Alapon

ইয়েমেনের লড়াই কি আদৌ থামবে?

ইয়েমেনের লড়াইয়ের শুরুটা হয় আরব বসন্তের সূত্র দিয়ে, যার মাধ্যমে আসলে দেশটিতে স্থিতিশীলতা আসবে বলে মনে করা হচ্ছিল। কিন্তু ঘটেছে উল্টোটা। ২০১১ সালে দেশটির দীর্ঘদিনের প্রেসিডেন্ট আলি আবদুল্লাহ সালেহকে তার ডেপুটি আবদারাবুহ মানসুর হাদির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বাধ্য করে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট হাদিকে অনেকগুলো সংকটের মুখোমুখি হতে হয়। আল কায়েদার হামলা, দক্ষিণে বিছিন্নতাবাতী আন্দোলন, সালেহর প্রতি অনেক সামরিক কর্মকর্তার আনুগত্য। এর বাইরে দুর্নীতি, বেকারত্ব আর খাদ্য সংকট তো রয়েছেই।

আর নতুন প্রেসিডেন্টের দুর্বলতার সুযোগে ইয়েমেনের শিয়া মুসলিম নেতৃত্বের হুতি আন্দোলনের কর্মীরা সাডা প্রদেশ এবং আশেপাশের এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। এ সময় অনেক সুন্নিরাও তাদের সমর্থন যোগায়। এরপর বিদ্রোহীরা সানা অঞ্চলেরও নিয়ন্ত্রণও নিয়ে নেয়। পরের মাসে দক্ষিণাঞ্চলীয় বন্দর এডেন থেকে পালিয়ে যান প্রেসিডেন্ট হাদি। হুতি আর নিরাপত্তা বাহিনীগুলো সাবেক প্রেসিডেন্ট সালেহের প্রতি অনুগত। এরপর তারা পুরো দেশের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার চেষ্টা করে। তাদের পেছনে ইরান সমর্থন জুগিয়ে যাচ্ছে বলে ধারণা করা হয়।

মনসুর হাদিকে ইয়েমেনে পুনরায় ক্ষমতায় আনতে সৌদি আরব আর অন্য আটটি সুন্নি দেশ একজোট হয়ে ইয়েমেনে অভিযান শুরু করে। এই জোটকে লজিস্টিক আর ইন্টেলিজেন্স সহায়তা করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য আর ফ্রান্স। এ যুদ্ধের মধ্যে পড়ে ইয়েমেনের বেসামরিক নাগরিকদের ব্যাপক মূল্য দিতে হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতে, সৌদির নেতৃত্বাধীন জোট হাসপাতাল, বিয়েবাড়ি এবং এমনকি শরণার্থী শিবিরগুলোতে বোমা হামলা চালিয়েছে। ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে একটি স্কুলবাসে বোমা হামলায় ৬ থেকে ১১ বছর বয়সী ৪০টি শিশু নিহত হয়। আহত হয় ৫৬টি শিশু।

যুক্তরাজ্যের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকার খবর অনুযায়ী, স্কুলবাসে যে বোমা দিয়ে হামলা চালানো হয়েছিল, তা ছিল ২২৭ কেজি ওজনের লেজারনিয়ন্ত্রিত বোমা। বোমাটি মার্কিন শীর্ষ অস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান লকহিড মার্টিনের তৈরি। অস্ত্র রপ্তানির অংশ হিসেবে সৌদি আরবের কাছে বিক্রি করা হাজার হাজার বোমার মধ্যে এটি একটি। সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের যুদ্ধবিমানগুলো এমনকি ইয়েমেনের হোদাইদাহ বন্দর, দেশের প্রধান পাইপলাইনে হামলা চালায়। এই পাইপলাইনের মাধ্যমে ইয়েমেনের ৭০ শতাংশ মানুষের কাছে খাদ্য, জ্বালানি ও অন্যান্য সাহায্য পাঠানো হয়। বিবিসি জানিয়েছে, সৌদি আরবের আকাশ, সাগর ও ভূমি অবরোধের কারণে এক কোটির বেশি মানুষ এখন দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি। পরিস্থিতি অত্যন্ত ভয়াবহ সেখানে।

সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন নিষ্ঠুর এই জোট ব্যাপক সামরিক সমর্থন পেয়েছে এবং এর পেছনে যারা ইন্ধন দিচ্ছে, তাদের মধ্যে যুক্তরাজ্য রয়েছে সবচেয়ে সক্রিয়ভাবে। ২০১৫ সালের পর থেকে ইয়েমেন অগ্নিগর্ভ হওয়ার পেছনে জ্বালানি হিসেবে কাজ করেছে যুক্তরাজ্য। সৌদি সামরিক অভিযানের জন্য তারা প্রায় ৫৭০ কোটি ডলার মূল্যের অস্ত্র বিক্রি করেছে। ২০১৯ সালে দ্য গার্ডিয়ান–এ প্রকাশিত আরন মিরাটের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তরাজ্য কেবল অস্ত্রই সরবরাহ করেনি, তারা সৌদি আরবের জন্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, বিশেষজ্ঞ এবং কর্মী সরবরাহ করেছে। মিরাট লিখেছেন, ‘ইয়েমেন প্রতিদিন ব্রিটিশ বোমার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে’, ‘প্রশিক্ষিত ব্রিটিশ পাইলটদের দ্বারা চালিত ব্রিটিশ বিমান থেকে বোমা বর্ষণ করা হয়েছে এবং হাজার হাজার ব্রিটিশ ঠিকাদার সৌদি আরবে অবস্থান করেছেন তাদের সাহায্য করার জন্য।’ মিরাটের মতে, সৌদি আরবের ঘাঁটিগুলোতে ৬ হাজার ৩০০ ব্রিটিশ ঠিকাদার রয়েছেন, যেখানে তাঁরা সৌদি পাইলটদের প্রশিক্ষণ এবং ইয়েমেনে অভিযান চালানো বিমানগুলো রক্ষণাবেক্ষণের কাজে নিয়োজিত।

ইয়েমেনে এখন মূলত মার্কিন ও ইরানিদের যুদ্ধ চলছে। মার্কিনের পক্ষে প্রক্সি দিচ্ছে সৌদি আর হুতিদের পক্ষে দাঁড়িয়েছে ইরান। মাঝ থেকে দুর্দশায় পড়েছে সাধারণ নাগরিকরা। ইয়েমেনের এই আপাত–বহুজাতিক লড়াইয়ের মূল কারণ হচ্ছে আঞ্চলিক আধিপত্য বজায় রাখা ও বিস্তার করা। আরবে ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে লড়াই এখন প্রকাশ্য। ইরান যদি ইয়েমেনে নিজস্ব বলয়ের সরকারকে ক্ষমতায় বসাতে পারে, তবে সহজেই এডেন সাগর নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। সৌদি আরবের একেবারে ঘাড়ের ওপর নিশ্বাস ফেলতে পারবে ইরান। ইয়েমেনের লড়াইয়ে ইরানকে পেছন থেকে সমর্থন দিচ্ছে রাশিয়া ও চীন। চীনের লক্ষ্য যদি হয় বাণিজ্য, তবে রাশিয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য খর্ব করা। চীন এডেন বন্দরকে নিয়ন্ত্রণে নিতে চায় বাণিজ্যিক কারণে। ইরান ও রাশিয়ার উদ্দেশ্য সামরিক। অন্যদিকে, সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটকে যুক্তরাষ্ট্র সহায়তা করছে আরবে ক্রমবর্ধমান রাশিয়া ও ইরানের প্রভাবকে প্রতিহত করতে। ইরানের প্রভাব বৃদ্ধি কেবল শুধু যুক্তরাষ্ট্রের মাথাব্যথার কারণ না; একই সঙ্গে ইসরায়েলের নিরাপত্তার বিষয়টিও যুক্তরাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হচ্ছে।

সবকিছু মিলে ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধে নানা দল লড়াই করছে। সৌদি সমর্থন পুষ্ট ইয়েমেনের সরকারকে ত্রিমুখী আক্রমণ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। ইরানের সহায়তাপুষ্ট শিয়া হুতিগোষ্ঠী, দক্ষিণের স্বাধীনতাকামী ও ধর্মীয় জঙ্গিগোষ্ঠী। সরকারবিরোধী তিন পক্ষ আবার নিজেদের মধ্যে লড়াই করছে। হুতিদের ওপর সৌদি জোট যেমন হামলা করছে; আবার হুতি বিদ্রোহীরাও সৌদিকে লক্ষ্য করে মিসাইল ছুড়ছে। হুতিরা সরকার–সমর্থক অনেককেই অপহরণ করে হত্যা করছে।

বস্তুত ইয়েমেনের মানুষ এখন পৃথিবীতে সবচেয়ে কঠিন সময় পার করছে। বিবিসির নিউজে দেখা গেছে, ২০১৫ সালের পর থেকে ইয়েমেনে নিহতের সংখ্যা প্রায় ১ লাখ। এর মধ্যে অন্তত দুই তৃতীয়াংশ নিহত হয়েছে সৌদি জোটের আক্রমণে। বিশ্বের মানবতাবাদীদের এখন ইয়েমেনের মানুষদের দিকে নজর দেয়া দরকার। যুদ্ধের কারণে ইয়েমেন থেকে যাতে মানুষ হারিয়ে না যায়।

পঠিত : ১৩৬৯ বার

মন্তব্য: ০