Alapon

সূফিবাদের শেকড় সন্ধান ও ইসলামপন্থী রাজনীতি...


প্রথমেই বলে নেয়া ভালো... সূফিবাদ বলতেই আমাদের চোখ ও ধারনায় সাধারন গৎবাধা কিছু দৃশ্য ভেসে উঠে। কোন বুজুর্গ আউলিয়ার মাজার ঘিরে তার ভক্ত আশেকদের আসর, জোরে উচ্চ স্বরে সমবেত জিকির, কারামত কাশাফতের অলৌকিক ইতিহাস / লোকগাথা ... ইত্যাদি ইত্যাদি।

আসলে সূফি বা সূফিবাদ বলতে এগুলো কিছু না। এগুলোর সবই সূফি ধারার ইতিহাসে নানা রকম বিকৃতির উপসর্গ আনুষ্ঠানিকতা। একটা বিষয় আমাদের খুব ভালো করে বুঝতে হবে... আজকে সূফি বলতে আমরা যেমন চট করে একটা নির্দিষ্ট কালচার রসম রেওয়াজ বুঝে ফেলি... ইসলাম ও মুসলমানদের ইতিহাসে সূফি বলতে আসলে কোন নির্দিষ্ট ধারার টার্মিনলোজির প্রচলন ছিলো না। যেমনটি ইসলাম ও মুসলিম ইতিহাসে " সালাফি " বলতে কোন গ্রুপ বা নির্দিষ্ট ধারা বা জামায়াতের অস্তিত্ব ছিলো না৷ ইসলামের ইতিহাসে সালাফদের পথ অনুসরনের দাবীটা শুরু থেকেই ছিলো। কিন্তু সুনির্দিষ্ট কোন মাজহাব বা অনুসারীদের কোন গ্রুপ ১৯০০ শতকের আগে নিজেদের " সালাফি " বলে নাম ধারন করেনি। একইভাবে ১৯০০ শতকের আগেও কোন নির্দিষ্ট গ্রুপ বা ধারার অনুসারীরা নিজেদেরকে " সূফি " নামকরন করেননি।

" সূফি " এই টার্মিনলোজির প্রচলনটা মূলত করেছে ইউরোপিয় ইতিহাস গবেষকরা। রাজনীতির অংগনে মুসলিম বিশ্বকে ওহাবি, ননওহাবি, সালাফি, মাজহাবি, সূফি এরকম বিভক্ত করে দেখানোর প্রবনতা ইউরোপিয় ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর ছিলো। তারই ধারাবাহিকতায় পশ্চিমা ওরিয়েন্টালিস্টদের এই
" সূফি " টার্মিনলোজির আবিস্কার।

তবে পশ্চিমা ওরিয়েন্টালিস্টরা " সূফি " শব্দটির শেকড় ঠিক মতো বের করতে পারেনি। কারো মতে রাসুলুল্লাহ হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা ( সাঃ) এর জীবদ্দশায় ইসলামের একাডেমিক জ্ঞান গবেষণার কাজে নিয়োজিত সাহাবাদের বিশেষজ্ঞ গ্রুপ " আসহাবে সুফফা " নাম থেকে সূফি শব্দের উৎপত্তি। আবার কারো কারো মতে... সূফিরা সব সময় সাধারন কম দামী অনারম্বর পোশাক হিসেবে ভেড়ার পশমের তৈরি একটি বিশেষ পোশাক পড়তেন... সেই পোশাকধারিদের বলা হতো " সূফা " মানে আবৃতকারি... সেখান থেকে সূফি শব্দের উৎপত্তি।

আসল কথা হলো ইসলামের একাডেমিক ইতিহাসের শুরুতে বিশেষত তাবেয়ি ও তাবে তাবেয়িনদের কালে সূফি ধারা বলে আলাদা কোন স্বতন্ত্র ধারার অস্তিত্ব খুজে পাওয়া যায় না। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে এরকম ধারার শুরু ও বিকাশ হয়... আব্বাসিয় খেলাফতের শাসন আমলে। ৮০০ শতকে শেষের দিক থেকে আব্বাসিয়দের নেতৃত্বে মুসলিম ইতিহাসের বৈষয়িক চরম গোল্ডেন কালের শুরু হয়। জ্ঞান, গবেষণা, আবিস্কার, সংস্কৃতি, সাহিত্য, সামরিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সম্পদ প্রাচুর্যে আব্বাসিয়দের সময়টা শীর্ষে চলে আসে।

সম্পদ প্রাচুর্যের অতিশায্য তখন সম্রাট, আমির ওমরাহ থেকে শুরু করে একেবারে মুসলিম সালতানাতের অতি সাধারন নাগরিকদের জীবনেও ছাপিয়ে পড়ে। এ বিষয়টি উলামাদের একটি অংশকে হতাশ করে তোলে। তারা তখন মুসলিমদের সাধারন সহজ সরল আখেরাতমুখি জীবন যাপনের আহবান জানাতে থাকে। মূলত এটাই হলো সূফি ধারা বলতে যাকে বলা হয়... তার শুরু।

সূফি ধারার মূল কথা হলো... আল্লাহর প্রতি বান্দার ভালোবাসা... আল্লাহর প্রতি বান্দা মানুষের প্রেম ভালোবাসাই বান্দার মূল লক্ষ্য। সেজন্য দুনিয়ায় আড়ম্বর প্রাচূর্য তারা এড়িয়ে চলেন । সূফি ধারা ব্যাপারে মূলত সমালোচনা দুইটা...

১) সূফি ধারার কারনে মুসলমানদের মধ্যে দুনিয়ার ব্যাপারে উন্নাসিকতা সৃষ্টি হয়। ফলে মুসলমানরা ধীরে ধীরে গবেষণা, আবিস্কার থেকে দূরে সরে গিয়ে একরমের নৈরাশ্যবাদী চরম তকদিরবাদি হয়ে যায়।

এই সমালোচনাটির একটি পিঠ সঠিক, আবার আরেকটি পিঠ ভুল। কারন মুসলিম বিজ্ঞানি গবেষকদের একটা বড় অংশই ছিলেন এই ধারা দ্বারা প্রভাবিত। আবার এটাও সত্যি সূফি ধারার বিকৃতির কালে বিশেষত ১৭০০ শতকের শেষের দিকে এসে সূফি ধারা নৈরাশ্যবাদীতার অন্ধকারে নিজেদের সপে দেয়।

২) দ্বিতীদয় সমালোচনাটি হলো... সূফিবাদের নামে মুসলমানদের মধ্যে ইসলামের নামে আধ্যাত্মবাদের নামে চরম বিকৃতির শুরু হয়। এ সমালোচনাটি অনেকটাই সঠিক। সূফি ধারার চরম উৎকর্ষের সময় সূফি উলামাদের যেরকম সাবধানতার প্রয়োজন ছিলো... সেটা তারা করেননি। ফলে অলি আউলিয়া বুজুর্গ উলামাদের প্রতি অতিরিক্ত অন্ধ ভালোবাসা শ্রদ্ধা আনুগত্যের পথ ধরে বিকৃতির সূচনা হয়। এই বিকৃতির রাশকে সূফি ধারার ভেতর থেকে কেউ না করার কারনে এর চরম বিকৃতিকে রুখে দেয়া যায়নি। একই কারনে বিপরীত প্রতিক্রিয়া হিসেবে ওহাবি ও সালাফি ধারার সূচনা হয়।

সূফি ধারার রাজনৈতিক চরম স্বর্নযুগ ছিলো উসমানিয় বা অটোমেনদের শাসনকালে। অটোমেনদের উপর সূফি ধারার চরম প্রভাব ছিলো। বলা যায় অটোমেনদের ইসলামী অনুপ্রেরনা হিসেবে সূফি ধারা কাজ করেছে। অটোমেনদের সময়েই সূফি ধারার মধ্যে
" নকশবন্দিয়া " তরিকা শক্তিশালী হয়। বর্তমান মুসলিম বিশ্বে " নকশবন্দিয়া " সূফি ধারাটিই সবচেয়ে বড়। তুরস্ক, সিরিয়া, মধ্য এশিয়া ( কাজাকিস্তান, উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, দাগেস্তান, ক্রিমিয়া, চেচনিয়া) , বলকান অন্চলে কসভো, বসনিয়া, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ভারত, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, চীনের হান ও উইঘুর মুসলিমদের মধ্যে নকশবন্দিয়া ধারার প্রভাব বেশি।

সূফি ধারা মুসলিম ইতিহাসের একটা দীর্ঘ সময় শতাব্দীর পর শতাব্দী... দাওয়াত ও জেহাদের পতাকা সমুন্মত রেখেছিলো। সূফি ধারা কখনোই রাজনীতিবিমুখ ছিলো না। বরং সূফি ধারা রাজনীতির সাথে উৎপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলো। ইতিহাসে সূফি ধারার রাজনীতি সম্পর্কে নীরব থাকাটাও ছিলো তাদের রাজনৈতিক কৌশল। আবার সময় সময়ে সূফিরা বিদ্রোহ বিপ্লবে অংশ নিয়েছে... জয় বা পরাজয় শেষে আবার নিজেদের খানকায় ফিরে গেছে।

ইসলামপন্থী রাজনীতির সাহিত্য সাংস্কৃতিক অংগনকে আরো সমৃদ্ধ করার জন্য এবং রাজনৈতিক অনুপ্রেরনার জন্য সূফি ধারার সঠিক ইতিহাস তুলে আনাটা ইসলামপন্থীদের জন্য খুবই জরুরী। ইসলামপন্থী রাজনীতি এই কাজটি সঠিকভাবে করতে পারলে... এটা তাদের গণভিত্তি অর্জনে খুবই কাজে আসবে।

লিখেছেন: রিফাত চৌধুরী

পঠিত : ১৪৭৮ বার

মন্তব্য: ০