Alapon

দায়িত্বশীলের অন্তর যেমন হওয়া উচিত...


মুসলমান হিসেবে আমরা প্রত্যেকেই রাসুলের (সা.) প্রকৃত সুন্নাহগুলোতে বিশ্বাস করি। আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো রাসুলের (সা.) এই সুন্নাহগুলোকে যতটুকু সম্ভব অনুসরণ ও ধারণ করা। কিছু কিছু সুন্নাহ আছে খুব ছোট ও সরল। এগুলো পালন করাও সহজ। যেমন, সালাম দেয়া, ডান হাতে খাবার খাওয়া প্রভৃতি। আবার কিছু কিছু সুন্নাহ আমল করা খুবই কঠিন। কুরআনে আল্লাহ তাআলা বেশ কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন, যা রাসুল (সা.) তার জীবনে অনুসরণ ও বাস্তবায়নও করেছেন। তবে, আমাদের জন্য তা পালন করা মোটেও সহজ নয়।

এখানে এই দাবির সপক্ষে আমরা যে আয়াতটির কথা বিশেষভাবে বলতে চাই তাহলো সুরা আল ইমরানের ১৫৯ নং আয়াত। এই আয়াতটি নাযিল হয়েছিল ওহুদ যুদ্ধের পরপরই। এই সংক্ষিপ্ত পরিসরে ওহুদ যুদ্ধের গোটা ইতিহাস আলোচনা করা সম্ভব নয়। তবে, আমরা আলোচনার সুবিধার্থে এই যুদ্ধের কয়েকটি মৌলিক ঘটনা উপস্থাপন করতে চাই।

ওহুদের যুদ্ধের আগে রাসুল (সা.) সাহাবিদের মধ্যে নির্দিষ্ট কিছু সংখ্যক সাহাবিকে একটি পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে থাকার দায়িত্ব প্রদান করেছিলেন। এই সাহাবিদের অধিকাংশই ছিল তিরন্দাজ। একবার দুবার নয়, রাসুল (সা.) বেশ কয়েকবার তাদেরকে পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে থাকার নির্দেশনা প্রদান করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “যত যাই কিছু হোক না কেন, তোমরা পাহাড় থেকে নামবে না। যদি নেমে যাও, তাহলে পাহাড়ের পেছনে ঘাপটি মেরে থাকা কাফের সদস্যরা বেরিয়ে এসে মুসলিম বাহিনীর উপর চড়াও হবে।”

কাফেররা যুদ্ধ শুরু হওয়ার অল্প সময় পরই বেকায়দায় পড়ে যায় এবং তারা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পিছনে হটতে শুরু করে। কাফেরদের রুদ্ধশ্বাসে পালিয়ে যাওয়া দেখে মুসলমানদের অনেকেই ভেবে নেয় যে, যুদ্ধ শেষ এবং তারা বিজয়ী হয়ে গেছে। মুসলিম বাহিনীর একটি বড়ো অংশ পলায়নরত কাফেরদের তাড়া করতে সামনে ছুটে যায়। আর পাহাড়ের উপরে থাকা সাহাবিরাও নীচে নেমে আসে। এই সুযোগে, পাহাড়ের পেছনে থাকা কাফের সদস্যরা সামনে বেরিয়ে আসে এবং মুসলমানদের উপর চড়াও হয়। সেই সময়ে রাসুল (সা.) এর পাশে মাত্র ৬ জন সাহাবি ছিলেন। অর্থাৎ এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি হলো যে, কয়েকশ কাফের সদস্যরা তাদের হাতের মুঠোয় মাত্র ৬ জন সাহাবিসহ রাসুলকে (সা.) পেয়ে গেল।
ফলে কাফের সদস্যরা রাসুলে করীমকে (সা.) আক্রমন করতে উদ্যত হলো। একটি তীর রাসুলের (সা.) মাথায় পরিহিত হেলমেটের ডান পাশ দিয়ে ঢুকে চোয়াল ভেদ করে দাঁত মুবারককে আহত করে। আর বাম পাশ দিয়ে আরেকটি পাথর এসে রাসুলকে (সা.) আহত করে। ফলশ্রুতিতে, রাসুলের (সা.) মুখের ডান ও বাম- উভয় পাশ দিয়ে রক্তপাত শুরু হয়। পাশাপাশি, একজন কাফের সদস্য তাকে তলোয়ার দিয়েও আঘাত করল। সব মিলিয়ে, সেই ঘটনায় রাসুলের (সা.) শরীরের তিনটি জায়গায় আঘাতপ্রাপ্ত ও আহত হলেন।

রাসুলের (সা.) এই অবস্থা দেখে মুসআব ইবনে উমাইর (রা.) নামক একজন সাহাবি একটা কৌশল অবলম্বন করলেন। তার চেহারার সাথে নবিজির চেহারা মুবারাকের কিছু সাদৃশ্য ছিল। তিনি রাসুলের (সা.) একটি আলখেল্লাও পড়ে নিলেন। পরে, কাফের সদস্যরা তাকে হত্যা করে এবং মনে করে যে, তারা রাসুলকেই (সা.) হত্যা করে ফেলেছে। পরে তারা নবিজিকে (সা.) ছেড়ে চলে যায়। কিছু সময় পর তারা ভুল বুঝতে পেরে আবার ফিরে আসে কিন্তু ততক্ষনে সাহাবিরা নবিজিকে (সা.) নিরাপদে পাহাড়ের উপর নিয়ে যেতে সক্ষম হন। এই হলো ওহুদের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা।

ওহুদ যুদ্ধে মুসলমানরা ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়। অসংখ্য সাহাবি শাহাদাত বরণ করেন। শুধু তাই নয়, হযরত হামজা (রা.) সহ খ্যাতনামা অনেক সাহাবির মৃতদেহকেও কাফেররা জঘন্যভাবে কাঁটাছেড়া করে।

যুদ্ধের পর মদিনায় ফিরে এসে রাসুল (সা.) এবং সাহাবিরা বিপর্যয়ের কারণগুলো পর্যালোচনা করেন। মুসলমানরা যুদ্ধে ভালো করছিল এবং বিজয়ের সম্ভাবনাও দেখা দিয়েছিল। অথচ, শুধুমাত্র পাহাড়ের উপরে থাকা সাহাবিরা নিজেদের দায়িত্ব পালন না করায় এবং রাসুলের (সা.) হুকুমের আনুগত্য না করে পাহাড় ছেড়ে নেমে আসার কারণেই মুসলমানরা পরাজয়ের মুখোমুখি হয়। এই যখন পরিস্থিতি, তখন স্বাভাবিকভাবেই পাহাড়ের উপর দায়িত্বপ্রাপ্ত সাহাবিরা নানা ধরনের আশংকায় পড়ে যান। তাদের উপর রাসুল (সা.) অসুন্তষ্ট হন কিনা, কিংবা তাদেরকে কোনো শাস্তি দেয়া হয় কিনা- তা নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। এমনকি, তারা রাসুলের (সা.) সামনে যেতেও সাহস পাচ্ছিলেন না।

রাসুল (সা.) ওহুদ থেকে ফিরে এসে পরবর্তী জুমআর দিনে যখন খুতবা দিতে দাঁড়ালেন, তখনো তিনি ঠিকমত কথা বলতে পারছিলেন না। তার মুখে তখনও ব্যান্ডেজ। মদিনায় ফিরে আসার পর তার মেয়ে ফাতেমা (রা.) ও জামাতা হযরত আলী (রা.) মাটি ও ভেষজ কিছু গাছের চূর্ণ দিয়ে একটি পেস্ট বানিয়ে তার মুখে মাখিয়ে দিয়েছিলেন। সেই পেস্টসহ ব্যান্ডেজ মুখে দিয়েই নবিজি (সা.) খুতবায় দাঁড়ালেন। আর উপস্থিত জনতার মধ্যে সেই ব্যক্তিরাও ছিলেন, যারা পাহাড় থেকে নেমে যাওয়ার কারণেই রাসুলের (সা.) এই দুর্গতি। কী একটি কঠিন বাস্তবতা!

সেই কারণেই সাহাবিরা আরো বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছিলেন। তারা ভয় পাচ্ছিলেন, আল্লাহ যদি তাদের উপর রুষ্ট হয়ে কুরআনের কোনো আয়াত নাযিল করে দেন। কেননা, তাদের জন্যই শুধু নবিজি (সা.) নয়, অসংখ্য সাহাবি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। গত জুমআয় তাদের সাথে নামাজ আদায় করেছেন এমন অসংখ্য সাহাবি সেদিন ছিল না কেননা তাদেরই ভুলের কারণে যুদ্ধের ময়দানে তারা শাহাদাত বরণ করেছেন। তাই তারা ভীষণ অপরাধবোধে ভুগছিলেন। অথচ, এরপরও তারা নামাজের জামাতে এসেছিলেন, খুতবা শুনতে সমবেত হয়েছিলেন। এই প্রেক্ষিতেই, আল্লাহ তাআলা সুরা আলে ইমরানের এই আয়াতগুলো নাযিল করেছিলেন।

এর মধ্যে একটি আয়াত আমি এখানে উল্লেখ করব- যেখানে আল্লাহ রাসুল (সা.) কে উদ্দেশ্য করে বলেন, “আল্লাহর রহমতেই আপনি তাদের জন্য কোমল হৃদয় হয়েছেন। ” (সুরা আল ইমরান: আয়াত ১৫৯)

ভেবে দেখুন, এই সময়টি কী আদৌ কোমল হওয়ার মতন? নাকি তখন উত্তেজিত হওয়ার সময়? কঠোর হয়ে প্রশ্ন করার সময় যে, তোমরা কী করলে? তোমাদেরকে কী বলা হলো আর তোমরা কী করলে? তোমাদের জন্য আজ আমাদের এই অবস্থা।”

অথচ এই সময়টিতেই আল্লাহ তাআলা তার রাসুলকে (সা.) কোমল হওয়ার কথা বলেছেন। এই আয়াতের পরের অংশে আল্লাহ আরো বলেন, “পক্ষান্তরে আপনি যদি রাগ ও কঠিন হৃদয়ের হতেন এবং আপনার কাছে এসে যদি তারা স্বস্তি না পেত তাহলে তারা আপনার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতো।” (সুরা আলে ইমরান: আয়াত ১৫৯)

আমরা যখন কোনো অপরাধ করি, অফিসের কাজে কোনো ভুল করি, তখন আমরা খুব কোনঠাসা হয়ে থাকি। অনুশোচনা আর অনুতাপে মলিন মুখে বসে রই। অফিসের বসের দিকে করুণ মুখে তাকিয়ে থাকি আর দোয়া করি, তিনি যেন আমাকে আজ সবার সামনে বেইজ্জতি না করেন। অফিসের কর্তাব্যক্তি যদি বকা না দিয়ে একটু তাকিয়ে থাকেন তাতেও আমরা আড়ষ্ট হয়ে যাই।

সেদিনের বাস্তবতাও তাই ছিল। রাসুল (সা.) মুখে কিছু না বলে যদি কেবলমাত্র মৌখিক বহি:প্রকাশেও কোনো নেতিবাচক ভাব প্রকাশ করতেন বা এড়িয়ে যেতেন, তাতেও উহুদের ভুল করা সাহাবিরা বেকায়দায় পড়ে যেতো।

আল্লাহর এই আয়াত নাযিলের প্রেক্ষাপট বুঝতে গেলে আমাদেরকে ওহুদ যুদের একটু পেছনের ঘটনা জানতে হবে। এই যুদ্ধের জন্য রাসুল (সা.) ১ হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী নিয়ে মদিনা থেকে বের হয়েছিলেন। যার মধ্যে ৩শ জন ছিলেন মুনাফিক। তারা এসেছিল, কারণ তাদেরকে অন্তর্ভুক্ত করেই রাসুল (সা.) যুদ্ধের পরিকল্পনা সাজিয়েছিলেন। কুরাইশরা ভেতরে ভেতরে দীর্ঘ এক বছর ধরে এই যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছিল। প্রক্ষান্তরে রাসুল (সা.) তার বাহিনী তৈরি করার জন্য মাত্র দুই ঘন্টা সময় হাতে পেয়েছিলেন। রাসুল (সা.) যখন যুদ্ধের জন্য চুড়ান্তভাবে বেরিয়ে গেলেন, তখন মুনাফিকরা তাদের স্বরূপে আবির্ভুত হলো। তারা যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে পালিয়ে গেলো। তাদের প্রস্থানের পর মুসলমান বাহিনীর সেনা সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ালো ৭শতে। অন্যদিকে, কাফের সদস্যদের সংখ্যা ছিল ৩ হাজার। অর্থাৎ মুসলিম বাহিনীর চেয়ে চারগুনেরও বেশি।

মুনাফিকরা চলে যাওয়ায় মুসলমানদের গোটা যুদ্ধ পরিকল্পনাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কেননা, তাদেরকে সাথে নিয়েই রাসুল (সা.) যুদ্ধ পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছিলেন। মুলত, কাফেরদের পরিকল্পনা ছিল রাসুলকে (সা.) বিপদে ফেলা, তাকে হত্যার মুখে ফেলে দেওয়া।
এবার চিন্তা করুন, যারা বেইমানি করে চলে গেলো, তারা ভুল করল। আর এই ভুলটি ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। আর যারা পাহাড় থেকে নেমে গেলো, তারাও ভুল করেছে। তবে সেটা সহনীয় এবং ক্ষমাযোগ্য অপরাধ। এই কারণেই আল্লাহ এখানে ভুল করা সাহাবিদের প্রতি কঠোর না হওয়ার কথা বলেছেন।

কিন্তু কুরআনের অন্যত্র আল্লাহ আবার রাসুলকে (সা.) নির্দেশ দিয়েছেন যাতে তিনি মুনাফিকদেরকে কঠোরভাবে দমন করেন।

“হে নবী, কাফেরদের সাথে যুদ্ধ করুন এবং মুনাফেকদের সাথে তাদের সাথে কঠোরতা অবলম্বন করুন। তাদের ঠিকানা হল দোযখ এবং তাহল নিকৃষ্ট ঠিকানা। (সুরা আত তাওবাহ: আয়াত ৭৩)

তাই যারা প্রথমবার ভুল করে ইসলাম তাদেরকে সংশোধনের সুযোগ দেয়। কিন্তু যারা ইচ্ছাকৃতভাবে বার বার একই ভুল করে কিংবা যারা দুরভিসন্ধি করে তাদের বিষয়ে নমনীয় থাকার কোনো সুযোগ নেই।

সাহাবিদের প্রতি নমনীয় না হলে, তারা বিব্রত হতেন। তারা দূরে সরে যেতে পারতেন। তাই যদিও তারা বড়ো ভুল করেছেন তারপরও তারা যেহেতু বাজে অভিপ্রায় থেকে করেননি, তাই আল্লাহ রাসুলকে (সা.) আদেশ দিয়েছেন যাতে তিনি তাদের প্রতি কঠোর না হন। এই সাহাবিরা দ্বীন ইসলাম ও রাসুলকে (সা.) ভালোবাসে- এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তারা নিজেদের জীবন ও সংসারকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেই যুদ্ধে গিয়েছিলেন। সাহাবিদের মধ্যে এমন অনেক সাহাবি ছিলেন যারা কিশোর বয়সী। তাদের মধ্যে অনেকেই বর্ম বা তলোয়ার ছাড়াই খালি হাতেই যুদ্ধে ছুটে গিয়েছিলেন।

এই আয়াতে আল্লাহ নিশ্চিতভাবে নবিজিকে (সা.) জানিয়ে দিয়েছেন, এই সাহাবিরা এতটা ঝুঁকি নিয়েছেন কেননা তারা আপনাকে ভালোবাসে। তারা কেবলমাত্র ইসলামের সুমহান বার্তা শুনেই ইসলামের ছায়াতলে আসেনি। বরং রাসুলের (সা.) নমনীয় ও কোমল আচরণ দেখেও তার কাছে ছুটে এসেছে। তাই তাদের প্রতি কঠোর হলে তারা কষ্ট পেয়ে দূরেও চলে যেতে পারে। তারা কুরআন পড়বে, ইসলামও অনুসরণ করবে, কিন্তু মানসিকভাবে হয়তো তারা নবিজি (সা.) থেকে দূরে সরে যাবে। আর মানসিক দূরত্ব খুবই নেতিবাচক একটি বিষয়। কেননা, এই ধরনের দূরত্ব তৈরি হয়ে গেলে কখনোই কোনো দলকে একত্রিত রাখা সম্ভব হয় না।

শুধু নমনীয় হওয়াই নয়, আল্লাহ তাআলা একই আয়াতে নবিজিকে (সা.) আরো তিনটি আদেশ দিয়েছেন।

আল্লাহ বলেন, “কাজেই আপনি তাদের ক্ষমা করে দিন এবং তাদের জন্য মাগফেরাত কামনা করুন এবং কাজে কর্মে তাদের সাথে পরামর্শ করুন। অতঃপর যখন কোন কাজের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ফেলেন, তখন আল্লাহ তা’আলার উপর ভরসা করুন। আল্লাহ তাওয়াক্কুল কারীদের ভালবাসেন।” (সুরা আলে ইমরান: আয়াত ১৫৯)
এই আয়াতে তিনটি কাজের কথা বলা হয়েছে। ১. ক্ষমা করে দেওয়া ২. মাগফেরাত কামনা করা এবং ৩. তাদের সঙ্গে পরামর্শ করা।

এখানে ক্ষমা করাটিকে আরবিতে আফুউন দিয়ে বোঝানো হয়েছে। আফুউন মানে হলো এমনভাবে ক্ষমা করা যাতে ক্ষমাকৃত ব্যক্তির অপরাধের কোনো চিহ্ন না থাকে। আমরা অনেক সময়ই কাউকে ক্ষমা করি, কিন্তু পরে আবার এটা নিয়ে তাকে খোঁচাও দেই। আফুউন তা নয়। বরং এটা হলো এমন ক্ষমা যা করলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির অপরাধের বিষয়টি স্থায়ীভাবে মুছে দেওয়া হয়। অধ:স্তন কেউ যদি সহনীয় ভ‚ল করে তাহলে নেতার দায়িত্ব হলো তাদেরকে স্থায়ীভাবে ক্ষমা করে দেওয়া।

মাগফেরাত কামনা করার যে কথা বলা হয়েছে তা প্রকাশ্যে করার মত কোনো বিষয় নয়। আমরা যদি প্রকাশ্যে একটি বিশেষ শ্রেনী বা বিশেষ কিছু ব্যক্তির জন্য বার বার ক্ষমা চাই, তাহলে একদিকে যেমন তারা হেয় হয়, বিব্রত হয় আর অন্যদিকে যারা বিষয়টি জানতো না, তারাও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অপরাধ সমন্ধে জানার সুযোগ পেয়ে যায়।

তাই কেউ ভুল বা অপরাধ করলে দায়িত্বশীলের কর্তব্য হলো একান্তে ও গোপনে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের জন্য দোয়া করা। এর উপযুক্ত একটি সময় হতে পারে তাহাজ্জুদের সময়। মানুষ যখন একান্তে ইবাদত করে তখন সে নিজের বিপদাপদ থেকে বাঁচার জন্য, দু:সময় কাটিয়ে দেয়ার জন্য দোয়া চায়। কিন্তু একজন নেতা তার তাহাজ্জুদে ও নফল ইবাদতে শুধু নিজের জন্যই দোয়া করবেন না। বরং যারা ভুল করেছে তাদের হেদায়েত কামনা করে এবং তাদের জন্য মাগফেরাত কামনা করেও দোয়া করবেন।

তৃতীয় যে বিষয় বা দায়িত্বশীলের দায়িত্বের কথা এই আয়াতে বলা হয়েছে, তাহলো যারা অপরাধ করেছে তাদের সাথে সংকটকালীন মুহূর্তগুলোতে শলাপরামর্শ করতে হবে।
মানুষের সাথে যখন পরামর্শ করা হয় তখন তার দুটো উপকারিতা আছে। একটি হলো যে, বিভিন্ন ধরনের পরামর্শ ও চিন্তা আসার কারণে সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হয়। এক্ষেত্রে সিদ্ধান্তটি সার্বজনীনভাবে গ্রহণযোগ্যও হয়। আর দ্বিতীয় উপকারিতা হলো, যার পরামর্শ করা হবে তাকেও মূল্যায়ন করা হয় এবং গুরুত্ব দেওয়া হয়। যারা একবার ভুল করেছে তাদের সাথে যদি দায়িত্বশীল আর পরামর্শ না করেন তাহলে তাদের কাছে মনে হবে যে, আমাদেরকে ক্ষমা করা হয়েছে ঠিকই কিন্তু আমরা এখনো তার দায়িত্বশীলের আস্থাভাজন হতে পারিনি। কিন্তু যদি তাদের সাথে যদি জরুরি পরিস্থিতিতে পরামর্শ করা হয় তাহলে তারা নিজেদেরকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করবে। নিজেদেরকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার সাথে তারা শামিল করতে সক্ষম হবে।

এই তিনটি আমল করা মোটেও সহজ নয়। এ কারণেই লেখার শুরুতেই বলা হয়েছিল যে, সব সুন্নাহ আমল করা সহজ নয়। যদিও আমরা জানি যে এগুলো স্পষ্ট সুন্নাহ। আমাদের মাঝে অনেকেই দায়িত্বশীল পর্যায়ে আছেন। কেউ হয়তো বাড়িতে, বা অফিসে বা সংস্থা, কিংবা প্রতিষ্ঠানে দায়িত্বশীলের অবস্থানে আছেন। আমাদের সন্তান-সন্ততি, অধ:স্তন জনশক্তি অহরহই ভুল করে। কখনো কখনো হয়তো তারা বড়ো ভুল বা অপরাধই করে বসে। এমনও হয়, আমরা তাদের সালামেরই উত্তর দেই না, ভালো ব্যবহার করা তো দূরের কথা। বরং যাচ্ছে তাই ব্যবহার করি। এভাবে মানুষের মন ভেঙ্গে যায়। আমাদের সচেতনভাবে চেষ্টা চালানো দরকার- যাতে আমাদের কোনো আচরণে আমাদের অধ:স্তনরা আমাদের থেকে দূরে সরে না যায়।

মনে রাখতে হবে, কারো ভুমিকার কারণে মুসলমানদের জয় বা পরাজয় নির্ধারিত হয় না। সুরা আলে ইমরানের পরের আয়াতেই আল্লাহ জানিয়ে দিয়েছেন,
“যদি আল্লাহ তোমাদের সহায়তা করেন, তাহলে কেউ তোমাদেরকে পরাজিত করতে পারবে না। আর যদি তিনি তোমাদের সাহায্য না করেন, তবে এমন কে আছে, যে তোমাদের সাহায্য করতে পারে? আর আল্লাহর ওপরই মুসলমানগনের ভরসা করা উচিত।” (সুরা আলে ইমরান: আয়াত ১৬০)

উপরোক্ত আয়াতের নির্দেশনার আলোকে আমাদের উচিত, কেউ যদি সহনীয় ও ক্ষমাযোগ্য ভুল করে তাহলে তাকে অন্তরের অন্ত:স্থল থেকে ক্ষমা করে দেওয়া, তার জন্য একান্তে দোয়া করা এবং সংকটকালীন মুহুর্তে তার সাথে শলা-পরামর্শ করা। হঠকারি আচরণ, দুর্ব্যবহার ও ক্ষনস্থায়ী উত্তেজনার বশবর্তী হয়ে যেন আমরা কারো প্রতি অন্যায় না করি।
মহান আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে যার যার জায়গা থেকে সঠিক ভ‚মিকা পালন করার তাওফিক দিন। আমিন।

(শায়খ নোমান আলী খানের একটি লেকচার থেকে অনুপ্রাণিত)

লিখেছেন: আলী আহমাদ মাবরুর

পঠিত : ৬৭০ বার

মন্তব্য: ০