Alapon

অমুসলিম তবু নেই রেহাই, জামায়াত-শিবির ট্যাগ দিয়ে ৫৪ বুলেটের আঘাতে খুন


হালিমা বেগম এখনো নাতির জন্য কাঁদেন। মা-মরা নাতিটাই ছিল তাঁর একমাত্র অবলম্বন। দুই বছর আগে মিরপুরে হালিমার নাতি রবিনসহ একসঙ্গে তিন কিশোরকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তাদের শরীরে ছিল ৫৪টি গুলির চিহ্ন। এক বছরের বেশি সময় ধরে এ ঘটনা তদন্ত করে আদালতে দেওয়া প্রতিবেদনে পুলিশ নিহত কিশোরদের নাম-ঠিকানাটা পর্যন্ত লেখেনি। সেখানে তাদের পরিচয় দেওয়া হয়েছে অজ্ঞাতনামা দুষ্কৃতকারী হিসেবে। আর আসামিদের বিষয়ে লেখা হয়েছে, আসামিদের শনাক্ত করা যায়নি, ভবিষ্যতেও শনাক্ত করা যাবে বলে মনে হয় না।


আদালত সেই তদন্ত প্রতিবেদন গ্রাহ্য করেননি। সঠিকভাবে মামলা তদন্ত হয়নি উল্লেখ করে অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। সেই তদন্ত এখনো চলছে। হত্যাকাণ্ডের পরদিন থেকেই তিন কিশোরের মধ্যে দুজনের পরিবার বারবার পুলিশের কাছে ধরনা দিলেও পুলিশ তাদের কোনো কথা শোনেনি। পরিবার দুটি বলেছে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গ থেকে পুলিশের অনুমোদন সাপেক্ষে লাশ নিয়ে দাফন করা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনে পুলিশ তাদের অজ্ঞাতপরিচয় হিসেবে উল্লেখ করেছে। পরিবারগুলোর অভিযোগ, মামলার শুরু থেকেই পুলিশ ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। এ জন্যই তাদের পরিচয় উল্লেখ করেনি।


তিন কিশোর খুনের ঘটনা ঘটে ২০১৫ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে। তখন রাজনৈতিক কর্মসূচি ও জ্বালাও-পোড়াও চলছিল। মিরপুর থানার পুলিশ জানিয়েছিল, এরা জামায়াত-শিবিরের সদস্য। নাশকতা করতে গিয়ে ধরা পড়ার পর গণপিটুনিতে মারা গেছে। কিন্তু নিহত কিশোরদের লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে আনার পর শারীরিক পরীক্ষায় জানা যায়, তিনজনের মধ্যে দুজন অমুসলিম। এই তিনজনের শরীরে পাওয়া যায় 


বুলেটের ৫৪টি চিহ্ন।


অনুসন্ধানে জানা যায়, মিরপুরের কাজীপাড়ার বাইশবাড়ি এলাকার সড়ক থেকে এই তিন কিশোরকে ধরে-বেঁধে নিয়ে গভীর রাতে গুলি করে হত্যা করেন স্থানীয় একদল লোক। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন সরকারদলীয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলে স্থানীয় ব্যক্তিরা জানালেও তাঁদের বিস্তারিত পরিচয় জানা যায়নি। পরে ঘটনা ধামাচাপা দিতে উঠেপড়ে লাগে পুলিশ। হত্যা ঘটনার পরদিন ঘটনাস্থলে গুলির খোসা, রক্তাক্ত দড়ি দেখা গেলেও পুলিশ জব্দ তালিকায় তা উল্লেখ করেনি।


নিহত কিশোরদের পরিচয়


নিহত কিশোরেরা হলো সুমন রবিদাস, রবিন ও জুয়েল। সুরতহাল প্রতিবেদনে তাদের বয়স ১৮ বছরের বেশি লেখা হলেও পরিবারের সদস্যরা বলছেন, তাদের কারোরই বয়স ১৫ বছরের বেশি নয়। সবাই কালশী কবরস্থান বস্তিতে থাকত। সুমন ও রবিন বাস ও হিউম্যান হলারে চালকের সহকারী (হেলপার) হিসেবে কাজ করত। জুয়েল পোশাক কারখানায় কাজ নিয়েছিল। সুমনের বাবা জনি রবিদাস পেশায় মুচি, মা জ্যোৎস্না বেগম গৃহকর্মী। ছয় ভাইবোনের মধ্যে সুমন তৃতীয়।


রবিনকে ৪০ দিনের রেখে তার মা মারা যান। বাবাও সংসারবিবাগী হন। সেই থেকে দাদি হালিমা বেগম রবিনকে লালন-পালন করছিলেন। রবিন খুন হওয়ার পর এখন দাদিকেও অন্যের বাসায় কাজ করতে হচ্ছে। আর জুয়েলের বাবা-মায়ের কোনো খোঁজ পাওয়া যায় না। ওই এলাকায় মাকুল নামের এক হিজড়ার সঙ্গে থাকত জুয়েল। তবে জুয়েলের লাশ গ্রহণ করতে পারেননি মাকুল। অজ্ঞাতপরিচয় হিসেবেই সরকারি ব্যবস্থাপনায় জুয়েলের শেষকৃত্য হয়। বাকি দুই কিশোরের লাশ পরিবার বুঝে নেয়।


সুমনের মা জ্যোৎস্না বেগম বলেন, সুমন নিখোঁজ হওয়ার পরদিন তিনি মিরপুর মডেল থানায় যান। সুমনের ছবি দেখে থানা থেকে ঢাকা মেডিকেল মর্গে যেতে বলা হয়। তিনি পরদিন মর্গে গিয়ে লাশ গ্রহণ করে লালবাগে দাফন করেন। এরপর একাধিকবার মামলা করার জন্য থানায় যান, কিন্তু পুলিশ মামলা নেয়নি। পরে তিনি আদালতে গিয়ে একটি মামলা করেন। সেই মামলায় ইসমাইল, রাসেল, রনি ও মনিরুল নামে স্থানীয় চারজনকে আসামি করেন। মামলায় উল্লেখ করা হয়, এই চারজন সুমনকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে যান।


কালশী কবরস্থান এলাকায় ইসমাইল, রাসেল, রনি ও মনিরুল সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তাঁরা স্থানীয় ছিঁচকে সন্ত্রাসী। এলাকায় চাঁদাবাজি করেন। ক্ষমতাসীন দলের মিছিল-মিটিংয়েও তাঁদের দেখা যায়। 


প্রত্যক্ষদর্শীর বক্তব্য


স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মিরপুরের কাজীপাড়ার বাইশবাড়ি এলাকায় কৃষিবিদ ভবনের পেছনে এক কানা গলিতে নিয়ে তিন কিশোরকে হত্যা করা হয়। তখন ওই এলাকায় পয়োনিষ্কাশন পাইপ বসানোর জন্য খোঁড়াখুঁড়ি চলছিল। ঘটনার পরদিন সেখানকার মাটিতে কিছু গুলির খোসা ও পিলেট (গুলির অগ্রভাগ), রক্তমাখা নাইলনের দড়ির গোছা পড়ে ছিল। কিন্তু এসব কিছুরই উল্লেখ নেই জব্দ তালিকায়।


স্থানীয় একজন নিরাপত্তারক্ষী বলেন, অনেক হইহল্লা হইছিল তখন। দড়ি দিয়া বান্ধি নিছিল।কারা ছিল জানতে চাইলে ওই নিরাপত্তারক্ষী বলেন, নাম কবার পারব না বাবা, আপনি খুঁজি নেন। সব ক্ষমতাওয়ালা লোক। কোন দিকে নেওয়া হয়েছিল জানতে চাইলে তিনি যুবলীগের ১৪ নম্বর ওয়ার্ড কার্যালয়ের দিকে ইশারা করেন। গভীর রাতে তিনি গুলির শব্দও শুনেছিলেন বলে জানান।


এলাকার স্থানীয় আরও এক ব্যক্তি মহানগর যুবলীগের একজন প্রভাবশালী নেতার দিকে এই ঘটনায় যুক্ততার বিষয়ে ইঙ্গিত দিলেও সুনির্দিষ্ট তথ্য মেলেনি।


পুলিশের মামলা


তিন কিশোর খুনের ঘটনা নিয়ে ২৩ ফেব্রুয়ারি মিরপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মাসুদ পারভেজ একটি মামলা করেন। সেই মামলায় বলা হয়, ২০-দলীয় জোটের হরতাল ও ধর্মঘট সফল করার উদ্দেশ্যে পল্লবী থানা এলাকা থেকে ১০ জনের একটি সংঘবদ্ধ দুষ্কৃতকারী বোমাবাজ দল গাড়ি ভাঙচুর ও যাত্রী হত্যার উদ্দেশ্যে রোকেয়া সরণির কৃষিবিদ ভবনের সামনে জড়ো হয়। রাত পৌনে ১০টার দিকে ককটেল ও পেট্রলবোমা হামলার আগে উপস্থিত জনতা টের পেয়ে তাদের ধাওয়া করে। পালিয়ে যাওয়ার সময় ওই তিনজনকে আটক করে পিটুনি দেয় এবং গুলি করে হত্যা করে। ওই মামলার জব্দ তালিকায় দুই লিটার পেট্রল, তিনটি পেট্রলবোমা ও দুটি ককটেলের কথা উল্লেখ করা হয়।


তদন্ত


প্রায় ১৭ মাস ঘটনাটি তদন্ত করে মিরপুর থানার পুলিশ। প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন উপপরিদর্শক (এসআই) সৈয়দ আসাদুজ্জামান। এরপর তদন্তের দায়িত্ব পান এসআই ইমরুল ফাহাদ। সবশেষে মামলাটি তদন্ত করেন এসআই অজিত কুমার রায়। তিনিই মামলাটির তদন্ত শেষ করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করেন।


মামলার তদন্ত প্রতিবেদনে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে এজাহারের বক্তব্যই তুলে ধরা হয়। তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ঘটনার সঙ্গে জড়িত আসামিদের শনাক্ত করা যায়নি এবং ভবিষ্যতেও শনাক্ত করা যাবে মর্মে মনে হয় না।


যোগাযোগ করা হলে এসআই অজিত কুমার রায় বলেন, পরে নিহত তিন কিশোরের মধ্যে দুজনের পরিচয় জানতে পেরেছেন, যা মামলার নথিতে যুক্ত করেন। ঘটনার সঙ্গে যুক্ত কোনো আসামিকে শনাক্ত না করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি তো মামলাটা পেয়েছি অনেক পরে নিহত সুমনের মা জ্যোৎস্না ও রবিনের দাদি হালিমা খাতুন বলেছেন, পুলিশ আগাগোড়া সব জানলেও তাঁদের বক্তব্য শোনেনি।


আদালতের প্রত্যাখ্যান


এই প্রতিবেদন দাখিলের পর গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর অধিকতর তদন্তের আদেশ দিয়ে ঢাকার মহানগর হাকিম মাজহারুল ইসলাম বলেন, এটি একটি হত্যা মামলা। এই তিনজনের পরিচয় সংগ্রহের জন্য বাস্তবে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে মর্মে প্রতীয়মান হয়নি। এতেই সঠিকভাবে মামলা তদন্ত হয়নি বলে প্রতীয়মান হয়। তাই মামলার অধিকতর তদন্ত প্রয়োজন। মামলাটি যত্নসহকারে তদন্তের জন্য ডিসি ডিবিকে (পশ্চিম) আদেশ দেওয়া হলো।


যোগাযোগ করা হলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির উপপরিদর্শক (এসআই) রফিকুজ্জামান বলেন, নিহত দুজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। একজনের নাম রবিন, আরেকজনের নাম শাহীন (যদিও শাহীন নামে কাউকে প্রথম আলোর অনুসন্ধানে পাওয়া যায়নি)। অন্যজনের পরিচয় পাওয়া যায়নি। তিনি বলেন, গণপিটুনিতে নিহত হলে তো নিহতদের শরীরে গুলি পাওয়ার কথা না। সে বিষয়টিরও তদন্ত হচ্ছে।


( বিস্তারিতঃ https://goo.gl/E1giXJ )

পঠিত : ১০১৮ বার

মন্তব্য: ০