Alapon

আখিরাত এবং কিছু কথা...

আখিরাতের উপর অধিকাংশ মানুষের ঈমান হলো এমন যে, "একজনের সামনে বিষ মেশানো খাবার দিয়ে তাকে বলে দেওয়া হলো, খাবারে বিষ মেশানো আছে। 'খাবারে বিষ মেশানো আছে' এটা সে বিশ্বাস করল, অতঃপর খাওয়া শুরু করল।" 'ইমাম গাজ্জালী' তাঁর 'আখিরাত' নামক গ্রন্থে মানুষের আখিরাতের উপর ঈমানের অবস্থা বর্ণনা দিতে গিয়ে এমন একটি উদাহরণই দিয়েছেন। কারণ, মানুষ আখিরাতকে সত্য জানে অথচ এর হক্ব আদায় করে না।

আমাদের জীবনের তিনটি অংশ- ১. রূহের জগৎ(পৃথিবীতে জন্মের পূর্বে), ২. পৃথিবীর জীবন এবং ৩. আখিরাতের জীবন(মৃত্যুর পরের অনন্ত জীবন)। 
বোকাদের কাছে বর্তমানই সব। তাই তারা বর্তমানের পাওয়াকেই গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। কিন্তু বুদ্ধিমানরা ভবিষ্যত নিয়েও ভাবে। আমরা যদি আমাদের ভবিষ্যতের দিকে তাকাই, দেখা যাবে আমাদের সামনে আছে দুনিয়ার কয়েকটা বছর আর আখিরাতের অনন্ত জীবন। দুনিয়ার অল্প কয়েকটা বছর যদি একটু কষ্ট করে আখিরাতের অনন্ত জীবনের অনাবিল শান্তি ও সন্তুষ্টি পাওয়া যায় , তাহলে কোনো বুদ্ধিমান ব্যক্তি কি করে এ কয়েকটা বছরের সুখের জন্য আখিরাতের অনন্ত জীবনের কষ্টকে বরণ করে নেয়? আল্লাহ তা'আলা বলেন, "দুনিয়ার জীবন তো খেল-তামাশা ছাড়া অন্য কিছু নয়। মুত্তাকীদের জন্য আখিরাতের আবাসই উত্তম। তোমরা কি বুদ্ধি-বিবেচনাকে কাজে লাগাবে না?" (সূরা: আন'আম- ৩২)

যারা দুনিয়াকে পুরোপুরি ভোগ করতে নিজেকে সর্বক্ষণ ব্যস্ত রাখে, আখিরাত তাদের জন্য নয়। আবার দুনিয়াকে পুরোপুরি ত্যাগ করে আখিরাতকে অর্জন সম্ভব নয়। দুটোর মধ্যে ভারসাম্য রাখতে হবে। কেউ যখন ইসলামকে কুরআন-হাদীস থেকে না শিখে অন্য কোনো মাধ্যম থেকে শিখে তখন তার মধ্যে এ ভারসাম্য থাকে না। দুনিয়া হলো পরীক্ষার জায়গা, যার ফলাফল আখিরাতে দেওয়া হবে। আর সেই ফলাফলের ভিত্তিতে মানুষ চিরস্থায়ী পুরস্কার ও শাস্তির সম্মুখীন হবে। পরীক্ষায় প্রত্যাশিত ফলাফলের জন্য লিখতে/বলতে হয়। পরীক্ষাকে ত্যাগ করলে যেমন ভালো ফলাফল আশা করা যায় না, তেমনি দুনিয়াকে ত্যাগ করে আখিরাতে এর ভালো ফলাফল আশা করা বোকামি। বরং দুনিয়াতে আমাদের যে দায়িত্ব দিয়ে খলিফা বা প্রতিনিধি হিসেবে পাঠানো হয়েছে, সেই দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেই আখিরাতের সফলতা অর্জন সম্ভব।

আখিরাতের বিভিন্ন পর্যায় আছে, যেগুলো আল্লাহর আদেশ অনুযায়ী ধাপে ধাপে সংঘটিত হবে। যার শুরু দুনিয়াতে আমাদের মৃত্যুর মাধ্যমে। এর মাধ্যমে মানুষের দুনিয়ার জীবনের সমাপ্তি ও আখিরাতের জীবনের যাত্রা শুরু হয়। 
মানুষ হলো শরীর এবং আত্মার সমন্বয়। মৃত্যু মানে কখনোই একজন মানুষের শেষ হয়ে যাওয়া নয়। মৃত্যু মানে হলো, দেহ থেকে আত্মাকে আলাদা করা। আত্মাকে আলাদা করলে দেহ এমনিতেই নষ্ট হয়ে যায়। যেমন- আমরা টানা একমাসও যদি নিজের শরীর পরিষ্কার না করি কিংবা ধৌত না করি, শরীর নষ্ট হয়ে যায় না। কিন্তু যখন শরীর থেকে আত্মাটাকে বের করে নেওয়া হয়, আমরা যত পরিষ্কার বা ধৌত করি না কেন কিছু সময় পর তা পঁচে যেতে থাকে এবং তার থেকে দুর্গন্ধ ছড়াতে থাকে। মানুষের সাথে তার ঘরের যেমন সম্পর্ক, আত্মার সাথেও মানব দেহের তেমন সম্পর্ক। বলা হয়ে থাকে , "তোমার একটি আত্মা নেই। বরং তুমিই হচ্ছো আত্মা। তবে তোমার একটি দেহ আছে।" দেহ হচ্ছে অনেকটা আত্মার পৃথিবীতে বসবাস করার ঘরের মতো। কিন্তু দেহের সাথে আত্মার সম্পর্কটা এতটাই বেশি যে, আত্মাকে ব্যথা দেওয়ার জন্য আত্মাকে সরাসরি আঘাত করতে হয় না। দেহকে আঘাত করলেই আত্মা ব্যথা পায়। আবার আত্মাবিহীন দেহেরও অনুভূতি থাকে না। আখিরাতে পাপী ব্যক্তির কষ্ট ও নেককার ব্যক্তির সুখ মূলত আত্মাকেই দেওয়া হবে। কিন্তু আল্লাহর পক্ষে আখিরাতে তার দেহে আত্মাকে আবার সংযোজন করে দেহকে শাস্তি দেওয়া অসম্ভব কিছু নয়। আবার আল্লাহ চাইলে দেহ ছাড়াও আত্মাকে শাস্তি দিতে পারেন। আল্লাহ তা'আলা সূরা বাকারার ২৮ নং আয়াতে বলেন, "তোমরা আল্লাহর সাথে কেমন করে কুফরী করো? অথচ তোমরা ছিলে মৃত, তিনি তোমাদের জীবন দিয়েছেন। অতঃপর তিনি তোমাদেরকে মৃত্যু দান করবেন, তারপর আবার জীবন দান করবেন, অতঃপর তোমরা তাঁরই দিকে ফিরে যাবে।"

যার মৃত্যু যখন হয়, তখন থেকেই তার আখিরাত শুরু হয়ে যায়। পৃথিবীর সকল মানুষের আখিরাত একই সময়ে শুরু না হলেও সকলের হাশর হবে একইসাথে। পৃথিবীর এই পরীক্ষার জায়গায় ততোদিনে সকল মানুষকেই হাশরের সেই কঠিন দিনের জন্য কিছু করে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে। কারণ সেইদিন শুধুমাত্র ঈমান ও আমল ছাড়া আর কোনো কিছুই কাজে আসবে না। মৃত্যুর পর থেকে হাশরের জন্য মৃতদের আবার উঠানোর আগ পর্যন্ত এই সময়টাকে বারযাখ বলে। পাপী বান্দাদের জন্য বারযাখের এ সময়টা খুবই কষ্টের হবে। আর নেককার বান্দাদের জন্য তা হবে শান্তির। হাশরের ময়দানে উঠানোর আগ পর্যন্ত মৃত ব্যক্তির এ বারযাখের সময় চলাকালীন পৃথিবী তার স্বাভাবিক গতিতেই চলতে থাকবে এবং কিয়ামতের দিকে এগোতে থাকবে। এই সময়ে ধারাবাহিকভাবে আল্লাহর পরিকল্পনামত কিয়ামতের আলামতগুলো ঘটতে থাকবে। সর্বশেষ কিছু মানুষের উপর কিয়ামতের ভয়াবহতা নেমে আসবে। কোনো মুমিনকে আল্লাহ তা'আলা কিয়ামতের এ ভয়াবহতার সম্মুখীন করবেন না। তাদেরকে আগেই উঠিয়ে নেওয়া হবে। যাদের মৃত্যু হয় এবং যারা বেঁচে থাকে, আল্লাহ তাদের মাঝে একটা পর্দা তৈরি করে দিয়েছেন। কোনো মানুষই এ পর্দা অতিক্রম করে পর্দার ওপারের কোনো কিছু জানতে পারে না। তবে আল্লাহ চাইলে স্বপ্ন বা অন্য কোনো মাধ্যমে বারযাখের জগতে অবস্থান করা কারো ব্যাপারে পৃথিবীতে অবস্থান করা কাউকে কিছু জানাতে পারেন। তবে সেসব বর্ণনা দ্বারা শারিয়াতের কোনো বিধান সাব্যস্ত হবে না। তার জন্য কুরআন-সুন্নাহই যথেষ্ট। 

বিজ্ঞান কিংবা যুক্তির মাধ্যমে কোনো প্রমাণ পাওয়া যাক বা না যাক, কিয়ামত তার নির্দিষ্ট সময়েই হবে। এমনকি কুরআন-হাদীসে যেভাবে বর্ণনা করা হয়েছে ঠিক সেভাবেই কিয়ামত সংঘটিত হবে। কিন্তু কিয়ামত কখন হবে তার নির্দিষ্ট কোনো সময় আমরা বলতে পারবো না। যদি হিসেব করে কিয়ামতের তারিখ বলা যেতো তাহলে রাসূল (স.) তা তার সাহাবিদের বলে যেতেন। রাসূল (স.) কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার কোনো নির্দিষ্ট সময় বলে না গেলেও কিছু আলামত বলে গেছেন, যেগুলো কিয়ামতের আগে সংঘটিত হবে। এর মধ্যে কিছু ইতোমধ্যে হয়ে গেছে আর কিছু ভবিষ্যতে হবে। "কিয়ামত যত ঘনিয়ে আসবে পৃথিবীতে অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, বিশৃঙ্খলা তত বাড়বে এবং দ্বীনদারী কমবে" এটা সত্য হলেও "কিয়ামতের সকল আলামত খারাপ" এটা ভাবা ভুল। কারণ, কিয়ামতের প্রথম আলামতই হলো হযরত মুহাম্মাদ (স.)-এর আগমন।

আখিরাত বিষয়ক আলোচনায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো হাশরের ময়দানের আলোচনা। এখানে সুন্দরভাবে পার পাওয়াতেই চূড়ান্ত সফলতা। সেদিন কবর থেকে সকল মানুষকে উলঙ্গ অবস্থায় উঠিয়ে হাশরের দিকে তাড়িয়ে আনা হবে। কেউ কেউ উল্টা হয়ে দৌড়াবে হাশরের ময়দানের দিকে। কেউ কারো দিকে তাকানোর সুযোগ পাবে না সেই ময়দানে। সবাই নিজেকে নিয়ে চিন্তিত থাকবে। সেখানে সকল যুগের, সকল স্থানের, সকল গোত্রের এক কথায় আদম (আ.) থেকে কিয়ামত পর্যন্ত যত মানুষ জন্মেছে সকলকে একত্র করা হবে। বাদ যাবে না জ্বীন জাতির কেউ। এমনকি সেদিন সকল পশু-পাখীদেরও উপস্থিত করা হবে। সকলকে একত্র করা হবে একটি সমতল ভূমিতে। সে এক ভয়ংকর দিন। সেদিন বিচার হবে প্রতিটি প্রাণির। পশু-পাখির মাঝে কিসাস করা হবে। দুর্বল প্রাণিরা সবলদের থেকে যেসব আঘাত পেয়েছে, তা ফেরত দেওয়া হবে। তারপর তাদেরকে মিশে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হবে। তখন হাশরের ময়দানে অবশিষ্ট থাকবে শুধু মানুষ ও জ্বীন। হাশরের ময়দান এতটাই উত্তপ্ত হবে যে পৃথিবীর কোনো ভয়ংকর মরুভূমির উত্তাপের সাথে যার তুলনা হয় না। তার উত্তাপের অনুমান করা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু সেই উত্তাপে কেউ মারা যাবে না। প্রত্যেকেই নিজের ঘামের মাঝে ডুবে থাকবে। গুনাহ অনুযায়ী কারো ঘাম পায়ের গিরা পর্যন্ত হবে, কারো হাঁটু, কারো কোমর, কারো কাঁধ, কারো কান এবং কেউ হাবুডুবু খাবে ঘামের মধ্যে। হাশরের ময়দানে সুদীর্ঘ সময় অপেক্ষার পর তাদের বিচার শুরু হবে। প্রত্যেকের হাতে তার আমলনামা তুলে দেওয়া হবে। সবকিছু সুস্পষ্টভাবে উপস্থাপন করা সত্ত্বেও কিছু লোক তখনও তাদের অপরাধগুলো অস্বীকার করবে। তখন আল্লাহ তাদের মুখ বন্ধ করে দিবেন। এরপর তাদের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সাক্ষ্য দিতে থাকবে। প্রতিটি অঙ্গ বর্ণনা করবে ঐসব বিষয়, গোপনে বা প্রকাশ্যে তাকে যেসব কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। যেগুলোকে দুনিয়ার জীবনে সে খারাপ কাজে লিপ্ত করেছে, সেগুলো সম্পূর্ণ তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। ব্যক্তি তখন আফসোস করতে থাকবে, "যেসব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচানোর জন্য আজ সে মিথ্যা বললো সেগুলোই তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিচ্ছে"। 
(সূরা ওয়াকিয়া- ৪৯-৫০, সূরা আনআম-৩৮, সূরা ইসরা- ৯৭, মুসলিম- ৬৭৪৫, মুসলিম- ৭৩৭৭, মুসলিম- ৪৭২, বুখারী- ৪৩৪৯)

সেই ভয়ংকর বিচার দিবসের ভয়াবহতা হবে আমাদের কল্পনার অতীত। মুমিনদেরকে আল্লাহ নিজেই সেই ভয়াবহতায় রক্ষা করবেন। যারা আল্লাহর উপর ভরসা করে দুনিয়ায় আল্লাহর পথে সকল কষ্ট ধৈর্য্যের সাথে বরণ করে নিয়েছে, দুনিয়ার ঐশ্বর্য অর্জনের থেকে আখিরাতের ঐশ্বর্য অর্জনকে গুরুত্ব দিয়েছে, আখিরাতের ভয়াবহতা থেকে বাঁচতে দুনিয়ার সকল ভয়কে তুচ্ছ করে দ্বীনের পথে টিকে ছিল, এক আল্লাহর গোলামিতে তার মন এমনভাবে পূর্ণ ছিল যে, দুনিয়ার অন্য কোনো প্রভুর গোলামি তার অজান্তেও মনে স্থান করে নিতে পারেনি, এমন ব্যক্তিকে যদি সেই ভয়াবহ দিনে আল্লাহ রক্ষা না করেন, তাহলে তার উপর জুলুম হবে। আর আল্লাহ হলেন ন্যায়বিচারক। সেদিন কারো উপর বিন্দুমাত্র জুলুম করা হবে না। সেইদিন সবচেয়ে কঠিন হিসাব হবে শাসক ও ধনাঢ্য ব্যক্তিদের হিসাব। অপরাধীদের মধ্যে কাউকে কাউকে বিনা হিসেবে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। পূণ্যবানদের মধ্যে কাউকে কাউকে সেদিন বিনা হিসেবে জান্নাত প্রদান করা হবে। আমরা সবসময় সেই দলের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার দোয়া করবো। কারণ যার হিসেব নেওয়া আল্লাহ শুরু করবেন, সে মহা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে যাবে।

সেদিন মানুষের আমলগুলো মীযানে পরিমাপ করা হবে। আল্লাহ তা'আলা বলেন, "আর সেদিন যথাযথই ওজন হবে। অতঃপর যাদের (সৎকাজের) পাল্লা ভারী হবে, তারাই সফলকাম হবে। আর যাদের (সৎকাজের) পাল্লা হালকা হবে, তারাই এমন হবে যারা নিজেদের ক্ষতি করেছে। কারণ তারা আমার আয়াতসমূহকে অস্বীকার করতো।" (সূরা আ'রাফ ৮-৯)

মীযানে যাদের পাপ ও পূণ্যের পাল্লা সমান হবে, তাদেরকে জান্নাত ও জাহান্নামের মাঝখানে আ'রাফ নামক স্থানে রাখা হবে। সেখান থেকে তারা জান্নাত ও জাহান্নামবাসী উভয়ের অবস্থা দেখতে পারবে। তাদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করা হবে। যেহেতু আল্লাহর দয়া তাঁর ক্রোধের উপর প্রাধান্য পায়, তাই শেষ পর্যন্ত তাদের জান্নাতেই পাঠানো হবে। আ'রাফবাসী সম্পর্কে আল্লাহ তা'আলা সূরা আ'রাফের ৪৬-৪৭ নং আয়াতে বলেন, "উভয়ের মাঝে থাকবে একটি প্রাচীর। এবং আ'রাফের উপর অনেক লোক থাকবে। তারা প্রত্যেককে তার চিহ্ন দ্বারা চিনে নেবে। তারা জান্নাতীদের ডেকে বলবে, তোমাদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক। তারা তখনও জান্নাতে প্রবেশ করবে না। তবে প্রবেশ করার ব্যাপারে আগ্রহী হবে। যখন তাদের দৃষ্টি জাহান্নামীদের উপর পড়বে, তখন বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক, আমাদেরকে এই জালিমদের সাথী করবেন না।"

হাশরের ময়দানে সকলেই থাকবে প্রচন্ড পিপাসার্ত। নবীদের হাউজগুলো ছাড়া আর কোথাও পানি পাওয়া যাবে না। কিন্তু সেই হাউজগুলো থেকে শুধু মুমিনরাই পানি পান করতে পারবে। রসুলুল্লাহ (স.) বলেন, "প্রত্যেক নবীর জন্য হাউজ থাকবে। প্রত্যেকে চাইবে তার হাউজে যেন বেশি লোক অবতরণ করে। আমি আশা করি, আমার হাউজেই বেশি লোক অবতরণ করবে।" (তিরমিজি- ২৪৪৩)
হাউজের বর্ণনা দিতে গিয়ে রসূলুল্লাহ (স.) বলেন, "দুধের চেয়ে সাদা। মধুর চেয়ে মিষ্টি। জান্নাত থেকে দুটি নালা হয়ে সেখানে পানি প্রবাহিত হবে। একটি নালা হবে স্বর্ণের অপরটি রূপার।" (মুসলিম- ৬১৩০)
"সেখানে অসংখ্য পেয়ালা থাকবে, যার পরিমাণ আকাশের তারকাসমূহের সমান। একবার যে পান করবে, দ্বিতীয়বার সে তৃষ্ণার্ত হবে না।" (মুসলিম- ৬২০৮)
হাউজে সেদিন মুহাজির ও আনসার সাহাবী, ইয়েমেনবাসী ও দ্বীনের জন্য ত্যাগ স্বীকারকারী মুমিনরা অগ্রাধিকার পাবে বলে বিভিন্ন হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। (বুখারী-৩৫৮২, মুসলিম-৬১৩০, মুস্তাদরাকে হাকিম-৭৩৭৪)

পাপীদের মৃত্যু থেকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করার পূর্ব পর্যন্ত ভয়াবহতার বর্ণনাই সুপথে ফিরে আসার জন্য যথেষ্ট ছিল। কিন্তু তারা এমন এক ঘোরের মধ্যে রয়েছে যে, তাদের বুদ্ধি কোনো কাজে আসছে না। অথচ জাহান্নামের শাস্তি ও ভয়াবহতার তুলনায় সেগুলো কিছুই না। আমি শুধু জাহান্নামের সবচেয়ে হালকা শাস্তির বর্ণনা দিয়ে বাকী শাস্তিগুলোর ভয়াবহতার দিকে ইঙ্গিত করতে চাই, যা রসূল (স.)-এর চাচা ও আলী (রা.)-এর পিতা আবু তালিবকে দেওয়া হবে। শাস্তিটি হলো, তাকে এমন এক আগুনের জুতা পরিয়ে দেয়া হবে যার উত্তাপে তার মাথার মগজ পর্যন্ত বিগলিত হবে।(মুসলিম) 
কতইনা দূর্ভাগ্য তাদের জন্য যারা দুনিয়াতে সময় থাকতেও সতর্ক না হয়ে নিকৃষ্ট জাহান্নামকে তার চিরস্থায়ী আবাসস্থল হিসেবে বেছে নিলো; যেখানে পিপাসার্তকে পিপাসা মিটানোর জন্য ক্ষতস্থানের পুঁজ দেওয়া হবে। সেই জাহান্নামের সকল বাসিন্দা মৃত্যুকে এমনভাবে কামনা করবে, যেন মরে গেলেই সে বেঁচে যায়। কিন্তু সে তো এমন জাহান্নামের জন্য নিজেকে উপযুক্ত করে নিয়েছে, যেখানে কোনো মৃত্যু নেই।

পৃথিবীতে একটু সুন্দরভাবে সুখে জীবন-যাপন করতে মানুষ দিনরাত কত খেটে যায়। সেই মানুষের পক্ষে এমন প্রস্তাবকে অস্বীকার করা কিভাবে সম্ভব যাতে লেখা থাকে, তুমি যদি এই এই বিষয়গুলোতে বিশ্বাস রাখো এবং এই এই কাজগুলো কর, তাহলে তোমাকে এমন এক চিরস্থায়ী আবাস দেওয়া হবে, যেখানে তোমার চোখ যা যেভাবে দেখতে চাইবে সেভাবে দেখতে পারবে, যেখানে তোমার কান যা যেভাবে শুনতে চাইবে সেভাবেই শুনতে পারবে, যেখানে তুমি যা যেভাবে খেতে চাইবে তা সেভাবেই পাবে, যেখানে তোমার প্রবৃত্তির কোনো চাহিদা অপূর্ণ রাখা হবে না। এক কথায় যে যা যেভাবে চাইবে সেভাবেই পাবে। তাও এই প্রস্তাব এমন এক সত্তার পক্ষ থেকে, যাঁর কাছে কোনো কিছুর কমতি নাই। পৃথিবীতে মানুষ যা ভোগ করছে, তা তাঁরই সম্পত্তির অংশ। বোকারা ছাড়া এমন প্রস্তাব কেউই প্রত্যাখ্যান করতে পারে না। মুমিনদের জন্য আল্লাহ তা'আলা এমনই জান্নাতের সুসংবাদ দিচ্ছেন, যাতে তারা চিরস্থায়ীভাবে থাকবে। 
মুমিন পুরুষ ও নারীর জন্য জান্নাতে তারা যা যেভাবে চাইবে সেভাবেই পাবে, এতটুকু বলা যথেষ্ট হলেও আল্লাহ তা'আলা পবিত্র কুরআনে পুরুষদের জান্নাতের পথে এগোতে উৎসাহিত করার জন্য জান্নাতে তাদের জন্য পবিত্র স্ত্রীগণের সুসংবাদ দিয়েছেন। এর কারণ হতে পারে, দুনিয়ায় পুরুষদের চিন্তায় এ বিষয়টি অত্যাধিক প্রাধান্য পেয়ে থাকে। এছাড়া জান্নাতের আবাস, প্রকৃতি, খাবার, পোশাক আমাদের এতটাই পছন্দনীয় হবে যে, এর বর্ণনা পৃথিবীর কোনো কিছুর সাথে তুলনা করে সর্বোচ্চ কিছু ধারণা দেওয়া সম্ভব। কুরআন-হাদীসে জান্নাতের বর্ণনা মানুষের বুঝার জন্য এভাবেই পৃথিবীর বিভিন্ন বস্তুর সাথে তুলনা করে দেওয়া হয়েছে, যেগুলোর অভিজ্ঞতা মানুষের আছে।

পাপী মুমিনদের জন্য শাফায়াত বা সুপারিশ সত্য। এই সুপারিশের মাধ্যমে অনেক পাপী মুমিনকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে। বাকী পাপী মুমিনদের পাপ অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত জাহান্নামে শাস্তি ভোগ করিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে। রসূলুল্লাহ (স.) বলেন, "আমার সুপারিশ কেবল আমার উম্মাতের কবীরা গুনাহকারীদের জন্য।" (মুসনাদে আহমাদ-১৩২২২)
অন্য হাদীসে নবী কারিম (স.) বলেন, "...... অতঃপর নবী, ফেরেশতা ও মুমিনগণ সুপারিশ করবেন। তারপর প্রতাপশালী আল্লাহ বলবেন, বাকী রইলো আমার সুপারিশ।"(বুখারী- ৭০০১)

মৃত্যু, কিয়ামত, পুনরুত্থান, হাশর, মীযান, পুলসিরাত, জান্নাত, জাহান্নাম ও শাফায়াত আখিরাতের এ বিষয়গুলোর উপর বিশ্বাস স্থাপন করা আকীদার অন্তর্ভুক্ত। এগুলো বিশ্বাস না করে কারো পক্ষে পরিপূর্ণ মুমিন হওয়া সম্ভব নয়। তবে এগুলোর বিস্তারিত জ্ঞান রাখা ঈমানের অন্তর্ভুক্ত নয়। সাধারন মুমিনরা যেসব বিষয় জানে না, সেগুলোর ব্যাপারে তাদের বিশ্বাসটা হতে হবে এমন যে, " যা কুরআন-হাদীসে সত্য বলে উল্লেখ আছে তাই আমার বিশ্বাস।"

ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে আমরা অনেক ধন-দৌলতের মালিক হলাম। সেগুলো স্বপ্নে ইচ্ছামত ভোগও করলাম। কিন্তু ঘুম থেকে ওঠার পর স্বপ্নে পাওয়া সম্পদের কোনো মূল্যই থাকে না আমাদের কাছে। কারণ আমরা জানি, বাস্তবে আমরা সেগুলোর মালিক নই। আখিরাতে বর্তমান দুনিয়ার জীবনটাও এমনই মনে হবে।
আখিরাত মীমাংসার স্থান। সেখানে সবকিছুর মীমাংসা হয়ে যাবে। যে সমাধানের পেছনে অনেকে সারাজীবন ব্যয় করেছে, সেখানে তা এক নিমিষে সমাধান হয়ে যাবে।

দুনিয়াতে আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপ যেন হয় আখিরাতে নাজাত পাওয়ার উদ্দেশ্যে। আল্লাহর কাছে সেই তাওফিক কামনা করছি।

সহায়ক গ্রন্থসমূহ-
* আখিরাত (ইমাম গাজ্জালী)
* পরকাল (মুহাম্মদ ইবনে আব্দুর রহমান আরিফী)

(সংগৃহিত)

পঠিত : ২৩৩৩ বার

মন্তব্য: ০