Alapon

মৌলানা আজাদের রাজনৈতিক চিন্তাধারা...


১৯৪৭ এর রাজনীতিতে ইসলাম ও মুসলমানদের স্বার্থে যারা সোচ্চার ছিলেন , মাওলানা আবুল কালাম আজাদ রহ তাদের অন্যতম । তিনি কংগ্রেসের রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন আজীবন । হিন্দু -মুসলিম সহাবস্থানের পক্ষে ছিলেন তিনি । এ ব্যপারে তিনি দৃঢ়পদ ও ধ্রুপদী মানসিকতার ধারক ছিলেন। তার সপক্ষে ছিল শক্তিশালী যুক্তি।

১)
তিনি বলেন," কুরআনে কওম শব্দটা শুধু মুসলমানদের জন্য প্রযোজ্য নয়, বরং ব্যাপক, অন্যান্য মানুষও এর অন্তর্ভুক্ত । তিনি মনে করেন, পাকিস্তান একটি মতাদর্শ। ভারতীয় মুসলমানদের জন্য এটি সংকট নিষ্পত্তির উপায় কি না তা তর্কসাপেক্ষ ব্যাপার । ইসলামে কোথাও লেখা নেই যে, বিশ্বাসী আর অবিশ্বাসীদের মাঝে দেশভাগ করতে হবে। উক্ত মতাদর্শে দেশ ভাগ করা হলে ইসলামের সার্বজনীনতা থাকলো কোথায়?
তাঁর দৃষ্টিতে মুসলিম লীগের লক্ষ্য বাস্তবায়িত হলে পাকিস্তান ও ভারতীয় মুসলমানদের কাছে ইসলাম একটি দুষ্প্রাপ্য বস্তু হয়ে যাবে।
তিনি একথাও বলতেন, " পাকিস্তান সৃষ্টির সূচনায় শুরু হবে ধর্মীয় সংঘাত। যাদের হাতে ক্ষমতার লাগাম থাকবে ইসলামের ক্ষতিটা তাদের হাতেই হবে। আযাদের এ কথা থেকে বুঝা যায়, মুসলিম লীগের নেতাদের মানসিকতা তার দৃষ্টি এড়ায় নি।
স্বচ্ছ ইশারায় তাদের সেক্যুলার চিন্তাকে তিনি প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন।

২)
ধর্মের দিক দিয়ে তাকালে ভারত বহুধাবিভক্ত যথা : হিন্দু, মুসলমান,পারসি,শিখ। এদের মধ্যে হিন্দু মুসলিমদের প্রভেদটা প্রগাঢ়। তাই বলে বিভেদের এ গাঢ়তা ভারতের স্বাধীনতা লাভের পথে অন্তরায় হবে বলে তিনি বিশ্বাস করতেন না।
তার মতে, স্বাধীনতা হচ্ছে রহমত। এটি প্রাপ্তির অধিকার সার্বজনীন, ধর্ম এখানে গৌন বিষয়। আর ইসলাম এমন একটি ধর্ম যা আঞ্চলিকতার বৃত্তে আবদ্ধ নয়।

৩)
তিনি মনে করেন, মুসলমানগন সম্প্রতি ঐক্য গড়ছে সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে, ইসলামের নামে না। গোষ্ঠীর প্রতি নির্ভেজাল আনুগত্যই তাদের মতে ইসলাম। গোষ্ঠীতো বহু, ওহাবি,শিয়া,সুন্নি ছাড়াও কতো গোষ্ঠীর উদ্ভব হয়েছে। শাখাগত বিষয়েও বাদানুবাদ সীমা ছাড়াচ্ছে। যখন তখন কাফের ফতোয়া দেওয়া হচ্ছে। যাদের কাজ ছিল অবিশ্বাসীদের কাছে ধর্মকে পৌঁছে দেওয়া, তারাই বিশ্বাসীদের ধর্ম কেড়ে নিচ্ছে। ইসলামের ইতিহাসে কতো সৎ-ধার্মিক লোককে কাফের ফতোয়া দেওয়া হয়েছে, তার হিসাব কঠিন। সর্বোপরি এ টাইপের সীমাবদ্ধতা থেকে আমাদের উঠে আসতে হবে।

৪)
পাকিস্তান সৃষ্টির কল্পনা একটি ঘৃণা থেকে সৃষ্ট।এ ঘৃণার বেঁচে থাকা অবধি এ রাষ্ট্রের অস্তিত্ব। আর ভূমিস্বল্পতার দরুন পাকিস্তানের পক্ষে সকল মুসলমানদের স্থান দেওয়া অসম্ভব। একদিকে যেমন হিন্দুদের পাকিস্তানে থাকা সম্ভব হবেনা, তাড়িয়ে দেওয়া হবে। হুবহু প্রতিক্রিয়া ভারতেও দেখা দিবে। এ অবস্থায় ভারতীয় মুসলমানদের জন্য ৩ টি পথ খোলা থাকবে।
ক] তারা নারকীয় অত্যাচারের শিকার হয়ে পাকিস্তান পাড়ি জমাবে। কিন্ত পাকিস্তানের জন্য তাদের বাসস্থান দেওয়া সম্ভবপর হয়ে উঠবে না।
খ ] তারা দাঙ্গা-হত্যার কবলে পড়বে। এটি ততদূর বিস্তৃত হবে,যতদূর দেশভাগের তিক্ততা বিদ্ধমান থাকবে।
গ] অন্যথায় হতাশার শিকার হয়ে মুসলমানরা ধর্ম ত্যাগে বাধ্য হয়ে যাবে।

দেশভাগের অভিজ্ঞতা :

প্রথমত :
একটি দেশ যখন বিভক্ত হয়ে যায়, দুর্বল হয়ে পড়ে। উন্নতির চেয়ে অবনতির গতি দ্রুততর হয়। ইবনে খলদুন তার "মুকাদ্দিমাতে " রাষ্ট্রভাগ নিয়ে আলোচনা এনেছেন -" তিনি দেশভাগের প্রেক্ষাপট ও উৎপত্তি সংক্রান্ত কথাবার্তায় যে দিকটি চিহ্নিত করেছেন, সেটি হলো -দেশের শান্তি, সমৃদ্ধি ও স্থিরতা। দেশ যখন সমৃদ্ধ হয়,পরষ্পর রেষারেষি হয়, অহেতুক বিতর্কের জন্ম হয়। এক পর্যায়ে দেশভাগের সূত্রপাত ঘটে।
কিন্ত ভারত ভাগ কালে দেশ স্থিতিশীল ছিল না। সংকটে ছিল। সেসময় ভারতের অসহায় অবস্থা। সবেমাত্র স্বাধীনতার ভেলা ঘাটে ভিরছে। এখনো গড়ে উঠেনি অর্থনৈতিক ভিত্তি। প্রয়োজন ছিল ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশের সমৃদ্ধি ঘটানো। আর যেকোনো রাষ্ট্র বিভক্ত হলে পূর্বের তুলনায় দুর্বল হয়ে পড়ে,গতি শ্লথ হয়। উভয় রাষ্ট্রের ক্ষেত্রের এটি ঘটেছিল। বিশেষত পাকিস্তান। তাই বলা যায়, '৪৭ এর দেশভাগ মানে -' মরণোন্মুখ জন্তর গর্ভে একটি প্রানহীন সন্তানের জন্ম'।

দ্বিতীয়ত :
ভারতের রক্তাক্ত গর্ভপাতে পাকিস্তানের জন্ম হলো। প্রচণ্ড রক্তক্ষরণ হলো। একটি অন্ধ আবেগের তাড়নায় অজস্র মানুষ গৃহহারা হলো।হতাশার কালো মেঘে ছেয়ে গেল গোটা দেশ। কাশ্মীরের বিরোধটির নিষ্পত্তি হয়নি এখনো,অথচ জিন্নাহ সাহেবের মৃত্যু হলো। ১৯৪৮ সালে। এ বিরোধের রেষ ধরেই আজ কাশ্মীরে চলছে গুম,হত্যা,কারফিউ সহ অকথ্য সব নির্যাতন।
যদিও গান্ধী এর আগেই মারা যান, কিন্ত তার প্রতিনিধিত্ব করবার মতো লোক ভারতে ছিল। নেহরু ছিল, সরদার প্যাটেল ছিল, আবুল কালাম আযাদের মতো শিক্ষা-মন্ত্রী ছিল। কে ছিল? যে জিন্নাহর পর পাকিস্তানের মুখপাত্র হবে। কেউই ছিল না। যারা ছিল তারা অদূরদর্শী,অপাংক্তেয়।
ফলে একজন সেক্যুলার পুঙ্গনেতা একটি অন্ধ গোষ্ঠীর দিকপ্রদর্শক হয়েও শেষে মাঠে মারা গেল।

তৃতীয়ত :
পাকিস্তান যে অঞ্চলগুলি নিয়ে জাতীভিত্তিক রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন করল, তাতে ইসলামী ঐতিহ্যের কিই-বা ছিল। সবতো ভারতেই রয়ে গেল। সূদীর্ঘ ৬০০ বছরের মুসলিম শাসনের সকল কীর্তি ভারতেই পড়ে আছে। কোন কোন কীর্তি বিশ্ব ঐতিহ্যে ভারতের প্রভাব ও মূল্যায়ন বৃদ্ধি করছে। সব মিলিয়ে মুসলিমগন রিক্তহস্ত। বতর্মানে ভারতে এ কীর্তিগুলোর প্রদর্শনী হয়, কতো মানুষ এসে মোহিত, বিমুগ্ধ হয়। কেউ গর্ব করে না অনুপ্ররেণা পায়না । যারা গর্ব করার,অনুপ্রানিত হবার, তারা কবেইতো এর দখল হারিয়েছে। দেশভাগ না হলে,ভারতের ধর্ম সংস্কৃতি,সংগীত,শিল্প,সাহিত্যে ও স্থাপত্যে মুসলিম শাসনের যে অবদান তা থেকে মুসলমানরা শক্তি অনুভব করতো। কখনো নিজেদেরকে পর-হিতৈষনার পাত্র বলে ক্ষুণ্ণ হতে হতো না।এক সময় দেখা যেত, ইসলামের সার্বজনীনতা ভারতে মুসলমানদের সর্ববৃহৎ সম্প্রদায়ে রুপ দিতো।

চতুর্থত:
এছাড়া মুসলমানগন দেশভাগের কারণে ভৌগোলিক- ভাবে এমন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল, শক্তি ম্লান হয়ে গেল। ঐক্যের সম্ভাবনাটাও কল্পনাতীত হয়ে গেল। অর্ধেক পড়ে রইল সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের রাষ্ট্রে, বাকি অর্ধেক পাকিস্তানে।
'খালিদা এদিব খানম ' তুরস্কের বিদুষি নারী লেখক । ইস্তাম্বুলে তার সাথে সৈয়দ আলী আহসানের ফোনালাপ হয়। সৈয়দ সাহেব পাকিস্তান থেকে এসেছেন শুনে, খালিদা এদিব খানম বললেন," মুসলমানরা পাকিস্তান সৃষ্টি করে উপমহাদেশে নিজেদের অস্তিত্বকে খন্ড-বিখন্ড করে তুলেছে, যে ভারতকে আমি জানতাম সেই ভারতে মুসলমানরা নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা না করে ভুল করেছে।

পঞ্চমত :
পাকিস্তানের কফিনে সর্বশেষ পেরেক দাবানো হয় বাংলাদেশকে বিভাগ করার মধ্য দিয়ে
এক্ষেত্রেও জিন্নাহ ও তার অনুচরদের উগ্রতা প্রতিফলিত হয়েছে। তারা ধর্মের নামে বাংলা ভাষার টুটি চেপে ধরতে প্রয়াস চালিয়েছে। এমন জগন্য মেছাল দুনিয়ার কোথাও নাই। ইসলামের কোথায় আছে যে, সবাইকে বাধ্যতামূলক আরবি ভাষা শিখতে হবে? যেখানে আরবির বিষয়েই ঐচ্ছিকতা দেওয়া আছে, সে স্থানে উর্দুর কয় পয়সা মূল্য আছে?
ড মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ লিখেছেন," ইসলাম প্রীতি আর মুসলিম ঐক্যের বুলি কতটুকু আন্তরিক,তাহা অনায়াসে বুঝিতে পারা যায়। আমরা পাকিস্তানে ইসলামের মতবাদকে কার্য্যে প্রযুক্ত দেখিতে চাই। উর্দুর পরিবর্তে আমরা ইসলামী ভাষা আরবিকেই রাষ্ট্রভাষা রুপে দেখিতে চাই। "
বলাবাহুল্য, "উর্দু রাষ্ট্রভাষা হোক।" এর পক্ষে যাদের অন্তরে দড়পড়ানি ছিল,তারা কতোটা ইসলামী বিধান মেনে চলতো? মুখে দাড়ি ছিল কতোজনের? এমন লোকদের মুখে ধর্মের বানী প্রতারনাই-তো।

মোদ্দাকথা :

যারা দ্বিজাতীতত্ত্বের কথা বলেছেন, দেশভাগের আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন, তাদের তত্ত্বের সারশূণ্যতা উন্মোচিত হয়েছে। সবকিছু ব্যর্থতার সাগরে তলিয়ে গেছে। তার অর্থ এই নয় যে, মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান ও বাংলাদেশ তাদের আবেদন হারিয়েছে,অগ্রযাত্রা শ্লথ হয়ে নিথর হয়ে আছে বা থাকবে। বরং তারা ইসলামি আদর্শ-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করবে। অন্যদের মাইলফলক হবে।
অন্যদিকে যারা হিন্দু রাষ্ট্রের অধিবাসী তারা মাদানির মতো চেতনাদীপ্ত হবে। উচ্চকিত রবে গর্বের বার্তা প্রতিধ্বনিত করবে,"এ ভারত আমাদের " আল্লামা ইকবালের কন্ঠেই একসময় প্রতিধ্বনিত হতো -" সারে জাঁহা মে আচ্ছা হিন্দুসতাঁ হামারা
হাম বুলবুলে হ্যাঁয়,ইসকি এ গুলিসতাঁ হামারা "।

সংগৃহিত...

পঠিত : ৫৬৯ বার

মন্তব্য: ০