Alapon

কুরআন ও হাদীসের দৃষ্টিতে জ্ঞান এবং জ্ঞানীর মর্যাদা...


পৃথিবীর শুরু থেকেই জ্ঞান এবং জ্ঞানীর মর্যাদা লক্ষ্য করা যায়। জ্ঞান এমন একটি বিষয় যা কখনো কোনো অবস্থাতেই উপেক্ষার স্বীকার হয়নি; সাথে জ্ঞানী ব্যক্তিরাও। অতীতের সাম্রাজ্য ব্যবস্থায় দেখা যেত, রাজা-বাদশাহ কিংবা সম্রাটরা সভাকবি রাখতেন। রাষ্ট্রিয় খরচে তাদের জীবন-যাপনের ব্যবস্থা করা হতো। সেই সাথে সভাকবিদের শুধু কবিই নয়, বুদ্ধিজীবি হিসেবেও গন্য করা হয়। আর বুদ্ধিজীবিদের কদর সভ্যতার সেই শুরু থেকেই চলে আসছে। বুদ্ধিজীবি হয় কারা, যারা জ্ঞান অর্জন করে এবং জ্ঞানকে সঠিক কাজে লাগানোর সামর্থ্য রাখে।

জ্ঞানীদের মর্যাদার খানিক নমুনা ইসলাম আবির্ভাবের পূর্বে ওরাকা ইবনে নওফেল-কে দিয়েও পাওয়া যায়। ওরাকা ছিলেন রাসূল সা. এর স্ত্রী খাদিজা রা. এর দুঃসম্পর্কের খালাতো ভাই। হেরা গুহায় জিব্রীল আমীন রাসূল সা. এর কাছে যখন ওহী নাযিল করেন তখন রাসূল সা. প্রচন্ড ভয় পেয়ে যান। জিব্রীল আমীনের বিশাল ডানায় ভর করে চলা দেখে রাসূল সা. এতোটাই ভয় পেয়ে যান যে, ভয়ের চোটে জ্বর এসে যায়। রাসূল সা. বাড়ি ফিরে স্ত্রীকে সমস্ত ঘটনা খুলে বলেন এবং কম্বল দিয়ে আবৃত করতে বলেন। খাদিজা রা. সব কথা শুনে প্রথমেই ওরাকা ইবনে নওফেলের কথা স্মরণ করেন। কারণ, ওরাকা ছিলেন তৎকালীন সময়ের সবচেয়ে জ্ঞানী এবং বিচক্ষণ মানুষ। অথচ ওরাকা ছিলেন একজন অমুসিলম; অমুসলিম হওয়া স্বত্ত্বেও আল্লাহর রাসূল এবং উম্মুল মুমিনীন খাদিজা রা. তাকে গুরুত্ব ও সম্মান দিয়েছিলেন। কারণ, তিনি সত্যিকার অর্থেই একজন জ্ঞানী ব্যক্তি ছিলেন।

আমাদের ইসলাম ধর্মও কিন্তু জ্ঞান অর্জন করার জন্য তাগাদা দিয়ে থাকে এবং একই সাথে জ্ঞানী ব্যক্তিদের সম্মান দিয়ে থাকে। তাহলে চলুন দেখি কুরআন এবং হাদীসের আলোকে জ্ঞান এবং জ্ঞানীর মর্যাদা।

প্রথমেই দেখে নেই কুরআনের দৃষ্টিতে জ্ঞান এবং জ্ঞানীর মর্যাদা।

এই বিষয়ে প্রথমেই দেখুন মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের অতীব মর্যাদাপূর্ণ বাণীঃ
‘'তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান আনে এবং যাদেরকে জ্ঞান দান করা হয়, আল্লাহ তাদেরকে সুউচ্চ মর্যাদা দান করেন।’' (সূরা মুজাদালা-১১)

'‘ওদের জিজ্ঞেস করো, জ্ঞানীরা আর অজ্ঞরা কি সমান হতে পারে?'’ ( সূরা আয যুমার-৯)

'‘আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে কেবল জ্ঞান সম্পন্ন লোকেরাই তাঁকে ভয় করে।’' (সূরা ফাতির-২৮)

‘এবং সুবিচারের উপর প্রতিষ্ঠিত জ্ঞানী লোকেরাও এই সাক্ষ্যই দেয় যে মহাপরাক্রমশালী বিজ্ঞানময় আল্লাহ ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই।’ ( সূরা আল ইমরান- ১৮)

'‘কিতাবের জ্ঞান ছিলো এমন এক ব্যক্তি বললো, আমি আপনার চোখের পলকের মধ্যেই ওটি 'সাবার রাণীর সিংহাসন’ এনে দিচ্ছি।'’ (সূরা নামল -৪০)

‘'কিন্তু জ্ঞানের অধিকারী লোকেরা বললো: তোমাদের অবস্থার জন্য ‍দুঃখ হয়। যে ব্যক্তি ঈমান আনে এবং আমলে সালেহ করে, তার জন্যে তো আল্লাহর পুরষ্কারই উত্তম।'‘ ( সূরা আল কাসাস-৮০)

‘'জ্ঞানের অধিকারী লোকদের অন্তরে তো এগুলো উজ্জ্বল নিদর্শন।’' (সূরা আনকাবুত-৪৯)

‘'আল্লাহ তোমাদের পরিবর্তে তাকে মনোনীত করেছেন, কারণ তিনি তাকে অঢেল মানসিক (জ্ঞানগত) ও শারীরিক যোগ্যতা দান করেছেন।’' ( সূরা আল বাকারা-২৪৭)

‘'আল্লাহকে সেভাবে স্মরণ করো, যেভাবে তিনি তোমাদের শিক্ষা দিয়েছেন।’' ( সূরা আল বাকারা- ২৩৯)

‘'এমন কোনো জিনিসের পেছনে লেগে পড়ো না, যে বিষয়ে তোমাদের জ্ঞান নেই।'’ ( সূরা বনি ইসরাইল-৩৬)

এবার আসুন দেখি হাদীসের দৃষ্টিতে জ্ঞান এবং জ্ঞানীর মর্যাদা।

রাসূল সা. বলেছেন, ‘আল্লাহ যার কল্যাণ চান, তাকে দীনের সঠিক বুঝ-জ্ঞান দান করেন।’ (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)

রাসূল সা. বলেছেন, ‘ সোনা রূপার খনির মতো মানুষও খনি। তাদের মধ্যে যারা ইসলাম গ্রহণের পূর্বে উত্তম ছিল, দীনের সঠিক বুঝ-জ্ঞান লাভ করতে পারলে ইসলাম গ্রহণের পরে তারা উত্তমই হয়ে থাকে।’ ( সহীহ মুসলিম)

রাসূল সা. বলেছেন, ‘জ্ঞান ও বিজ্ঞানের কথা জ্ঞানী ও বিজ্ঞানীদের হারানো সম্পদ। সুতরাং যেখানেই তা পাওয়া যাবে, প্রাপকই তার অধিকারী।’ ( ইবনে মাজাহ)

রাসূল সা. বলেছেন, ‘ইসলামের একজন সঠিক জ্ঞানের অধিকারী ব্যক্তি শয়তানের কাছে হাজারো (অজ্ঞ) ইবাদত গুজারের চাইতে ভয়ংকর।’ ( ইবনে মাজাহ)

রাসূল সা. বলেছেন, ‘জ্ঞানান্বেষন করা প্রত্যেক মুসলিমদের একটি অবশ্য কর্তব্য কাজ।’ (ইবনে মাজাহ)

রাসূল সা. বলেছেন, ‘ দীনের অধিকারী ব্যক্তি কতোইনা উত্তম মানুষ। তার কাছে এলে তিনি তাদের উপকার করেন, আর না এলে তিনি কারও ‍মুখাপেক্ষি হন না।’ (মিশকাত)

রাসূল সা. বলেছেন, ‘জ্ঞানের আধিক্য (নফল) ইবাদাতের আধিক্যের চেয়ে উত্তম। ‘ (বায়হাকি)

রাসূল সা. বলেছেন, ‘সর্বোত্তম মানুষ হলো তারা যারা জ্ঞানীদের মধ্যে উত্তম।’ (দারেমি)

রাসূল সা. বলেছেন, ‘ যে ব্যক্তি জ্ঞানার্জনের কোনো পথ অবলম্বন করে, তার দ্বারা আল্লাহ ঐ ব্যক্তির জন্যে জান্নাতের একটি পথ সহজ করে দেন। যখন কিছু লোক আল্লাহর কোনো ঘরে একত্রিত হয়ে আল্লাহর কিতাব (কুরআন) পড়ে এবং নিজেদের মাঝে তার মর্ম আলোচনা করে তাদের উপর নেমে আসে প্রশান্তি, ঢেকে নেয় তাদেরকে আল্লাহর রহমত, পরিবেষ্টিত করে তাদেরকে ফেরেশতাকূল। তাছাড়া আল্লাহ তাঁর কাছের ফেরেশতাদের নিকট তাদের কথা আলোচনা করেন।’ (সহীহ মুসলিম)

রাসূল সা. বলেছেন, ‘ফেরেশতারা জ্ঞানান্বেষণকারীদের জন্যে নিজেদের ডানা বিছিয়ে দেয়।’ ( মুসনাদে আহমদ)

রাসূল সা. বলেছেন, ‘জ্ঞান লাভে নিরত ব্যক্তি তা থেকে বিরত না হওয়া পর্যন্ত আল্লাহর পথে জিহাদে লিপ্ত বলে গণ্য হবে।’ ( তিরমিযি)

আল্লাহ আমাদের জ্ঞান অর্জনে আরও আগ্রহী করে তুলুন এবং প্রকৃত জ্ঞানের অধিকারী হবার তৌফিক দান করুন।

পঠিত : ৯৭১ বার

মন্তব্য: ০