Alapon

সমাবর্তনের গাউন, টুপি: পশ্চিমা অনুকরণ নাকি অন্য কিছু?


বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যখন ছাত্র-ছাত্রীরা লেখাপড়া সমাপন করে, তখন সমাবর্তন অনুষ্ঠানে মাথায় চারকোণাবিশিষ্ঠ ছাতাওয়ালা একটি টুপি পরে। গায়ে জুব্বার মতো ঢিলেঢালা গাউন পরে। এগুলো পশ্চিমা অনুকরণ। শিক্ষার ক্ষেত্রে যেহেতু মুসলিম দেশগুলো পাশ্চাত্যরীতি অনুসরণ করে, সেহেতু মুসলিম দেশেও সমাবর্তন অনুষ্ঠানে এভাবে টুপি ও গাউন পরার প্রচলন ঘটে গেছে। পশ্চিমারা তো এককভাবে দাবি করে, এই রীতি তাদের খ্রিষ্টধর্মের সভ্যতার সাথে জড়িত। প্রাচীনকালে ক্যাথলিক যাজকরা এই ধরণের টুপি ও আলখাল্লা পরতেন।

কিন্তু বিষয়টা কি আসলে তা-ই?! না, বিষয়টা আসলে তা নয়। এটিকে একতরফাভাবে পশ্চিমা সভ্যতা বললে চলবে না। এই সভ্যতার ইতিহাস একটি মতানৈক্যপূর্ণ ইতিহাস। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, এই টুপি ও গাউন পরার ইতিহাস মুসলিমসভ্যতার সাথে জড়িত। স্বয়ং পশ্চিমা ঐতিহাসিকদের কলমেও এর তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়। এর প্রচলন ঘটেছে আন্দালুসে। আজ থেকে শত শত বছর পূর্বে। কিন্তু কীভাবে? তাহলে জানুন--

যখন ইউরোপ ছিল অজ্ঞতার অতল সমুদ্রে নিমজ্জিত, তখন আন্দালুস ছিল শিক্ষা ও সভ্যতার স্বর্গরাজ্য। টলেডো, সেভিল ও গ্রানাডার বিদ্যালয়গুলো ছিল জ্ঞানের আলোকবর্তিকা। কুরআন-সুন্নাহর বিদ্যাধরদের পাশাপাশি চিকিৎসা, রসায়ন, জ্যামিতি, ফিলোসফি, পদার্থ ও অন্যান্য আধুনিক শিক্ষার জ্ঞানতাপসদের তীর্থস্থান ছিল আন্দালুস। তদুপরি আন্দালুসের ঘরে ঘরে ছিল শিক্ষিতা নারী। এজন্য স্বয়ং ইউরোপের সম্রাটরা তাদের শাহজাদা-শাহজাদিদের প্রেরণ করত আন্দালুসে। ইউরোপ থেকে দলে দলে শিক্ষার্থীরা আগমন করত আন্দালুসে। একসময় তাদের ভাষা মিশ্রিত হয়ে যেত! ইউরোপে ফিরে যেত ঢিলেঢালা আজানুলম্বিত পোশাক পরে। আরব্য শিক্ষিত হওয়ার বেশধারণ করে। শুধু তাই নয়; কথায় কথায় তারা আরবি বুলি আওড়াতো। শিক্ষার ঘ্রাণ শুঁকাতে!

আন্দালুসের মুসলিম পণ্ডিতরা যখন স্বীয় ছাত্রদের শিক্ষাদান শেষ করতেন, তখন সমাবর্তন উনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন। এই অনুষ্ঠানে ছাত্রদের মাথায় চারকোণাবিশিষ্ট ছাতাওয়ালা টুপি পরিয়ে দিতেন। যাতে সেখানে এককপি কুরআনুল কারিম রাখা যায়। ছাত্রদেরকে সুরা ইউসুফের আল্লাহ তা'আলার সেই বাণী স্মরণ করিয়ে দিতে-- {فوق كل ذي علم عليم}, অর্থাৎ প্রত্যেক জ্ঞানীর ওপর মহাজ্ঞানী রয়েছেন।

ছাত্ররা সেই টুপির ওপর এককপি কুরআন রাখত। আর বুঝত যে, তারা যতোই জ্ঞান হাসিল করুক না কেন; তাদের ওপর স্বয়ং আল্লাহ মহাজ্ঞানী রয়েছেন। এছাড়াও সাথে তারা জ্ঞানের সাক্ষ্যস্বরূপ একখানা শাহাদাহ বা সার্টিফিকেট লাভ করত। উস্তাদরা নিজ হাতে লিখে এই শাহাদাহ দান করতেন।

উপরের তথ্যগুলোর সূত্র খুঁজে পাওয়া যায় স্বয়ং পশ্চিমা ঐতিহাসিকদের লিখনীতে। প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক জ্যাক গোডি তাঁর লিখিত বই 'Islam In Europe'-এর মধ্যে বলেন, আজও পর্যন্ত আরবদের ইসলামি পোশাক জ্ঞানগর্বমূলক মর্যাদায় অন্যতম প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়। বিশেষ করে শিক্ষাবিষয়ক উপলক্ষগুলোতে। যেমন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিতর্ক-অনুষ্ঠান এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সমাবর্তন অনুষ্ঠানমালায়।

১৪৯২ সালে ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের হাতে আন্দালুসের পতন ঘটে। উজাড় হয়ে যায় আমাদের এ বাগান। কিন্তু আন্দালুসি সভ্যতা হারায়নি। বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন রুপে ও নানা ঢঙে জীবিত আছে আজও। আন্দালুসের মুসলিম শিক্ষানবিসদের সমাবর্তনীয় এই রীতি ক্যাথলিকরা পুরোপুরি গ্রহণ করে। এরপর তা গোটা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। ইউরোপ থেকে পুরো বিশ্বে। এভাবেই আন্দালুসি মুসলিমদের প্রচলনকৃত এই সভ্যতা আজ এককভাবে পশ্চিমাদের সভ্যতা হয়ে যায়!

আহ! আন্দালুস!!
আমাদের হারানো ফিরদাউস!!!
------
সূত্রাবলি:
(১) المسلمون في الأندلس (আন্দালুসের ইতিহাস-গবেষক ড. মাহির মাহমুদ পরিচালিত ফেসবুক পেইজ)
(২) الإسلام في أوروبا: ১৫৩, জ্যাক গোডি। (Islam In Europe-এর আরবি অনুবাদ)

Collected
(৩) صفحة روايتي الثقافية (নির্ভরযোগ্য আরবি সাইট)

সংগৃহিত

পঠিত : ১৪৪০ বার

মন্তব্য: ০