Alapon

মাওলানা আজিজুল হক ও হরকাতুল জিহাদ প্রসঙ্গ



সম্প্রতি একটি টেলিভিশন (যমুনা) আজিজুল হককে হুজির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। এর বিরুদ্ধে ক্ষেপে উঠেছে কওমী সমাজ। বিশেষত আজিজুল হকের ছেলে মাওলানা মমিনুল হক ও তাদের সংগঠন। তারা ইতোমধ্যে বিক্ষোভ করেছে ও প্রতিবাদ জানিয়েছে।

কিন্তু যমুনা টিভির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ চলাকালে অনলাইন ও অফলাইনে কওমী আলেমরা হুজির ব্যাপারে যে মনোভাব দেখিয়েছেন তাতে মনে হচ্ছে হুজির লোকেরা কাফের বা জাহেল। তারা যেন জীবনেও হুজি দেখেন নাই, হুজির সাথে মিশেন নাই অথবা হুজিকে চিনেনই না। যমুনা অবশ্যই ভালো কাজ করে নাই আজিজুল হক সাহেবকে হুজির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে উল্লেখ করা। তবে তাদের কাছে যদি কোনো প্রমাণ থাকে তবে তাদের সেটা উপস্থাপন করা দরকার।

তবে এর মানে এই না আজিজুল হক সাহেব হুজির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন না। এদেশের সকল কওমী মাদ্রাসা ও কওমী আলেমরাই হুজির পৃষ্ঠপোষক। হুজি গোপনে প্রতিষ্ঠা হয়নি। প্রেসক্লাবে ঘটা করে তাদের প্রতিষ্ঠা হয়। হুজি প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর আজিজুল হকের মাদ্রাসা মোহাম্মদপুরের জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়াতে হুজির নিয়মিত সমাবেশ হতো। ২০০০ সালের আগ পর্যন্ত কওমী মাদ্রাসাগুলোতে ব্যানার টানিয়ে হুজি নিয়মিত প্রোগ্রাম করতো ও সদস্য সংগ্রহ করতো। আফগান যুদ্ধ চলাকালে এ দেশ থেকে প্রকাশ্যে মুজাহিদ সংগ্রহ করা হয়েছিল। তখন ঢাকায় জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের সামনে ব্যানার টানিয়েও সদস্য সংগ্রহ করা হয়েছিল। হুজি ছিলো কওমী অঙ্গনের স্বপ্নের সংগঠন। কওমী ছাত্ররা শিক্ষার্জন শেষে মুজাহিদ হওয়ার স্বপ্ন দেখতো হুজির মাধ্যমে।

১৯৮৪ সালে আফগানিস্তানে সোভিয়েতবিরোধী যুদ্ধের সময় আফগানিস্তান-পাকিস্তান সীমান্তের খোস্ত রণাঙ্গনে দেওবন্দি যোদ্ধাদের নেতৃত্বে হুজির জন্ম হয়েছিল। তাদের বেসিক উদ্দেশ্য ছিল, যেখানে বা যে দেশে জিহাদ হবে, সেখানে মুজাহিদ পাঠানো। বাংলাদেশে এই সংগঠনটির শাখা খোলা হয়েছিল মিয়ানমারের আরাকানে স্বাধীনতাকামী রোহিঙ্গা মুসলমানদের হয়ে লড়াই করার জন্য। বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রম চালানো হয়েছে পরে বিভিন্ন এজেন্সির প্ররোচনায় ও বিপথগামী কিছু হুজি নেতার মাধ্যমে।

বাংলাদেশে ১৯৮৯ সালে হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যশোরের মনিরামপুরের মাওলানা আবদুর রহমান ফারুকী। কিন্তু ওই বছরই আফগানিস্তানের খোস্তে মাইন অপসারণের সময় মাওলানা ফারুকী নিহত হন। এর পরে দীর্ঘদিন আর দেশে সংগঠনটির কাজ পরিচালিত হয়নি। পরে ১৯৯২ সালে ৩০ এপ্রিল ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ করে হুজির বাংলাদেশ শাখা। আফগানফেরত মুজাহিদদের বেশির ভাগই এর সঙ্গে যুক্ত হন। তাঁরা ছিলেন এ দেশে ভারতের দেওবন্দ ধারার মাদ্রাসায় শিক্ষিত এবং হানাফি মাজহাবের। আফগান যুদ্ধের সময় তাঁরা গেরিলাযুদ্ধ ও ভারী অস্ত্র চালনায় প্রশিক্ষণ পেয়েছিলেন। বাংলাদেশে জিহাদী মনোভাব জাগ্রত করার জন্য এই সংগঠনের ভূমিকা অসাধারণ।

হুজিকে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা পেতে কোন বেগ পেতে হয়নি। বাংলাদেশের সবক'টি কওমী মাদ্রাসা ছিলো এদের একেকটি শাখা। সংগঠনের আফগানফেরত মুজাহিদরা ছিলেন এ দেশে দেওবন্দ ধারার কওমি মাদ্রাসার ছাত্রদের কাছে বিরাট শ্রদ্ধার পাত্র। আর সেই ভাবমূর্তিকে কাজে লাগিয়ে তাঁরা আরাকানের ‘মজলুম মুসলমানদের’ পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়ে দেশের বিভিন্ন মাদ্রাসা থেকে সদস্য সংগ্রহ শুরু করেন। তারা কওমী মাদ্রাসাগুলোতে মোটিভেশনাল স্পিচ দিতেন আর তাতেই জিহাদী চেতনায় উজ্জিবিত হয়ে কওমী ছাত্র শিক্ষকরা তাদের সংগঠনে একটিভ হয়ে যেতেন। হুজি নেতারা এসব সদস্যদের মধ্যে বাছাই করা সদস্যদের জন্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও বান্দরবানের পাহাড়ি এলাকায় সশস্ত্র প্রশিক্ষণকেন্দ্র গড়ে তুলেছিলেন। এসব প্রশিক্ষণকেন্দ্র নিয়ে বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে নানা খবর বের হয়েছিল। যেভাবে তাঁরা সদস্য সংগ্রহ করতেন একইভাবে তাঁরা টাকাও সংগ্রহ করতেন। যারা সদস্য হতে পারতেন না তারাও দুই হাতে টাকা বিলিয়ে হুজিকে সাপোর্ট করতেন। অল্প কয়দিনের মধ্যেই হুজি একটি বিশাল ও সম্পদশালী সংগঠনে পরিণত হয়। তারা রোহিঙ্গাদের সাথে কাজ করতে শুরু করে। তাদের জিহাদের দিকে আহ্বান করে।

ইতিহাস থেকে দেখা যায় এসব সংগঠন বিশেষ করে কওমী আলেমদের সংগঠন কখনো এক্ত্র থাকতে পারে না। তারা খুবই নেতৃত্বলোভী। এ কারনে কওমীদের সব ধরনের সংগঠন বিভক্ত হয়ে পড়ে। আর সেটা যদি কোনো সফল সংগঠন হয় তবে তা ভেঙ্গে পড়া আবশ্যক। হুজির ক্ষেত্রেও সেটা হয়েছে। ১৯৯৮-৯৯ সালে হুজি তিন ভাগে বিভক্ত হয়েছিল, যার একাংশের নেতৃত্বে ছিলেন গোপালগঞ্জের মুফতি আবদুল হান্নান। আরেক অংশের নেতৃত্বে ছিলেন মাদারীপুরের মুফতি আবদুর রউফ। আর হুজির মূলধারাটি আবদুস সালাম, সিলেটের হাফেজ ইয়াহিয়া, কিশোরগঞ্জের মুফতি শফিকুল ইসলাম, কুমিল্লার আবদুল হাই, খুলনার শেখ ফরিদদের নেতৃত্বে ছিল।

এর মধ্যে আব্দুর রঊফের সংগঠন নাম পরিবর্তন করে অন্য সংগঠনে পরিণত হয় ও তাদের কার্যক্রম কমে যায়। আব্দুল হান্নান তাদের প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য থেকে সরে এসে মিয়ানমার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিজ দেশে কার্যক্রম পরিচালনা শুরু করেন। আব্দুস সালামের মূলধারা রোহিঙ্গাদের সাথেই কাজকে প্রাধান্য দেন। আরাকানে হুজিরা মোটেই সফলতা পায়নি, অর্থাৎ রোহিঙ্গাদের জিহাদে আগ্রহী করতে সমর্থ হয়নি ফলে তাদের উদ্দেশ্য ব্যহত হয়। আব্দুল হান্নান সেই ব্যর্থতা কাটিয়ে দেশে কার্যক্রম শুরু করলে ও কিছু গেরিলা আক্রমণ চালালে হুজির সদস্যরা তার দিকে ঝুঁকে পড়ে এবং তার দল মূল দলে পরিণত হয়।

প্রতিষ্ঠার পর থেকে ৯৯ সাল পর্যন্ত হুজি নিজেদের মজবুতি অর্জন করে। ২০০৩ সাল থেকে মুফতি হান্নান তার ভাষায় এদেশের সেক্যুলার, জাতীয়তাবাদী, মওদুদীবাদী ও কাদিয়ানী রাজনীতিবিদদের হত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠার (!) একটি স্বপ্ন দেখে। কিছু গেরিলা হামলা ও হত্যার ঘটনার প্রেক্ষিতে ২০০৫ সালে জোট সরকার তাদের নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।

অনেকে বলে থাকেন হুজি বাংলাদেশে প্রথম ইসলামী যোদ্ধাদের সংগঠন। কিন্তু তা সঠিক নয়, এর আগে মেজর মতিউর নামে একজন মুসলিম মিল্লাত বাহিনী নামে একটি সংগঠন কায়েম করেন। ১৯৮৬ সালে এই বাহিনী গঠন করেন চাকরিচ্যুত সেনা কর্মকর্তা মতিউর রহমান। এর কয়েক বছর আগে কিছুসংখ্যক বাংলাদেশি ফিলিস্তিনে গিয়েছিলেন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পক্ষে লড়াই করতে। এ জন্য তাঁরা ভাতাও পেয়েছিলেন। মুসলিম মিল্লাত বাহিনীর প্রধান চাকরিচ্যুত মেজর মতিউর রহমান মধ্যপ্রাচ্য ঘুরে এসে কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়ার শিমুলিয়ায় নিজ গ্রামে আস্তানা গড়ে তোলেন। সেখানেই তিনি তার অনুসারীদের প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু করেন।

পাকুন্দিয়ার ওই আস্তানায় সদস্যদের থাকার জন্য ১৩১টি ঘর ও বেশ কিছু তাঁবু এবং ৬১টি পরিখা (বাংকার) তৈরি করা হয়েছিল। ছিল নিজস্ব জেনারেটরে বিদ্যুতের ব্যবস্থা। একটা মাদ্রাসাও করা হয়েছিল সেখানে। নাম ‘শিমুলিয়া ফরজে আইন মাদ্রাসা’। তার ফরজে কেফায়া বিভাগে যুদ্ধবিদ্যা শিক্ষা দেওয়া হতো। যতদূর জানা যায় তারা দেওবন্দি আকিদার ছিলেন না। তারা ওয়াহাবি মতবাদের অনুসারী ছিলেন। যারা বর্তমানে আহলে হাদীস ঘরানার। আরো স্পষ্ট করতে চাইলে বলা যায় জেএমবি মতাদর্শের সংগঠন ছিলো।

১৯৮৯ সালের ১২ ডিসেম্বরে পুলিশ পীর মেজর (অব.) মতিউর রহমানের আস্তানায় অভিযান চালাতে গেলে পুলিশের সঙ্গে যুদ্ধ হয়। আড়াই দিন ধরে চলে ওই যুদ্ধ। এতে পুলিশের দুই সদস্যসহ ২১ জন নিহত হন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে মর্টারের গোলাবর্ষণও করতে হয়েছিল। আহত অবস্থায় পালাতে গিয়ে পীর মতিউর ও তাঁর ৪৮ সঙ্গী গ্রেপ্তার হন। তাঁর আস্তানা থেকে রাইফেল, রিভলবার, বন্দুক, তীর-ধনুক, বল্লম, লাঠি, তলোয়ারসহ বিপুল পরিমাণ অস্ত্র-গুলি, খাকি পোশাক ও সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। উদ্ধার হয় ২৭টি পাসপোর্ট, যেগুলোতে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের ভিসা ছিল।

পঠিত : ১০১৯ বার

মন্তব্য: ০