Alapon

অভিভাবক কীভাবে প্রতিপক্ষ হতে পারে?



পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছেন সাকিব আল হাসানরা। বাংলাদেশের মানুষের গর্বের শেষ নেই তাদের নিয়ে। সারা বাংলাদেশ এক সঙ্গে আনন্দে উদ্বেলিত হয় সাকিব আল হাসানদের সাফল্যে। অতি ক্ষুদ্র কিছু বিতর্ক থাকলেও, সাকিবদের ক্রিকেটের প্রতি-দেশের প্রতি-দেশের মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা-ভালোবাসার ঘাটতি আছে, এমনটা কখনো সামনে আসেনি। ক্রীড়াক্ষেত্রে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অঙ্গনের একমাত্র গর্বের বিষয় ক্রিকেট ও ক্রিকেটাররা। সেই ক্রিকেট ও ক্রিকেটারদের বিরুদ্ধে দেশ বিরোধী ‘ষড়যন্ত্র’র অভিযোগ আনছেন স্বয়ং ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি। কোনো ষড়যন্ত্রকারী কোনো বিবেচনাতেই দেশের প্রতিনিধিত্ব করতে পারেন না। পাপন নিশ্চিত করে বলেছেন, একটু সময় দিলেই তিনি ষড়যন্ত্রকারীদের খুঁজে বের করে ফেলবেন। সাকিবরা যদি ষড়যন্ত্রকারী হয়, বাংলাদেশের হয়ে ক্রিকেট খেলবেন কে, কারা? সভাপতির ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’র পেছনে ‘ভ্রম’ বা ‘কল্পনা’ কাজ করছে না তো? আমরা একটু নাজমুল হাসান পাপনের সংবাদ সম্মেলনের দিকে ফিরে তাকাই।

১. পুরো সংবাদ সম্মেলনে নাজমুল হাসান পাপনের শারীরিক অঙ্গভঙ্গি গভীরভাবে বিশ্লেষণের দাবি রাখে। তার শরীরী ভাষা ও বক্তব্য গবেষণা-বিশ্লেষণ হওয়া জরুরি, বাংলাদেশের ক্রিকেটের স্বার্থেই। দু’একটি বিষয় সুনির্দিষ্ট করে উল্লেখ করলে হয়তো বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে, গবেষণা-বিশ্লেষণের দাবি শক্ত ভিত্তি পাবে।

ক. পাপন বলছেন, শ্রীলঙ্কা থেকে ফেরার পথে বিমানবন্দেরের লাউঞ্জে মাশরাফি ও তামিম আমার কাছে এসে বলল, আমাদের বেতন একটু বাড়িয়ে দেন। আমি বললাম, বাড়ালাম তো। এখন কত পাও? তারা বলল, আড়াই লাখ। একজন বলল, একটু বেশি করে বাড়িয়ে দেন। আরেকজন বলল, ৫০ হাজার টাকা বাড়িয়ে দেন। ৫০ হাজার টাকা বাড়ালে কত হয়, ৩ লাখ? ঐখানে বসেই বললাম, যাও ৪ লাখ। তোমাদের বেতন ৪ লাখ।

‘বিসিবি’ বাংলাদেশের ক্রিকেট বোর্ড হলেও, তার পরিধি আন্তর্জাতিক অঙ্গন পর্যন্ত বিস্তৃত। আইসিসির নিয়মানুযায়ী একটি নির্বাচিত পরিচালনা পর্ষদ অনুযায়ী বোর্ড পরিচালিত হওয়ার কথা। ক্রিকেটারদের বেতন বাড়ানো বা সুযোগ সুবিধা সংক্রান্ত যে কোনো সিদ্ধান্ত হবে, বোর্ড পরিচালকদের আলোচনা-সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে।

নাজমুল হাসান পাপনের বক্তব্য অনুযায়ী, বিমানবন্দরের লাউঞ্জে বসে কোনো পরিচালকের সঙ্গে আলোচনা না করে, মিটিং না করে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন তিনি একা। এমন সিদ্ধান্ত সাধারণ কারও ব্যক্তিগত বা পারিবারিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে নেয়ার নজির দেখা যায়। বিসিবি কারও ব্যক্তিগত বা পারিবারিক প্রতিষ্ঠান নয়। বিসিবি রাষ্ট্রীয় এবং আন্তর্জাতিক নিয়ম-নীতি দ্বারা পরিচালিত প্রতিষ্ঠান। সেই প্রতিষ্ঠানের সিদ্ধান্ত সভাপতি বা একক কোনো পরিচালক মিটিং-আলোচনা ছাড়া নিতে পারেন না। কিন্তু নাজমুল হাসান পাপন নিচ্ছেন।

খ. একজন পরিচালক এসে তার কাছে বলছেন, ক্রিকেটাররা এটা চাচ্ছেন না। আর তিনি বলে দিচ্ছেন, ঠিক আছে ক্রিকেটাররা যদি না চায় তো হবে না। এর জন্যেও কোনো মিটিং বা আলোচনা করছেন না।

এই দুটি ঘটনা দিয়ে বোঝা যায়, বিসিবি কতটা অগণতান্ত্রিক, অপেশাদার ও সভাপতির একক কর্তৃত্ববাদী প্রক্রিয়া দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে।

২. ‘ক্রিকেটাররা খেললে খেলবে, না খেললে নাই’- ক্রিকেটারদের নিয়ে কতটা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ও কর্তৃত্ববাদী মানসিকতা ধারণ করলে বোর্ডের সভাপতি হয়ে এমন কথা বলা যায়!

বাংলাদেশের ক্রিকেটের আজকের যে অবস্থান, তা ক্রিকেটারদের কারণে। বোর্ড বা কর্মকর্তাদের অবদান অনস্বীকার্য। সেই কর্মকর্তা কারা? সৈয়দ আশরাফুল হক, সাবের হোসেন চৌধুরীরা। প্রতিকূল সময়ে ওয়ানডে স্ট্যাটাস, টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার নেপথ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন তারা। তারপরও তাদের ভূমিকা দিয়ে কিছু হতো না, যদি না ক্রিকেটাররা ভালো খেলতেন। বাংলাদেশের ক্রিকেট ও ক্রিকেট বোর্ডের সংগ্রামের সময়ে নাজমুল হাসান পাপন কোথাও ছিলেন না। তিনি বিসিবি দায়িত্বে নিয়েছেন সুসময়ে। যখন ক্রিকেট বোর্ড অন্যতম ধনী প্রতিষ্ঠান। ক্রিকেট বোর্ড যে ধনী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে, তা ক্রিকেটারদের অবদানে। কোনো কর্মকর্তা বা সভাপতির অবদানে নয়।

ক্রিকেটারদের কত সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়েছে, চ-ব্বি-শ কোটি টাকা বোনাস দেয়া হয়েছে! বোর্ড সভাপতি বিস্মিত হয়ে যে অঙ্গভঙ্গিতে এ কথা বলছেন, তাতে মনে হয় ব্যক্তিগত অর্থ থেকে তিনি তা দিয়েছেন।

ক্রিকেটাররা ভালো খেলেছেন বলেই বোর্ডে টাকা এসেছে। সেই টাকা ক্রিকেটারদের দেয়া হয়েছে। এতে সভাপতি বা কর্মকর্তাদের বিস্মিত হওয়ার কী আছে? আয় অনুযায়ী ক্রিকেটাররা অর্থ পাবেন। ২৪ কোটি কেন, ২৪’শ কোটিও হতে পারে। ক্রিকেটাররা বেশি টাকা পেয়ে গেলেন বলে কর্মকর্তাদের দুঃখ বা মনঃকষ্টে ভোগার কারণ কী?

কোনো ক্রিকেটারের বাচ্চা অসুস্থ, ব্যক্তিগতভাবে ভিসা করায় সহায়তা করেছেন, তা সংবাদ সম্মেলনে বলার বিষয়? বোর্ড যদি প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতিতে পরিচালিত হতো, তবে তো ব্যক্তিগত সহায়তার প্রশ্নই আসত না।

ঘরোয়া ক্রিকেটে পাতানো খেলার অভিযোগ, এক ওভারে (চার বলে) ৯২ রান দেয়ার অভিযোগ তো প্রকাশ্যে এসেছে। বছরের পর বছর ধরে তা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। কোনো তদন্ত-ব্যবস্থা না নিয়ে বলছেন সিসিটিভি ক্যামেরা লাগিয়েছেন? পাতানো বা পূর্ব নির্ধারিত ফলাফল ধরার এই ‘সিসিটিভি ক্যামেরা’ পদ্ধতির আবিষ্কারক বিসিবি। আবার বলছেন, আর কী করতে পারি? এই প্রশ্ন করে কি পদে থাকা যায়?

৩. খুবই যৌক্তিক একটি কথা, ক্রিকেটাররা দাবিগুলো বোর্ডের কাছে না তুলে সরাসরি ধর্মঘটে গেলেন কেন? বাংলাদেশের ক্রিকেটের আইকন মাশরাফি বিন মর্তুজাকেই বা পূর্বে কিছু জানানো হলো না কেন? অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই প্রশ্ন দু’টির গ্রহণযোগ্য জবাব বা ব্যাখ্যা ক্রিকেটারদের কাছে আছে কিনা জানি না। তবে প্রশ্ন দু’টি সামনে আসার সুযোগ দিয়ে ক্রিকেটাররা নিজেদের অদূরদর্শিতার পরিচয় দিলেও, তাদের আচরণে নমনীয়তা-শিষ্টাচার দৃশ্যমান ছিল। তার উত্তরে বোর্ড সভাপতির ভাষা ও আচরণ ছিল চরম ঔদ্ধত্যপূর্ণ। দেশের গর্ব ক্রিকেটারদের প্রতি সামান্যতম সম্মান-শ্রদ্ধা না দেখিয়ে, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে কথা বলেছেন তিনি।

যদিও কারোরই অজানা নয় যে, ক্রিকেটাররা যে ১১ দফা দাবি সামনে এনেছেন, তা গত কয়েক বছর ধরে বারবার বিসিবির সামনেও তুলে ধরেছেন। কিন্তু বিসিবি দাবিগুলো বিবেচনায় নিয়ে প্রতিকার করেনি। তারপরও বিষয়টি যদি এমন হয় যে, ক্রিকেটাররা ধর্মঘটে গিয়ে ঠিক করেননি, দাবিগুলো বোর্ডকে আনুষ্ঠানিকভাবে না জানিয়ে ভুল করেছেন, তাহলেও কী বোর্ড সভাপতির বাচন-ভঙ্গি, বক্তব্য এমন হতে পারে? বোর্ড সভাপতি মানে তিনি বাংলাদেশ ক্রিকেটের অভিভাবক। অভিভাবকের ভালো-খারাপ আচরণের বেশ কিছু নজির ক্রিকেট বিশ্বে আছে। অস্ট্রেলিয়ান বোর্ডের সঙ্গে যখন ক্রিকেটারদের বিরোধ দেখা দেয়, তখন বোর্ড সভাপতির অভিভাবকসুলভ বিচক্ষণতা ও বিবেচনাবোধ দেখেছিল ক্রিকেট বিশ্ব। রক্ষা পেয়েছিল অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট। বিচক্ষণতা ও বিবেচনাবোধের অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জিন্বাবুয়ে বা কেনিয়ার ক্রিকেট। আমাদের অভিভাবক অস্ট্রেলিয়ার দৃষ্টান্ত অনুসরণ না করে হাঁটছেন জিম্বাবুয়ে বা কেনিয়ার পথে। এর মধ্য দিয়ে প্রমাণ হচ্ছে, অভিভাবক হিসেবে তিনি কতটা অদক্ষ। ক্রিকেটারদের সঙ্গে বসে যা দশ মিনিটে সমাধান করা যেত, তা তিনি জটিল করে ফেলেছেন। পদবি তাকে অভিভাবকের দায়িত্ব দিলেও, আচরণে তিনি নিজেকে ক্রিকেট ও ক্রিকেটারদের প্রতিপক্ষে পরিণত করেছেন। প্রতিপক্ষ হয়ে অভিভাবক হওয়া যায় না, পদেও থাকা যায় না। তার এবং তার নিয়োগদাতাদের উপলদ্ধিতে বিষয়টি আসা দরকার।

বিষয়টি দৃশ্যমানভাবে সামনে এসেছে, সঠিক পথে নেই বাংলাদেশের ক্রিকেট। পথ হারিয়েছে বা হারাতে যাচ্ছে বাংলাদেশের ক্রিকেট। যার দায় ক্রিকেটারদের নয়, বোর্ড কর্তাদের। ক্রিকেটারদের স্বার্থ দেখার প্রতিষ্ঠান ‘কোয়াব’ নেতাদের বিসিবিতে নিয়োগ দেওয়া, কোনো সুস্থ লক্ষণ হতে পারে না। গঠনতন্ত্র পরিবর্তন করে কোনো কোনো ঘরোয়া ক্লাবকে দু’টি ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা করা, বড় রকমের প্রশ্নবিদ্ধ বিষয়।

৪. বোর্ড সভাপতির শরীরী ভাষা ও বক্তব্য সম্ভবত শুধু তার-ই নিজস্ব নয়। তাহলে বোর্ড-ক্রিকেটার মুখোমুখি, এই পরিস্থিতির পরিণতি কী? এমন একটি পরিবেশ কী তৈরি হতে যাচ্ছ, যাতে দাবি থেকে সরে আসতে বাধ্য হবেন ক্রিকেটাররা? বোর্ড সভাপতির ভাষায় যারা দেশের ক্রিকেট ধ্বংসের ষড়যন্ত্রকারী! এই ‘ষড়যন্ত্রকারী’দের বাধ্য করা হবে বা তারা বাধ্য হয়ে অখুশি মনে মাঠে নামবেন?

বোর্ড সভাপতি অভিভাবক। অভিভাবক যখন প্রতিপক্ষ হয়ে যায় তখন অভিভাবকের পদটি প্রশ্নবিদ্ধ হতে বাধ্য।

পঠিত : ১৩৪৮ বার

মন্তব্য: ০