Alapon

বিজিত সবসময় বিজয়ীর বৈশিষ্ট্য, পরিচ্ছদ, পেশা ও অন্যান্য আচরণের অনুসরণ করে।


পাশ্চাত্যেরর সাথে বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে মুসলিম উম্মাহ দু’টি বড় মাপের ভুল করেছে। এ ভুলগুলোর মাশুল এখনো দিতে হচ্ছে। প্রথম ভুলটা ছিল উসমানি সালতানাতের শেষ দিকে। মুসলিম সভ্যতার জন্য সময়টা ছিল অধঃপতনের। এনলাইটেনমেন্ট এবং ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভোল্যুশানের পর ইউরোপের জন্য সময়টা ছিল অভাবনীয় উন্নতির। অর্থনৈতিক, জ্ঞান, প্রযুক্তি ও সামরিক দিক দিয়ে ইউরোপ শক্তিশালী হচ্ছিল। আর এর মোকাবেলার জন্য, ইউরোপীয় আগ্রাসন প্রতিহত করার জন্য উপুযক্ত সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ নিতে আমরা ব্যর্থ হয়েছিলাম। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম সম্পূর্ণভাবে পশ্চিমা সভ্যতাকে প্রত্যাখ্যান করার। পশ্চিমা সভ্যতার ভালো ও উপকারী অংশ আর মন্দ, ক্ষতিকর অংশের মধ্যে পার্থক্য করতে আমরা পারিনি। আর সঠিকভাবে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে না পারার কারনে সমস্ত মুসলিম ভূখণ্ডগুলো খুব অল্প সময়ের মধ্যে পশ্চিমাদের অর্থনৈতিক, সামরিক ও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের চলে গেল।

আমাদের দ্বিতীয় ভুলকে প্রথম ভুলের প্রতিক্রিয়া বলা যায়। পরাজয় তিক্ত বাস্তবতা যখন আমাদের চিন্তার জগতকে ধসিয়ে দিল, যখন এর মাত্রা ও তীব্রতা অনুভব করলাম, আমরা এক চরম অবস্থান থেকে আরেক চরম অবস্থানের দিকে ছুটলাম। পশ্চিমের বিরুদ্ধে আমাদের পরাজয়কে আমরা পশ্চিমা আদর্শের শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ হিসেবে ধরে নিলাম। এবার আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম পশ্চিমের অনুকরণের মাধ্যমে পশ্চিমের মোকাবেলার। ঢালাওভাবে তাদের ব্যবস্থা, আদর্শ, দর্শন, আক্বীদা আমরা গ্রহন করা শুরু করলাম। কোন প্রশ্ন, বিশ্লেষণ, পর্যবেক্ষন ছাড়াই অনুকরণ ও অনুরসনের পথ বেছে নিলাম। এক ধরণের ওভার কম্পেনসেইশান।

প্রথম ভুলের ফলাফল হল মুসলিম সভ্যতার পতন। দ্বিতীয় ভুলের ফলাফল হল এ পরাজিত অবস্থার দীর্ঘায়িত হওয়া। এখন এ পরাজিত অবস্থাকেই আমাদের মধ্যে বিশাল একটা অংশ অপরিবর্তনীয় বাস্তবতা হিসেবে মেনে নিয়েছে। অনেকে নিজেকে পশ্চিমা সভ্যতারই অংশ মনে করছে, আবার অনেকে আয়নায় নিজেকে দেখছে পশ্চিমা লেন্সের মধ্য দিয়ে। এমনকি আমাদের মধ্যে যারা পশ্চিমা সভ্যতার মোকাবেলার কথা বলছে তাদের মধ্যে প্রচ্ছন্নভাবে পশ্চিমকে শ্রেষ্ঠ মনে করা ও অনুসরণ করার প্রবণতা কাজ করছে।

যেমন অনেকে পশ্চিমের ভাষায় পশ্চিমকে বোঝানোর চেষ্টা করেন। কেন ইসলাম মানবিক, কেন ইসলাম বৈজ্ঞানিক, কেন দাসপ্রথা যৌক্তিক, কেন বহুবিবাহ সামাজিকভাবে ভালো ফলাফল বয়ে নিয়ে আনবে, জিহাদ হল আসলে মানবাধিকার নিশ্চিত করার জন্য যুদ্ধ – ইত্যাদি বোঝাতে ব্যস্ত হয়ে যান। তারা মনে করেন ইসলাম কতো সুন্দর এটা বোঝাতে পারলেই বুঝি ইসলাম ও মুসলিমদের প্রতি পশ্চিমা বিশ্বের যে বিদ্বেষ তা বন্ধ হয়ে যাবে। তারা সবসময় জাতে ওঠার প্রচেষ্টায় ব্যস্ত থাকেন। আবার অনেকে নিজের ইসলাম নিয়ে এতোই হীনমন্যতায় ভোগেন যে ইসলামকে মানবিক, বৈজ্ঞানিক, আধুনিক ইত্যাদি প্রমাণ করা তার নিজের ঈমান রক্ষার জন্যই অপরিহার্য হয়ে যায়। অনেকে ইসলামের বিজয়ের পথ খুঁজে পান ‘জ্ঞান-বিজ্ঞানে’ উন্নতির মাঝে। একইভাবে এই অন্ধ অনুসরণের ফলাফল হিসেবে ইসলামি গণতন্ত্র, ইসলামি ব্যাংক, ইসলামি ফেমিনিযমসহ এধরনের অনেক ‘ধারণা’ গড়ে ওঠে। এবং সামষ্টিকভাবে এ সবকিছু আমাদের পরাজিত অবস্থাকে দীর্ঘায়িত করে।

এধরণের ধারনায় বিশ্বাসীদের অনেকেই দুঃখপ্রকাশ করে বলেন, আমাদের মধ্যে ক্রিটিকাল থিংকিং এর খুব অভাব। চর্চা হওয়া প্রয়োজন। চিন্তাগত জড়তা ছেড়ে যুগের চাহিদা অনুযায়ী মুসলিম হিসেবে আমাদের পরিবর্তনশীল সময়ের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা দরকার। খুব সুন্দর কিছু কথার মাধ্যমে তারা এ আইডিয়াটা মানুষের মাথায় ঢুকিয়ে দেন। তারা বলেন –

“ইসলাম সর্বযুগের জন্য প্রযোজ্য। ইসলাম আল্লাহর মনোনীত শ্রেষ্ঠ জীবন ব্যবস্থা। তাই ইসলাম কোন সময়ের সাথে খাপ খাবে না – এমন হতেই পারে না। সমস্যা হচ্ছে, আমরা সঠিক ভাবে ইসলামের শিক্ষাকে বুঝতে পারছি না। কিছু পুরনো ধ্যানধারণা আকড়ে ধরে আছি।”

কথাগুলো শুনতে ভালো কিন্তু উদ্দেশ্য খারাপ। তাদের এ কথার অর্থ হল, পশ্চিমা সভ্যতার বাস্তবতার সাথে খাপ খাওয়ানার জন্য আমাদের নতুন ভাবে ইসলামকে ব্যাখ্যা করা উচিৎ। এধরণের চিন্তার জগতে পশ্চিমা সভ্যতা ধ্রুবক, ইসলাম পরিবর্তনশীল। ক্রিটিকাল থিংকিং বলতে তারা বোঝান ইসলামকে বদলে নেয়া, যাতে করে তা পশ্চিমের সাথে সাংঘর্ষিক না হয়।

আমি অ্যাগ্রি করি। আমাদের মধ্যে ক্রিটিকাল থিংকিং এর অভাব আছে। চর্চা প্রয়োজন। তবে পশ্চিমের ছাঁচে ফেলে নতুন ইসলাম তৈরির জন্য না। আমাদের চিন্তার গভীরতা বাড়ানো প্রয়োজন পশ্চিমা ধারণাগুলোকে সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করার জন্য। যেসব ধারণা আমরা চোখ বন্ধ করে আমাদের সমাজে গ্রহন করেছি, সেগুলো কীভাবে আমাদের সমাজকে প্রভাবিত করছে, কী ধরনের ফলাফল বয়ে আনছে তা বোঝার জন্য। পশ্চিমা সভ্যতার যে বিষয়গুলো ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক সেগুলো চিহ্নিত করে বাদ দেয়ার জন্য। আমাদের ক্রিটিকাল থিংকিংর এর প্রয়োজন শত্রুর দুর্বলতা আর শক্তির জায়গাগুলো চেনার জন্য। মুসলিমদের পশ্চিমা সভ্যতার ক্ষতি সম্পর্কে সচেতন করার জন্য। উম্মাহ যেন শত্রুকে চিনতে পারে, তা নিশ্চিত করার জন্য। পশ্চিমের অনুকরন থেকে বের হয়ে আসার জন্য। বিদ্বান সাজার জন্য না।

যতোক্ষণ উম্মাহ পশ্চিমের অনুসরণ করে যাবে উম্মাহ মানসিক দাসত্ব থেকে মুক্ত হতে পারবে না। আর এক্ষেত্রে মানসিক দাসত্ব কেবল পরাজয়ের ফলাফল না, বরং এখন শারীরিক দাসত্বের প্রধান কারণে পরিণত হয়েছে। পশ্চিমাদের কাছে ইসলামকে গ্রহণযোগ্য হিসেবে উপস্থাপন করার বদলে, পশ্চিমের বাস্তব অবস্থা মুসলিম উম্মাহর সামনে তুলে ধরা প্রয়োজন। গণতন্ত্র, পশ্চিমা মানবাধিকার, সেক্যুলার হিউম্যানিযম, ফেমিনিযম, পশ্চিমের সিস্টেম্যাটিক যৌন বিকৃতি, ট্রান্সজেন্ডার মুভমেন্ট, ব্যাংকিং সিস্টেম, পশ্চিমা সংস্কৃতির বিকৃতি, পশ্চিমা সমাজ ও রাষ্ট্রের ভাঙ্গন –মানসিক দাসত্ব থেকে বের হয়ে আসার জন্য পশ্চিমা সভ্যতার এসব ধারণার বাস্তবতা উম্মাহর সামনে বোধগম্য তুলে ধরা প্রয়োজন। উল্টোটা না।

কিন্তু যদি আমরা গোঁ ধরি অন্ধভাবে অনুসরণের, তাহলে শুধু আমাদের পরাজয়ের অধ্য্যায় দীর্ঘায়িত হবে না, যে অন্ধকার গহ্বরের কিনারে পশ্চিমা সভ্যতা পৌছে গেছে তাদের সাথে সাথে আমাদের জায়গাও হবে তার তলদেশে। বিজিত-বিজয়ীর সম্পর্কের এ ডায়নামিক্সের কারণেই আমাদের মধ্যে পশ্চিম নিয়ে একটা মুগ্ধতা কাজ করে। কলোনিয়াল লুটপাটের মাধ্যমে কেন্দ্রীভূত করা বিপুল ঐর্শ্বর্যের ব্যবহারের মাধ্যমে কয়েক শতাব্দী আগে মাসে এক বা দু'বার গোসল করা চরম, নোংরা, বর্বর, হিংস্র ও অমানবিক শ্বেতাঙ্গ ইউরোপীয় জাতি আজ সফিস্টিকেইশানের সবক দিচ্ছে। বর্বর এখন ভদ্র হয়েছে। আর দুঃখজনকভাবে তাদের লুটপাটের ফলাফল হিসেবে সমাজ ও ব্যক্তিজীবনে আসা এ উৎকর্ষকে আমরা ভাবছি তাদের সফলতার কারণ। তাদেরকে নৈতিকতা ও মানবীয় উৎকর্ষের আইকন হিসেবে মাথায় তুলে নিচ্ছি। অথচ এ সভ্যতার প্রতি পদে পদে ছড়িয়ে আছে ছোটবড় নানা অনৈতিকতার গল্প।

[আল মুকাদ্দিমা, ইবন খালদুন]

পঠিত : ৫৯৮ বার

মন্তব্য: ০