Alapon

বলিউডের চোখে মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাস...


গত ৩০ বছরে ভারতীয় ফিল্মমেকাররা যতবার ইতিহাস ভিত্তিক সিনেমা বানিয়েছে ততবার তা ইতিহাস কম রাজনীতি বেশি হয়েছে। ভারতীয় রাজনীতির শিকার বাবড়ি মসজিদ থেকে শুরু করে বলিউড সিনেমা পর্যন্ত।

আশুতোষ গোয়ারকার বানিয়েছিল 'যোধা-আকবর' কিন্তু আসল ইতিহাসে যোধা নামে আকবরের কোন স্ত্রী ছিল না। আকবরের জীবন আর রাজকার্যে তাঁর কোন স্ত্রীর বিশেষ প্রভাব আর ভুমিকা ছিল না, যা ছিল সম্রাট বাবর আর সম্রাট জাহাঙ্গীরের জীবনে। অথচ সিনেমাতে আকবরের স্ত্রী হিসাবে যোধাকে আকবরের বিশাল পরামর্শদাতা হিসাবে দেখানো হয়েছে। ৯৯% মানুষ সিনেমায় দেখানো গল্পকে সত্য বলে মেনে নিয়েছে। এভাবেই মানুষের মনে ঢুকানো হয়েছে আকবরের যত মহান কাজ তার পিছনে রয়েছে আকবরের স্ত্রী যোধার হাত। যা সর্বোপর ভাবে ইতিহাস বিকৃতি।

আমি নিজে তিন বছর আগে ভারত সফরে গিয়েছিলাম, আমাদের ভারতীয় ট্যুর গাইড ছিল, যার ইতিহাস বয়ানের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল আমাদের বুঝানো যে আকবরের মহান কাজের পিছনে যোধার অনেক অবদান। ফতেহপুরশিক্রি তে যেয়ে সে ইনিয়ে বিনিয়ে আমাদের বুঝিয়েছে যে এখানে যোধা রান্না করত, ওখানে যোধা সখিদের সাথে খেলত, সেখানে যোধা চুল শুখাতো। সবাই বেশ মনোযোগ দিয়েই গাইডের কথা শুনেছে, আর আমার মনে হয়েছে গাইডকে ধরে দেই এক ............ অথচ আকবরের জীবনে কোন যোধা ছিল না। ফতেহপুরের সাথে যোধার কোন সম্পর্ক নাই। জোধার কোলে জাহাঙ্গীরের জন্ম হয় নাই। আকবরের পুত্র জাহাঙ্গীরের জন্ম হয়েছে মরিয়ম জামানির কোলে যাকেও কোন ইতিহাসবিদ যোধা বলে স্বীকৃতি দেন নাই। যাই হোক গাইডেরা যে ইচ্ছা করে ইতিহাস বিকৃত করছে তা বুঝাই যায়। ভারতের ইতিহাস থেকে মুসলমানদের নাম চিরতরে মুছে ফেলার অনেক চেষ্টা চলছে এখন ভারতে।


সঞ্জয় লীলা বনশালী বানিয়েছে পদ্মাভাত (পদ্মাবতী??) । এই সিনেমায় সম্রাট আলাউদ্দিন খিলজিকে নারী লোভি, সমকামী হিসাবে হাইলাইট করা হয়েছে, অথচ ইতিহাসে তার কোন প্রমাণ নাই। ইন ফ্যাক্ট পদ্মাবতী সিনেমাটা বানানো হয়েছে একটা কাব্যের উপর ভিত্তি করে, সত্যকারের ইতিহাসের উপর ভিত্তি করে নয়। কিন্তু মানুষের মননে এসব সিনেমাকে মনে হয় সত্য ঘটনার অবলম্বনে বানান। আলাউদ্দিন খিলজি ছিলেন ভারতীয় ইতিহাসের সেই সাহসী আর ব্রিলিয়ান্ট জেনারেল সম্রাট যিনি ভারতকে মঙ্গোলদের আক্রমন থেকে একবার নয়, দুইবার নয়, ছয়বার রক্ষা করেছিলেন। মঙ্গোলরা যখনই কোন রাজত্বকে আক্রমন করে জয়লাভ করেছে সেখানে রক্তের নদী বহিয়ে দিয়েছিল, কিন্তু আলাউদ্দিন খিলজির কারনে মঙ্গোলদের সেই অভিলাশ ভারতে পুরন হয়নি। আলাউদ্দিন খিলজি মুলত ভারতের হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-জৈন সবার রক্ষাকর্তা, কিন্তু তাঁকে সঞ্জয় লীলা দর্শকের কাছে নারী পিপাসু হিসাবে পেশ করেছে। দেখানো হয় নাই যে সম্রাট আলাউদ্দিন খিলিজির আমলে আসলে যে কোন বিদ্রোহে হয় নাই তাঁর আইন আর অর্থনীতির সুন্দর কনট্রোলের কারনে।


আমি এখানে আমির খানেরও সমালোচনা করব। সিপাহী বিদ্রোহ নিয়ে সিনেমা বানিয়েছে, প্রধান চরিত্র বানিয়েছে মঙ্গল পান্ডেকে, যে একজন সাধারন সেনা ছিল। বিদ্রোহের শুরুতেই যার ফাসি হয়ে যায়। আসল বিদ্রোহ শুরু হয় বিদ্রোহী সেনারা দিল্লিতে বাহাদুর শাহ জাফরের কাছে লাল কেল্লাতে পৌঁছালে। এই ব্যাপারে বিখ্যাত মোঘল হিস্টোরিয়ান উইলিয়াম ডালরিম্পলের ফ্রাস্ট্রেশান তার বই 'দ্যা লাস্ট মোঘলে' আছে। তিনি লিখেছেন,


" Since the time of V.D. Svarkar's book The Indian War of Independence 1857, published in 1909, the March outbreak in Barrackpore has been as the crucial event of the Mutiny, and Mangal Pandey its central icon. This is a position which was cemented by the recent Bollywood film which, though known as The Rising in its English language avatar, was called simply Mangal Pandey in Hindi.


Yet in many ways Pandey was almost irrelevant to the outbreak which took place two months later at Merut in May." Pg 20, The Last Mughal, William Dalrymple.


একদিকে ইতিহাসবিদ অখ্যাত মঙ্গল পান্ডেকে সিপাহী বিদ্রোহে শুরু হওয়ার প্রধান চরিত্র বানিয়ে ইতিহাস লেখাছে অপরদিকে বলিউড সিনেমা বানিয়ে সেই অখ্যাত মঙ্গল পান্দেকে মানুষের মন ও মগজে ঢুকিয়ে দিয়েছে। যেই আফসোসটা উইলিয়াম ডালরিম্পল পর্যন্ত করেছেন। অথচ সিপাহী বিদ্রোহের অন্যতম প্রধান চরিত্র ছিল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের পুত্র মির্জা মোঘল। ২৬ বছর বয়স্ক এই রাজপুত্র দেখতে যেমন নায়কচিত ছিল তেমন অসিম সাহসী আর লড়াকু যোদ্ধা। সিপাহী বিদ্রোহে যার লড়াইয়ের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সমস্ত ঘটনাবলী নিয়ে বানানো যায় আসল সিপাহী বিদ্রোহের উপর সিনেমা আর ব্রিটিশদের হাতে যার মৃত্যু হতে পারে সেই সিনেমার শেষ করুন দৃশ্য। কিন্তু আজ পর্যন্ত বলিউডের সব সিনেমা নির্মাতা ইচ্ছা করে মির্জা মোঘলকে এড়িয়ে গেছে।

আগামি মাসে আশুতোষ গোয়ারকারের নতুন মুভি 'পানিপথ' মুক্তি পেতে যাচ্ছে। আধুনিক আফগানিস্তানের জনক আহমদ শাহ আবদালীকে (ওনার অপর নাম আহমদ শাহ দুররানি) এই সিনেমার প্রধান দুই চরিত্রের একটি। এটা ইতিহাসের সেই সময়ের ঘটনা যখন মোঘলদের শক্তি একেবারেই শেষ, মুলত রাজত্ব চলছে তখন মারাঠাদের । অতএব, দর্শকেরা মারাঠাদের ব্রাভাডো আর মুসলমানদের নৃশংসতা দেখার জন্য তৈরি হোন।

বলিউডের সিনেমা নির্মাতারা মুসলমান কোন ঐতিহাসিক চরিত্র নিয়ে যখনই সিনেমা বানিয়েছে তখনই সেখানে হিন্দু নারী চরিত্রকে প্রধান করে মুসলমান চরিত্রকে অলমোস্ট পার্শ্ব চরিত্র বা খল চরিত্র বানিয়েছে, অথবা মুসলমান চরিত্রকে হিন্দুপ্রধান চরিত্র থেকে ইচ্ছাক্রিতভাবে বিকৃত করে দেখিয়েছে।

লিখেছেন: সাবিনা আহমেদ

পঠিত : ২০০৭ বার

মন্তব্য: ০