Alapon

দেশে দেশে এরদোয়ানের মসজিদ নির্মাণ প্রকল্প...


এরদোয়ানবিরোধী সেক্যুলারদের দুর্গ হিসেবে পরিচিত তুরস্কের অন্যতম বৃহৎ শহর ইজমিরে নতুন একটি মসজিদের উদ্বোধন করেছেন প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান। ষোড়শ শতকের উসমানি আমলের আদলে নির্মিত এ মসজিদটি ইজমিরের সর্ববৃহৎ মসজিদে পরিণত হয়েছে। জুমার নামাজের পর এক সমাবেশে এরদোয়ান এ মসজিদটিকে ইজমিরের অতুলনীয় সিম্বল হিসেবে তুলে ধরেন। এর আগে গত বছর ইস্তাম্বুলে উদ্বোধন করেছিলেন তুরস্কের ইতিহাসের সর্ববৃহৎ ক্যামালিকা মসজিদ। যা নিয়ে সেক্যুলাররা সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠেছিল। তবে ঘরে বাইরে সমালোচনা যাই হোক, বিগত ১৭ বছরে তুরস্ককে মসজিদের দেশে পরিণত করেছেন এরদোয়ান।

বিবিসি তুর্কির তথ্যমতে, বিগত ১০ বছরে অর্ধ বিলিয়ন ডলার খরচ করে তুরস্কজুড়ে নির্মাণ করা হয়েছে ১০৩ টি মেগা মসজিদ। এর বাইরে ২০০৫ থেকে ২০১৫ এর মধ্যে নির্মাণ করা হয়েছে নয় হাজারের অধিক ছোট বড় মসজিদ। বর্তমানে নব্বই হাজারেরও অধিক মসজিদ রয়েছে তুরস্কে। এরদোয়ান সরকারের অভিনব এ মসজিদ নির্মাণ প্রকল্প বরাবরের মতই বিরোধী সেক্যুলার রাজনৈতিক দল ও পশ্চিমাদের সমালোচনা থেকে রেহাই পায় নি। তবে এই প্রকল্পে কোন সমালোচনারই পরোয়া করেননি এরদোয়ান। মসজিদ নির্মাণের প্রশ্নে তিনি অনড়। এর কারণটা ঐতিহাসিক। আতাতুর্কের ধর্মহীনতার প্লাবনে যখন ভেসে যাচ্ছিল তুর্কী জনগণের ঈমানী অতীত, তখন এ মসজিদগুলোই ‘সাদ্দে সেকান্দরী’র ভূমিকা নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। বিস্মৃত ঈমানী জাতিসত্তার আহবান নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল মসজিদের মিনার আর গম্বুজগুলো। কালের বিবর্তনে তুর্কিরা অনেক কিছুই ভুলে যায় , কিন্তু শত শত বছরের অতীতকে ধারণ করে দাঁড়িয়ে থাকা সুলতান আহমেদ মসজিদ, সোলেমানিয়া মসজিদ, আইয়ুব সুলতান মসজিদ, ফাতিহ মসজিদসহ অসংখ্য মসজিদ তাদের অতীত স্মৃতি চোখের তারায় ভেসে ওঠে । এসব কারণে আগামী প্রজন্মের ঈমানি নিরাপত্তার স্বার্থে মসজিদময় তুরস্ক রেখে যেতে চান এরদোয়ান।

তবে আনন্দের ব্যাপার হল, এরদোয়ান সরকারের এ মসজিদ নির্মাণ প্রকল্প শুধু তুরস্কে সীমাবদ্ধ থাকে নি , সারা দুনিয়াতেই ছড়িয়ে পড়েছে। এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকা তিন মহাদেশেই এ প্রকল্প নিয়ে হাজির হয়েছে তুরস্কের রাষ্ট্রীয় ধর্মীয় সংস্থা ‘দিয়ানাত ফাউন্ডেশন’। জার্মানি, ইংল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ফিলিপাইন, আলবেনিয়া, ঘানা, সুদান, সোমালিয়া, ভেনেজুয়েলা ও কিউবাসহ পৃথিবীর ১৪৫ টি দেশে চলছে মসজিদ, কালচারাল ইনস্টিটিউট, মানবাধিকার,শিক্ষা ও স্বাস্থ্যবিষয়ক এ প্রকল্পটি। ইউরোপের দেশে দেশে যখন ইসলামবিরোধী প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে পড়ছে, তখন ইউরোপে স্ট্র্যাটেজিকভাবে নির্মাণ করা হচ্ছে শত শত মসজিদ ও ইসলামি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। ইউরোপের অন্যতম মুসলিমবিদ্বেষী রাষ্ট্র এক জার্মানিতেই তুরস্কের অর্থায়নে নির্মাণ করা হয়েছে প্রায় নয় শত মসজিদ। এ সব মসজিদে পাঠানো হচ্ছে ধর্মীয় ও আধুনিক শিক্ষাপ্রাপ্ত প্রশিক্ষিত ইমাম। যারা একইসাথে দাঈ এবং বুদ্ধিবৃত্তিক ক্রসেডের মোকাবেলায় লড়াকু সৈনিক। এছাড়া ইংল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও রাশিয়ায় নির্মাণ করা হয়েছে কয়েকশো মসজিদ। যেগুলো নামাজের পাশাপাশি ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার কেন্দ্র হিসেবেও তৈরি করা হয়েছে। এবং স্ট্র্যাটেজিকভাবে নির্মিত হওয়ার কারণে এ মসজিদগুলো বিশেষ নিরাপত্তা লাভ করে থাকে। যা ইউরোপীয় মুসলিমদের জন্য অনেক বড় পাওয়া।

এছাড়া মধ্য এশিয়ার সর্ববৃহৎ মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে কিরগিজস্তানের রাজধানী বিশকেকে। আর বলকান অঞ্চলের সর্ববৃহৎ মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছে আলবেনিয়ার রাজধানী তিরানায়। দেশটির জনসংখ্যার ৫৭ ভাগ মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও সরকারি অর্থায়নে বৃহৎ কোন মসজিদ ছিল না সেখানে। সম্প্রতি তুরস্কের অর্থায়নে দেশটিতে পুরো বলকান অঞ্চলের বৃহৎ মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে। এর বাইরে ঘানার রাজধানী আক্কায় পুরো পশ্চিম আফ্রিকার সর্ববৃহৎ
আকারের একটি মসজিদ নির্মাণ করে দিয়েছে তুরস্ক। ভেনেজুয়েলা ও কিউবার মত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বৃহৎ বাজেটে এগিয়ে চলছে প্রকল্পের কাজ। রাশিয়ার সর্ববৃহৎ মসজিদটিও তুরস্কের অর্থায়নে নির্মিত। চলতি বছর এসবের বাজেট ধরা হয়েছে ১০ বিলিয়ন তুর্কি লিরা। যা ২০১৭ সালের বাজেটের শতকরা ৪৫ ভাগ বিশালকায়। বৃহৎ এ প্রকল্পে দিয়ানাত ফাউন্ডেশনের পাশাপাশি কাজ করছে টিকা নামের একটি দাতব্য সংস্থা। একসময়ের উসমানি খিলাফতের আওতাভুক্ত বিভিন্ন রাষ্ট্রের হারিয়ে যাওয়া স্থাপনা ও নির্মাণ পুননির্মাণ করা হচ্ছে। এর সাথে সাথে মুসলিম বিশ্বের বিপন্ন দেশগুলোর পুনর্গঠন ও সহযোগিতায় ব্যয় করা হচ্ছে কয়েক বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ফিলিস্তিন, ইয়েমেন, সিরিয়া, সুদান, সোমালিয়া, ইরাক, আরাকান ও উইঘুরসহ বিপর্যস্ত মুসলিম বিশ্ব ও একসময়ের উসমানি খিলাফতের আওতায় থাকা দেশগুলোই প্রধানত এ অনুদান পাচ্ছে। বিগত কয়েক বছরের জরিপ অনুযায়ী দাতব্য সংস্থায় পৃথিবীর সর্ববৃহৎ অনুদান প্রদানকারী দেশ তুরস্ক। ঠিক যে সময়ে তুরস্কের চেয়ে অর্থনৈতিক শক্তিশালী আরব দেশগুলো বিশ্ব দাবা গেমস, রেস লিং খেলা আর রাজতন্ত্র রক্ষায় দেশে দেশে ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধে ঢেলে দিচ্ছে টাকার পাহাড়, তখন তুরস্কের এসব সহযোগিতামূলক প্রকল্প নির্জীব উম্মাহকে প্রাণোচ্ছল করে তোলে। যেন একটি আহবান উঠে আসছে হতাশার সাগরে হাবুডুবু খাওয়া উম্মাহকে রক্ষার। মৃত্যু উপত্যকায় জীবনের আশ্বাস নিয়ে ছুটে আসছে সেই আহবান। গোলাবারুদ আর ধ্বংসের রাজত্বে ভ্রাতৃত্ব্যের সৌরভ বিতরণ করছে সেই আহবান। সেই আহ্বানে কলকল করে ধ্বনিত হচ্ছে প্রেম, সৌহার্দ্য ও ভ্রাতৃত্বের সংরাগ। পবিত্র সেই আহবানে যত তাড়াতাড়ি সাড়া দিবো আমরা, ততই কল্যাণ হবে আমাদের।

এরদোয়ানকে আল্লাহ নেক হায়াত দান করুন। এবং উম্মাহর কল্যাণে তার সব প্রচেষ্টাকে কবুল করুন। হৃদয়ের গভীর থেকে এই প্রার্থনা।

© আরটি এরদোয়ান

পঠিত : ৬৯১ বার

মন্তব্য: ০