ইতিহাসের রাজনৈতিক পাঠ এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর পরিণতি...
তারিখঃ ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ১২:১১
ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, কোনো সাম্রাজ্য যখন অন্য সাম্রাজ্যকে জয় করার জন্য আক্রমন করে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে, তখন মূলত নিজ সাম্রাজ্য ধ্বংসের বার্তা নিয়েই ফিরে আসে।
ব্যাপারটা আরও একটু সহজ করে বলি। উসমানি সালতানাতের কথা নিশ্চয়ই সকলেই জানেন। আর উসমানি সালতানাতের সুলতান সুলেমান দ্য ম্যাগনেফিশেন্ট এর কথা পৃথিবী জানে। সুলতান সুলেমানের শাসনের শেষের দিকে তিনি কয়েকটি আক্রমনাত্মক জিহাদ পরিচালনা করেন এবং জিহাদে পরাজিত হয়ে ফিরে আসেন। তাঁর এই পরাজয় তাঁর প্রতি সাম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ ও প্রজাসাধারণের আস্থার উপর আঘাত হানে। তখন বিভিন্নজন বিভিন্ন কথা বলতে থাকে। এর দরুন তারা নিজেরা নিজেরাই বেশ কয়েকটি দল উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। আর এভাবেই সাম্রাজ্যের মধ্যে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। যার সর্বশেষ পরিণতি, ধ্বংস। ইতিহাস সাক্ষি, সুলতান সুলেমানের সেই পরাজয়ের কারণে তারপর থেকে ধীরে ধীরে ধ্বংসের দিকে হাটতে থাকে। ১৯১৭ সালে এসে খিলাফত বিলুপ্তির মধ্য দিয়ে সেই ধ্বংস চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে।
এটি রাজনীতির একটি পাঠ। এটি যে শুধু সাম্রাজ্য বা রাজা, বাদশাহদের ক্ষেত্রেই ঘটেছে তা নয়। বর্তমান সময়ের রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষেত্রেও একই পরিণতি ঘটে।
যেমন, বিএনপি আওয়ামীলীগের কাছ থেকে ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের জন্য আক্রমনাত্মক রাজনৈতিক দিক বেঁছে নেয়। আক্রমনাত্মক রাজনীতির স্বভাবগত দিক হচ্ছে, হয় বিজয় নয়তো চিরতরে ধ্বংস। বিএনপি আওয়ামীলীগের বিরুদ্ধে আক্রমনাত্মক রাজনীতে পেরে উঠতে পারেনি। যার ফলাফল স্বরূপ আজ বিএনপির চেয়ারপার্সন জেলখানায় মৃত্যুর প্রহর গুনছে, আর তার দল বিএনপির শেষকৃর্তানুষ্ঠান চলছে। এই আক্রমনাত্মত রাজনীতির চর্চার আগে বিএনপি যে শক্তি নিয়ে রাজনীতি করত, তা এখন আর দেখা যায় না। আগামীতেও দেখা যাবে না। কারণ, আক্রমনাত্মক রাজনীতির খেলায় তারা পরাজিত হয়েছে। অতএব তাদের চিরতরে বিলুপ্তি এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। তবে দলের আদর্শ যতো শক্তিশালী হবে দলের ধ্বংস ততোই ত্বরান্বিত হবে মাত্র।
বাংলাদেশের রাজনীতির আর একটি গুরুত্বপূর্ণ দল হল জামায়াত। বিএনপির জোটের সাথি হিসেবে জামায়াতও আওয়ামীলীগের বিরুদ্ধে আক্রমনাত্মত রাজনীতির খেলায় যোগদান করেছিল। জামায়াতের ক্ষেত্রেও ফলাফলের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। তারাও পরাজিত হয়েছে।
জামায়াত হয়তো ভেবেছিল, এই পরাজয়ের প্রভাব তাদের মূল দলের উপর খুব একটা প্রভাব ফেলবে না। কিন্তু বাস্তবতা হল ভিন্ন। ইতিমধ্যেই জামায়াতের মধ্য থেকে একটি গ্রুপ নতুন একটি রাজনৈতিক দল করার ঘোষণা দিয়েছে। আক্রমনাত্মক রাজনীতির খেলায় জামায়াত যদি বিজয় লাভ করতো, তাহলে আজ তাদের মধ্য থেকে নতুন কোনো রাজনৈতিক দলের আবির্ভাব হতো না। যেকোনো পরাজয়, নেতৃস্থানীয় পরিষদের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তাদের উপর থেকে কর্মীদের আস্থার ঘাটতি তৈরী হয়। এই আস্থার সংকটময় পরিস্থিতি যে দল যতো তাড়াতাড়ি অনুধাবন করে পদক্ষেপ গ্রহণ করবে, সে দল তত কম ভাঙ্গনের মুখোমুখি হবে। ইতিহাসের রাজনৈতিক পাঠ এটাই শিক্ষা দেয়।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, রাজনৈতিক খেলায় পরাজিত হয়ে বিএনপিকে যতোটা নাজুক অবস্থায় দেখা যাচ্ছে, জামায়াতের বেলায় তেমন মনে হচ্ছে না কেন! এর জবাব আগেই দিয়েছি। যে রাজনৈতিক দলের আদর্শ যতো শক্তিশালী সেই রাজনৈতিক দলের ভাঙ্গন বা ধ্বংস ততোটাই ত্বরান্বিত হবে। এই হিসাবনুসারে বিএনপির আদর্শ হয়তো জামায়াতের আদর্শের চেয়ে অনেক বেশি দুর্বল ছিল। যার কারণে, বিএনপি খুব দ্রুতই ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে।
দ্বিতীয়ত, জামায়াতকে কতটা ভুগতে হবে? জনআকাঙ্ক্ষা নামে যে রাজনৈতিক দল আসার ঘোষণা পাওয়া গেছে, ভাঙ্গন কি এখানেই থেমে যাবে?
এই প্রশ্নের জবাব হল, না! এখানেই থেমে যাবে না। এই ভাঙ্গন যদি চূড়ান্ত রূপ নিতে পারে তবে জামায়াতকে আরও ভাঙ্গনের মুখোমুখি হতে হবে। তবে, এই মুহুর্তে জামায়াত যদি ক্যারিশমাটিক নেতৃত্ব দ্বারা পুরো দলকে উদবুদ্ধ করতে পারে তবে এক্ষেত্রে জামায়াতের চেহারা পরিবর্তন হতে পারে। কিন্তু ইতিহাসের শিক্ষা বলে, জামায়াত যদি গতানুগতিক আপন ধারায়, আপন কর্মপন্থায় চলতে থাকে তবে সামনের দিনগুলোতে তাদের জাসদের পরিণতি ভোগ করতে হবে। দল ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে বহুদলে পরিণত হবে। তখন মূল দল কোনটা তা ঠাহর করতেই কূল কিনারা হারিয়ে যাবে।
জামায়াত কী করবে, তা তাদের নীতি-নির্ধারকদের ব্যাপার! কিন্তু ইতিহাস বলে, গতানুগতিকতা যে কোনো সাম্রাজ্য ও রাজনৈতিক দলের ধ্বংসের অন্যতম প্রধান কারণ! যারা এই সংকট উপলবদ্ধি করে নিজেদের ঢেলে সাজাতে পেরেছে, ভবিষ্যতে তারাই বিজয় লাভ করেছে।
মন্তব্য: ০