Alapon

সেই শিক্ষা শিখতে হবে, যা কেউ শেখাতে পারে না!

বসরার ঘটনা। এক বৃদ্ধ তার একমাত্র পুত্র সন্তানকে শিক্ষিত করে তোলার জন্য বাগদাদের সবচেয়ে নামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যুগের সবচেয়ে বুজুর্গ জ্ঞানীর নিকট পাঠালেন। বছর কয়েক ছেলেটি সেখানে শিক্ষা গ্রহণ শেষে বাড়ি ফিরল।

বহুদিন পরে আত্মজ ফিরে আসছে, বাবার আনন্দের কোনো শেষ নেই! অধীর আগ্রহে অপেক্ষমাণ! এক সময় ছেলে বাড়ি আসল। বাবার সাথে পুত্রের দীর্ঘ দিন পরে দেখা, কুশল বিনিময়। ছেলে তার বৃদ্ধ বাবাকে ভক্তি-সম্মান-ভালোবাসা দেখাতে কোনো ত্রুটিই করলো না।

কিন্তু বৃদ্ধ তৃপ্ত হতে পারলেন না। তিনি যেন কোনো মতেই শান্তি পাচ্ছেন না মনে। যে শিক্ষা গ্রহণের জন্য সন্তানকে এতটা বছর চোখের আড়ালে রাখলেন, সন্তান কি সেই শিক্ষা পেয়েছে? তার ভেতরে তো তেমন কোনো লক্ষণই নেই!

সারারাত বৃদ্ধ ছটফট করলেন। সকাল হতেই তিনি সন্তানকে ডেকে বললেন; 'বাছা, তুমি আবার ফেরত যাও, তোমার ওস্তাদকে আমার সালাম দিয়ে বলবে; তোমাকে যেন সেই জ্ঞান শিখিয়ে দেন, যে জ্ঞান কেউ কখনও কাউকে শেখাতে পারে না। '

বাবার এমন অদ্ভূত নির্দেশ শুনে ছেলেটা অবাক হলেও তার অবাধ্য হবার মত সাহস ছিল না, নির্দেশ পালনে সে ফিরে গেল, ওস্তাদকে সবিনয়ে জানালো বাবার নির্দেশ।

ওস্তাদ খুব মনোযোগ দিয়ে শুনে ছাত্রটিকে নির্দেশ দিলেন শহরের বাইরে মরুময় ও পাহাড়ী অঞ্চলে রাখালদের কাছে যেতে। এক রাখালের নাম বলে তিনি বললেন; তার কাছে তিনশত ভেড়া-দুম্বা আছে। তুমি উক্ত ভেড়া আর দুম্বাগুলো দেখা শোনার ভার নেবে, আর যখন দেখবে ঐ ভেড়া দুম্বাগুলো সংখ্যায় বেড়ে এক হাজার পূর্ণ হয়েছে, তখন ফেরত আসবে।'

কুরআন-হাদিস, উসুল-ফিক্বাহ, দর্শন-ইতিহাস বিষয়ে বিশ্ববিখ্যাত উস্তাদের সান্নিধ্যে থেকে একাডেমিক পাঠ সমাপ্ত করা তুখোড় ছাত্রটি অনিচ্ছাসত্তেও শেষ পর্যন্ত ওস্তাদ ও বৃদ্ধ পিতার নির্দেশ পালনে বাধ্য হয়েই চলে গেল জনমানবহীন পাহাড়ী মরুপ্রান্তরে। সেখানে খুজে বের করল সেই রাখালকে, ওস্তাদের নির্দেশমত তার কাছ থেকে ঐ তিনশত পশুচারণ ও দেখভালের ভার নিজের কাঁধে তুলে নিল।

এভাবেই জনমানবহীন নির্জন প্রান্তরে শুরু হলো এক তুখোড় একাডেমিশিয়ানের নি:সংগ জীবন। রাখাল জীবন! কথা বলার কেউ নেই। শোনারও নেই কেউ। নিজের সাথেই কথা বলে চলে ছেলেটা আনমনে। কখনও কখনও ভেড়ার সাথেও! অবোধ ভেড়া ভ্যা ভ্যা করে তাকিয়ে থাকে!

পালের ভেড়া আর দুম্বাগুলো চরানোর পাশাপাশি সে পাহাড় দেখে, পাহাড়ের গায়ে পাথরের রং-এ মেশানো বৈচিত্রতা দেখে। আকাশে মেঘের আনোগাণা দেখে, এক অসীম শূন্যতার মাঝেও সে দেখে! কি যেন দেখে!! আমাবশ্যার রাতে ঘোর আঁধারে চারিদিকে এক অবর্ণনীয়, অচিন্তনীয়, অকল্পনীয় রুপ দেখে! আঁধারের রুপ! আঁধারের কী রুপ থাকে? থাকে কী কোনো সৌন্দর্য?

সে তো দর্শন পড়েছিলো। ওস্তাদ বড় যত্ন করেই দর্শন পড়িয়েছেন, কিন্তু আঁধারের এই রুপ তো তিনি শেখাননি! রাখাল ছেলে নির্ঘুম জেগে জেগে রাতের আকাশ ভরা তারা দেখে, চাঁদের জোস্নায় আলোকিত অপরুপ বিশ্ব দেখে! ওস্তাদ শিখিয়েছিলেন মহান আল্লাহর বাণী; ‘মা খালাক্বতা হাজা বাতিলাঁও

আজ যেন আয়াতটি অনেক বেশি অর্থবহ, অনেক বেশি গভীর হয়ে তার কাছে ধরা দিচ্ছে! মাদ্রাসায় সহপাঠীদের সাথে বাহাসে, ওস্তাদের কাছ থেকে জ্ঞান আহরণে সবচেয়ে তুখোড় ছেলেটা এই নির্জনে যেন নতুন করে শিখছে! শিখছে এমন কিছু, যা কোনদিন কোনো ওস্তাদ তাকে বলেননি, যা কোনো দিন সে কোনো কেতাবেও পড়েনি।

শন শন শব্দে বয়ে যাওয়া বাতাসের গুঞ্জনের মাঝেও যে সূর লহরী আছে! নিকষ আঁধারেরও যে একটা মনোহরী রুপ আছে, রুক্ষ পাথরের গায়েও যে খোদাই করা থাকে ইতিহাসের পাঠ, দর্শনের সুত্র, তা তার জানা ছিল না।

অবুঝ, অবোধ পশুর জীবনাচারের মধ্যেও যে একজন মানুষের শেখার মত শৃংখলাবোধ থাকে, তা তো কোনো ওস্তাদ কোনো দিন বলেননি! মসজিদ নয়, খানক্বাহ নয়, মরুর নির্জন পরিবেশেও যে ঐ আকাশের মালিকের সাথে মন খুলে কথা বলা যায়, মিনতি জানানো যায়, তা তার জানা ছিল না। কেউ কোনদিন তাকে সে কথা বলেনি!

যুবকটির ভাবনার জগতে এক ভিন্ন মাত্রা পায়। তবে কী এই কারণেই আল্লাহপাক তাঁর প্রতিটি নবী রাসুলকে জীবনের কোনো না কোন পর্যায়ে মরুপ্রান্তরে নির্জন বাস করিয়ে নিয়েছেন? এই কারণেই কী তিনি ঐ সব মহামানবদের দিয়ে পশু চারণের মত কাজটাও করিয়ে নিয়েছেন! মহাকুশলী, মহাজ্ঞানী আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কৌশল বোঝে, সে সাধ্য কার?

এভাবেই এক এক করে দিন পার হবার সাথে সাথে পালের ভেড়া-দুম্বাও বাড়তে থাকে। একসময় তা হাজারে এসে ঠেকে। যে যুবক একদিন নি:সঙ্গতার ভয়ে নির্জনাবাসে আসতে চায়নি, আজ সেই তারই মন কেঁদে উঠছে নির্জনতাকে ছেড়ে যেতে! শেষপর্যন্ত যুবকটি ওস্তাদের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো।

বিনম্র, নত যুবক! এককালের প্রিয় ছাত্রটিই আজ আবার ভিন্নরুপে ওস্তাদের সামনে হাজির! নির্জনতাকে ছেড়ে আসতে গিয়েও ছাত্রটি যেন নির্জনতার পুরো মৌনতাকেই নিজের মধ্যে ধারণ করেছে! ওস্তাদ তাকে দেখে মুঁচকি হাসলেন কেবল, কিছুই বললেন না।

নীরবতারও যে একটা ভাষা আছে, ততদিনে যুবকটি তা খুব ভালো করেই জেনেছে। আর তাই ওস্তাদের না বলা কথাও সে বুঝেছে। ওস্তাদ তাকে বুকে জড়িয়ে দোয়া করলেন, আর বাড়ি গিয়ে বৃদ্ধ পিতার সাথে দেখা করতে বললেন।

যুবকটি দ্রত বাড়ির পথ ধরলো। দীর্ঘদিন পরে সন্তান এসে দাঁড়ালো বাবার সামনে। বৃদ্ধ, প্রাজ্ঞ জন্মদাতা পিতা সন্তানকে দেখে তৃপ্তির হাসি হেসে বুকে জড়িয়ে ধরলেন!

হ্যাঁ, আজ যেন মনে হচ্ছে সন্তান তার কিছু শিখে এসেছে! জ্ঞান আর প্রজ্ঞার ভারে সন্তান তার নুয়ে পড়ছে যেন! মৌনতাকে ধারণ করে শিক্ষিত হয়ে এসেছে! সন্তান সেই শিক্ষা শিখে এসেছে, যে শিক্ষা কেউ কাউকে শেখাতে পারে না।

শিখতে হয় নিজে নিজেই। শিখতে হয় প্রকৃতি থেকে, যেখানে কোনো পাঠ নেয়া দেয়া নেই! উপলব্ধি কেবলই হৃদয় দিয়ে! আর তৃতীয় নয়নে বিশ্বকে দেখে দেখে মনের কোণে জ্বালাতে হয় হেরার আলো! এর জন্য প্রয়োজন হয় নীরবতা, নির্জনতা আর গভীর ভাবনাবোধ! এভাবেই মানুষ প্রাজ্ঞ হয়ে উঠে জ্ঞানের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা (Clarity of Knowledge) লাভের মাধ্যমে।



লিখেছেন: জিয়াউল হক

পঠিত : ১৩৩৩ বার

মন্তব্য: ০