Alapon

জিহাদের জন্য খলিফা বা রাষ্ট্রপ্রধান থাকা জরুরি নয়...

জিহাদ প্রসঙ্গে বহুল প্রচলিত একটি সংশয় হলো, খলিফা বা রাষ্ট্রপ্রধান ছাড়া জিহাদ নেই। রাষ্ট্রীয় নেতৃত্ব ছাড়া ব্যক্তিগতভাবে কিংবা সাংগঠনিক প্রচেষ্টায় জিহাদ করা বৈধ নয়। এই ধরনের রাষ্ট্রবিচ্ছিন্ন কর্মকাণ্ড জিহাদ নয়, সন্ত্রাস। এতে কেউ মারা গেলে সে শহিদ হবে না; বরং জাহান্নামে যাবে।

বস্তুত সালাফের কর্মপন্থা ও উম্মাহর ইজমা অনুযায়ী এ মতের কোনো ভিত্তি নেই। এটি একটি পরিষ্কার ভ্রান্ত মত, যা সুস্পষ্ট আয়াত, হাদিস এবং শরয়ি মূলনীতির সাথে সাংঘর্ষিক। আমরা দলিলের আলোকে সংশয়টি অপনোদনের প্রয়াস পাব।
.

এক.
যে সমস্ত কুরআনের আয়াত ও হাদিসে আল্লাহর পথে জিহাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, সেগুলোতে এ ধরনের কোনো শর্তারোপ করা হয়নি; বরং আয়াত ও হাদিসগুলো ব্যাপক ও শর্তমুক্ত এবং সেখানে একসঙ্গে সকল মুমিন-মুসলমানকে সম্বোধন করা হয়েছে।

আল্লাহ তাআলা বলেন :
وَقَاتِلُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ الَّذِينَ يُقَاتِلُونَكُمْ
‘আর যারা তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে, তোমরাও তাদের সাথে আল্লাহর পথে যুদ্ধ করো।’ (সুরা আল-বাকারা : ১৯০)

وَقَاتِلُوهُمْ حَتَّى لَا تَكُونَ فِتْنَةٌ وَيَكُونَ الدِّينُ كُلُّهُ لِلَّهِ
‘তোমরা তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করো যতক্ষণ না ফিতনা (শিরক ও কুফর) দূরীভূত হয় এবং আল্লাহর দ্বীন পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়।’ (সুরা আল- আনফাল : ৩৯)

إِنَّ اللَّهَ اشْتَرَى مِنَ الْمُؤْمِنِينَ أَنْفُسَهُمْ وَأَمْوَالَهُمْ بِأَنَّ لَهُمُ الْجَنَّةَ يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَيَقْتُلُونَ وَيُقْتَلُونَ
‘নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাআলা মুমিনদের নিকট থেকে তাদের প্রাণ ও তাদের ধন-সম্পদ ক্রয় করে নিয়েছেন, এ বিনিময়ে যে, তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত। তারা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করে (কাফিরদের) হত্যা করে এবং (নিজেরাও) নিহত হয়।’ (সুরা আত-তাওবা : ১১১)

অনুরূপভাবে রাসুলুল্লাহ সা. বলেন :
جَاهِدُوا الْمُشْرِكِينَ بِأَمْوَالِكُمْ وَأَنْفُسِكُمْ وَأَلْسِنَتِكُمْ
‘তোমরা মুশরিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ করো তোমাদের সম্পদ, জীবন ও জবান দ্বারা।’ (সুনানু আবি দাউদ : ২৫০৪)

ইমাম ইবনে হাজম রহ. বলেন :
قَالَ تَعَالَى: (فَقَاتِلْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ لَا تُكَلَّفُ إِلَّا نَفْسَكَ) وَهَذَا خِطَابٌ مُتَوَجِّهٌ إلَى كُلِّ مُسْلِمٍ , فَكُلُّ أَحَدٍ مَأْمُورٌ بِالْجِهَادِ وَإِنْ لَمْ يَكُنْ مَعَهُ أَحَدٌ
‘আল্লাহ তাআলা (فَقَاتِلْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ لَا تُكَلَّفُ إِلَّا نَفْسَكَ) এই আয়াতে সকল মুসলমানকে সম্বোধন করেছেন। সুতরাং প্রত্যেকেই জিহাদের ব্যাপারে আদিষ্ট; যদিও তার সঙ্গে কেউ না থাকে।’ (আল-মুহাল্লা : ৭/৩৫১)

ইমাম ইবনে কুদামা রহ. বলেন :
وَالْجِهَادُ فَرْضٌ عَلَى الْكِفَايَةِ ...فَالْخِطَابُ فِي ابْتِدَائِهِ يَتَنَاوَلُ الْجَمِيعَ، كَفَرْضِ الْأَعْيَانِ، ثُمَّ يَخْتَلِفَانِ فِي أَنَّ فَرْضَ الْكِفَايَةِ يَسْقُطُ بِفِعْلِ بَعْضِ النَّاسِ لَهُ، وَفَرْضُ الْأَعْيَانِ لَا يَسْقُطُ عَنْ أَحَدٍ بِفِعْلِ غَيْرِهِ
‘জিহাদ আমলটি ফরজে কিফায়া...। প্রথমে ফরজে আইনের মতো এটিতেও সকলের প্রতিই সম্বোধন করা হয়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে উভয়ের মাঝে এভাবে পার্থক্য হয়ে যায় যে, ফরজে কিফায়া কতক মানুষের সম্পাদন করার দ্বারাই আদায় হয়ে যায়, আর ফরজে আইন একজনের সম্পাদন করার দ্বারা আরেকজন থেকে মাফ হয় না।’ (আল-মুগনি : ১০/৩৬৪)

আল্লামা আব্দুর রহমান বিন হাসান বিন মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব রহ. বলেন :
وَلَا رَيْبَ أَنَّ فَرْضَ الْجِهَادِ بَاقٍ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ وَالْمُخَاطَبُ بِهِ الْمُؤْمِنُوْنَ فَإِذَا كَانَتْ هُنَاكَ طَائِفَةٌ مُجْتَمِعَةٌ لَهَا مَنْعَةٌ وَجَبَ عَلَيْهَا أَنْ تُجَاهِدَ فِيْ سَبِيْلِ اللهِ بِمَا تَقْدِرُ عَلَيْهِ لَا يَسْقُطُ عَنْهَا فَرْضُهُ بِحَالٍ وَلَا عَنْ جَمِيْعِ الطَّوَائِفِ
‘এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, জিহাদের ফরজিয়্যাত (আবশ্যিকতা) কিয়ামত পর্যন্ত বাকি থাকবে এবং সকল মুমিনকেই সে ব্যাপারে সম্বোধন করা হয়েছে। সুতরাং যদি কোথাও এমন কোনো সংঘবদ্ধ দল থাকে, যাদের প্রতিরক্ষা শক্তি রয়েছে তাহলে তাদের জন্য তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী আল্লাহর পথে জিহাদ করা ওয়াজিব। এ ফরজিয়্যাত তাদের থেকে এবং অন্যান্য সকল দল থেকে কোনো অবস্থাতেই রহিত হবে না।’ (আদ্দুরারুস সানিয়্যা : ৭/৯৮)
.

দুই.
সমগ্র উম্মাহর এ কথার ওপর ইজমা হয়েছে যে, জিহাদ ফরজে কিফায়া আমল। যাদের সামর্থ্য ও যোগ্যতা আছে, তাদের কেউ সম্পাদন করার আগ পর্যন্ত এটি সকলের ওপর ফরজ থাকে। কেউ আদায় করে ফেললে বাকিরাও দায়িত্বমুক্ত হয়ে যায়। তবে জিহাদ ফরজে আইন হয়ে গেলে কারও দায়মুক্তির সুযোগ নেই; বরং সবাইকেই জিহাদে অংশগ্রহণ করতে হবে।

ইমাম তাবারি রহ. তাঁর তাফসিরগ্রন্থে জিহাদ সম্পর্কে বলেন :
هُوَ عَلَى كُلِّ وَاحِدٍ حَتَّى يَقُوْمَ بِهِ مَنْ فِيْ قِيَامِهِ الْكِفَايَةُ فَيَسْقُطُ فَرْضُ ذَلِكَ حِيْنَئِذٍ عَنْ بَاقِيْ الْمُسْلِمِيْنَ ... وَعَلَى هَذَا عَامَّةُ عُلَمَاءِ الْمُسْلِمِيْنَ
‘তা সকলের ওপরই ফরজ থাকে; যতক্ষণ না এমন কেউ জিহাদের দায়িত্ব পালন করে, যার দ্বারা জিহাদের দায়িত্ব সবার পক্ষ থেকে যথেষ্ট হয়ে যায়। এমনটা হলে তখন বাকি মুসলমানদের থেকে এর ফরজিয়্যাত মুলতবি হয়ে যায়। ...আর জুমহুর উলামায়ে কিরাম এ মতই পোষণ করেন।’ (তাফসিরুত তাবারি : ৪/২৬৯)

ইবনে আতিয়্যা রহ. তাঁর তাফসির গ্রন্থে বলেন :
وَالَّذِي اسْتَمَرَّ عَلَيْهِ الْإِجْمَاعُ أَنَّ الْجِهَادَ عَلَى كُلِّ أُمَّةِ مُحَمَّدٍ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَرْضُ كِفَايَةٍ، فَإِذَا قَامَ بِهِ مَنْ قَامَ مِنَ الْمُسْلِمِينَ سَقَطَ عَنِ الْبَاقِينَ، إِلَّا أَنْ يَنْزِلَ الْعَدُوُّ بِسَاحَةِ الْإِسْلَامِ فَهُوَ حِينَئِذٍ فَرْضُ عَيْنٍ
‘এ কথার ওপর নিরবচ্ছিন্ন ইজমা চলে আসছে যে, জিহাদ সমস্ত উম্মতে মুহাম্মাদির ওপর ফরজে কিফায়া। যখন মুসলমানদের মধ্য থেকে কেউ তা সম্পাদন করে নেবে তখন বাকিদের থেকে তা স্থগিত হয়ে যাবে। তবে শত্রুরা মুসলমানদের ভূমিতে চলে এলে তখন তা ফরজে আইন হয়ে যায়।’ (তাফসিরুল কুরতবি : ৩/৩৮)
.

তিন.
জিহাদ দুই প্রকার :
প্রথম প্রকার হলো, আক্রমণাত্মক জিহাদ।
শত্রুভূমিতে গিয়ে আক্রমণ করাকে আক্রমণাত্মক জিহাদ বলা হয়। এ প্রকারের জিহাদ শুদ্ধ হওয়ার জন্য খলিফা বিদ্যমান থাকা শর্ত নয়। তবে যখন আমির জিহাদের নেতৃত্বে থাকবে তখন তার অনুমতি ও সিদ্ধান্ত ব্যতীত অগ্রবর্তীতা ও স্বেচ্ছাচারিতা করা যাবে না। কেননা, তাকে এ বিষয়টির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তাই তার কাছ থেকে অনুমতি গ্রহণ করা ওয়াজিব। তবে তা জিহাদ শুদ্ধ হওয়ার জন্য শর্ত নয়। তার অনুমতি ছাড়া যে জিহাদ করবে সে গুনাহগার হবে ঠিকই, কিন্তু তার জিহাদ শুদ্ধ হয়ে যাবে। কেননা, যদি কখনো খলিফা না থাকে বা অনুপস্থিত থাকে কিংবা নিহত হয়ে যায় তাহলেও জিহাদ চালু রাখতে হবে, বন্ধ করার বিধান নেই।

ইমাম ইবনে কুদামা রহ. বলেন :
فَإِنْ عُدِمَ الْإِمَامُ، لَمْ يُؤَخَّرْ الْجِهَادُ؛ لِأَنَّ مَصْلَحَتَهُ تَفُوتُ بِتَأْخِيرِهِ. وَإِنْ حَصَلَتْ غَنِيمَةٌ، قَسَمَهَا أَهْلُهَا عَلَى مُوجَبِ الشَّرْعِ
‘যদি খলিফা না পাওয়া যায় তাহলে জিহাদকে বিলম্বিত করবে না। কেননা, বিলম্ব করার দ্বারা জিহাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বিনষ্ট হয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে যদি কোনো গনিমত অর্জিত হয় তাহলে তা শরিয়তের আহকাম মোতাবেক গনিমতের হকদারদের মাঝে বণ্টন করে দেবে।’ (আল-মুগনি : ১০/৩৭৫)

সুতরাং যদি খলিফা বিদ্যমান থাকা জিহাদ শুদ্ধ হওয়ার জন্য শর্তই হতো, তাহলে তা বন্ধ করে রাখা এবং খলিফা পাওয়া যাওয়া পর্যন্ত বিলম্বিত করা ওয়াজিব হতো এবং মুসলমানদের কল্যাণের স্বার্থে তা চালিয়ে নেওয়ার অবকাশ থাকত না। অনুরূপভাবে গনিমত ভক্ষণও তখন বৈধ হতো না।
তেমনিভাবে যখন খলিফা বিদ্যমান থাকবে ঠিকই, কিন্তু মুজাহিদদের জন্য তার কাছ থেকে অনুমতি গ্রহণ করা অসম্ভবপ্রায় হয়ে যাবে, তখনও জিহাদ বিলম্বিত করা ওয়াজিব হতো। অথচ প্রয়োজনের তাগিদে খলিফার অনুমতি ছাড়াই তাদের জন্য তা চালিয়ে যাওয়া বৈধ।

ইবনে কুদামা রহ. বলেন :
فَإِنَّهُمْ لَا يَخْرُجُونَ إلَّا بِإِذْنِ الْأَمِيرِ؛ لِأَنَّ أَمْرَ الْحَرْبِ مَوْكُولٌ إلَيْهِ... إلَّا أَنْ يَتَعَذَّرَ اسْتِئْذَانُهُ لِمُفَاجَأَةِ عَدُوِّهِمْ لَهُمْ، فَلَا يَجِبُ اسْتِئْذَانُهُ، لِأَنَّ الْمَصْلَحَةَ تَتَعَيَّنُ فِي قِتَالِهِمْ وَالْخُرُوجِ إلَيْهِ، لِتَعَيُّنِ الْفَسَادِ فِي تَرْكِهِمْ
‘তারা খলিফার অনুমতি ছাড়া বের হবে না। কেননা যুদ্ধের বিষয়টি তার দায়িত্বে দেওয়া হয়েছে...। তবে যদি শত্রুর আকস্মিক হামলার কারণে তার কাছ থেকে অনুমতি নেওয়া অসম্ভবপ্রায় হয়ে যায়, তাহলে আর অনুমতি গ্রহণের আবশ্যকীয়তা থাকবে না। কেননা, শত্রুদের ছেড়ে দেওয়ার মধ্যে সুনিশ্চিত ক্ষতি থাকায় শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করা ও জিহাদে বের হওয়ার মাঝেই মাসলাহাত বা কল্যাণ রয়েছে।’ (আল-মুগনি : ১০/৩৯০)

সুতরাং যদি খলিফার বিদ্যমান থাকা ও তার অনুমতি গ্রহণ করা আক্রমণাত্মক জিহাদ শুদ্ধ হওয়ার জন্য শর্তই হতো তাহলে তার বিদ্যমান না থাকার সময় জিহাদ শুদ্ধ হতো না। অনুরূপভাবে খলিফা বিদ্যমান থাকার সময়ও প্রয়োজনের সময় অনুমতি ছাড়া জিহাদ শুদ্ধ হতো না। কেননা শর্ত তাকে বলা হয়, যার শূন্যতায় যার জন্য তাকে শর্ত করা হয়েছিল তার শূন্যতাও আবশ্যক হয়ে পড়ে। অথচ এখানে এই দুই অবস্থায় আক্রমণাত্মক জিহাদকে ফুকাহায়ে কেরাম নাকচ করেননি। এখান থেকে বুঝা গেল খলিফা বিদ্যমান থাকা এ প্রকারের জিহাদ শুদ্ধ হওয়ার জন্য শর্ত নয়; বরং উভয় অবস্থাতেই মূল বিবেচ্য বিষয় হলো, মুসলমানদের কল্যাণ নিশ্চিত করা ও ক্ষতি বিদূরিত করা; যেমনটি ইবনে কুদামা রহ. কারণ দর্শিয়েছেন।

দ্বিতীয় প্রকার হলো, প্রতিরক্ষামূলক জিহাদ।
এ প্রকারের জন্য খলিফা থাকাটা যে শর্ত নয়, তা আরও অধিকতর স্পষ্ট ও পরিষ্কার। কেননা, এ প্রকারের জিহাদ ওয়াজিব হওয়ার জন্য কোনো শর্তই নেই; বরং প্রত্যেকের ওপরই তার সাধ্যমতো প্রতিরোধ করা ওয়াজিব। সুতরাং সন্তান তার বাবার কাছে, স্ত্রী তার স্বামীর কাছে, ঋণগ্রহীতা তার ঋণদাতার কাছে অনুমতি চাইবে না। অথচ এরা সকলেই অনুমতি ও আনুগত্যে আমীরের তুলনায় বেশি হকদার ছিল। তা সত্ত্বেও এ মুহূর্তে তাদের হক বাতিল হয়ে গেছে। কেননা, জিহাদ এখন সকলের ওপরই ফরজে আইন। তাই এখন খলিফার বিদ্যমানতা শর্ত হওয়া তো দূরের কথা; বরং খলিফা বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও তার থেকে অনুমতি গ্রহণ করা শর্ত নয়।

শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন :
وَأَمَّا قِتَالُ الدَّفْعِ عَنِ الْحُرْمَةِ وَالدِّيْنِ فَوَاجِبٌ إِجْمَاعًا، فَالْعَدُوُّ الصَّائِلُ الَّذِيْ يُفْسِدُ الدِّيْنَ وَالدُّنْيَا لَا شَيْءَ أَوْجَبُ بَعْدَ الْإِيْمَانِ مِنْ دَفْعِهِ، فَلَا يُشْتَرَطُ لَهُ شَرْطٌ بَلْ يُدْفَعُ بِحَسَبِ الْإِمْكَانِ
‘মুসলমানদের মর্যাদা ও দ্বীনের হিফাজতের জন্য আগ্রাসী শত্রুকে প্রতিহত করা সর্বসম্মতিক্রমে ফরজ। যে আগ্রাসী শত্রু মুসলমানদের দ্বীন ও দুনিয়া উভয়টিকে ধ্বংস করে, ইমান আনার পর তাকে প্রতিরোধ করার চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ কোনো ফরজ নেই। আর এর জন্য কোনো শর্তও প্রযোজ্য নয়; বরং সামর্থ্য অনুযায়ী প্রতিরোধ করতে হবে।’ (আল-ফাতাওয়াল মিসরিয়্যা : ৪/৫০৮)

ইমাম ইবনে হাজম রহ. বলেন :
إِلاَّ أَنْ يَنْزِلَ الْعَدُوُّ بِقَوْمٍ مِنْ الْمُسْلِمِينَ فَفَرْضٌ عَلَى كُلِّ مَنْ يُمْكِنُهُ إعَانَتُهُمْ أَنْ يَقْصِدَهُمْ مُغِيثًا لَهُمْ
‘তবে যদি শত্রুরা মুসলমানদের কোনো জনগোষ্ঠীর ওপর আক্রমণ করে বসে, তাহলে তাদেরকে সাহায্য করতে সক্ষম প্রত্যেকের ওপর তাদের সাহায্যার্থে তাদের উদ্দেশে যুদ্ধযাত্রা ফরজ হয়ে যায়।’ (আল-মুহাল্লা : ৭/২৯২)

ইমাম আবু বকর জাসসাস রহ. বলেন :
وَمَعْلُومٌ فِي اعْتِقَادِ جَمِيعِ الْمُسْلِمِينَ أَنَّهُ إذَا خَافَ أَهْلُ الثُّغُورِ مِنْ الْعَدُوِّ، وَلَمْ تَكُنْ فِيهِمْ مُقَاوِمَةٌ لَهُمْ فَخَافُوا عَلَى بِلَادِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ وَذَرَارِيِّهِمْ أَنَّ الْفَرْضَ عَلَى كَافَّةِ الْأُمَّةِ أَنْ يَنْفِرُ إلَيْهِمْ مَنْ يَكُفُّ عَادِيَتَهُمْ عَنْ الْمُسْلِمِينَ. وَهَذَا لَا خِلَافَ فِيهِ بَيْنَ الْأُمَّةِ
‘সমস্ত মুসলমান পরম বিশ্বাসে এই কথা জানে যে, যখন সীমান্তবাসীরা শত্রুর পক্ষ থেকে আক্রমণের আশঙ্কা করে এবং তাদের কাছে প্রতিরোধ-ক্ষমতা না থাকার ফলে তারা নিজেদের জান, সন্তান ও শহর নিয়ে শঙ্কাবোধ করে তখন সমগ্র মুসলিম উম্মাহর ওপর শত্রু অভিমুখে যুদ্ধযাত্রা করে মুসলমানদের থেকে তাদের জুলুম প্রতিহত করা ফরজ হয়ে যায়। আর এ ব্যাপারে উম্মাহর কারও মাঝে কোনো দ্বিমত নেই।’ (আহকামুল কুরআন : ৪/৩১২)
এটাই হচ্ছে জিহাদ ফরজে আইন হওয়ার মর্ম যে, যখনই সময় হবে তাৎক্ষণিকভাবে বেরিয়ে পড়তে হবে। সুতরাং যদি তা শুদ্ধ হওয়ার জন্য কোনো শর্ত থাকত, যেমন : খলিফা বিদ্যমান থাকা বা তার অনুমতি গ্রহণ করা, তাহলে শত্রুরা মুসলমানদের ওপর আক্রমণ করার সময় কখনোই জিহাদ ফরজে আইন হতো না। অথচ উম্মাহর কোনো ফকিহই এ কথার প্রবক্তা নন। এ কারণেই ইমাম মাওয়ারদি রহ. বলেছেন :
فَرْضُ الْجِهَاِد عَلَى الْكِفَايَةِ يَتَوَلَّاهُ الْإِمَامُ مَا لَمْ يَتَعَيَّنْ
‘ফরজে কিফায়া জিহাদ পরিচালনা করবেন খলিফা, যতক্ষণ না তা ফরজে আইন হয়ে যায়।’ (আল-ইকনা : পৃ. নং ১৭৫)
.

চার.
ফিকহের কিতাবাদিতে সংশ্লিষ্ট অধ্যায়ে জিহাদ ওয়াজিব হওয়ার শর্ত, জিহাদ কার ওপর ওয়াজিব হবে এবং কখন ওয়াজিব হবে―সব বিষয়ই আলোচিত হয়েছে। কিন্তু সেখানে খলিফা বিদ্যমান থাকাকে শর্ত করা হয়নি।

বুখারির বর্ণনায় এসেছে :
مَا بَالُ أَقْوَامٍ يَشْتَرِطُونَ شُرُوطًا لَيْسَتْ فِي كِتَابِ اللَّهِ مَنْ اشْتَرَطَ شَرْطًا لَيْسَ فِي كِتَابِ اللَّهِ فَلَيْسَ لَهُ وَإِنْ اشْتَرَطَ مِائَةَ شَرْطٍ
‘লোকদের কী হলো—তারা এমন সব শর্ত আরোপ করছে, যা আল্লাহর কিতাবে নেই! যে ব্যক্তি এমন শর্ত আরোপ করে, যা আল্লাহর কিতাবে নেই সে ওই শর্তের হকদার হবে না; যদিও সে একশত শর্ত আরোপ করে।’ (সহিহ বুখারি : ২৭৩৫)

আব্দুর রহমান বিন হাসান বিন মুহাম্মদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব রহ. এই শর্তটির অসারতা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন :
بِأَيِّ كِتَابٍ أَمْ بِأَيِّ حُجَّةٍ أَنَّ الْجِهَادَ لَا يَجِبُ إِلَّا مَعَ إِمَامٍ مُتْبَعٍ؟ هَذَا مِنَ الْفِرْيَةِ فِيْ الدِّيْنِ وَالْعُدُوْلِ عَنْ سَبِيْلِ الْمُؤْمِنِيْنَ وَالْأَدِلَّةُ عَلَى بُطْلَانِ هَذَا الْقَوْلِ أَشْهَرُ مِنْ أَنْ تُذْكَرَ مِنْ ذَلِكَ عُمُوْمُ الْأَمْرِ بِالْجِهَادِ وَالتَّرْغِيْبِ فِيْهِ وَالْوَعِيْدِ فِيْ تَرْكِهِ
‘কোন কিতাব বা কোন দলিল দ্বারা এটা প্রমাণিত হলো যে, আমির না থাকলে জিহাদ ওয়াজিব হয় না? এটা দ্বীনের মধ্যে মিথ্যা সংযোজন ও মুসলমানদের পথ থেকে বিচ্যুত হওয়ার নামান্তর। এ বক্তব্যটির অসারতার প্রমাণাদি এতটাই প্রসিদ্ধ যে, তা আর উল্লেখের প্রয়োজন পড়ে না। তন্মধ্যে একটি হলো, জিহাদের আদেশ ও উৎসাহমূলক আয়াত-হাদিসগুলো এবং জিহাদ ত্যাগের নিষেধ ও হুঁশিয়ারিমূলক আয়াত-হাদিসগুলোর ব্যাপকতা।’ (আদ্দুরারুস সানিয়্যা : ৭/৯৭)

সুতরাং জিহাদ কিয়ামত পর্যন্ত চলবে, চাই খলিফা বিদ্যমান থাকুক বা না থাকুক।

শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ., ইবনে কাইয়্যিম রহ. এবং অন্যান্য অনেক ইমাম দলিল দিয়ে থাকেন আবু বাসির রা. ও তাঁর সঙ্গীসাথী কর্তৃক মুশরিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ ও পথরুদ্ধ করার ঘটনা দিয়ে। যে ঘটনায় রাসুলুল্লাহ সা. তাঁর বীরত্বের প্রশংসা করে তাঁর শানে ইরশাদ করেছিলেন :
وَيْلُ أُمِّهِ مِسْعَرَ حَرْبٍ لَوْ كَانَ له أَحَدٌ
‘তাঁর মায়ের জন্য আফসোস! (এটি আরবদের আশ্চর্যভাব প্রকাশক একটি বাকভঙ্গি) সে তো দেখছি যুদ্ধের আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। আহ! তার যদি কোনো সাহায্যকারী থাকত!’ [সহিহ বুখারি : ২৭৩১] (জাদুল মাআদ : ৩/৩০৯)

অথচ তখন আবু বাসির রা. রাসুলুল্লাহ সা.-এর অধীনেও ছিলেন না এবং কোনো দারুল ইসলামেও ছিলেন না; এমনকি নিজেও স্বয়ং কোনো খলিফা ছিলেন না এবং তার সাথে কোনো ঝান্ডাও ছিল না। তিনি মুশরিকদের ওপর আক্রমণ করে তাদের সাথে লড়াই করে গনিমত আহরণ করতেন ও তা দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করতেন। এটা জানার পরও রাসুলুল্লাহ সা. তাঁকে মৌন সমর্থন দিয়েছেন এবং তাঁর প্রশংসা করেছেন।

আব্দুর রহমান বিন হাসান রহ. এ ঘটনা দ্বারা দলিল পেশ করে বলেন :
فَهَلْ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم أَخْطَأْتُمْ فِيْ قِتَالِ قُرَيْشٍ لِأَنَّكُمْ لَسْتُمْ مَعَ إِمَامٍ سُبْحَانَ اللهِ مَا أَعْظَمَ مَضَرَّةَ الْجَهْلِ عَلَى أَهْلِهِ؟
‘রাসুলুল্লাহ সা. কি তাদেরকে বলেছেন যে, কুরাইশদের সাথে লড়াই করে তোমরা ভুল করেছ? কেননা তোমরা তো কোনো খলিফার অধীনে নও! সুবহানাল্লাহ! চিন্তা করে দেখুন, মূর্খদের জন্য তাদের মূর্খতা কতটা ক্ষতিকারক হতে পারে!’ (আদ্দুরারুস সানিয়্যা : ৭/৯৭)
.

পাঁচ.
জিহাদ কায়েম করা যেমন ওয়াজিব, খলিফা নিযুক্ত করা তেমনই ওয়াজিব। তাই মুজাহিদদের জন্যে আবশ্যক হলো, পূর্ব থেকে সেখানে কোনো রাষ্ট্রীয় খলিফা না থাকলে নিজেদের মধ্য থেকে কাউকে আমির বানিয়ে নেওয়া। কেননা, খলিফা বিদ্যমান থাকা জিহাদ শুদ্ধ হওয়ার জন্য শর্ত নয়; বরং খলিফার বিদ্যমানতার জন্য (অর্থাৎ খলিফার খলিফা হিসেবে বাকি থাকার জন্য) জিহাদ শর্ত। কেননা, খলিফার খিলাফত তথা রাষ্ট পরিচালনা শুদ্ধ হওয়ার জন্য জিহাদ কায়েম করা জরুরি। জিহাদ পরিত্যাগ করে কোনো খলিফা শরয়ি খলিফা থাকতে পারে না। এটা সঠিক নয় যে, খলিফা ছাড়া জিহাদ হয় না।

আব্দুর রহমান বিন হাসান রহ. বলেছেন :
كُلُّ مَنْ قَامَ بِالْجِهَادِ فِيْ سَبِيْلِ اللهِ فَقَدْ أَطَاعَ اللهَ وَأَدَّى مَا فَرَضَهُ اللهُ وَلَا يَكُوْنُ الْإِمَامُ إِمَاماً إِلَّا بِالْجِهَادِ لَا أَنَّهُ لَا يَكُوْنُ جِهَادٌ إِلَّا بِإِمَامٍ
‘যারা আল্লাহর পথে জিহাদ করল তারা আল্লাহর আনুগত্য করল এবং আল্লাহ তাআলা তাদের প্রতি যা ফরজ করেছিলেন তা আদায় করল। আর কোনো খলিফা জিহাদ ছাড়া (শরয়ি) খলিফা হতে পারে না। এমনটা নয় যে, খলিফা ছাড়া কোনো জিহাদ হয় না।’ (আদ্দুরারুস সানিয়্যা : ৭/৯৭)

একথা সকলেরই জানা যে, খলিফার প্রথম দায়িত্ব হচ্ছে জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং শরিয়ত প্রতিষ্ঠা করা। সুতরাং সে যদি জিহাদ ও জনগণকে রক্ষা করতে অক্ষম হয় তাহলে সে খিলাফতের মূল লক্ষ্য থেকেই বেরিয়ে যায়। বরং তখন তার বিদ্যমান থাকা ও না থাকা বরাবর হয়ে যায়। আর যদি সে মুসলমানদের জান-মাল ও ইজ্জত-আব্রু রক্ষার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে তখন তো তার থাকার চেয়ে না থাকাই ভালো। এমতাবস্থায় শরিয়তের দৃষ্টিতে তার খিলাফত বাতিল হয়ে যায়। কেননা, তার খলিফা থাকার উদ্দেশ্য এখানে পূরণ হচ্ছে না।

বুখারির বর্ণনায় এসেছে :
وَإِنَّمَا الإِمَامُ جُنَّةٌ يُقَاتَلُ مِنْ وَرَائِهِ وَيُتَّقَى بِهِ
‘খলিফা হলো ঢাল স্বরূপ, যার অধীনে থেকে যুদ্ধ করা হয় এবং শত্রুর আক্রমণ থেকে নিরাপত্তা লাভ করা হয়।’ (সহিহ বুখারি : ২৯৫৭)

তাই খলিফা এজন্য নিযুক্ত করা ওয়াজিব, যেন সে ঢাল ও প্রতিবন্ধক হয়ে জনগণকে রক্ষা করতে পারে এবং জনগণ তার অধীনে থেকে লড়াই করতে পারে। পক্ষান্তরে সে যদি মুসলিমদের বদলে শত্রুদের ঢাল হয় তাহলে তো সে জাগতিককভাবে মুসলমানদের খলিফা হিসেবে বাকি থাকলেও শরিয়তের দৃষ্টিতে কিছুতেই খলিফা থাকতে পারে না।
.

ছয়.
আব্দুল্লাহ বিন আমর রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সা. বলেন :
مَنْ قَاتَلَ دُونَ مَالِهِ فَهُوَ شَهِيدٌ
‘যে ব্যক্তি তার মাল রক্ষার্থে যুদ্ধ করে নিহত হয় সে শহিদ।’ (সুনানে নাসায়ি : ৪০৮৫)

অনুরূপভাবে হাদিসে আরও এসেছে, যে ব্যক্তি দ্বীনের জন্য লড়াই করে মৃত্যুবরণ করে সে শহিদ। অনুরূপ যে ব্যক্তি পরিবারের নিরাপত্তা রক্ষায় লড়াই করে মারা যায় সে শহিদ। আর এটা সর্বজনস্বীকৃত যে, এ হাদিসটি সকলের ক্ষেত্রেই ব্যাপক। বরং এ হাদিসটি একক ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হওয়ার ব্যাপারে কারও দ্বিমত নেই এবং প্রতিটি মুসলমানের জন্য এই বৈধতা আছে যে, সে নিজের মর্যাদা, সম্পদ ও দ্বীনের প্রতিরক্ষার জন্যে লড়াই করবে; যদিও সে একাকি হয়। এমনকি আগ্রাসী ব্যক্তি যদি তার মতো একজন মুসলিমও হয় তবুও সে লড়াই করতে পারবে এবং এক্ষেত্রে যদি সে মারা যায় তাহলে সে শহিদ হবে। সুতরাং যে ব্যক্তি খলিফার বিদ্যমান থাকা বা তার অনুমতি গ্রহণকে শর্তারোপ করে, সে প্রকারান্তরে হাদিসের নির্দেশনাকেই অকেজো করে দেয়। তাছাড়া সহিহ মুসলিমের হাদিসে এসেছে যে, আব্দুল্লাহ বিন আমর রা. এ হাদিস দ্বারা মুসলিমদের জন্য নিজের জান, মাল ও ইজ্জতের প্রতিরক্ষায় লড়াই করা জায়িজ হওয়ার ব্যাপারে দলিল পেশ করেছেন। এমনকি আগ্রাসী ব্যক্তি যদি স্বয়ং খলিফাও হয় তবুও। বাদশাহ যখন তাঁর (আব্দুল্লাহ বিন আমর রা.) জমি নিয়ে যেতে মনস্থ করে তখন তিনি এই হাদিস দ্বারা দলিল পেশ করে বাদশাহর সাথে লড়াই করার জন্যে প্রস্তুতি গ্রহণ করেন।

সুতরাং এ জাতীয় লড়াইয়ে যেহেতু খলিফার অনুমতি গ্রহণ করা শর্ত নয়, তাহলে কাফির শত্রু থেকে নিজের জান, মাল, ইজ্জত-সম্মান, ভূমি ও দ্বীন প্রতিরক্ষায় কী করে তা শর্ত হতে পারে? বরং নিঃসন্দেহে সেক্ষেত্রে এ হুকুম আরও ভালোভাবে প্রযোজ্য হবে। অর্থাৎ সন্দেহাতীতভাবে খলিফার অনুমতি গ্রহণ করা শর্ত হবে না।
.

সাত.
সহিহ মুসলিমের বর্ণনায় এসেছে :
لاَ تَزَالُ طَائِفَةٌ مِنْ أُمَّتِى يُقَاتِلُونَ عَلَى الْحَقِّ ظَاهِرِينَ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ
‘আমার উম্মতের একদল লোক সত্য দ্বীনের ওপর প্রতিষ্ঠিত থেকে বাতিলের বিরুদ্ধে লড়তে থাকবে।’ (সহিহ মুসলিম : ৪১২)

এই হাদিসে বর্ণিত ‘একদল লোক’ বলতে মুজাহিদিনে কিরাম উদ্দেশ্য। এ কথা বলাই বাহুল্য যে, একটি দল মানে জাতির কতিপয় লোকই হবে, পুরো জাতি নয়। আর তাদের জিহাদ ও বিজয়ও সেক্ষেত্রে জাতি ও খলিফা ব্যতীতই হয়ে থাকবে। কেননা, খলিফা যদি তাদের সাথেই থাকতই তাহলে তো খলিফার অনুগামী হয়ে পুরো জাতিও তাদের সাথে থাকত। আর সেক্ষেত্রে তো জাতির তুলনায় এই দলটির আলাদা কোনো বৈশিষ্ট্য রইল না। সুতরাং উপরোক্ত হাদিসটি ইঙ্গিতাকারে এ কথারই জানান দিচ্ছে যে, মুসলমানদের একটি দল এককভাবে মুশরিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ করতে পারবে; যদিওবা পুরো জাতিই তাদের পরিত্যাগ করে এবং খলিফাও তাদের সাহায্য না করে। আর যদি জিহাদ শুদ্ধ হওয়ার জন্য খলিফা বিদ্যমান থাকা বা তার অনুমতি গ্রহণ শর্তই হতো তাহলে হাদিসে বর্ণিত সেই দলটির জন্য জিহাদ করাও শুদ্ধ হতো না এবং রাসুলুল্লাহ সা.-ও সমগ্র জাতিকে ছেড়ে তাদের এই শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করতেন না।
.

আট.
উম্মাহর সালাফ ও আকাবিরের আমলি ইজমাও এই বিধানটিকে আরও জোরদার করেছে। কেননা, এ যুগে যেখানেই শত্রুরা মুসলমানদের ওপর আক্রমণ করেছে, খলিফার অবিদ্যমানতা সত্ত্বেও তখনই মুসলমানরা তাদের মোকাবেলায় দাঁড়িয়ে গেছে। যেমনটি ঘটেছে খিলাফতে উসমানি ধ্বংসের পর এবং পশ্চিমা ঔপনিবেশিক শক্তির হাতে মুসলিম বিশ্বের পতনের পর।

আলজেরিয়া, লিবিয়া, মিসর, সিরিয়া, ইরাক ও ভারতবর্ষসহ অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর উলামায়ে কিরাম ও মুজাহিদগণ তাদের ভূমি ও মর্যাদা রক্ষায় জিহাদে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। তাদের জিহাদ বৈধ হওয়ার ব্যাপারে ও তাদেরকে সাহায্য করা ওয়াজিব হওয়ার ব্যাপারেও উলামায়ে কেরাম তখন ঐকমত্য পোষণ করেছিলেন। অথচ তখন মুসলমানদের না ছিল কোনো কেন্দ্রীয় খলিফা, না ছিল সে অঞ্চলগুলোর জন্যে কোনো বিশেষ আমির, আর না ছিল তাদের নিকট কোনো ভারসাম্যপূর্ণ শক্তি; বরং তা ছিল আবু বাসির রা. ও তাঁর সাথীদের ন্যায় কেবলই একটি দলভিত্তিক যুদ্ধ। ইতিহাসের পাতা থেকে কয়েকটি দৃষ্টান্ত দেয়া যাক :

তাতারিরা যখন আব্বাসি খলিফাকে ৬৫৭ হিজরিতে হত্যা করে তখন থেকে ৬৫৯ হিজরি পর্যন্ত মুসলমানদের কোনো খলিফা ছিল না। কিন্তু এরপরও উলামায়ে কেরাম তাতারিদের বিরুদ্ধে কিতাল ফরজ হওয়ার ফতোয়া দিয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে নজিরবিহীন কিতাল হয়েছে। তখন তো এই প্রশ্ন ওঠেনি যে, খলিফা তো নেই, তাহলে জিহাদ ফরজ হবে কেন।

আমাদের আকাবিরের মধ্যে সাইয়েদ আহমদ বেরলবি রহ.-এর নাম এখানে সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। ‘ইজ হাব্বাত রিহুল ইমান’ গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে যে, ইংরেজ, শিখ ও মারাঠা বাহিনী যখন ইসলামকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দিতে উদ্যত হয় এবং মুসলমানদের ব্যাপকহারে নিধন করতে শুরু করে তখন সাইয়েদ আহমাদ বেরলবি রহ. মুসলমানদের সংগঠিত করতে লেগে যান। মাওলানা ইসমাইল শহিদ রহ. ও মাওলানা আব্দুল হাই রহ.-এর মতো যশস্বী আলিমরা তাঁর সহযোগী হন। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি জিহাদের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেন। তিনি যখন লাহোরের মহারাজার বিরুদ্ধে প্রথম অস্ত্র ধরেন তখন তার সাথে ছিল মাত্র ৭০০ মুজাহিদ। পক্ষান্তরে শত্রুশিবিরে ছিল ৭,০০০ সৈনিক। এই অসম লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত মুজাহিদরাই বিজয়ী হয়। কী ছিল তখন আমাদের এই পুণ্যাত্মা পূর্বসূরিদের হাতে?! জিহাদের এই অমর সিপাহসালার বালাকোট প্রান্তরে শহিদ হন। তাঁর সাথে শহিদ হন মাওলানা ইসমাইল রহ.ও। তাদের এই জিহাদ কি তবে অবৈধ জিহাদ ছিল?

ভারতবর্ষ ইংরেজরা দখলে নেওয়ার পর হাজি ইমদাদুল্লাহ রহ., কাসিম নানুতুবি রহ., রশিদ আহমদ গাঙ্গুহি রহ. প্রমুখ শামেলির জিহাদ করেছেন। তখন তো এ প্রশ্ন ওঠেনি যে, খলিফা নেই, জিহাদ হবে কীভাবে।

আফগানিস্তানে রাশিয়ার বিরুদ্ধে কিতাল হয়েছে পনেরো বছর। তখন তো কোনো খলিফা ছিল না। আজ যারা বলছে ইমাম ছাড়া জিহাদ নেই, তারাই তো তখন আফগান জিহাদ নিয়ে গৌরব করত। কিন্তু আজ যখন তাদের বন্ধুদেশ আমেরিকার বিরুদ্ধে জিহাদ শুরু হয়েছে, তখন ফতোয়াও পাল্টে গেছে।

সুতরাং যারা জিহাদ শুদ্ধ হওয়ার জন্য খলিফা বিদ্যমান থাকার শর্তারোপ করে, তারা ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে যে সমস্ত উলামায়ে কেরাম ও নেতৃস্থানীয় মুসলমানগণ জিহাদ করেছেন তাদের ব্যাপারে কী বলবেন? এই সব জিহাদে যেসব লক্ষ লক্ষ মুসলমান শহিদ হয়েছেন, তাদের ব্যাপারেই বা কী বলবেন?

শেষ কথা :

কাফির শত্রু যখন কোনো মুসলিম ভূখণ্ডে আক্রমণ করে বসে তখন তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করাটা কখনো ফিতনার লড়াই হতে পারে না। এমন কথা উম্মতের উলামায়ে কিরামের কেউই বলেননি। বরং প্রকৃত ফিতনা হচ্ছে, সে সময় লড়াই পরিত্যাগ করা এবং তাদেরকে প্রতিরোধ না করা।

ইমাম ইবনে হাজম রহ. বলেন :
‘যে ব্যক্তি কাফিরদের সাথে জিহাদ করতে নিষেধ করে এবং পবিত্র স্থানগুলোকে তাদের নিকট সমর্পণ করার জন্য আদেশ করে, কুফরির পর এই ব্যক্তির গুনাহের চেয়ে বড় আর কোনো গুনাহ নেই।’ (আল-মুহাল্লা : ৭/৩০০)

যেমনিভাবে শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যা রহ. বলেন :
فَالْعَدُوُّ الصَّائِلُ الَّذِيْ يُفْسِدُ الدِّيْنَ وَالدُّنْيَا لَا شَيْءَ أَوْجَبُ بَعْدَ الْإِيْمَانِ مِنْ دَفْعِهِ
‘যে আগ্রাসী শত্রু মুসলমানদের দ্বীন ও দুনিয়া উভয়টিকে ধ্বংস করে, ইমান আনার পর তাকে প্রতিরোধ করার চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ কোনো ফরজ নেই।’ (আল-ফাতাওয়াল মিসরিয়্যা : ৪/৫০৮)
.
লেখক : মাওলানা তারেকুজ্জামান


পঠিত : ২৬৬৭ বার

মন্তব্য: ০