Alapon

নবাব সিরাজ কেন যুদ্ধে হেরে গেলেন?

  1. ভারতীয় উপমহাদেশের পরাধীনতা ও পলাশীর ট্র্যাজেডি পরস্পর অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এই ট্র্যাজেডির মধ্য দিয়ে সমগ্র ভারতবর্ষে ব্রিটিশের শাসনের পথ উন্মুক্ত হয়। ১৬০০ সালের ৩১ ডিসেম্বর ব্রিটেনের রানী প্রথম এলিজাবেথ ভারতবর্ষে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে ব্যবসায় করার জন্য অনুমতি প্রদান করেন। কিন্তু ক্রমান্বয়ে এ কোম্পানি সমগ্র ভারতবর্ষে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার শুরু করে। ১৬৫৮ সালে কোম্পানির প্রতিনিধি জেমস হার্ট ঢাকায় আগমন করেছিলেন। কেন্দ্রীয় মোগল শক্তি দুর্বল হয়ে পড়েছিল তখন। মহারাষ্ট্র, হায়দরাবাদ, পাঞ্জাব, রোহিলাখণ্ড, বাংলা প্রভৃতি অঞ্চলে আঞ্চলিক শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। এসব শক্তির সাথে আগে থেকেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রতিনিধিদের বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে সঙ্ঘাত-সংঘর্ষ হয়েছিল। হায়দরাবাদের অধিপতি হায়দার আলী ব্যতীত অন্য কোনো আঞ্চলিক শক্তি যুদ্ধে ব্রিটিশদের পরাজিত করতে পারেননি। হায়দার আলী অকস্মাৎ মারা গেলে ব্রিটিশ সেনারা প্রবল শত্রুর হাত থেকে মুক্তি পায়। বাংলার নবাব আলীবর্দি খান দূরদর্শিতা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার মাধ্যমে ব্রিটিশ শক্তির অবাঞ্ছিত প্রভাব বিস্তার প্রতিহত করতে সমর্থ হয়েছিলেন। আলীবর্দির মৃত্যুর পর অপরিণত বয়সে অপরিপক্ব রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা নিয়ে সিরাজউদ্দৌলা বাংলার মসনদে আসীন হন। তার চার দিকে ষড়যন্ত্রের জাল ক্রমাগত প্রসার লাভ করে। বাংলা বিহার ও উড়িষ্যার নবাব আলীবর্দির পুত্রসন্তান ছিল না। তিনি দৌহিত সিরাজউদ্দৌলাকে অত্যন্ত ¯েœহ করতেন। তিনি সিরাজকে রাজকার্য পরিচালনায় সব সময় পাশে রাখতেন। তিনি সিরাজউদ্দৌলাকে তার উত্তরাধিকারী হিসেবে মনোনীত করে যান। আলীবর্দির অন্যতম নিকটাত্মীয় ও প্রধান সেনাপতি মীর জাফর আলী খানসহ অনেক অমাত্য এটা মেনে নিতে পারেননি। মীর জাফর আলী, জগৎশেঠ, উমিচাঁদ, ইয়ার লতিফসহ প্রভাবশালী রাজন্যবর্গ ও ধনকুবেররা ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠেন।

  2. নবাব আলীবর্দির জীবদ্দশাতেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে বাংলার শাসকের সম্পর্কের অবনতি ঘটেছিল। তিনি মৃত্যুর আগে কোম্পানির বিরুদ্ধে চূড়ান্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেননি। তবে তিনি সিরাজউদ্দৌলাকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দুরভিসন্ধি সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়ে যান। নতুন নবাব ক্ষমতায় আসার সাথে সাথে কোম্পানি তার বিরোধিতায় অবতীর্ণ হয়। নবাবের নির্দেশ অমান্য করে তারা কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ নির্মাণ শুরু করে দেয়। নবাবের কর্মচারীদের নিকট বাণিজ্য কর প্রদান করতে তারা অস্বীকার করে। তদুপরি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ব্যবসায় একচেটিয়া মুনাফা করতে থাকে। প্রতিক্রিয়ায় নবাব এক ফরমানের মাধ্যমে দেশীয় ব্যবসায়ীদের বাণিজ্য কর মওকুফ করে দেন। ফলে ইংরেজ কোম্পানির সাথে নবাবের সরাসরি সঙ্ঘাত শুরু হয়। 

  3. কোম্পানি ঔদ্ধত্যের সীমা অতিক্রম করলে নবাব তার সেনাবাহিনী নিয়ে কলকাতা অভিমুখে রওনা হন। সম্মুখযুদ্ধে তিনি কোম্পানির সৈন্যদের পরাজিত করে ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ দখল করে নেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাহিনী নৌযুদ্ধে পারদর্শী ছিল। কোম্পানির সৈন্যরা ফোর্ট উইলিয়াম থেকে সরে গিয়ে যুদ্ধজাহাজে দূরে অবস্থান করতে থাকে। অপর দিকে, নবাবের নৌশক্তি ছিল দুর্বল। সে কারণে নবাবের বাহিনী কোম্পানির সৈন্যবাহিনীর পশ্চাৎদ্ধাবন করতে পারেনি। রাতের আঁধারে কোম্পানির সেনাবাহিনী নবাব বাহিনীর ওপর পাল্টা হামলা করে ক্ষয়ক্ষতি সাধন করে। ‘আলীপুর সন্ধি’র মাধ্যমে উভয় পক্ষ আপাতত যুদ্ধ বন্ধ করতে সম্মত হয়। অপর দিকে, ভারতবর্ষে বাণিজ্যিক কারণে প্রভুত্ব বিস্তার করা নিয়ে ব্রিটিশদের সাথে ফরাসিদের বিরোধ ছিল। ফরাসিরা ব্রিটিশদের সাথে যুদ্ধ করে পরাজিত হয়েছিল। সে কারণে ফরাসিরা নবাব সিরাজউদ্দৌলার সাথে সখ্য গড়ে তোলে। নবাব ফরাসিদের মাধ্যমে তার সেনাবাহিনীকে প্রশিক্ষিত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সময়ের অভাবে তা সম্ভব হয়নি।

  4. পলাশীর যুদ্ধ ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে। এ যুদ্ধের মধ্য দিয়েই বাংলা তথা ভারতের স্বাধীনতা সূর্যের অস্ত গমন শুরু হয়ে ব্রিটিশ শাসন কায়েমের পথ প্রশস্ত হয়েছিল। পলাশীর যুদ্ধ আসলে যুদ্ধের নামে প্রহসন। একপক্ষে নবাবের ৫০ হাজার সেনাবাহিনী এবং অপরপক্ষে ব্রিটিশের তিন হাজার সেনাবাহিনী নদীয়া জেলার পলাশীর প্রান্তরে দৃশ্যত যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল। এটা ছিল এক অসম যুদ্ধ। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধের আগে প্রচণ্ড বর্ষণে নবাবের গোলাবারুদের স্তূপ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ব্রিটিশ বাহিনী আম্রকাননে অবস্থান নেয়ায় বর্ষায় তাদের গোলাবারুদ কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যুদ্ধের শুরুতেই নবাব বাহিনীর প্রবল আক্রমণে ব্রিটিশ বাহিনী কৌশলগতভাবে আম্রকাননে আশ্রয় নিয়েছিল। ব্রিটিশ গোলন্দাজ বাহিনীর আক্রমণে নবাব পক্ষীয় সেনাপতি মীর মদন ও মোহনলাল মৃত্যুবরণ করেন। এতে নবাব বাহিনীর যুদ্ধের গতি শিথিল হয়ে পড়ে। 

  5. প্রধান সেনাপতি মীর জাফর আলী খানের যুদ্ধক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয়তার কারণে তার বেশির ভাগ সেনা যুদ্ধে অংশ নেয়নি। ফলে যুদ্ধক্ষেত্রে স্থবিরতা সৃষ্টি হয়। নবাব সিরাজউদ্দৌলা স্বয়ং যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত ছিলেন। তিনি ছিলে সাহসী যোদ্ধা। তবে রণকৌশলে ছিলেন অপরিপক্ব। যুদ্ধের চরম মুহূর্তে তিনি প্রধান সেনাপতি মীর জাফর আলী খানকে ডেকে পাঠান এবং তার নিকট যুদ্ধের বিষয়ে পরামর্শ চান। প্রধান সেনাপতি নবাবকে যুদ্ধ বন্ধ করতে পরামর্শ দেন। সরল মনে নবাব সেনাপতির পরামর্শ মেনে নেয়া ছিল চরম অপরিণামদর্শিতা। ইচ্ছা করলে নবাব প্রধান সেনাপতিকে বরখাস্ত বা তাকে বন্দী করতে পারতেন অথবা নিজে সেনাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারতেন। তিনি এর কোনোটাই না করে প্রধান সেনাপতির পরামর্শ মেনে যুদ্ধবন্ধ করার নির্দেশ প্রদান করেন। গোলাম হোসেন রচিত, বিখ্যাত ‘সিয়ার-উল-মুতাখেরিন’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, যুদ্ধক্ষেত্রে সেনাপতি মীর মদনের মৃত্যুর পরও সেনাপতি মোহনলালের একক প্রচেষ্টায় যুদ্ধের গতি নবাবের অনুকূলেই ছিল। অথচ নবাব প্রধান সেনাপতির সর্বনাশা পরামর্শে সৈন্যবাহিনীকে যুদ্ধ না করার নির্দেশ প্রদান করেন। ফলে ব্রিটিশ বাহিনী প্রবল বেগে বিশৃঙ্খল নবাব বাহিনীকে আক্রমণ করে পরাজিত করে। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন ছিল নবাবের চূড়ান্ত আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। তিনি জানতেন, রাজধানীতে তার কোনো রিজার্ভ সৈন্য নেই। তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে সাহসিকতার সাথে নেতৃত্ব দিলে যুদ্ধের গতি পরিবর্তন হতে পারত অথবা যুদ্ধরত অবস্থায় মৃত্যু বরণ করলে তার সে মৃত্যু হতো টিপু সুলতানের মতো মহৎ জীবনদানের নজির।

  6. নবাব সিরাজউদ্দৌলা রাজধানী মুর্শিদাবাদে উপস্থিত হয়ে বিক্ষিপ্ত সৈন্যবাহিনীকে সংগঠিত করার চেষ্টা করেন। তবে তার সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। জানা যায়, তিনি নৌকাযোগে ফরাসি নৌবাহিনীর সহায়তা লাভের জন্য পলায়ন করছিলেন। পথিমধ্যে রাজমহলে শত্রুহস্তে বন্দী হন। তাকে বন্দী করে মুর্শিদাবাদে এনে নতুন নবাব মীর জাফরের দরবারে উপস্থিত করা হলে মীর জাফর সিরাজের ‘বিচারের ভার’ নিজের পুত্র মিরনের হস্তে অর্পণ করেন। মিরনের নির্দেশে সিরাজের এক সময়ের অনুচর, নিষ্ঠুর মুহাম্মদী বেগ তাকে রাতের অন্ধকারে নির্মমভাবে হত্যা করে। পরিণামে ভারতবর্ষে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রভাব বলয় বিস্তারের পথ সুগম হয়ে যায়। নবাব সিরাজউদ্দৌলার দেশপ্রেম ছিল প্রশ্নাতীত। তিনি জীবনের চরম সন্ধিক্ষণে ফরাসিদের সহায়তা নিয়ে হলেও বাংলার মসনদের মর্যাদা রক্ষায় সচেষ্ট ছিলেন। যদি কেবল জীবন রক্ষার চেষ্টা করতেন তাহলে তিনি দিল্লি অভিমুখে পলায়ন করতে সচেষ্ট হতেন। তিনি তা না করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রতিদ্বন্দ্বীদের সহযোগিতা পেতে তৎপর হন। এর প্রতিক্রিয়ায় তাকে যড়যন্ত্রের শিকার হয়ে নিজের জীবন বিসর্জন দিতে হলো।

পঠিত : ২৪৮৭ বার

মন্তব্য: ০