Alapon

মেয়েদের বিয়ে ভীতিঃ কারন ও প্রতিকার...


১.
আমাদের উপমহাদেশীয় সংস্কৃতি তে পরিবার কে অনেক প্রাধান্য দেয়া হয়। আর পরিবার গঠনের একটি বড় মাধ্যম হচ্ছে বিয়ে।

ইসলামে বিয়ে কে অনেক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সামর্থ্য থাকলে দ্রুত বিয়ের কথা বলা হয়েছে।

রাসুল (সঃ) বলেছেন, “হে যুব সমাজ! তোমাদের মধ্যে যারা সামর্থ্য রাখ তাদের উচিত বিয়ে করা।‘

বিয়েকে বলা হয়েছে ইমানের অর্ধেক। কারণ বিয়ের মাধ্যমেই একজন পুরুষ ও নারী তাদের জৈবিক চাহিদা পূরণের সুযোগ পায়।
তার ভালো কাজের সাহায্য কারী পায়। তাই একটা মানুষের জীবনে বিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

২.
আমাদের তরুণ তরুণীদের মনে বিয়ে নিয়ে এক ধরনের রোমাঞ্চ ও উত্তেজনা কাজ করে। সামাজিক ভাবে বিয়েটাকে ইতিবাচকভাবেই দেখা হয়।

এরপরও দেখা যাচ্ছে বর্তমানে তরুণ তরুণী দের বিয়ে করতে অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে। অভিভাবকরাও এখন দেরি করে বিয়ে দিচ্ছেন ।

এছাড়াও, বর্তমানে তরুণ তরুণীদের মনে বিয়ে কেন্দ্রিক এক ভয় ও আতংক কাজ করে। কিন্তু, কেন?

এর একটা বড় কারণ হচ্ছে আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক কিছু সংস্কৃতি । যা বিয়ের পরের সময়টাকে অনেক কঠিন করে তুলেছে। এজন্য অভিভাবকেরাও কম বয়সে নিজের মেয়েদের বিয়ে দিতে ভয় পায়।

৩.

আরেকটু ভেঙ্গে বলি।

যেমন ধরুন, একটা ১৮ বছর বয়সী মেয়ের বিয়ে ঠিক হল।
সেই কৈশোর পেরোনো মেয়েটির মনে স্বামীকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন।
স্বামীর হাত ধরে কত জায়গায় ঘুরবে,বারান্দায় বসে কফি খাবে, শাড়ি পরে স্বামীর জন্য অভিমানী চোখে অপেক্ষা করবে।

কিন্তু, বিয়ে হতে না হতেই সে দেখল, সে দায়িত্বের এক অথৈ সাগরে পড়েছে।
তার কল্পনা জুড়ে এতদিন ছিল শুধু স্বামী।
কিন্তু, একটি পরিবার তো শুধু স্বামী নিয়ে হয় না।
সেখানে থাকে শশুর শাশুড়ি - দেবর - ননদ আরো অনেক সম্পর্ক।

আমাদের সমাজে বিয়ের পরপরই একটি মেয়েকে পরিপুর্ণ দায়িত্বশীল হিসেবে দেখতে চায়।
প্রথমেই আত্নীয় স্বজনের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়, মেয়ে ঘরের কাজ ও রান্না বান্নায় কতটুকু পটু। মেয়েটার বয়স কম নাকি বেশি সেটা দেখা হয় না।
সে যে তার বাপের বাড়ি থেকে কিছুই শিখে আসেনি, নানা ভাবে তাকে বোঝানো হয়।

অথচ, এভাবে কথা বলে দোষ ধরা যে কোন গুনাহের কাজ হতে পারে তা কারও চিন্তাতেও আসবে না।
বরং ৬০-৭০ বয়সী শাশুড়ি টিও নিজের দক্ষতার সাথে নতুন বউ এর দক্ষতার তুলনা করে।
দেবর - ননদ বয়সে যত বেশি ই হোক না কেন, তাদের আদর যত্ন ঠিক মত হয় নি বলে খোটা দেয়।

আমি এমন ও দেখেছি স্বামী বড় বোন এর মেয়েও নতুন বউ এর চাইতে বয়সে বড়। অথচ, সেই বড় বোনের প্রতি দায়িত্ব পালন করা হয় নি বলে নতুন বউকে খোটায় খোটায় জর্জরিত করা হয়। স্বামীর সাথে ঘুরতে গেলে সেটার জন্য পরিবারে জবাবদিহি করতে হয়।

স্বামী বউ এর পিছনে কত খরচ করছে বা বউ তার নিজের বাড়ির জন্য কত খরচ করছে তা পরিবারে অত্যন্ত মুখরোচক গল্প।
বিয়ের পর ছেলে যে আমূল বদলে গিয়েছে এই দোষ টিও এসে পড়ে নতুন বউ এর ঘাড়ে।
কিন্তু প্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে এত দিন পরিবার থেকে কি শিক্ষা পেল সেই প্রশ্ন কেউ করে না। স্বামীর সাথে কোথাও বেড়াতে গেলেও মুখোমুখি হতে হয় নানা গঞ্জনার।

এত এত প্রত্যাশা পূরণ করতে না পেরে মেয়েটির মনের সব কষ্ট অভিমান গিয়ে পড়ে স্বামীর উপর। স্বামী বেচারাও দুদিকের চাপে প্রতিনিয়ত পিষ্ট হয়।

মেয়েটির কাছে বিয়ের আগের মধুর রোমান্টিক স্বপ্ন পরিণত হয় হতাশায়।
এর চেয়ে সেই বান্ধবীটিকে অনেক সৌভাগ্যবতী মনে হয়, যে ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে প্রজাপতির মত স্বাধীন ভাবে ঘুরছে, পড়ালেখা করছে, সেমিনারে যাচ্ছে, গবেষণা করছে।
মনে মনে কিশোরী মেয়েটি সিদ্ধান্ত নেয়, আমার যখন মেয়ে হবে তাকে অনেক পড়ালেখা করাব। অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে তার জীবনটাকে আমার মত এত জটিল ও কঠিন করে তুলব না।

এতসব কথা বলার উদ্দেশ্য এই নয় যে, বিয়ের পর একটি মেয়ে শুধু স্বামীর সাথে মজা করে ঘুরে বেড়াবে। পরিবারে কোন দায়িত্ব পালন করবে না।

এসব বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে, আমরা যদি কম বয়সীদের জন্য বিয়ে পরবর্তী সময়টাকে সহজ না করি, তবে দিন দিন নারী পুরুষ উভয়ের জন্য বিয়ে একটি ভীতি হিসেবে দেখা দিবে।

৪.
বিয়ের পরের জীবনটাকে কঠিন করে, নব বিবাহিত দম্পতিদের উপর পাহাড় সমান দায়িত্বের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে, তরুন তরুনীদের অল্প বয়সে বিয়েতে উদবুদ্ধ করা যাবে না।
আর্লি ম্যারিজকে উতসাহিত করতে চাইলে বিয়েটাকে সহজ করতে হবে।

এমন পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যাতে বিয়েটাকে দায়িত্বের এক সুকঠিন জগদ্দ্বল পাথর মনে না হয়। বিয়েটা হয় উপভোগ্য।

বিয়ে পরবর্তী জটিলতার কারনে, ওয়েস্টার্ন কালচার আমাদের উপর চেপে বসছে । তরুণ তরুণীরা ভাবে, যত দেরী করে বিয়ে হয় ততই ভালো। আরো বেশি দিন স্বাধীনভাবে চলা যাবে। জীবনটাকে উপভোগ করা যাবে।

এই ভয়েই অনেক নারী স্বনির্ভর হয়ে বিয়ে করতে চায়। তখন বিপত্তি বাধে অন্য জায়গায়।

আমাদের দেশে পড়ালেখা শেষ করে আত্মনির্ভর হতে হতে বয়স ত্রিশ পেরিয়ে যায়।
ফলে, বিয়ে হতে দেরি হয়। সন্তানের জন্মও হয় দেরিতে।
তৈরি হয় শারিরীক, মানসিক, সামাজিক নানাবিধ জটিলতা।

তাহলে এর সমাধান কি? কিভাবে তরুণ তরুণীদের মন থেকে বিবাহ নামক ভীতি দূর করা যায়?

৫.

ইসলামে এর সমাধান আছে।
আমরা যদি আমাদের পরিবার গুলোতে সঠিকভাবে ইসলামের চর্চা করি, সব কিছুতে আল্লাহর উপর ভরসা করতে পারি, তবে আমাদের পরিবার গুলোই হবে এক একটি জান্নাতের বাগান।
তখন বিয়ে নিয়ে তরুণ তরুণীদের মনে কোন ভীতি কাজ করবে না।

প্রশ্ন হল, পরিবারে ইসলামের চর্চা বলতে আসলে কি বোঝায়? শুধু মাত্র পর্দা আর পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ? না।

বরং ইসলাম মানা মানে নামাজে আল্লাহর সামনে কোরানের যে আয়াত গুলো তেলাওয়াত করি সেগুলো জীবনে প্রয়োগ করা। পরিবারের মানুষের সাথে আচার ব্যবহারে আল্লাহর নির্দেশ মানা, কার উপর কতটুকু অধিকার, দায়িত্ব আছে তার সঠিক জ্ঞান রাখা।

আমরা যদি ঐতিহ্যের কথা বলে আমাদের যুগ যুগ ধরে চলে আসা বাঙ্গালী কালচারের দোষ গুলো দূর না করি, তবে আস্তে আস্তে ওয়েস্টার্ন কালচারগুলো আমাদের উপর চেপে বসবে।
তখন বিয়ে না করে স্বাধীন জীবনকে অনেক সুন্দর লাগবে।
অথচ সেটাতো সুখ নামের আরেক মরীচিকা।

৬.

বিয়েকে সহজ ও সুন্দর পরিবার গড়তে নিচের পরামর্শগুলো মেনে চলার বিকল্প নেই।

ক.পরিবারকে সুন্দর ও আনন্দময় করতে প্রথমেই আমাদের গীবত থেকে দূরে থাকতে হবে।

কোরআন শরিফে বলা হয়েছে,
“ হে ইমানদারগণ, বেশী ধারনা ও অনুমান করা থেকে বিরত থাক কারণ কোন কোন ধারনা ও অনুমান গোনাহ।
দোষ অন্বেষণ করো না।
আর তোমাদের কেও যেন কারো গীবত না করে।
এমন কেও কি তোমাদের মধ্যে আছে যে নিজের মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়া পছন্দ করে?
দেখো তা খেতে তোমাদের ঘৃণা হয়।
আল্লাহকে ভয় কর।
আল্লাহ অধিক পরিমাণে তওবা কবুল কারী ও দয়ালু। (সুরা হুজরাতঃ ১২)

অনেক ধার্মিক মানুষ কেই দেখেছি কারো অনুপস্থিতে দোষ বলা যে গীবত তা জানে।
কিন্তু ছেলের বউ এর দোষ আত্নীয় সজন ও পাড়া প্রতিবেশীকে বলে বেড়ানো যে গীবত তা জানে না।

বউ যতই খারাপ হোক না কেন, তার দোষ দ্বিতীয় কোন ব্যক্তিকে বলা ইসলামে সম্পূর্ণ নাজায়েজ, গুনাহের কাজ।
এই গীবতের কারণে মানুষে মানুষে সম্পর্ক খারাপ হয় । সেই খারাপ সম্পর্ক থেকে ভাঙ্গে সংসার।

খ. ননদ- দেবর, তাদের ছেলে মেয়ের প্রতি বউয়ের দায়িত্ব পালন খুব ভালো কাজ।
এর জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে অনেক সওয়াব পাওয় যাবে।

কিন্তু, এর জন্য নতুন বউয়ের উপর কোন চাপ প্রয়োগ করা যাবে না।
মনে রাখতে হবে, ছেলে আর ছেলে বউয়ের দায়িত্ব এক নয়। ছেলের দায়িত্ব ছেলে বউয়ের উপর চাপিয়ে দেয়া অনুচিত, অন্যায়।

বউ যদি ইসলামিক মূল্যবোধ সম্পন্ন হয়, তবে এমনিতেই সে এগুলো করবে।
কিন্তু তাকে সময় দিতে হবে।
বউ এর বয়স কম হলে ধৈর্য্য ধরতে হবে।
বয়স বাড়ার সাথে সাথে সে আপনাতেই শিখে নিবে। প্রথম দিন থেকেই প্রতাশার পাহাড় চাপিয়ে দেয়া যাবে না।

গ. স্বামী- স্ত্রী যেন বিয়ের পর সুন্দর সময় কাটাতে পারে সে জন্য সাহায্য করতে হবে। অনেক পরিবারেই দেখা যায় স্বামী -স্ত্রীর ঘুরতে যাওয়া, একত্রে সময় কাটানোকে পছন্দ করা হয় না।

অথচ, স্বামী স্ত্রী একে অপরের সাথে যত বেশী কোয়ালিটি সময় কাটাবে ততই তাদের ভালোবাসা বাড়বে। বন্ধন মজবুত হবে। কমবে বিয়ে বহির্ভুত সম্পর্ক, পরকীয়ার সম্ভাবনা।

অনেক পরিবারেই দেখেছি, স্বামী-স্ত্রী নিজের মত করে ঘুরতে গেলে পরিবারের সবার মুখ কালো হয়ে যায়। এটা একেবারেই অনুচিত ও অগ্রহনযোগ্য।

ঘ.অনেকেই ভাইয়ের স্ত্রী কি করেছে,ভাইয়ের টাকা কোথায় খরচ করেছে তা নিয়ে সমালোচনা করে। দোষারোপ করে । কথা শোনায়।

মনে রাখতে হবে, এটা স্বামী স্ত্রীর একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়। এ বিষয়ে ভাই –বোন নাক গলানোর অধিকার রাখে না। এ নিয়ে সামনে পিছনে নিন্দা করা,অপমান অত্যন্ত গুনাহের কাজ।

কোরআন বলা হয়েছে, ‘দুর্ভোগ রয়েছে এমন প্রত্যেক ব্যক্তির জন্যে, যে (সামনে পেছনে মানুষদের) নিন্দা করে। (সুরা আল হুমাযাহঃ১)

৭.
তাই আসুন আমরা বিয়েকে সহজ করি।

নিজেদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে ইসলামের বিধিবিধান মেনে চলি।
গীবত, পরনিন্দা, পরচর্চা, অন্যকে কষ্ট দিয়ে কথা বলার অভ্যাস পরিত্যাগ করি।
নববিবাহিত দম্পত্তিদের বিয়ে পরবর্তী জীবনকে সুন্দর করতে যথাযথ দায়িত্ব পালন করি।

এতে আমাদের পারস্পরিক সম্পর্ক সুন্দর হবে। পারিবারিক বন্ধন হবে শক্তিশালী।
পাশাপাশি তরুন তরুনীদের মন থেকে বিয়ে ভীতি কমবে।
তারা আর্লি ম্যারিজে উতসাহিত হবে।
কমবে পরকিয়া, অবৈধ প্রেম ও অসামাজিক কাজের পরিমান।

তেমন একটা সমাজ ও পরিবেশই আমাদের কাম্য।

লিখেছেনঃ Kanij Sharmin Shithi

পঠিত : ১৩১২ বার

মন্তব্য: ০