Alapon

অলিম্পিকের দেশে, ম্যারাথনের পদযাত্রা...



ম্যারাথন! ইতিহাসের বিখ্যাত আলোচিত জায়গার মধ্যে একটি। খৃষ্টপূর্ব ৪৯০ অব্দে গ্রীক সেনাপতি মিলটিয়াডেস এর সাথে পারস্য অধিপতি রাজা দারায়ুসসের সাথে এক ভয়াবহ লড়াই সংঘটিত হয়। ইতিহাসে এই লড়াইকে ম্যারাথনের লড়াই হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। স্থানটির নাম "ম্যারাথন"। এই শব্দটি শিক্ষিত মানুষেরা নিশ্চয়ই শুনে থাকবেন। বর্তমান গ্রীসের রাজধানী এথেন্সের সন্নিকটে ওরোপস নামক ছোট্ট শহরের পাশেই জায়গাটির অবস্থান। ম্যারাথনের লড়াই নিয়ে বহু চিত্র কর্ম, স্থির চিত্র, চল চিত্র, কার্টুন চিত্র নির্মিত হয়েছে। জলে-স্থলে ৮০ হাজার পারস্য সৈন্যের আক্রমণে গ্রীকের ‘এথেন্স ও স্পার্থা’ ব্যতীত বাকী সব বড় বড় শহর পারস্যের দখলে চলে যায়। গ্রীক জেনারেল ‘মিলটিয়াডেস’ ১০ হাজার সৈন্য নিয়ে পারস্য বাহিনীর উপর শেষ বারের জন্য মরণ আঘাত হানতে ম্যারাথন নামক স্থানে মোকাবেলায় লিপ্ত হয়। দীর্ঘসময়ের ভয়ানক ও বীভৎস এই যুদ্ধে পারস্য বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে পরে। গ্রীক তখনও পরিপূর্ণ বিজয় অর্জন করতে না পারলেও, বিজয় সুনিশ্চিত! এই কথাটি এথেন্সে অবস্থিত ভয়ার্ত জনসাধারণ কে অতিসত্বর জানানো প্রয়োজন হয়ে পড়ে।

এ খবর এক্রোপলিসে তথা এথেন্সের রাজ দরবারে পৌঁছানোর জন্য এগিয়ে আসে ‘পেয়িডিপ্পাস’ নামক এক তরুণ সৈনিক! আমরা জিতে গেছি! আমরা জিতে গেছি! এই বাক্য বলতে বলতে, কোন জায়গায় না দাঁড়িয়ে, একনাগাড়ে বিরতিহীন ভাবে ৪২.২ কিলোমিটার তথা প্রায় ২৬ মাইল পথ অতিক্রম করে খবরটি শহরে পৌছাতে সচেষ্ট হয়। এ খবর তিনি যখন এথেন্সের উপকণ্ঠে এক্রোপলিস প্রাসাদে পৌঁছে দেন, তখন তিনি ভয়ানক পরিশ্রান্ত। ক্লান্ত শরীর নিয়ে তিনি যেই মাত্র দাঁড়ালেন, সাথে সাথেই তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লে!
প্রায় আড়াই হাজার বছর আগের কাহিনী মনে করে এখনও গ্রীক বাসী তাঁকে সম্মান করে। সৈনিক ‘পেয়িডিপ্পাস’ এর স্মরণে একটি দৌড় প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। এই দৌড় প্রতিযোগিতাটি বর্তমানে সারা দুনিয়াতে ম্যারাথন দৌড় প্রতিযোগিতা হিসেবে পরিচিত। প্রতি চার বছর অন্তর অনুষ্ঠিত অলিম্পিক গেইমে ম্যারাথন দৌড়ের ইভেন্টটি সংযুক্ত করা হয়। উল্লেখ্য, ম্যারাথনের এই ঘটনার প্রায় ২০০ বছর আগে থেকে তথা আজ থেকে প্রায় ২৭০০ বছর পূবেই গ্রীসে প্রথম চালু হয়েছিল অলিম্পিক গেইম!

অনেক ইচ্ছে ছিল ম্যারাথনের সেই এলাকা দেখার। খবর নেওয়া শুরু করলাম কিভাবে যেতে হবে। হোটেল ম্যানেজার থেকে বিস্তারিত তথ্য নিয়ে এথেন্স শহর থেকেই ১৯৯৭ সালের ১৩ই রমজান রোববার ছুটির দিন সতের জন মিলে শহর এলাকার বাসে উঠলাম। উদ্দেশ্য বাসের শেষ গন্তব্য স্থল ম্যারাথনের নিকটবর্তী ছোট্ট শহর ‘ওরোপোস’ পৌঁছানো। সেখানে গিয়েই সিদ্ধান্ত নিতে হবে বাকী পথ কিভাবে যেতে হবে। জীবনে বহু ভ্রমণে বের হয়েছি তবে এবারের ভ্রমণটি সত্যিই ব্যতিক্রমী ও অদ্ভুত অনুভূতি সম্পন্ন! তিন জন পাকিস্তানী, পাঁচ জন ভারতীয়, এক জন জর্ডানি, দুই জন্য লেবাননী, দুই জন ফিলিস্তিনি, এক জন মালয়েশিয়ান, এক জন ইন্দোনেশিয়ান, এক জন কানাডীয় এবং আমি একমাত্র বাংলাদেশী সতের জন একই অফিসের কলিগ মিলে ম্যারাথন লেক দেখতে ভ্রমণে বের হয়েছি। রোজার দিনের সকালে চোখে ঘুমের আমেজ নিয়ে বের হলেও; সাত সকালে এথেন্সের ফকফকা আকাশ, আরাম দায়ক শীতল বায়ু, ধূলী-মুক্ত বাতাসে যখন নামলাম, বুঝতে পারলাম ভ্রমণ খুবই উপভোগ্য হবে। এদেশে একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে জলবায়ু, নারী ও যৌবন এই তিন জিনিষে ভরসা রাখতে নেই! এসব কথা সেদেশের সাথে সামঞ্জস্য হলেও আমাদের কখনও পরখ করে দেখা কিংবা বিশ্বাস করার কোন কারণ ঘটেনি। সুন্দর আকাশ, নির্মল বায়ু, মিষ্টি রোদ, শহরের ফাঁকা রাস্তা দেখে ভ্রমণটি দারুণ উৎসব মুখর হবে এই ধারনা বদ্ধমূল হল এবং যাত্রা শুরু হল।

গ্রীসে রাস্তার পাশে দেখার মত অনেক কিছুই আছে। পুরো দেশটিই যেন বিশাল পাহাড়ের দেওয়ালে ঘেরা। কখনও পাহাড়ের কোল ঘেঁষে, কখনও গিরিপথ দিয়ে, কখনও উপত্যকার উপর দিয়ে, কখনও সমতলের পিট বেয়ে চলে গেছে রাস্তা। পাশে দেখা যাবে দিগন্ত বিস্তৃত গমের ক্ষেত। কোন বাড়ী ঘর নেই, কৃষিকাজে ব্যবহৃত পানি সরবরাহের যন্ত্রপাতি নজরে পড়ে। দেখলেই বুঝা যায় কৃষিতে এদেশের সরকারের স্বদিচ্ছা কেমন! কোন ফাঁকা জায়গা খালি নাই, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে মাইলের পর মাইল কৃষি আর কৃষিকাজের সমারোহ। কোথাও আঙ্গুরের ক্ষেত-খামার নজরে পড়ে, কোথাও কমলালেবু। এদেশের সর্বত্র আঙ্গুর, কমলালেবু ও প্রচুর পরিমাণে জলপাই জন্মে। আমাদের দেশে বিভিন্ন এলাকার বনে জঙ্গলে নানাবিধ গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ নজরে পড়ে যার প্রায় সবগুলো কাঁটা নির্ভর। সেদেশের পাহাড়ে ছোট ছোট নাম না জানা গুল্মের জন্ম হয় যেগুলোতে কাটা থাকেনা এবং নানা রঙ্গ-বেরঙ্গের ফুল জন্মে। রাস্তার পাশে আগাছা হিসেবে বিচিত্র ধরণের টিউলিপ ফুল দোল খেতে থাকে, যা দেখতে সত্যিই মনোরম, মনোহর! পথে এসব দেখতে দেখতে শহর এলাকার বাস চলছিল। ফলে এক ঘণ্টার যাত্রাটি দুই ঘণ্টা ব্যয়ে বেলা দশটায় ‘ওরোপোস’ নামক ছোট্ট শহরে পৌঁছল। দেখতে আমাদের দেশের বড় আকৃতির কোন উপজেলা সদরের মত হবে। সকল বাড়ীগুলো পাহাড়ের ঢালুতে গড়া। গ্রীক-বাসী সমতল ভূমি চাষবাসের জন্য এবং পাহাড়ের কোল ও নদীর তীর বাড়ী করার জন্য বেছে নেয়। আমাদের দেশের মত সমতলীয় জনপদ এখানে দেখা যায়না বললেই চলে। এথেন্স শহরটিও পাহাড় আর সমুদ্রের কোল ঘেঁষে গড়ে উঠেছে।

ওরোপোস থেকে ম্যারাথনে কোন বাস যায়না, ট্যাক্সি ব্যতীত দ্বিতীয় কোন বিকল্প নাই দেখে চারটি ট্যাক্সি ভাড়া করেই ম্যারাথনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। এই যাত্রায় শুধু পাহাড় আর পাহাড়, কোন সমতল নেই, ক্ষেত খামার নেই। ট্যাক্সি একবার পাহাড়ের চুড়ায় উঠল তো মুহূর্তেই নীচে নামার রাস্তা। পিচ করা প্রশস্ত রাস্তা, মোটেও বিপদ জনক নয়, এই যাত্রায় একটু ভিন্ন ধরনের আনন্দ লাগল। বাতাসে নানা ধরনের পাহাড়ি লতা-পাতার সুবাস মিশ্রিত ঘ্রাণে মন উচাটন হয়। কখন ম্যারাথন এসে পৌঁছলাম বুঝতেই পারলাম না। যেখানে নামলাম সেখানে হাট-বাজার কিছুই নেই। কোন জনবসতি চোখে পড়ল না। ঝুপড়ি আকৃতির একটি অস্থায়ী দোকান চোখে পড়ল। তাতে কলা, বিস্কুট, কেক নজরে পড়ল আর সারি সারি মদের বোতল সাজানো দেখতে পেলাম। ট্যাক্সি ওয়ালাদের স্থানীয় মুদ্রা ‘দ্রাগমা’ দিয়ে প্রশ্ন করলাম আমরা কিভাবে ফিরে যাব? এই প্রশ্নের উত্তরে তারা আমাদের কিছু একটা বলতে চাচ্ছিল তবে আমরা কেউ বুঝতে পারছিলাম না। ইংরেজি বুঝে এমন কোন গ্রীক সেখানে ছিল না। আবার আমাদের পক্ষে গ্রীক ভাষা দুই এক লাইন যা শিখা হয়েছে তা দিয়ে আজকের মুসিবত উদ্ধারের মত পূঁজি নাই। তখনও মোবাইলের ব্যবহার শুরু হয়নি যাতে করে বাহির থেকে সহযোগিতা নিব। ড্রাইভারদের আকারে ইঙ্গিতে বুঝানো হল, সূর্যের অবস্থান আকাশের ঐ স্থানে হলে, চারটি ট্যাক্সি যেন আমাদের নিতে আসে। তারাও মাথা নেড়ে সায় দিল।

আড়াই হাজার বছর আগে ম্যারাথন যুদ্ধ হয়েছিল তার কোন নিদর্শন থাকা সম্ভব নয়। তার পরও প্রত্মতাত্ত্বিক বিভাগ যেখান থেকে যুদ্ধটা শুরু হয়েছিল সে স্থানকে চিহ্নিত করে রেখেছে। তবে এই জায়গায় সবচেয়ে দৃশ্যনীয় বস্তু হল ম্যারাথন লেক। এটি সুস্বাদু পানির লেক, পুরো লেকের পানিই হালকা নীল বর্ণের, চারিদিকে হাজার হাজার পাখির সমারোহ। লেকের একপাশে পাইন গাছের দিগন্ত বিস্তৃত সারি। আরেক পাশে সবুজ পাতার বিবর্ণ গাছের সমারোহ। এটি দেখতে খুবই মনোরম, কেননা ঋতুর শুরুতে সবুজ পাতার সমারোহ, ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে গাছের পাতা বিবর্ণ হয়ে অন্য রং ধারণ করা সত্যিই অতুলনীয়! বছরে চার বার একই জায়গায় গেলে, চার বর্ণের প্রকৃতি উপভোগ করা যায়! লেকের এক জায়গায় বাঁধ দিয়ে পানি আটকানো হয়েছে। এই বাঁধের নাম ‘ম্যারাথন ডেম’। বাঁধের কারণে বিশাল এলাকা জুড়ে পানি জমে লেকের সৃষ্টি হয়েছে, আমাদের দেশের কাপ্তাই লেকের মত।

ম্যারাথন ডেম পৃথিবীর একমাত্র বৃহত্তম ডেম যা মার্বেল পাথরে নির্মিত। সমুদ্র তীরে অবস্থিত এথেন্স শহর থেকে ২৬ মাইল দূরের এই লেক হতে শহরের মানুষদের সুপেয় মিষ্টি পানির ব্যবস্থা করা হয়। এই অঞ্চলের চাষাবাদ এবং শহরের পানি সরবরাহ করেও এতে প্রচুর পানি অতিরিক্ত থাকে। এই বাঁধের কোন নিরাপত্তা ব্যবস্থা চোখে পড়েনি, বাধের উপর দিয়ে প্রাইভেট কার পার হয়ে অন্যদিকে চলে যেতে পারে। কোন গেইট নাই, দারোয়ান নাই, পুলিশ নাই। এত বড় একটি রাষ্ট্রীয় সম্পদ হেফাজত করার জন্য কাউকে চোখে পড়েনি। আগে থেকেই দুইজোড়া ইটালিয়ান দম্পতি বসা ছিলেন এবং দুই ঘণ্টায় দুটি প্রাইভেট কার কে সে এলাকা পাড়ি দিতে দেখলাম। মানুষের কাছে দেশপ্রেম বোধ জাগ্রত থাকলে এভাবে সরকার নিরাপত্তার সকল দায়িত্ব জনগণের উপর ছেড়ে দিয়ে নির্বিঘ্নে ঘুমাতে পারে।

সূর্য সঠিক জায়গায় হেলে পড়ার পড়, ট্যাক্সি যেখানে আমাদের নামিয়ে দিয়েছিল, সেখানে পৌঁছলাম। দেখতে পেলাম কোন ট্যাক্সি আসেনি এমনকি ঝুপড়ি মার্কা দোকানটিও বন্ধ! ব্যাপারটি নিয়ে সবার মনে দুঃচিন্তা ছিল কিন্তু দোকানটি বন্ধ দেখার পর, সবার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। সবারই ভয়ঙ্কর খিদে আর আমিই একমাত্র রোজাদার তাই খিদে মোকাবেলা করার অভ্যাস রপ্ত হয়েছিল। বেশী দুঃচিন্তায় আছে আমাদের সাথে থাকা বাকী তিনজন মুসলিম ভাই। রোজার সময়ে খালি পেটে দীর্ঘ পথ হাঁটার তিক্ত অভিজ্ঞতা আমার ছিল, সেটা অন্য কারো ছিলনা! এই রাস্তার দূরত্ব সম্পর্কে কারো কোন ধারণা নাই, হাঁটা শুরু করলে কতক্ষণ লাগতে পারে সে ধারণা করারও সেই মুহূর্তে কঠিন। যাক, সবাইকে ডেকে একটি বক্তব্য দিলাম, তাদের বুঝালাম, গ্রীসের এই পাকা রাস্তার চেয়েও জটিল-দূরহ দীর্ঘ রাস্তা বৃষ্টির দিনে রোজা রেখে একাকী পাড়ি দিয়েছি। সুতরাং কোন ভয় নেই, কোন চিন্তা নেই, আমিই তোমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাব এবং সংক্ষিপ্ত সময়ে নিকটবর্তী শহর ওরোপোসে পৌঁছতে পারব। তবে শর্ত হল, সবাইকে একটি করে নিজ দেশের দেশাত্মবোধক গান গাইতে হবে। ভারী পরিশ্রমে অভ্যস্ত নয় এ সকল ব্যক্তিদের মনে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসল। আলালের ঘরে দুলাল মার্কা দুই জন চোখের কোণে জমে থাকা পানি অতি সন্তর্পণে মুছেও নিলো।

ভারতীয় এক বন্ধু বলল আজকে যেহেতু হাঁটতেই হবে তাহলে এই হাঁটার যাত্রাটি আমারা সৈনিক ‘পেয়িডিপ্পাসের’ স্মরণে উৎসর্গ করতে পারি। আর আমাদের এই যাত্রার নাম হবে ‘ম্যারাথনের পদযাত্রা’ দূরত্ব ছাব্বিশ মাইল নাই হোক দশ মাইল তো হবে! অফিসে গিয়ে বাহাদুরি করে বলা যাবে আমরা ‘পেয়িডিপ্পাসের’ স্মরণে ম্যারাথন পদযাত্রায় অংশ নিয়েছি। এতে করে তাদের কাছে গৌরব করা যাবে, যারা অংশ নিতে পারেনি তারা আফসোস করবে। বললাম ঠিক আছে, মুছিবতে পড়ে সমস্যাকে সম্ভাবনায় রূপান্তর করে নেওয়া, হতাশা দুর করার উত্তম মাধ্যম হতে পারে। রোজা রেখে এভাবে ম্যারাথন থেকে পদযাত্রার পরীক্ষা দিতে হবে কল্পনাতেও ভাবিনি! শুরু হল যাত্রা, কেউ পেশাদার গায়ক-শিল্পী না হওয়াতে গানের পর্ব খুবই তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল। একই ভাষাভাষী না হওয়াতে গল্প-কৌতুক বলেও আনন্দ পাওয়া গেলনা। পরিশেষে যে যার মত করে চিৎকার করে বনের চিরাচরিত নিস্তব্ধতাকে খান খান করে আনন্দ উল্লাসে রাস্তার দূরত্ব ছোট করতে থাকল।

আমার জন্য যাত্রার এই অংশটি খুবই ফলপ্রসূ হল। উদ্ভিদ বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলাম বলে পথে পথে বিভিন্ন প্রজাতির গাছের সাথে পরিচিত হয়েছিলাম। ইউনানি চিকিৎসা বিজ্ঞানের অব্যবহৃত একটি ডিগ্রিও আমার ঝুলিতে ছিল। আরো কৌতূহলের বিষয় ছিল, আরবিতে 'ইউনান' শব্দের অর্থ হল ‘গ্রীক’। অর্থাৎ ইউনানি চিকিৎসা বিজ্ঞানের অর্থ দাড়ায় হল ‘গ্রীক চিকিৎসা বিজ্ঞান’। ফলে ইউনানি ঔষধে গ্রীকের লতা-গুল্মের একটি যোগসূত্র আছে। চলার পথে পথে আমি সেসবে ব্যস্ত হলাম এবং পুরো পথটাই আমার আনন্দে কাটল। এই বনে রাস্তার পাশে প্রতি আধা কিলোমিটার অন্তর অন্তর মৌমাছির চাষ করা হয়েছে। জানিনা এটা কি ব্যক্তি উদ্যোগে নাকি সরকারী উদ্যোগে? কোথাও এক সাথে সর্বোচ্চ ১৫০টির মত মৌমাছির বাসা দেখেছি, যার কোন কোনটি ছয় তলা বিশিষ্ট। সৌখিন মৌমাছি পালক হিসেবে দেশীয় জীবনে আমার একটু কুটনাম ছিল। দক্ষতা ছিল অভিজ্ঞতাও ছিল। একটি মৌচাক খুলে দেখেছি যাতে আধা মণ মধু অনায়াসে পাওয়া যাবে। কোন পাহারা ব্যতীত রাস্তার পাশে গড়ে উঠা এসব খামারে চুরি হয় বলে মনে হল না। কেউ গাড়ী নিয়ে এই রাস্তায় অনায়াসে কয়েক ড্রাম মধু নিতে যেতে পারবে। গ্রীক জীবনে পরবর্তীতে অন্যান্য বন-জঙ্গলেও এভাবে মধুর চাষ হতে দেখেছি।

কিছু দূর যাওয়ার সবার বিশ্রামের প্রয়োজনীয়তা অনুভব হল। হালকা বাতাসে আন্দোলিত, ঘাস ফুলে ভরপুর, একটি স্থান বাছাই করা হল। কেউ কেউ ঘাসের উপর শুয়ে গেল, আচমকা কেউ একজন সাপ বলে আর্তনাদ করে উঠল। এই দেশে এই প্রথম সাপের কথা শুনলাম। সাহসীরা এগিয়ে গেল বটে কিন্তু সাপের দেখা পাওয়া গেলনা। তাকে প্রশ্ন করলাম কোথায় শুয়েছিলে? সে জায়গাটি দেখিয়ে দিল, যা সন্দেহ করেছিলাম তাই হল। গ্রীসের বনে এক পাতা বিশিষ্ট আগাছা গুল্ম জন্মাতে দেখেছি। এক বিগত কিংবা তার চেয়ে কিছু বড় হয় এগুলো। গোখরো সাপ যেভাবে ফণা ধরে দাঁড়িয়ে থাকে, এই গুল্ম দেখতে অবিকল সাপের ফণার মত! পিছনে ডোরাকাটা দাগ, সামনে লিকলিকে জিহ্বা নিয়ে এই গুল্ম খুবই অসহায় ভাবে নিজের অবস্থান তুলে ধরে। এ ধরণের গুল্মের আড়ালে ভদ্রলোক শুয়েছিল, হালকা বাতাসের দোলায় এগুলো ছোবল মারার ভঙ্গিতে কাঁপতে থাকে, তা দেখেই ভদ্রলোক ভীষণ ভয় পেয়েছিল! (ব্লগে ছবি সংযুক্ত আছে)

সাড়ে তিন ঘণ্টা হেঁটে সবাই ওরোপোসে পৌঁছলাম, আবারো শহর এলাকায় বাসে চাপলাম। বাসে সর্বদা মহিলা যাত্রীর সংখ্যাধিক্য থাকে, আজ আরো বেশী বলে মনে হল। পরিচিত না হলে গ্রীকেরা সাধারণত কারো সাথে কথা বলেনা, ভদ্রতা সহকারে চুপচাপ বসে থাকে, বিরক্ত লাগলে কানে প্লেয়ার লাগিয়ে গান শুনে। গান এদের খুবই পছন্দ। এদেশে গানের শিল্পীরা রাতারাতি খ্যাতিমান ও বিত্তশালী হতে পারে। গাড়িতে অনবরত রেডিও বেজে চলছে, কেউ ড্রাইভারকে বলল আওয়াজ বাড়িয়ে দিতে। রেডিওতে কি বলা হচ্ছিল তার কিছুই বুঝতে পারলাম না, জানার কোন উপায় নাই কিন্তু সকল যাত্রীর চেহারায় ফ্যাকাসে ভাব। গ্রীক বাসী ইংরেজি ভাষা জানেনা, আর জানলেও ইংরেজি বলেনা। আবার ইংরেজি জানা মানুষ যদি ইংরেজি বলে সেটা কেউ বুঝেও না। কেননা তারা তাদের উচ্চারণে ইংরেজি বলে। গ্রীক ভাষা পৃথিবীর প্রাচীন ভাষা, সভ্য ভাষা, ইউরোপের অন্যান্য সকল ভাষা সৃষ্টি হয়েছে এই গ্রীক থেকেই। তাদের অহংকার যা গ্রীক থেকে সৃষ্টি তা উচ্চারণ করতে গ্রীকের প্রাধান্য থাকা চাই। সুতরাং তারা কোন দুঃখে অন্য ভাষার সাহায্য নেবে! ভাষা নিয়ে এরা চরম দাম্ভিক। সন্তানকে ইংরেজি শিখাতে চাইলে অনেক খরচ হয় এবং সরকারকে মোটা দাগে ভ্যাট দিতে হয়। তাদের উচ্চারণ রীতির কয়েকটির উপমা দেওয়া হল, যেমন ইংরেজি Blood (ব্লাড) কে ‘ব্লুড’ বলে, Flood (ফ্লাড) কে ‘ফ্লুড’ বলে, Encyclopedia (এনসাইক্লোপিডিয়া) কে 'এনসাইক্লোপিডিয়া' বলে। তাদের দাবী এগুলো সবই গ্রীক শব্দ, আমরা কেন ইংরেজির মায়ায় শব্দের ভুল উচ্চারণ করব? ইংরেজি ভাষার হাজার হাজার শব্দ গ্রীক থেকে আগত, আর গ্রীকেরা ইংরেজি শিখলেও উচ্চারণে কোন ছাড় দেয়না। তাদের মত করে ইংরেজির উচ্চারণ করে বলেই, অনেকে তাদের ইংরেজি বুঝে না।

গাড়ীতে কান্নার আওয়াজ শুনলাম। রেডিও চলছে, কয়েকটা মেয়ে কান্না করছে, বুড়োরা দুঃচিন্তায় আছে। গাড়ী ততক্ষণে ব্যাপক বৃষ্টির মাঝে ঢুকে পড়েছে, আগেই বলেছিলাম এদেশের জলবায়ুর কোন ভরসা নাই। পুরো গাড়ীতে এক প্রকার ভীতি ছড়িয়ে পড়ল। আমরা সবাই চোখ দেখা-দেখি করলাম, কেউ কিছু উদ্ধার করতে পারলাম না। যাত্রীদের কান্না দেখে বুঝতে পারি বাঁচা-মরার দোলাচলে চলছি, আচানক বিপদ এসে মরে যেতে পারি! আমাজনের জঙ্গলে নই! রীতিমত পৃথিবীর এক শিক্ষিত ও সভ্য দেশের রাজধানীর বুক চিড়ে চলছি, তবে কোন ধরনের বিপদে পড়তে যাচ্ছি, তার কোন হদিস করতে পারছিনা! আমাদের দুঃচিন্তা দেখে এক ইংরেজি জানা ভদ্রমহিলা এগিয়ে এলো। উচ্চারণ মুসিবতের কারণে পরিপূর্ণ তথ্য বুঝলাম না। অবশেষে তিনি একটি কাগজে লিখে জানালেন যে, সামনে প্রবল বৃষ্টি হচ্ছে, এই বৃষ্টি আরো আধা ঘণ্টা চললে রাস্তা পানির নীচে তলিয়ে যাবে। এই খবর শুনে সবাই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত! হাঁসব না কাঁদব বুঝে উঠতে পারলাম না, আমাদের অনেকেই হেঁসে ফেলল। শিক্ষক মহোদয়কে কে বললাম, ভারতীয় উপমহাদেশে আমরা এসব দেখেই বড় হয়েছি। তবে মনে সান্ত্বনা পেলাম এই জন্য যে, দশ মিনিট পরেই আমরা গন্তব্যে পৌঁছে যাব। বাসের মধ্যে অজানা আতঙ্কে যেভাবে একটি ঘণ্টা ব্যয় করেছি তার জন্য আফসোস লাগল, অনর্থক কষ্ট বুকে নিয়ে একটি দীর্ঘ সময় পার করেছি। অবশেষে সৈনিক পেয়িডিপ্পাসকে ধন্যবাদ জানিয়ে এথেন্স শহরের মূলকেন্দ্র সিন্‌দাগমা স্কয়ারে আমাদের ম্যারাথন পদযাত্রার ইতি টানা হল।

লিখেছেন: নজরুল ইসলাম টিপু

পঠিত : ৮৭৪ বার

মন্তব্য: ০