Alapon

শুলে ইউকসেল শেনলের: তুরস্কের হিজাব আন্দোলনের অগ্রদূত ।

শুলে ইউকসেল শেনলের, তুর্কি নারী সাংবাদিক ও লেখিকা। মূলত তুরস্কে হিজাব আন্দোলনের রাহবার তিনি। হিজাবের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ বিরোধী আন্দোলন পরিচালনার জন্য তিনি খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। এই আন্দোলন পরিচালনা করতে গিয়ে তাকে কারাগারেও যেতে হয়েছে, কিন্ত তাতেও তিনি দমে না গিয়ে হিজাবী নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করে গেছেন।

১৯৩৮ সালের ২৯শে শুলে ইউকসেল শেনলের তুরস্কের কায়সেরি প্রদেশে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা হাসান তাহসিন শেনলের ও মাতা মিহরিবান উমরান-এর ছয় সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। শুলে ইউকসেল শেনলেরের ছয় বছর বয়সে তার পরিবার ইস্তানবুলে বসবাস শুরু করে।

স্কুলে ৮ম গ্রেডে পড়া অবস্থায় শুলে ইউকসেল পরিবারের আর্থিক অনটন ও মায়ের অসুস্থতার কারণে স্কুল ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। পরিবারকে সহায়তার জন্য এসময় তিনি প্রতিবেশী এক দরজির সহযোগী হিসেবে কাজ শুরু করেন।

স্কুল ছেড়ে দিতে হলেও শুলে ইউকসেল সবসময় পড়তে ভালবাসতেন। যখনই কাজ থেকে অবসর হতেন, বিভিন্ন বিষয়ের উপর বিভিন্ন বই তিনি পড়তেন। তার এই পাঠাভ্যাসই পরবর্তীতে একজন সফল লেখিকা ও সাংবাদিক হিসেবে নিজেকে তৈরি করে নিতে তাকে সাহায্য করেছে।

মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে পত্রিকায় তার লেখা প্রথম গল্প প্রকাশিত হয়। তুর্কি নাট্যকার সাফা ওনেল-এর প্রকাশিত ইয়েলপাযে ম্যাগাজিনে প্রকাশিত এই গল্পের মাধ্যমে তার লেখক জীবনের সূচনা হয়। পরবর্তিতে ইয়েনি ইশতিকলাল পত্রিকায় তরুণদের পাতায় তিনি কলাম লেখা শুরু করেন। এছাড়া তুর্কি কবি ফারুক নাফিয চামলিবেলের সাপ্তাহিক কাদিন পত্রিকায় তিনি প্রবন্ধ লেখতেন। ২১ বছর বয়সে তিনি পেশাদার সাংবাদিক ও লেখিকা হিসেবে কাজ করা শুরু করেন।

যদিও শেনলের পরিবার ছিল রক্ষণশীল প্রকৃতির, তথাপি তারা তৎকালীন রাষ্ট্রশক্তির চাপিয়ে দেওয়া সেক্যুলার জীবন ব্যবস্থায় অভ্যস্ত ছিল। কেননা তৎকালীন সময়ে তুরস্কের অবস্থা ছিল এমন যে, একজন ব্যক্তিকে হয় ধর্মীয়ভাবে জীবন যাপন অথবা শিক্ষা ও চাকরি এই দুই বিষয়ের মধ্যে একটিকে বেছে নিতে হত। বিশেষ করে নারীদের জন্য এই অবস্থা ছিল আরো কঠিন। ফলে শুলে হিজাব ও ধর্মীয় জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন না।

কিন্তু তার বড় ভাই ওযের শেনলের ছিলেন ব্যতিক্রমী চিন্তাভাবনার লোক। তুরস্কে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের চাপিয়ে দেওয়া সেক্যুলার আদর্শের বিপরীতে ইসলামী আদর্শ ও চিন্তাধারার প্রচারকারী তুর্কি আলেম বদিউজ্জামান সাঈদ নূরসীর অনুসারী ওযের তার বোনকে সাঈদ নূরসীর লেখা রিসালায়ে নূর পড়ার জন্য উপদেশ দেন এবং ইসলামী জীবন ব্যবস্থা অনুসারে জীবন যাপনে উৎসাহিত করেন।

শুলে ধীরে ধীরে নূরসীর আন্দোলনের সাথে যুক্ত হন এবং তাদের বিভিন্ন বৈঠকে অংশ গ্রহণ করতে থাকেন। তবে তিনি তখনো হিজাব পরিধানে উৎসাহী ছিলেন না। বিভিন্ন বৈঠকে তার পোশাক সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা হলে তিনি বলতেন,

“আপনারা যদি আমাকে এভাবে গ্রহণ করতে না পারেন, তাহলে আমি আর আসবো না।”

১৯৬৫ সালে ২৭ বছর বয়সে তিনি হিজাব পরিধান শুরু করেন। তিনিই ছিলেন প্রথম তুর্কি নারী সাংবাদিক, যিনি হিজাব পরে তার পেশাগত দায়িত্ব পালন করেন। শুলে ইউকসেল তার কলমকে মুসলিম নারীদের অধিকার রক্ষা ও হিজাবের পক্ষে ব্যবহার করতে থাকেন।

পেশাগত দায়িত্বের পাশাপাশি তিনি শুধু হিজাব পরিধানের উপর উৎসাহিত করে একটি নারী বিষয়ক ম্যাগাজিন বের করেন। এখানে হিজাব বিষয়ে বিভিন্ন লেখা ছাড়াও মুসলিম নারীদের জন্য বিভিন্ন ডিজাইনের হিজাবের ছবিও প্রকাশ করা হয়।

একইসাথে তুরস্কের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করে মুসলিম নারীদের হিজাব পরিধানে উৎসাহ প্রদান করে তিনি পাবলিক লেকচার দিতে থাকেন। তার এই কর্মকান্ডে উৎসাহিত হয়ে তুরস্কে নতুন করে অনেক নারীই হিজাব পরিধান করা শুরু করে।

শুলের হিজাব আন্দোলনের কার্যক্রম যে কোন প্রকার বাধা ছাড়াই চলছিল, তা নয়।

১৯৬৭ সালে তার্কিশ উইম্যানস ইউনিয়ন তার লেখা এক প্রবন্ধের প্রেক্ষিতে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ে করে, যে প্রবন্ধে তিনি বলেন,

“প্রত্যেক মুসলিম নারীরই উচিত হিজাব পরিধান করা।”

১৯৭১ সালে তৎকালীন তুর্কি প্রেসিডেন্ট জেভদেত সুনাই আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকল্টি অব ল্যাঙ্গুয়েজ, হিস্টরি অ্যান্ড জিউগ্রাফিতে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে ভাষণ দান কালে বলেন,

“রাস্তায় হিজাবী নারীর বেড়ে যাওয়ার পেছনে যারা আছে, তাদের শাস্তি দেওয়া হবে।”

প্রেসিডেন্টের এই মন্তব্যের প্রেক্ষিতে শুলে ইউকসেল শেনলের এক খোলা চিঠিতে প্রেসিডেন্টকে আল্লাহ ও জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়ার দাবি করেন।

তার এই মন্তব্যের কারণে প্রেসিডেন্টকে অপমানের অভিযোগে তাকে বন্দী করা হয় এবং আট মাসের কারাদন্ড প্রদান করা হয়। পরবর্তীতে জনরোষের কারণে তার দুই মাসের সাজা ক্ষমা করা হলেও শুলে ইউকসেল এই ক্ষমা গ্রহণে অস্বী কৃতি জানান। এসময় তিনি যক্ষ্মায় আক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও সম্পূর্ণ সাজা ভোগ করে জেল থেকে বের হন।

জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তিনি তার হিজাব আন্দোলনের কার্যক্রম অব্যাহত রাখেন।

তার লেখা বিভিন্ন গ্রন্থের মধ্যে, “সাফারিং অব দ্যা ইউথ”, “হোয়াট হ্যাপেন্ড টু আস”, “উইম্যান ইন ইসলাম অ্যান্ড টুডে”, “টিয়ারস অব সিভিলাইজেশন”, “দ্যা গার্ল অ্যান্ড দ্যা ফ্লাওয়ার” ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

তবে তার রচিত উপন্যাস ‘পিস স্ট্রিট’ (Peace Street) বিপুল পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করে। তুর্কিতে ‘হুযুর সোকায়ি’ (Huzur Sokağı) নামে লেখা এই উপন্যাসটি অবলম্বনে ১৯৭০ সালে তুর্কি চলচ্চিত্রকার ইউচেল চাকমাকলি “ইন্টারেকশন অব ওয়েস” (Intersection of Ways) বা তুর্কিতে “বিরলেশেন ইওললার” (Birleşen Yollar) নামে একটি চলচ্চিত্র তৈরি করেন। বিখ্যাত তুর্কি অভিনেত্রী তুরকান শরাই ও অভিনেতা ইযযেত গুনেই এই চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। এছাড়া ২০১২ সালে এই উপন্যাসটি অবলম্বনে একই নামে তুরস্কে একটি টিভি সিরিজ তৈরি করা হয়।

২০১৯ সালের ২৮শে আগস্ট ইস্তানবুলে ৮১ বছর বয়সে শুলে ইউকসেল শেনলের ইন্তেকাল করেন।


লিখেছেন: মুহাম্মদ আল-বাহলুল

পঠিত : ৬৯৬ বার

মন্তব্য: ০