টানাপোড়েন
তারিখঃ ২৯ জুলাই, ২০১৯, ০৫:৫০
বাস থেকে নামতে না নামতেই প্রচন্ড ধুলিঝড়ে পরে গেল ফাহিম । ওভার ব্রিজটা পার হয়ে শ্যামলী স্কোয়ারের সামনে আসতেই সারা শরীর ধুলোবালিময় হয় যায় তার । তীব্র ঘূর্ণি বাতাসে রাস্তার ধুলো-ময়লাগুলো কুন্ডলি পাকিয়ে টালমাটাল রূপ নিয়েছে । বৈদ্যুতিক তারের সাথে আর এক তার লাগতেই স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে ভূতুরে আবহ তৈরি হচ্ছে । কিন্তু, ফাহিম প্রকৃতির এই রুদ্র রূপেও নিস্পৃহ দাঁড়িয়ে থাকে ওভার ব্রিজের সিঁড়ির গোড়ায়। দেহ বাস্তব জগতে থাকলেও, মন পরাবাস্তব জগতের গলিপথে ঘুরতে থাকে ফাহিমের । এতটুকু বয়সে আর কত দুর্যোগ মোকাবেলা করতে হবে?
এই মুহূর্তে প্রকৃতির ঝড়ের সাথে পাল্লা দিয়ে ফাহিমের ব্যথার পারদ দ্বিগুন ফেনিয়ে ওঠে । ভার্সিটির টিউশন ফির পেমেন্ট স্লিপটা প্যাকেট থেকে বের করে চতুর্থবারের মত চোখ বুলায় ফাহিম । একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে । বাসা ভাড়া, মিলের টাকা, টিউশন ফি এখনো বকেয়া । কয়েকমাস ধরে বেশ আর্থিক সংকটে পড়েছে সে ।
ধ্যুত ! হাজতের বন্দি জীবনটাই বোধহয় ভাল ছিল । কোন টানাপোড়ন নাই, নিশ্চিন্ত জীবন ! --অস্ফুট স্বরে বলে ফাহিম ।
মাঝে মাঝে মা যখন জেলখানায় দেখতে আসত তখনি কেবল, বিষাদ আর মন খারাপের কালোমেঘগুলো হানা দিত হৃদয়রাজ্যে ।
ক্যাম্পাসে কোটা সংস্কার আন্দোলনে যে কয়েকজন সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিল -- ফাহিম তাদের মধ্যে একজন । অযৌক্তিক বস্তাপচা কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের আন্দোলনে বন্ধুদের নিয়ে শামিল হয় সেও। একদিন -- ফুটপাতের টঙ দোকানে সহযোদ্ধাদের নিয়ে পরবর্তীতে কিভাবে সাধারণ ছাত্রদের নিয়ে আন্দোলন বেগবান করা যায় সে বিষয়ে কথা হচ্ছিল । কিন্তু হঠাৎ ক্যাম্পাসের কয়েকজন জুনিয়র ও বহিরাগত সন্ত্রাসী লাঠিসোটা নিয়ে আতর্কিতভাবে হামলে পড়ে তাদের উপর । জ্ঞান ফেরার পর নিজেকে হাতপাতালে আবিষ্কার করে সে । সুস্থ হতেই জেলে ৷
জীবনের প্রথম জেল । অথচ তার স্বপ্ন ছিল বিসিএস ক্যাডার হওয়ার । তা হওয়ার মত যথেষ্ট মেধাবী ও পরিশ্রমীও সে ।
তিনমাস পর জেল থেকে বের হয়ে টিউশনিগুলো হারাতে হয় তাকে । যেগুলো তার থাকা ও খাওয়ার টাকার যোগান দিত । আটপৌরে মধ্যবৃত্ত কৃষক বাবা তাকে মুক্ত করতে অনেক কাটখড় পুরিয়েছেন ।
এই কয়েকমাস কী বিপদে'ই না কেটেছে তার পরিবারের ।
টিউশনি ছাড়াও একটা কোচিংয়ে ক্লাস প্রতি দেড়শ টাকা পেত ফাহিম । তা দিয়ে কোনমতে চলে যেত তার । কিন্ত যে ব্যাচটা সে পড়াত তাদের এইচএসসি পরীক্ষা শুরু সামনে সপ্তাহ থেকে । কোচিং কর্তৃপক্ষ আজ জানিয়ে দিয়েছে পরে কোন ব্যাচে টিচার লাগলে তাকেই ডাকবে ।
আপাতত কোন তাকে লাগছে না ।
এবার উভয়সংকটে পতিত হয় ফাহিম ৷
ঝড়োবাতাস শেষে একটু বৃষ্টি পড়েই পরিবেশ কিছুটা শান্ত হয় । এবার সিঁড়ি থেকে নেমে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দেয় সে। খুব পিপাসা পেয়েছিল তা । একগ্লাস লেবুর শরবত গ্লাস খাওয়া যাক -- মনে মনে ভাবে ফাহিম । শরবত খেয়ে টাকা দিতে গিয়ে খেয়াল হলো তার ম্যানি ব্যাগে একটি মাত্র পাঁচ টাকার নোটই অবশিষ্ট আছে । শ্যামলী থেকে শিয়া মসজিদ পর্যন্ত লেগুনা ভাড়া পাঁচ টাকা ।
রুমমেটের কাছ থেকে ভাড়ার জন্যই বিশটাকা নিয়েছিল । এখন তবে হেঁটেই যেতে হবে !
অগত্যা হাটতে শুরু করে ফাহিম ।
শ্যামলী ক্লাবের সামনে আসতেই এলাকার এক বড় ভাইয়ের সাথে তার দেখা ।
: কি অবস্থা ফাহিম, কেমন আছ ?
: আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি ভাই ।
: আচ্ছা তুমি কি একটা টিউশনি করাতে পারবে ? মাসান্তে ভাল পেমেন্ট দিবে ।
( কথাটা শুনেই যেন চমকিত হয় ফাহিম, তবে কি আবার টানাপোড়েনের ঝড় থেমে যাবে? )
: পারবো ভাই, ব্যগ্র গলায় জবাব দেয় ফারাবী ।
ফাহিম বাসার ঠিকানাটা বলে চলে যায় বড় ভাই ।
ফাহিম মনে মনে ভাবে মনে হয় স্বপ্ন দেখছে সে !
আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া জানাতে ভুলেনা ফাহিম ।
লাখো কোটি শুকরিয়া তোমার দরবারে মা'বুদ ।
দৃঢ়পায়ে বাসায় দিকে পা বাড়ায় ফাহিম ।
মন্তব্য: ০