে সুবিধাজনক জায়গায় বদলি করে তাকে দেয়া হয় আরো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। নিজের ছেলের গৃহশিক্ষককেও নিয়োগ দিয়েছেন ট্রেইনার পদে। জানা গেছে, নিজের নিকটাত্মীয় ও ঘনিষ্ঠজনদের নিয়োগ দিয়ে তিনি ইফা পরিচালনা ও কার্যক্রমের ক্ষেত্রে একটি চক্র বা বলয় তৈরি করে ফেলেছেন।

ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের অধীনে ১৫০জন কেয়ারটেকার নিয়োগ করা হয় ইফা মহাপরিচালকের আস্থাভাজন ব্যক্তিদের যোগসাজশে। প্রায় সবগুলো পদেই নিয়োগ হয়েছে অর্থের বিনিময়ে, শুধু টাকার দুর্নীতিই নয়, এক্ষত্রে নীতিমালাও মানা হয়নি।  জেলা পর্যায়ে এ ধরণের নিয়োগ কার্যক্রমে সভাপতি হওয়ার কথা জেলা প্রশাসক বা তার প্রতিনিধির। কিন্তু সামীম আফজাল কোন জেলা প্রশাসক বা তার প্রতিনিধিকে এ কাজে সম্পৃক্ত করেননি। নিজের বিশ্বস্ত একজন কর্মকর্তাকে দিয়ে এসব কাজ করিয়েছেন তিনি। টাকা-পয়সার বিষয়টি সামলেছেন বর্তমানে অবসরে থাকা ওই কর্মকর্তাই।

কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রতি বিরূপ মনোভাবাপন্ন একজন ডিজি
একজন সরকারি বেতনভূক্ত ব্যক্তি সবসময়ই আশা করেন তার চাকরি রাজস্বখাতে যাবে, চাকরিকালীন এবং চাকরি পরবর্তী সব ধরণের সুযোগ সুবিধা অর্থাৎ পেনশনসহ যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা পাবেন। এতো গেল সাধারণ চাকরিজীবীর প্রত্যাশার কথা, পক্ষান্তরে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা চান এবং সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন যাতে তাদের অধীনস্থ ব্যক্তিরা সরকারি সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত না হন। এদিক থেকে ব্যতিক্রম ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক সামীম আফজাল। মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রমের ১০০ জনবলকে রাজস্বখাতে স্থানান্তরে আদালতের নির্দেশনা ছিল, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোও এ ব্যাপারে অনুমোদন দেয়, তারপরও এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নেননি সামীম আফজাল, রাজস্বখাতে স্থানান্তরে নিয়োগে মাথাপিছু এক লাখ টাকা করে দাবি করা হয় তার পক্ষ থেকে। টাকার জন্য সামীম আফজাল আদালতের রায়, মন্ত্রণালয়গুলোর সম্মতি কোন কিছুরই তোয়াক্কা করেননি, তার অর্থলিপ্সার কাছে পরাস্ত হয় চাকরি স্থায়ী হওয়ার ব্যাপারে অনেক মানুষের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন। অথচ সে লোকগুলোর চাকরি স্থায়ী হলে শুধু তারাই লাভবান হতেন তাই নয়, নিশ্চিত মনে নিজ দায়িত্ব পালন করতে পারলে শিক্ষামূলক এই কার্যক্রম আরো বেশি ফলপ্রসূ হতো এবং সে ফলাফলটা দৃশ্যমানও হতো। নিয়োগ স্থায়ী না করে এই কার্যক্রমকে একটা দায়সারা প্রকল্পে পরিণত করার দিকে ঠেলে দেন সামীম আফজাল।

বিতর্কিত কর্মকাণ্ড
সামীম আফজাল শুধু দুর্নীতিগ্রস্থই নন বিতর্কিত অনেক কর্মকা- করে তিনি ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করেছেন। ইমাম প্রশিক্ষণের এক অনুষ্ঠানে তিনি নারীদের নাচের পর্ব রেখেছিলেন বলে অভিযোগ ওঠে, সে সময় এ ঘটনায় সারাদেশে তোলপাড় হলেও সামীম আফজালের টিকিটিও ছোঁয়া যায়নি। 

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বিভিন্ন প্রকাশনার জন্য লেখক সম্মানি নিয়েও তিনি অনেক নয়-ছয় করেছেন। বইকেনা নিয়েও তার বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই। পছন্দের প্রকাশক আর মুখচেনা ব্যক্তিদের কাছ থেকেই তিনি বই কিনেছেন। অথচ অনেক সৃজনশীল প্রকাশক চান ইসলামিক ফাউন্ডেশনে তাদের বইগুলো যেন যায়। এটা শুধু ব্যবসায়িক কারণেই নয়, তারা এমনটা আশা করেন- কেন না তাদের অনেকেই ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উপযোগী বইও প্রকাশ করেন। 

এ বছর চাঁদ দেখা নিয়ে যে বিতর্ক তার দায় পুরোপুরি চাঁদ দেখা কমিটির, আরো নির্দিষ্ট করে বললে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের, আর ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী অর্থাৎ মহাপরিচালক হিসেবে এ দায়িত্ব পড়ে সামীম আফজালের উপর। ঈদ নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হওয়ায় ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়েছে সরকারের। এ নিয়ে সংসদে আলোচনাও হয়েছে, কিন্তু ইফা মহাপরিচালক হিসেবে এই বিশৃঙ্খল ও অনভিপ্রেত পরিস্থিতি তৈরির দায়টা পুরোপুরি ধর্মপ্রতিমন্ত্রীর দিকে ঠেলে দিয়েছেন সামীম আফজাল। তবে অনেকেই মনে করেন, চাঁদ দেখা নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টির জন্য সামীম আফজালকে সংসদীয় কমিটিতে তলব করা উচিত। 

সামীম আফজালের বিরুদ্ধে একাট্টা সবাই
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক সামীম আফজালের বিরুদ্ধে একাট্টা হয়ে আন্দোলনে নেমেছেন ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। ইতিমধ্যে তারা অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন, দিতে পারেন কর্মবিরতির মতো কর্মসূচিও। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তারা বলছেন, তারা সামীম আফজালকে কোন অবস্থাতেই ইফায় ঢুকতে দেবেন না, ঢুকতে হলে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের লাশের ওপর দিয়ে ঢুকতে হবে। শুধু রাজধানীতেই নয়, সামীম আফজালের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হয়েছে চট্টগ্রামেও। বিভিন্নস্থানে বিক্ষোভে ইফা কর্মকর্তারা বলছেন, সরকার যেখানে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নিয়েছে সেখানে সামীম আফজালের মতো একজন শীর্ষ দুর্নীতিবাজ ও স্বৈরাচারী মনোভাবের মানুষ কি করে ইফার ডিজি পদে থাকেন? তারা চান, সামীম আফজালের বিষয়টি নিয়ে আর পানি ঘোলা না করে তাকে অবিলম্বে সসম্মানে বিদায় দেয়া হোক। ইফা সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য হচ্ছে, একজন সাবেক জজ হিসেবে সামীম আফজালেরই উচিত সম্মানের যেটুকু অবশিষ্ট আছে তা নিয়ে বিদায় হওয়া। 

এবারও কি পার পেয়ে যাবেন সামীম মোহাম্মদ আফজাল?
এক নাগাড়ে ১০ বছর দায়িত্ব পালনের সুযোগে সামীম মোহাম্মদ আফজাল ক্ষমতার অপব্যবহার করে ইসলামিক ফাউন্ডেশনকে কার্যত ‘ওয়ান ম্যান শো’ বানিয়ে রেখেছেন, তার ইচ্ছা-অনিচ্ছাই ফাউন্ডেশনে সবচে’ বড় আইন। তবে ক্ষমতার অপব্যবহার করে সম্ভবত: এবার ভালমতোই ফেঁসে যাচ্ছেন সামীম আফজাল। জানা গেছে, তাকে ইসলামী ফাউন্ডেশন থেকে সরাতে এবার শক্তভাবেই এগোচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। তার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ কেন বাতিল করা হবে না তা জানতে চেয়ে কারণ দর্শানোর নোটিসও দেয়া হয়েছে ইতিমধ্যে। 

জানা গেছে, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মসজিদ মার্কেট বিভাগের পরিচালক মহিউদ্দিন মজুমদারকে সাময়িক বরখাস্ত করেন মহাপরিচালক সামীম আফজাল। নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সুবিধার জন্য বায়তুল মোকাররম মসজিদের একটি পিলার সরিয়ে নেন সোহরাব হোসেন নামের একজন ব্যবসায়ী। মসজিদের পিলার সরানোর বিষয়টি তিনি গোপন রেখেছিলেন। তবে জাতীয় মসজিদের নিরাপত্তা আর মসজিদ ভবনের ঝুঁকির কথা মাথায় রেখে বিষয়টি নিয়ে ধীরে ধীরে আলোচনায় সরব হন অন্য ব্যবসায়ীরা। মসজিদের মার্কেট বিভাগের পরিচালক মহিউদ্দিন মজুমদার এ ঘটনায় অভিযুক্তের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেন, তিনি ওই ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ইফা মহাপরিচালকের কাছে নথি পাঠান। সামীম আফজাল ওই ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা তো নেনইনি উপরন্তু ঠুনকো কারণ দেখিয়ে মহিউদ্দিন মজুমদারকে সাময়িক বরখাস্ত করেন। মহিউদ্দিন মজুমদার ওই আদেশ পর্যালোচনার জন্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন। পর্যালোচনা করে মন্ত্রণালয় দেখতে পায়, মহিউদ্দিন মজুমদারকে বরখাস্তের ক্ষেত্রে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি, এমনকি একজন পরিচালককে মহাপরিচালক সরাসরি অব্যাহতি দিতে পারেন কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে ধর্ম মন্ত্রণালয় মহিউদ্দিন মজুমদারকে তার পদে বহাল রাখে।

সবমিলিয়ে ধর্ম মন্ত্রণালয় এ ঘটনাসহ আগের আরো কিছু অভিযোগের কারণে ডিজি সামীম আফজালের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়ে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য কারণ দর্শানোর নোটিস দেয়। তবে বরাবরের মতোই এবারও নিজেকে বাঁচাতে তৎপরতা শুরু করেছেন সামীম আফজাল। সবসময়ই নিজেকে ক্ষমতার বলয়ের আশীর্বাদপুষ্ট বলে দাবি করেন তিনি। ধর্মমন্ত্রণালয়ে নিজের অবস্থান নাজুক বুঝতে পেরে সামীম আফজাল এবার আরো উঁচু জায়গায় যোগাযোগ করছেন বলে জানা গেছে। একজন চুক্তিভিত্তিক ও বিতর্কিত কর্মকর্তা হয়েও সামীম আফজালের এ দৌড়ঝাপ কি ধর্মমন্ত্রণালয়কে এর কঠোর অবস্থান থেকে সরাতে পারবে? যদিও গত ২২ জুন অনুষ্ঠিত ইফা বোর্ড অব গভর্নর্ন্সের সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সামীম আফজাল আপাতত স্বপদেই বহাল থাকছেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কি দাঁড়ায় সেটাই এখন দেখার বিষয়।

পঠিত : ১৮৫৯ বার

মন্তব্য: ০