Alapon

ইবনে খালদুন ও আল মুকাদ্দিমা পাঠ...


বছর কয়েক আগে আমি আমার প্রিয় শায়েখ পীর জুলফিকার আহমেদ নকশবন্দির বয়ান শুনছিলাম। কুরআন ও কুরআনের হেফজ সংক্রান্ত আলোচনায় তিনি বলছিলেন, ইসলামের ইতিহাসে এমনসব মানুষও এসেছে যারা গমের দানায় সূরা ইখলাস লিখতে পারতেন। শায়েখ তখন ইবনে খালদুনের মুকাদ্দিমার বর্ণাদির রহস্যের আলোকে অনেক কিছুই বলেছিলেন। কিন্তু আমি তেমন কিছুই বুঝিনি। আর বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বস্তুতে সূরা লিখে ফেলার কাহিনীগুলো আমাকে আশ্চার্যান্বিত করে। সেদিনই প্রথম ইবনে খালদুনের প্রতি আমার আগ্রহ জন্মায়।

ফেসবুকে এসে বড় বড় জ্ঞানীগুণীদের সাথে যুক্ত হই। বিশেষ করে খালদুন বিশেষজ্ঞ ইফতেখার জামিল, মাসুদ জাকারিয়া, ইকবাল বিন শহিদ, মোহাম্মদ নোমান, হুজাইফা মাহমুদ, ইমরান রাইহান, আব্দুল্লাহ বাকি ভাই। খালদুন সংক্রান্ত উনাদের বিভিন্ন পোস্ট ও উনাদের লেখায় খালদুনের উদ্ধৃতি দেখে আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। আগ্রহ থেকে মুকাদ্দিমার বঙ্গানুবাদ ক্র‍য় করি ও রোজেনথালের করা ইংরেজি অনুবাদটি ডাউনলোড করি।

গতবছর আমি মুকাদ্দিমা পড়তে শুরু করি। কিন্তু খালদুনের জীবনী ও মুকাদ্দিমার শুরুর দিকের কিছুটা পড়ার পর আর বেশিদূর এগোতে পারিনি। এগোতে পারিনি দুটি কারণে,
এক. অনুবাদের দুর্বোধ্যতার কারণে।
দুই. সেসময় আমি বিভূতিভূষণের 'আরণ্যক' পড়েছিলাম। তাই ঘরের বাহির থেকে শেয়াল হাঁক শুনলে আমি আরণ্যকে হারিয়ে যেতাম। অথবা বাহিরে জোছনার আলো ছড়িয়ে পরলে আমি আরণ্যকের মুগ্ধতায় ডুবে যেতাম। যেকারণে আমি মনোযোগ ধরে রাখতে পারিনি৷ আর মুকাদ্দিমা এমন বই যাকে পড়ার সময় একাগ্রতা ও সম্পূর্ণ মনযোগ ব্যাতিরেকে তার ন্যূনতম রসাস্বাদনও সম্ভব নয়।

কয়েক সপ্তাহ আগে আমি যায়েদ আহমেদের The Epistemology of Ibn Khaldun বইটা ডাউনলোড করি। বইটি পড়তে শুরু করে মনে হলো, মুকাদ্দিমা পড়া ছাড়া এই বই থেকে তেমন উপকার লাভ করতে পারবো না। তারপর আবার মুকাদ্দিমা পড়তে শুরু করলাম। কিন্তু ফেসবুক ও মোবাইল ফোন বারবার বাধা দিতে লাগল। তাই আমার এন্ড্রয়েড ফোনটি পার্শ্ববর্তী উপজেলায় আমার বোনের বাড়িতে পাঠিয়ে দেই।

আমার দুইটি মোবাইল। একটি এন্ড্রয়েড, অন্যটি সাধারণ নোকিয়া। দুই সপ্তাহ আগে যখন এন্ড্রয়েড থেকে মুক্তি নেই তখন আমার নোকিয়া আসল ফোনে ব্যালেন্স ছিলো মাত্র ১ পয়সা। তারপর এই দুই সপ্তাহ এই ১ পয়সাতেই চলে গেছি। পুরো দুই সপ্তাহে আমার কাছে ফোন এসেছে মাত্র চারজনের। আমার ফোন করার প্রয়োজন হয়নি। নামাজ, সন্ধ্যায় কিছু বাচ্চাকাচ্চা পড়ানো, খাওয়া, পাড়ার মাহফিলে একদিন সন্ধ্যা থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত ব্যায় করা ছাড়া আর বাকি সময় শুধু মুকাদ্দিমা। মোটামুটি ঘরের একান্ত প্রয়োজনীয় কাজ ছাড়া নিজের কামরায় বন্দি ছিলাম খালদুনের মুকাদ্দিমার সাথে।

আলহামদুলিল্লাহ! এভাবে ধীরে ধীরে পড়তে পড়তে মুকাদ্দিমার প্রথম খন্ড শেষ করি। এভাবে পড়তে দ্বিতীয় খন্ডও শেষ করি। দ্বিতীয় খন্ডের কয়েকটি অনুচ্ছেদ স্বেচ্ছায় বাদ দিয়েছি। কারণ এই দুই খন্ড পড়েই আমার অবস্থা 'দেড় মাসের মতো পাগল আছিলাম'। মুকাদ্দিমা নিয়ে কিছু বলব না আপাতত। অনেক জ্ঞানীরা লিখেছেন, কখনো জ্ঞানীদের সোহবত পেলে ও সাহস হলে আমিও কিঞ্চিৎ লেখব ইনশাআল্লাহ!

মুকাদ্দিমা কোন গল্প, উপন্যাস, বা প্রবন্ধ নয় যে এক নাগাড়ে পড়ে যাওয়া যায়। আমিও এক নাগাড়ে পড়ে যেতে পারিনি। কিছুটা পড়ে চোখ বন্ধ করে বিশ্রাম নিতে হয়েছে বারবার। এমন মানসিক পরিশ্রম আর কখনো করিনি হয়তো। বইটা পড়ে আপাতত এইটাই বলব, পনেরো দিন পূর্বেকার শরিফ আর পনেরো দিন পরের শরিফ আর এক নেই৷ আলহামদুলিল্লাহ! আমি বদলে গেছি। প্রশ্ন জাগতে পারে! আমি কতটুকু মুকাদ্দিমা বুঝেছি? আমি বলব, আমি অনেক অনেক কিছুই বুঝেনি। তবে আমি যে প্রত্যাশা নিয়ে পড়তে শুরু করেছিলাম সেই প্রত্যাশার চেয়ে বেশিই বুঝেছি। খালদুন নিজেও একটি স্পেশাল বই তিনবার পড়ার কথা বলেছেন, আল্লাহ যদি টাকাপয়সা, সময় ও সুযোগ দেন তবে মুকাদ্দিমা আমি আরও দুইবার পড়ব। আমি জানিনা আমার ভবিষ্যৎ কি! জানিনা আমি কোনদিকে যাচ্ছি! এমনকি জানিনা আমার লক্ষ্য কি!

মনে জমা হওয়া কথার বিশাল ভাণ্ডার থেকে একটা কথা বলেই লেখাটা শেষ করি। একদিন আমার ফেসবুকীয় ভাই নাজমুদ্দিন তুফি আমাকে বলেছিলেন, আপনি অনেক কিছু জানেন। তখন বলেছিলাম, ভাই আমার কলস খালি। তাই বাজেও বেশি। তুফি ভাই বললেন, তাও ভালো আপনার কলস আছে।
মুকাদ্দিমা পড়ে আমার সবচেয়ে বড় পাওয়া হলো আমি বুঝতে পেরেছি, আমার খালি কলস থাকা তো দূরের কথা! কলসই নেই। বাকি জীবন কলসের জন্য প্রচেষ্টা করতে হবে, আর কখনো কলস লাভ করতে পারলে কলস ভরার চেষ্টা করতে হবে। আর তা কখনোই সম্ভব হবে না

লিখেছেন: শরিফ সাইদুর

পঠিত : ১০৩৪ বার

মন্তব্য: ০