Alapon

মাত্র ২৫টি পয়েন্টে রাসূল সা.-এর পূর্ণাঙ্গ জীবনী জানুন



১. রাসূল সা.-এর জন্ম ও শৈশব
তাঁর নাম মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুল মুত্তালিব ইবনে হাশেম। হাশেমের দিকে সম্পর্কযুক্ত করে নবীজীর বংশ হাশেমি বংশ হিসেবে পরিচিত। মুহাম্মদ সা. এর জন্ম ৫৭০ সালে, হস্তী বাহিনী ধ্বংসের বছর জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মের ৬ মাস পূর্বেই তার পিতা আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুল মুত্তালিব সফররত অবস্থায় মদিনায় ইন্তেকাল করেন । সে সময়ের ঐতিহ্য অনযায়ী সম্ভান্ত আরব পরিবারের সন্তানদেরকে অন্য গোত্রে লালন-পালন করতে দেওয়া হত। সে হিসেবে নবী করীম সা. বনী সা‘দ গোত্রে লালিত- পালিত হন এবং চার অথবা পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত সেখানেই বসবাস করেন।

২. জন্মের সময় কিছু অলৌকিক ঘটনা
তাঁর জন্মের ৫০ দিন পূর্বে বায়তুল্লাহ আক্রমণকারী ইয়ামানের শক্তিশালী বাদশাহ আবরাহা তার সৈন্যসহ সমূলে ধ্বংস হয়েছিল। মক্কায় তখন মহা দুর্ভিক্ষ চলছিলো, তিনি তাঁর মায়ের গর্ভে আসার সাথেই দুর্ভিক্ষ অবসান হয়ে গিয়েছিল। হারিয়ে যাওয়া যমযম কূপের সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল। তাঁর মা জননী আমেনা বর্ণনা করেন, মুহাম্মদ তার পেটে অবস্থান নেয়ার সাথেই সারা বিশ্বে আলোক রশ্মি ছড়িয়ে পড়েছিল, যার সাহায্যে তিনি সুদূর সিরিয়ার রাজ প্রাসাদসমূহ পরিস্কার দেখতে ছিলেন। এমনিভাবে আরো অসংখ্য ঘটনা পৃথিবীতে ঘটতেছিল। তিনি যখন জন্মগ্রহণ করলেন, মক্কায় তখন ভূ-কম্পনের দ্বারা মূর্তিগুলো ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গিয়েছিল। জ্বিনদের আসমান থেকে সংবাদ সংগ্রহ করা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। অপরদিকে পারস্য সম্রাটের রাজমহলে ভূ-কম্পনের আঘাতে রাজমহলের ১৪ টি স্তম্ভ ধ্বসে পড়েছিলো।

৩. বক্ষ বিদীর্ণ হওয়া
রাসূল সা.-এর যখন চার কি পাঁচ বছর তখন তাঁর কাছে জিবরাঈল আ. এলেন, তখন তিনি শিশুদের সাথে খেলছিলেন। তিনি তাঁকে ধরে শোয়ালেন এবং বক্ষ বিদীর্ণ করে তাঁর হৎপিন্ডটি বের করে আনলেন। তারপর তিনি তাঁর বক্ষ থেকে একটি রক্তপিন্ড বের করলেন এবং বললেন এ অংশটি শয়তানের। এরপর হৎপিন্ডটিকে একটি স্বর্ণের পাত্রে রেখে যমযমের পানি দিয়ে ধৌত করলেন এবং তার অংশগুলো জড়ো করে আবার তা যথাস্হানে পূনঃস্থাপন করলেন। তখন তাঁর খেলার সাথী শিশুরা দৌড়ে তাঁর দুধমায়ের কাছে গেল এবং বলল, "মুহাম্মাদকে হত্যা করা হয়েছে"। কথাটি শুনে সবাই সেদিকে এগিয়ে গিয়ে দেখল তিনি ভয়ে বিবর্ণ হয়ে আছেন! আনাস রা. বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর বক্ষে সে সেলাই-এর চিহ্ন দেখেছি"। এটি ছিলো তাঁর প্রথম বক্ষ বিদীর্ণ হওয়ার ঘটনা।

গবেষকদের মতে, মোট চার বার রাসূল সা. এর বক্ষ বিদারণ হয়।
ক। হালিমার গৃহে অবস্থান কালে চার বছর বয়সে।
খ। ১০ বছর বয়সে।
গ। হেরা পর্বতের গুহায় ১ম ওহী নাজিলের সময়
ঘ। মিরাজের রাতে।

৪. মায়ের মৃত্যু ও দাদা-চাচার তত্ত্বাবধান
নবী করীম সা.-এর মা আমেনা মদিনা মুনাওয়ারায় নিজ স্বামী আব্দুল্লাহ এর কবর যিয়ারতের পর ফেরার পথে মক্কা ও মদিনার মাঝে অবসি'ত আবহাওয়া নামক স্থানে ইন্তেকাল করেন। তখন নবী মুহাম্মদ সা. এর বয়স ছিল মাত্র ছয় বছর। মাতা-পিতার মৃত্যুর পর দাদা আব্দুল মুত্তালিব তাঁর লালন পালনের দায়িত্ব ভার গ্রহণ করেন। দাদার মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি তাঁর তত্ত্বাবধানেই ছিলেন। দাদা আব্দুল মুত্তালিবের মৃত্যুর পর চাচা আবু তালিব তাঁর দায়িত্ব নেন। তখন তার বয়স ছিল আট বছর। তিনি চাচাকে বকরি লালন-পালন ও শাম দেশের ব্যবসায়ে সহযোগিতা করতেন।

৫. বিয়ে এবং সন্তানাদি
পঁচিশ বছর বয়সে খাদীজা রা.-কে বিবাহ করেন। একমাত্র ইবরাহীম ব্যতীত তাঁর সব কয়টি সন্তান খাদীজার রা. এর গর্ভ থেকেই হয়েছে। কাসেম তাঁর প্রথম সন্তান। এর নামেই তাঁর উপনাম আবুল কাসেম। অতঃপর যয়নব, রূকাইয়া, উম্মে কুলসুম, ফাতেমা ও আব্দুল্লাহর জন্ম হয়। তাঁর ছেলেরা সকলেই বাল্য বয়সে মারা যান। মেয়েদের সকলেই ইসলাম গ্রহণ করে হিযরত করার সুযোগ পান। ফাতেমা রা. ব্যতীত তাদের সকলেই নবীজীর জীবদ্দশায় মারা যান। তিনি নবীজীর ইন্তেকালের ছয় মাস পর মৃত্যুবরণ করেন। খাদিজা রা. কে ছাড়াও নবীজি আরো দশজনকে বিবাহ করেন। তাঁরা হলেন, সওদা বিনতে যাম‘আহ, আয়েশা বিনতে আবুবকর, হাফসাহ বিনতে উমার, জয়নব বিনতে খুযায়মা, উম্মে সালামাহ, জয়নব বিনতে জাহশ, জুওয়াইরিয়া বিনতুল হারেছ, উম্মে হাবীবাহ রামলাহ বিনতে আবু সুফিয়ান, সাফিয়া বিনতে হুয়াই বিন আখত্বাব, মায়মুনা বিনতুল হারেছ।

৬. ওহী নাযিলের সূচনা
তিনি মক্কায় অবস্থিত হেরা গুহায় ইবাদত করতেন। চল্লিশ বছর বয়সে তিনি নবুয়ত প্রাপ্ত হন। জিবরাইল আ. আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে ওহী নিয়ে অবতরণ করেন। সর্ব প্রথম সূরা ‘আলাকের প্রথম পাঁচটি আয়াত নাযিল হয় : যার অর্থ- পাঠ করূন, আপনার পালন কর্তার নামে,যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্ত থেকে। পাঠ করূন, আপনার পালনকৃত মহা দয়ালু।যিনি কলম দ্বারা শিক্ষা দিয়েছেন। শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানত না। (সূরা আলাক:১-৫) ওহী নাজিলের আগেও তিনি ছিলেন চিন্তায় সঠিক, সিদ্ধান্তে নির্ভুল, ব্যক্তিত্বে অনন্য, চরিত্রে শ্রেষ্ঠতর, প্রতিবেশী হিসেবে অতি মর্যাদাবান,সহনশীলতায় সুমহান, সত্যবাদিতায় মহত্ত্বর, সচ্চরিত্র, বদান্যতা, পুণ্যকর্মা, প্রতিশ্রুতি রক্ষা ও বিশ্বস্ততায় অনুপম আদর্শ। এসব গুণে মুগ্ধ হয়ে তার গোত্র তাঁকে আল-আমিন উপাধিতে ভূষিত করে।

৭. গোপন দাওয়াত
আল্লাহ তাআলা রাসূল সা.-কে মানুষের মাঝে ইসলাম প্রচারের আদেশ করেন। এ মর্মে তিনি ইরশাদ করেন, হে চাদরাবৃত ব্যক্তি! ওঠ এবং সতর্ক কর। (সুরা-মুদ্দাসির:১-২)। নবী করীম (সাঃ) স্বীয় প্রতিপালকের আদেশ যথাযথ পালন করেন এবং গোপনে গোপনে মানুষের মাঝে ইসলাম প্রচার করতে শুরু করেন। যাতে করে কুরাইশদের বিরোধিতা প্রকট না হয়। তিনি সর্বপ্রথম আপন পরিবার- পরিজন ও বন্ধুদের ইসলামের দাওয়াত দেন। সর্বপ্রথম খাদীজা রা. তাঁর দাওয়াত গ্রহণ করেন। পুরুষদের মধ্যে সর্বপ্রথম আবু বকর সিদ্দীক রা., ছোটদের মধ্যে আলী ইবনে আবু তালিব রা. এবং ক্রীতদাসদের মধ্যে যায়েদ ইবনে হারেসা রা. ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি খাদিজা রা.-এর ক্রীতদাস ছিলেন। রাসূল সা. তিন বছর পর্যন্ত নিকটস্থ লোকদের মাঝে ইসলাম প্রচারে গোপনীয়তা অবলম্বন করেন। তিনি দারূল আরকাম তথা কুরাইশ নেতা আরকাম ইবনে আবু আরকামের বাড়িটি মুসলমানদের সম্মেলনস্থল হিসেবে নির্বাচিত করেন।

৮. প্রকাশ্যে দাওয়াত
অতঃপর আল্লাহ তায়ালা প্রকাশ্যে দ্বীন প্রচারের আদেশ করলেন- ইরশাদ হচ্ছে, অতএব আপনি প্রকাশ্যে শুনিয়েদিন যা আপনাকে আদেশ করা হয় এবং মুশরিকদের পরোয়া করবেন না।” (সূরা হিজর : ৯৪), “আপনি নিকটাত্মীয়দেরকে সতর্ক করুন।” (সূরা শু‘আরা : ২১৪)। আল্লাহ তাআলার আদেশ পেয়ে নবী মুহাম্মদ সা. তাঁর নিকটতম আত্মীয়-স্বজনদেরকে সাফা পাহাড়ের পাদদেশে একত্রিত করেন। অতঃপর তাদেরকে মূর্তিপূজা পরিত্যাগ করে এক আল্লাহর ‘ইবাদত করতে আহ্বান করেন। সমবেত লোকদের মধ্য থেকে তাঁর চাচা আবু লাহাব বলে উঠলো, তোমার ধ্বংস হোক, এ জন্যেই কি আমাদেরকে একত্রিত করেছে? এরপর আবু লাহাব ও তার পরিবার রাসূল সা.-এর উপর নির্যাতনের পূর্ন মাত্রা প্রয়োগ করে। এর প্রেক্ষিতে আল্লাহ তা'আলা আবু লাহাব ও তার স্ত্রী উম্মে জামীল সম্পর্কে সূরা লাহাব অবতীর্ণ করেন, “আবু লাহাবের দু’হাত ধ্বংস হোক এবং ধ্বংস হোক সে নিজে। কোন কাজে আসেনি তার ধন-সম্পদ ও যা সে উপার্জন করেছে। সহসাই সে প্রবেশ করবে লেলিহান অগ্নিতে এবং তার স্ত্রীও, যে ইন্ধন বহন করে, তার গলদেশে খেজুরের পাকানো রশি নিয়ে।” (সূরা লাহাব : ১-৫)

৯. ঠাট্টা-বিদ্রূপ, অত্যাচার ও নির্যাতন
মক্কার মুশরিকরা রাসূল সা.-কে বিভিন্ন উপায়ে উপহাস করত। কখনো কখনো তাকে পাগল ও যাদুকর বলত। আবার কখনো বলত কবি ও গণক। আগন্তুক লোকদেরকে তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতে অথবা কথা শুনতে বাধা দিত। তাঁর চলাচলের রাস্তায় কাঁটা বিছিয়ে রাখত এবং সালাতরত অবস্থায় তাঁর উপর ময়লা-আবর্জনা নিক্ষেপ করত। মুশরিকরা তাদের মুসলিম গোলামদের উপর কঠিন নির্যাতন চালাতো। তাদেরকে হাত-পা বেঁধে ভর দুপুরে উত্তপ্ত বালুতে শুইয়ে দিত এবং ভারী পাথর দ্বারা তাদের বুক চাপা দিত এবং ছড়ি দ্বারা প্রহার করত ও আগুনের সেঁকা দিত। নির্যাতনের এমন কোন পদ্ধতি নেই যা তারা মুসলমানদের উপর প্রয়োগ করেনি। মুসলমানগণ মুশরিকদের সকল নির্যাতন ও নিপীড়ন ধৈর্য ও দৃঢ়তার সাথে মোকাবিলা করতেন। কেননা নবী করীম সা. তাদেরকে সাওয়াব ও জান্নাত লাভের আশায় বিপদে ধৈর্য ধারণ ও অনড় থাকার পরামর্শ দেন। মুশরিকদের নির্যাতন ভোগ করেছেন এমন কয়েকজন উল্লেখযোগ্য সাহাবী হলেন, বিলাল ইবনে রাবাহ ও আম্মার ইবনে ইয়াসির রা. প্রমূখ । তাদের নির্যাতনের শিকার হয়ে শহীদ হয়েছেন ইয়াসির ও সুমাইয়া রা.। ইসলামের ইতিহাসে এরাই সর্বপ্রথম শহীদ। আবু জাহেল তাদের খুন করে।

১০. হাবশায় (আবিসিনিয়ায়) হিজরত
রাসূল সা. কাফেরদের অনবরত নির্যাতনের কারণে সাহাবাগণের প্রতি দয়া পরবশ হয়ে হাবশাতে হিজরত করার নির্দেশ দেন। হাবশার বাদশা নাজ্জাশী ন্যায়পরায়ণ ও দয়ালু ছিলেন বলে হাবশাকেই হিজরতের জন্যে মনোনীত করা হল। নাজ্জাশী ঈসা আ.-এর অনুসারী ছিলেন। নবুয়্যাতের পঞ্চম বছর প্রথম মুহাজিরদের এ দলে ছিলেন দশ জন পুরূষ ও চার জন মহিলা। তারা কুরাইশদের অজান্তে চুপিসারে হাবশার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। কিছুদিন পর আরো একটি মুহাজির দল তাদের সাথে মিলিত হলেন। পুরুষ, মহিলা, শিশু সহ তাদের মোট সংখ্যাছিল প্রায় একশোজন। বাদশা নাজ্জাশী তাদের সম্মান এবং সুন্দর ব্যবহার করেন পাশাপাশি সেখানে নিরাপদে বসবাস করার অনুমতি দেন।

১১. শিয়াবে আবু তালিবে আটক
মুশরিকরা ভাবলো, বনু হাশিমের সহযোগিতাই মুহাম্মাদ সা. এর শক্তির উৎস। তাই বনু হাশিমের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। সকলে মিলে বনু হাশিমকে বয়কট করার সিদ্ধান্ত নেয়। বয়কট চুক্তি অনুযায়ী সবাই বনু হাশিমের সাথে মেলামেশা বন্ধ করে দেয়। তাদের কিছু কেনা ও তাদের নিকট কিছু বেচা বন্ধ হয়ে যায়। খাদ্য ও পানীয় সরবরাহ পর্যন্ত বন্ধ করে দেয়া হয়। বলা হলো, হত্যার জন্য মুহাম্মাদকে তাদের হাতে তুলে না দেয়া পর্যন্ত এই বয়কট চলতে থাকবে।

আবু তালিব বানু হাশিমের লোকদেরকে নিয়ে শিয়াবে আবু তালিব নামক গিরি খাদে আশ্রয় নেন। আবু লাহাব ছাড়া বানু হাশিমের মুসলিম-অমুসলিম সকল সদস্যই মুহাম্মাদ সা. এর সঙ্গী হন। আটক অবস্থায় তাঁদেরকে থাকতে হয় তিন বছর। এই তিন বছরে তাঁদেরেক দুঃসহ যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছে। খাদ্যাভাবে অনেক সময় গাছের পাতা ও ছাল খেতে হয়েছে। শুকনো চামড়া চিবিয়ে চিবিয়ে ক্ষুধার জ্বালা নিবারণের চেষ্টা করতে হয়েছে। পানির অভাবে অবর্ণনীয় কষ্ট পেতে হয়েছে।

তিন বছর পর আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এই বন্দীদশা থেকে তাঁদের মুক্তির পথ করে দেন। বনু হাশিম খান্দানের এই নিদারুণ দুঃখ-কষ্ট দেখে একদল যুবকের মন বিগলিত হয়। তারা এই অমানুষিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠে। তাদের মধ্যে ছিলো মুতইম ইবনু আদি, আদি ইবনু কাইস, যামআহ ইবনুল আসওয়াদ, আবুল বুখতারী, জুহাইর এবং হিশাম ইবনু আমর। তারা অস্ত্রসজ্জিত হয়ে আবু জাহালের নিষেধ অমান্য করে বানু হাশিমকে মুক্ত করে আনে। এটা ছিলো নবুয়াতের নবম সনের ঘটনা।

১২. তায়েফ গমন
রাসূল সা.-এর আশ্রয়দাতা চাচা আবু তালিবের মৃত্যুকে কুরাইশরা সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করল। তার উপর নির্যাতনের মাত্রা পূর্বের চেয়ে অনেক বাড়িয়ে দেয়। এ কঠিন পরিস্থিতিতে সহযোগিতা ও আশ্রয় পাওয়ার আশায় তিনি তায়েফ গমন করলেন। কিন্তু সেখানে উপহাস ও দুর্ব্যবহার ছাড়া আর কিছুই পেলেন না। তারা রাসূল সা.-কে পাথর নিক্ষেপ করে মারাত্মকভাবে আহত করে। বাধ্য হয়ে তিনি মক্কায় ফিরে আসেন।

১৩. বিভিন্ন গোত্রের নিকট রাসূল সা.-এর দাওয়াত
রাসূল সা. হজ্বের মৌসুমে মক্কায় আগত বিভিন্ন গোত্রের নিকট দাওয়াত নিয়ে উপস্থিত হন। তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দেন এবং শত্রুদের থেকে আত্মরক্ষা ও দাওয়াতের নিরাপত্তা বিধানে সহযোগিতা কামনা করেন। তবে কোন গোত্রই এতে সাড়া দিল না। কারণ, কুরাইশরা তাদেরকে ভয়ভীতি প্রদর্শন করে এবং তাদেরকে তার নিকট হতে দূরে রাখার কৌশল অবলম্বন করে। ইতিমধ্যে মদিনার নেতৃস্থানীয় ছয়জন লোক রাসূলের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং কুরাইশদের ভয়ে গোপনে তাঁর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন। তারা নিজ দেশে প্রত্যাবর্তন করে মানুষের সাথে ইসলাম সম্পর্কে এবং রাসূল সা.-এর চরিত্র ও দাওয়াতের সত্যতা সম্পর্কে আলোচনা করেন এবং মদীনাবাসীদের মাঝে ইসলাম প্রচারের কাজ করেন। ফলে মদিনার অনেকেই ইসলাম গ্রহণ করেন।

১৪. মিরাজের ঘটনা
নবুয়্যাতের একাদশ বছরে মুহাম্মদ সা. প্রথমে কাবা শরিফ থেকে জেরুজালেমে অবস্থিত বায়তুল মুকাদ্দাস বা মসজিদুল আকসায় গমন করেন এবং সেখানে তিনি নবীদের জামায়াতে ইমামতি করেন। অতঃপর তিনি বোরাক নামক বিশেষ বাহনে আসীন হয়ে ঊর্ধ্বলোকে গমন করেন। ঊর্ধ্বাকাশে সিদরাতুল মুনতাহায় তিনি আল্লাহ'র সাক্ষাৎ লাভ করেন। এই সফরে ফেরেশতা জিবরাইল তার সফরসঙ্গী ছিলেন। কুরআনের সুরা বনি ইসরাঈল এর প্রথম আয়াতে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, "পবিত্র মহান সে সত্তা, যিনি তাঁর বান্দাকে রাতে নিয়ে গিয়েছেন আল মাসজিদুল হারাম থেকে আল মাসজিদুল আকসা পর্যন্ত, যার আশপাশে আমি বরকত দিয়েছি, যেন আমি তাকে আমার কিছু নিদর্শন দেখাতে পারি। তিনিই সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।

১৫. আকাবার শপথ
নবুয়্যাতের দ্বাদশ বছর হজ্জের মৌসুমে বারো জন লোক মদীনা হতে বের হয়ে মিনাতে আকাবার প্রথম বাইআতের সময় রাসূল সা. এর সাথে দেখা করে এবং বাইয়াতে অংশ গ্রহণ করেন। এ বাইয়াতকে ইসলামের ইতিহাসে ‘আল আকাবাতুল উলা’ প্রথম বাইয়াত বলা হয়। মদীনায় ফিরে যাবার সময় রাসূল সা. তাদের সাথে মুস‘আব ইবনে উমায়ের রা.-কে কুরআন তিলাওয়াত এবং দ্বীন শিখানোর জন্য পাঠান।

আকাবার প্রথম বাইয়াতের পরবর্তী বছর নবুয়্যাতের ত্রয়োদশ বছর হজের মৌসুমে সত্তর জন পুরুষ, দুই জন মহিলা মক্কার উদ্দেশ্যে হজ্জ পালনের লক্ষ্যে মদীনা হতে রওয়ানা হন এবং কুরাইশদের অগোচরে গোপনে মিনাতে রাসূল সা.-এর সাথে সাক্ষাত করেন। আর তারা সকলে রাসূলের চাচা আব্বাস, আবু বকর এবং আলী ইবনে আবু তালিবের উপস্থিতিতে রাসূল সা.-এর নিকট বাইয়াত গ্রহণ করেন। এ বাইয়াতকে ইসলামের ইতিহাসে ‘আল-আকবাতুস সানীয়াহ’ বলা হয়। এতে তারা জান-মালের বিনিময়ে রাসূল সা.-কে রক্ষা করার অঙ্গীকার করেন। তারা তাঁকে এ মর্মে আশ্বস্ত করলেন যে, তিনি যদি তাদের দেশে তাদের নিরাপত্তায় হিজরত করেন তাহলে তারা স্বাগত জানাবেন।

১৬. হিজরত
কুরাইশরা রাসূল সা.-কে হত্যার ষড়যন্ত্র করে। কিন্তু তারা ব্যর্থ হয় এবং আল্লাহ তাআলাকে তাঁকে হেফাযত করেন। রাসূল সা. নিজের ঘর থেকে বের হন এবং আল্লাহ তাআলা কাফেরদের চোখ অন্ধ করে দেন যাতে তারা রাসূল সা.-কে দেখতে না পারে। তিনি চলতে চলতে মক্কার বাইরে বন্ধু আবু বকর সিদ্দীক রা. এর সাথে মিলিত হন। অতঃপর তারা উভয়ে এক সাথেই পথ চলা আরম্ভ করেন। ‘সওর’ নামক পাহাড়ে পৌঁছে একটি গুহায় তিন দিন পর্যন্ত আত্মগোপন করেন। আব্দুল্লাহ বিন আবু বকর রা. তাদের নিকট কুরাইশদের সংবাদ পৌঁছাতেন এবং তার বোন আসমা রা. খাদ্য ও পানীয় পৌঁছাতেন। তারপর নবী করীম সা. ও তার সঙ্গী গুহা হতে বের হন এবং ইয়াসরিব (মদিনা) অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন।

১৭. মদীনায় নতুন রাষ্ট্রের সূচনা
রাসূল সা. মদীনায় পৌঁছে তাকওয়ার ভিত্তিতে ইসলামের সর্বপ্রথম মসজিদ নির্মাণ করেন। বর্তমানে মদীনা শরীফে এ মসজিদটি “মসজিদে কু’বা” নামে পরিচিত। মদীনাতে রাসূলুল্লাহ সা. সর্বপ্রথম যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেন তা হচ্ছে মসজিদে নববী নির্মাণ এবং মুহাজির ও আনসারদের মাঝে ভ্রাতৃত্ব স্থাপন। এরপর তিনি মদিনার অপরাপর ইহুদী গোষ্ঠীদের সাথে মদিনা সনদের মাধ্যমে সার্বভৌম মদিনা রাষ্ট্র গঠন করেন। এটাই প্রথম ইসলামিক রাষ্ট্র। এখানে রাসূল সা. আল্লাহর আইন ও ইসলামের রাষ্ট্র পরিচালনা পদ্ধতি বাস্তবায়ন করেছেন।

১৮. বদর যুদ্ধ
কুরাইশদের একটি ব্যবসায়ী দল সিরিয়া থেকে বিশাল যুদ্ধসামগ্রী কিনে মক্কা প্রত্যাবর্তন করছে মর্মে সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে। রাসূলুল্লাহ সা. এ ব্যাপারে অবগত হলে সেই কাফেলাকে বাধা দিতে চাইলেন। কারণ ইতিপূর্বে মক্কাবাসীরা মুহাজিরদের সম্পদ দখল করে নিয়েছিল। ঐ দলনেতা আবু সুফিয়ান রাসূল সা. এর সংকল্পের কথা জানতে পেরে এক লোককে কুরাইশদের নিকট পরিস্থিতি সম্পর্কে সংবাদদানের জন্য পাঠালেন। সংবাদ পেয়ে কুরাইশরা বাণিজ্যিক কাফেলা রক্ষার্থে দ্রুত বের হয়ে আসলো। এদিকে আবু সুফিয়ান আগেই কাফেলাসহ পলায়ন করতে সক্ষম হয় এবং বেঁচে যায়। কুরাইশরা মক্কায় ফিরে যেতে চাইলো কিন্তু কুরাইশ নেতারা বিশেষত আবু জাহেল মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ঘোষণা দেয় এবং প্রায় এক হাজার যোদ্ধার একটি সেনাদল মদিনাভিমুখে পাঠায়। নবী সা. পরামর্শ করে মুহাজির ও আনসারগণের নিয়ে গঠিত প্রায় ৩১৩ জনের একটি সেনাদল নিয়ে মুশরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার লক্ষ্যে বের হলেন। হিজরী দ্বিতীয় সনের ১৭ রামাদান বদর নামক স্থানে উভয় দল মুখোমুখি হয় এবং সেখানেই বদর যুদ্ধ সংঘটিতহয়। এ যুদ্ধে মুসলমানরা মহা বিজয় লাভ করেন। এ যুদ্ধে মুসলমানগণ অনেক গনিমতের সম্পদ লাভ করেন। রাসূলুল্লাহ সা. তাদের মাঝে সেগুলো বণ্টন করে দেন। এ যুদ্ধে মোট সত্তর জন মুশরিক নিহত হয় এবং সত্তর জন বন্দী হয় আর মুসলমানদের শহীদের সংখ্যা মাত্র চৌদ্দজন।

১৯. উহুদ যুদ্ধ
বদর যুদ্ধে কুরাইশরা শোচনীয় পরাজয় এবং নিজেদের বড় বড় নেতা হারিয়ে দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে মক্কায় প্রত্যাবর্তন করার পর তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য মুসলমানদের পক্ষ হতে হুমকির সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা করে। ফলে তারা পূর্ণ এক বছর যাবৎ সৈন্য ও সম্পদ সঞ্চয় এবং প্রতিবেশী গোত্রীয় মিত্রদেরকে সহায়তা প্রদানের আহ্বানসহ জোর প্রস্তুতি গ্রহণ করে এবং আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে তিন হাজারের অধিক একটি বিশাল সেনাদল গঠন করে।

রাসূল সা.-এর নিকট কুরাইশদের আগমন বার্তা পৌঁছোলে তিনি মুহাজির ও আনসার নিয়ে গঠিত এক হাজার যোদ্ধার একটি সেনাদল নিয়ে তাদের প্রতিরোধ করার জন্য বের হন এবং উহুদ পাহাড়ের ঢালুতে অবস্থান গ্রহণ করেন। পাহাড় পিছনে রেখে তিনি সৈন্যদের সুসংগঠিত ও বিন্যস্থ করেন। যে কোনো পরিস্থিতিতে স্থান ত্যাগ না করার জন্য তাদেরকে নির্দেশ প্রদান করেন। যুদ্ধের শুরুর দিকে মুসলমানদের জয় হলো এবং মুশরিকরা পিছু হটলো। কিন্তু মুসলিম তীরান্দাজগণ গনিমতের মাল সংগ্রহণ করতে গিয়ে নিজেদের স্থান ত্যাগ করে বসলেন। মুশরিকরা এ সুযোগে তীর নিক্ষেপের স্থানগুলো দখল করে নিলো এবং মুসলমানদের পিছন দিক থেকে তীর নিক্ষেপ করতে লাগল। যার কারণে মুসলমানরা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। এতে অনেক মুসলমান শাহাদাত বরণ করেন। তাদের মধ্যে শহীদগণের সরদার হামযা বিন আব্দুল মুত্তালিব রা. ছিলেন। এ যুদ্ধে রাসূল সা.-এর মুখমন্ডল এবং দাঁত মারাত্মক আঘাতপ্রাপ্ত হয়। উহুদ যুদ্ধ সংঘটিত হয় হিজরী সনের তৃতীয় বছর শাওয়াল মাসের ১৫ তারিখ রোজ শনিবার।

২০. খন্দকের যুদ্ধ
মুসলমানদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা, তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও হিংসাত্মক আচরণের কারণে যে সব ইয়াহুদীদের রাসূল সা. মদীনা হতে তাড়িয়ে দেন তারা মক্কায় কুরাইশদের দলভুক্ত হয়। কুরাইশদেরকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার প্রেরণা জোগায় এবং তাদেরকে জনবল, টাকা-পয়সা ও অস্ত্র-শস্ত্র দিয়ে সহযোগিতা করার প্রতিশ্রুতি দেয়। মদিনার ইয়াহুদীদের পরামর্শ অনুসারে মক্কাবাসী ধন-সম্পদ জোগাড় করতে আরম্ভ করল। কুরাইশরা ও ইয়াহুদীরা তাদের স্বীয় গোত্র ও মিত্রদের সহযোগিতা করার আহ্বান জানাল। পঞ্চম হিজরিতে আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে দশহাজারেরও বেশি যোদ্ধা মদিনাভিমুখে রওয়ানা হয়। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করা।

রাসূল সা. কুরাইশদের প্রস্তুতি ও প্রতিজ্ঞা সম্পর্কে অবগত হওয়ার পর করণীয় নির্ধারণে সহাবাগণের সাথে পরামর্শ করেন। তারা সিদ্ধান্ত করেন মুসলমানগণ মদিনায় অবস্থান করে প্রতিরোধ করবে। মদিনার উত্তর পার্শ্বের সীমান্ত অরক্ষিত থাকায় সালমান ফারসী রা. মদিনায় দুশমনদের প্রবেশে বাধাগ্রস্থ করার লক্ষ্যে উত্তর পার্শ্বে পরিখা খননের পরামর্শ দেন। রাসূল সা. সালমান ফারসী রা. এর পরামর্শ গ্রহণ করেন। মুসলমানগণ পরিখা খনন আরম্ভ করেন এবং রাসূল সা. নিজেই মুসলমানগণের সাথে কাজে অংশগ্রহণ করেন। পনেরো দিনের মধ্যে পরিখা খনন সম্পন্ন হয়। রাসূল সা. মহিলা ও শিশুদের দুর্গে আশ্রয় গ্রহণের নির্দেশ দেন। মুশরিক সৈন্যরা পরিখার অদূরে মদিনার বাইরে অবস্থান করতে বাধ্য হয়। কেননা তাদের অশ্বগুলো পরিখা অতিক্রম করতে পারেনি। তারা একমাস ধরে মদিনা অবরোধ করে রাখে। অতঃপর তাদের অশ্বারোহীরা নিহত হলে এবং আল্লাহর পাঠানো ঝড়ো বাতাসে তাদের তাঁবু ও সরঞ্জাম লণ্ডভণ্ড হলে তারা পলায়ন করে।

২১. হুদাইবিয়ার সন্ধি
যষ্ঠ হিজরিতে রাসূল সা. উমরা করার লক্ষ্যে মক্কার উদ্দেশ্যে রওয়ানা করেন। এ সফরে তাঁর যুদ্ধ করার কোন ইচ্ছা ছিল না। চৌদ্দশত আনসার ও মুহাজির সাহাবি তাঁর সফরের সাথী হন। যখন তারা হুদাইবিয়া নামক স্থানে পৌঁছেন সকলে ইহরাম বাঁধা অবস্থায় ছিলেন। কুরাইশরা এ সংবাদ জানতে পেরে শপথ করল যে, তারা নবী করীম সা. ও তার সাথীদেরকে মক্কায় প্রবেশ করতে দেবে না। রাসূল সা. উসমান রা.-কে কুরাইশদের নিকট এ খবর দিয়ে প্রেরণ করেন যে, তারা যুদ্ধের জন্য মক্কার দিকে রওয়ানা হননি। বরং তারা শুধুমাত্র উমরার উদ্দেশ্যেই মক্কায় প্রবেশ করতে চান। তারপর তারা আলোচনায় বসার জন্য সম্মত হয়। আলোচনা আরম্ভ হলে তা সন্ধির মাধ্যমে সমাপ্ত হয়। এ সন্ধিকেই হুদাইবিয়ার সন্ধি বলা হয়। সিদ্ধান্ত হয় রাসূল সা. তার উমরা পালনকে এক বছর পিছিয়ে দেবেন এবং দশ বছর যাবত যুদ্ধ বন্ধ থাকবে। আর যে কোন গোত্র তাদের ইচ্ছানুসারে যে কোন দলের অন্তর্ভুক্ত হতে পারবে। এ চুক্তির ফলে খোযাআ’ গোত্র মুসলমানদের সাথে মিলিত হল এবং বনু বকর গোত্র কুরাইশদের সাথে মিলিত হল। সন্ধি চুক্তিসম্পন্ন হওয়ার পর রাসূল সা. পশু জবেহ করেন এবং মাথা মুড়িয়ে ফেলেন। মুসলমানগণ তাঁর অনুকরণ করেন। অতঃপর তিনি মুসলমানদেরকে নিয়ে মদিনায় ফেরত আসেন। আল্লাহ তায়ালা এই সন্ধিকে বড় বিজয় হিসেবে উল্লেখ করেন।

২২. মক্কা বিজয়
হুদায়বিয়ার সন্ধির পর নবী সা. বিভিন্ন গোত্রে তাঁর দাওয়াতী কর্মসূচী অধিক পরিমাণে বিস্তৃতি ঘটাতে সক্ষম হন। ফলে এক বছরের মাথায় মুসলমানদের সংখ্যা অধিক হারে বৃদ্ধি পেল। এরই মাঝে কুরাইশদের সাথে মৈত্রী চুক্তিতে আবদ্ধ বনু বকর মুসলমানদের মিত্র কবিলায়ে খুযা‘আর উপর আক্রমণ করল। এর অর্থ দাঁড়াল করাইশ এবং তার মিত্ররা হুদায়বিয়ার সন্ধি চুক্তি ভঙ্গ করল। রাসূল সা. এ সংবাদ পেয়ে অত্যধিক ক্ষুব্দ হন এবং মক্কা বিজয়ের উদ্দেশ্যে দশহাজার যোদ্ধার একটি বিশাল সেনাদল গঠন করেন।

তখন ছিল হিজরী অষ্টম বর্ষের রমাযান মাস। এদিকে কুরাইশরা রাসূল সা. এর মক্কাভিমুখে অভিযানের সংবাদ পেয়ে তাদের নেতা আবু সুফিয়ানকে ক্ষমা প্রার্থনা, সন্ধি চুক্তি বলবৎ এবং চুক্তির মেয়াদ আরো বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়ে নবী সা.-এর নিকট আসে। রাসূল সা. তাদের ক্ষমার আবেদন নাকচ করে দিলেন। কেননা তারা অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছে। আবু সুফিয়ান ইসলাম গ্রহণ ভিন্ন বাঁচার আর কোন উপায় না দেখে ইসলাম গ্রহণ করেন। অতঃপর সেনাদল (মক্কাভিমুখে) রওয়ানা হয়ে মক্কার কাছাকাছি আসলে মক্কাবাসী বিশাল দল দেখে আত্মসমর্পণ করে।

এরপর সমবেত মক্কাবাসীর প্রতি লক্ষ্য করে বললেন, আমি তোমাদের সাথে কেমন আচরণ করব বলে তোমাদের ধারণা? তারা বললো, সহানুভূতিশীল, উদার ও ভ্রাতৃত্বসুলভ আচরণ। আপনি মহৎ মহানুভবের ভ্রাতুষ্পুত্র। নবী করীম সা. তাদের সকলকে ক্ষমা করে দিয়ে বললেন, তোমরা সকলেই মুক্ত। এরপর মানুষ দলে দলে আল্লাহর দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত হতে লাগলো।

২৩. বিদায় হজ্জ
দশম হিজরী সনে রাসূল সা. মুসলমানদেরকে তাঁর সাথে হজ্জ পালন ও হজ্জের আহকাম শিক্ষা গ্রহণ করতে মক্কা যাবার আহ্বান জানান। তাঁর আহ্বানে প্রায় এক লক্ষের মত লোক সাড়া দিল। তাঁরা যিলকদ মাসের পঁচিশ তারিখ তাঁর সাথে মক্কা পানে বের হন। বাইতুল্লাহতে পৌঁছে প্রথমে তওয়াফ করেন। অতঃপর যিলহজ্জ মাসের আট তারিখ মিনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। এরপর নয় তারিখ জাবালে আরাফাহ অভিমুখে যাত্রা করেন। রাসূল সা. সেখানে অবস্থান করেন এবং মুসলমানদের উদ্দেশ্যে তার ঐতিহাসিক অমর ভাষণ দান করে তাদেরকে ইসলামী বিধি-বিধান ও হজের আহকাম শিক্ষা দেন এবং আল্লাহ তাআলার নিম্নোক্ত বাণী তিলাওয়াত করে শুনান- আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম। তোমাদের প্রতি আমার নিয়ামত পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্যে একমাত্র দ্বীন হিসেবে মনোনীত করলাম।”

২৪. রাসূল সা.-এর জীবনে যুদ্ধ
রাসূল সা. সর্বমোট তেইশটি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তন্মধ্যে মোট নয়টি যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। বাকীগুলো শুধু অভিযান হয়েছে। যথা- (১) বদরের যুদ্ধ (২)উহুদের যুদ্ধ, (৩)আহযাবের যুদ্ধ (৪) বনী কুরাইযা যুদ্ধ (৫) মুত্তালিক যুদ্ধ (৬) খাইবার যুদ্ধ (৭) ফাতহে মক্কা যুদ্ধ (৮) হুনাইনের যুদ্ধ এবং (৯) তায়িফের যুদ্ধ। আর রাসূল সা. নিজে সশরীরে অংশগ্রহণ না করে অপর কাউকে সিপাহসালার নিযুক্ত করে সাহাবায়ে কেরামকে যে জিহাদ অভিযানে প্রেরণ করেছেন,তাকে 'সারিয়্যা' বলে। এ ধরনের যুদ্ধের সংখ্যা ৪৩টি। এসবগুলো যুদ্ধই সংঘটিত হয়েছে হিজরতের পরে দশ বছরে।

২৫. আল্লাহর সান্নিধ্যে
বিদায় হজ্জ পরবর্তী বছর রাসূল সা. জ্বরাক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং প্রিয় সহধর্মিণী আয়েশা রা. এর ঘরে শয্যাগ্রহণ করেন। রাসূল সা. ৬৩ বছর বয়সে ১২ রবিউল আউয়াল সোমবার দুপুরের পর মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের ডাকে সাড়া দিয়ে ইহকাল ত্যাগ করে পরপারে গমন করেন। অতঃপর খলীফা নির্বাচনের কাজ সমাধা করে ১৪ রবিউল আউয়াল রাতে হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রা.-এর গৃহে রাসূল সা.-কে সমাহিত করা হয়।

রাসূল সা.-এর ইন্তেকালে মুসলমানগণ একবারেই নিরাশ ও হতাশ হয়ে যান। এ পরিস্থিতিতে আবুবকর রা. ভাষণ দেয়ার উদ্দেশ্যে দাঁড়িয়ে বলেন, যারা মুহাম্মাদের উপাসনা করতো তারা জেনে রাখুক যে, মুহাম্মাদ সা. আজ মৃত্যুবরণ করেছেন। আর যারা আল্লাহর ইবাদত করে, নিশ্চয় আল্লাহ তা'আলা চিরঞ্জীব, কখনো মৃত্যুবরণ করবেন না। এরপর নিম্নোক্ত আয়াত তিলাওয়াত করেন : “আর মুহাম্মাদ একজন রাসূল বৈ কিছুই নন। তার পূর্বেও বহু রাসূল অতিবাহিত হয়ে গেছেন। তাহলে কি তিনি যদি মৃত্যুবরণ করেন অথবা নিহত হন, তবে তোমরা পশ্চাদপসরন করবে? বস্তুত: কেউ যদি পশ্চাদপসরন করে, তবে তাতে আল্লাহর কিছুই ক্ষতি হবেনা। আর যারা কৃতজ্ঞ আল্লাহ তাদের সাওয়াব দান করবেন।”
(সূরা আলে ইমরান : ১৪৪)

পঠিত : ১৫৮৩ বার

মন্তব্য: ০