Alapon

দিল্লীর পুরানা কেল্লা : এক চমকপ্রদ ইতিহাস...


মোগল সম্রাট বাবরের পুত্র মির্জা নাসির উদ্দীন মোহাম্মদ হুমায়ুন ১৫৩৩ সালে পুরানা কেল্লা তৈরি করেন। ইতিহাসে তিনি পাদশাহ হুমায়ূন কিংবা সম্রাট হুমায়ুন হিসেবে পরিচিত এবং তিনি মোগল সাম্রাজ্যের বিখ্যাত সম্রাট আকবরের বাবা। পুরানা কেল্লা তৈরি করতে সর্বমোট পাঁচ বছর সময় লাগে। দিল্লীর লাল কেল্লা থেকে এই কেল্লার দূরত্ব প্রায় তিন কিলোমিটার। পুরানা কেল্লার সাথে বাংলার একটা যোগসূত্র আছে। ভারতীয় উপমহাদেশে সম্রাট হুমায়ুনের চমকপ্রদ বহু কথা রয়েছে। তিনি ছিলেন একাধারে কবি, সাহিত্যিক, অতি-জাগতিকতা নিয়ে উৎসাহী মানুষ। ছিলেন রাজনীতিবিদ, যথেষ্ট আরাম-আমোদপ্রিয়, কখনও হেঁয়ালীপনা এবং নরম দিলের মানুষ। ফলে তার চারিদিকে বহু চরিত্রের মানুষের ভিড় জমে থাকত। তার শত্রু-মিত্রের অভাব ছিলনা। আপন ভাইয়েরাও তার চির শত্রু হিসেবে চিত্রিত ছিলেন। ফলে তাকে বারে বারে ভাগ্য বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছিল। তিনিই একমাত্র মোগল সম্রাট যার অভিধানে চরম পরাজয়ের ঘটনা যেমন রয়েছে সেভাবে বিপুল বিজয়ের ঘটনাও রয়েছে। তিনি বেশী দিন বাঁচেন নি তবুও, তিনি বিশ্ব ইতিহাসে বহু গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের রচয়িতা।

এই পুরানা কেল্লা তারই হাতের বানানো কীর্তি। টিলা আকৃতির জায়গাতেই এই কেল্লার স্থান নির্বাচন করা হয়। কেল্লার নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য একটু ভিন্ন প্রকৃতির, যা পৃথিবীর অন্যান্য কেল্লা গুলো থেকে একটু আলাদা প্রকৃতির। কেল্লার চারিদিকে বিশাল নিরাপত্তা দেওয়াল রয়েছে যা টপকানো কোন অবস্থাতেই সম্ভব নয়। শত্রু পক্ষ দেওয়াল টপকাবে দূরের কথা, তারা দেওয়ালের কাছেই আসতে পারবে না! সে ব্যবস্থাই সুকৌশলে করা আছে। দেওয়ালের বাহিরের চারিদিকে ঘেরা রয়েছে বিশালকায় পানির লেক দিয়ে। ব্যাপক প্রশস্ত লেকের পানি সাঁতরিয়ে কিনারে উঠেই চিন্তা করতে হবে কিভাবে দেওয়াল টপকানো যাবে। এই দুর্গ আক্রমণ করতে গেলে বয়ে আনতে হবে কামান, গোলা, নৌকা, জলজ অস্ত্র সহ অনেক কিছু। যা কোন অবস্থাতেই সম্ভব ছিলনা। কেল্লার ভিতরেই আছে বহু ভবন যেখানে থাকতেন স্বয়ং সম্রাট হুমায়ুন।

হুমায়ূন আফগান বীর শের খানের পিছু নিয়েছিলেন। অবশেষে তিনি দিল্লী থেকে ছুটতে ছুটতে চৌসারে পৌছে যান। শের-শাহ ছিলেন ধুরন্ধর ও উপস্থিত বুদ্ধিমত্তায় পারদর্শী। তিনি জানতেন সরাসরি লড়াই করে মোগল বাহিনীকে পরাজিত করা সম্ভব নয়। সেটা হুমায়ুন নিজেও জানতেন। তাই তিনি যুদ্ধের মধ্যেও খামখেয়ালী পনা দেখাতেন। ১৫৩৯ সালের ২৬ জুন ভোরে শের-শাহের বাহিনী হঠাৎ করে হুমায়ুনের বাহিনীকে চরমভাবে পরাজিত ও বিপর্যস্ত করে। হুমায়ুন কোন প্রকারে প্রাণ বাঁচিয়ে এদেশ থেকে সেদেশ পালিয়ে বেড়াতে থাকেন। তার জীবন এতটাই সঙ্গিন হয়ে উঠেছিল যে, তার এই অব্যাহত পালানোর মধ্যেই জন্ম হয় পরবর্তী সম্রাট আকবরের। ভাগ্য তার এতটাই প্রতিকুলে ছিল যে, শিশু সন্তানকে জঙ্গলে ফেলে দিয়েই মোগল বাদশাহকে জানের ভয়ে আবারো পালাতে হয়েছিল। পুরানা কেল্লা শের খানের দখলে চলে যায়। তিনি শের শাহ সূরি নাম দিয়ে ভারত শাসন করতে থাকেন। তখন বাংলা শাসিত হতে থাকে ঈশা খানের হাতে।

পুরানা কেল্লা হুমায়ুনের হাতে তৈরি হলেও এটি পদানত করা হুমায়ুনের পক্ষেও সম্ভব ছিলনা। শের শা নিজেও পুরানা কেল্লার অনেক পরিবর্তন আনেন। তিনি পুরানা কেল্লাকে কেন্দ্র করেই দেশ শাসন করতে থাকেন। ইতিহাসের অন্যতম কীর্তি ও দীর্ঘ সড়ক তথা গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড সৃষ্টি করেছিলেন শের শাহ। তিনি এই রাস্তায় ব্যাপক সরাই খানা বানান এবং ডাক ব্যবস্থা চালু করেন। কৌতূহলের ব্যাপার হল এই সড়কের শুরু হয়েছিল পুরানা কেল্লা থেকে এবং শেষ হয়েছিল বাংলাদেশের সোনারগাঁয়ে এসে।

নিজেদের কামানের গোলা ফেটে শের শাহ নিহত হলে হুমায়ুনের রাজ্য উদ্ধার সহজ হয়ে যায়। ইরানের সম্রাট তাকে সৈন্য দিয়ে সহযোগিতা করে। তিনি আবারো যুদ্ধের ময়দানে ফিরে আসেন এবং পুনরায় পুরানা কেল্লায় স্থলাভিষিক্ত হন। পুরানা কেল্লা আরো নান্দনিক ও মজবুত হয়। অতঃপর মোগল সাম্রাজ্য এই পুরানা কেল্লাকে কেন্দ্র করেই স্থায়ী ভাবে ভিত গড়ে তুলে।

আমি নিজের চোখে পুরানা কেল্লার বিশাল এলাকা দেখেছি। তিন দিকে পানি একদিকে পাহাড়ের সাড়ি। প্রয়োজনে পালানোর জন্য এই ব্যবস্থা। কিন্তু এই কেল্লা ও তৎসংলগ্ন এলাকা এতই সমৃদ্ধশালী ছিল যে, এখানে থেকে কারো পালানোর দরকার পড়েনি। পৃথিবীর বহু জাতির বহু বিখ্যাত নরপতি বিশাল ভারতকে শাসন করেছেন এই দিল্লীকে কেন্দ্র করেই। পুরানা কেল্লার লেকের পানিতে এখন পর্যটকদের নৌকা চলে, ইঞ্জিন চালিত যানে ভরা এই এলাকা। দিল্লী চিড়িয়াখানা এশিয়ার বিখ্যাত চিড়িয়াখানা গুলোর একটি। বিশাল এই পর্যটন স্থান গড়ে উঠেছে পুরানা কেল্লার নিজের জায়গায়! ঠিক দিল্লী শহরের প্রাণ কেন্দ্রে। সম্ভবত রাজধানীর মূল কেন্দ্রে এভাবে বিশাল চিড়িয়াখানা বানাতে পেরছে একমাত্র ভারত।

ঐতিহাসিক ঐতিহ্যই ভারতকে কোটি কোটি কোটি রুপী অর্থের জোগান দেয়। শের শাহ কামান ফেটে ৫৮ বছর বয়সে মারা গিয়েছিলেন আর লাইব্রেরীর সিঁড়ি দিয়ে জলদি নামতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে গিয়ে, মাত্র ৪৮ বছর বয়সে পাদশাহ হুমায়ুন ইহলোক ত্যাগ করেন! এটি এই কেল্লার মন্দতর দিক। তার স্ত্রী সম্রাট আকবরের মা, হামিদা বানু বেগম স্বামীর স্মৃতি ধরে রাখতে তৈরি করেন একটি বিশাল আকৃতির দরগাহ। যার নাম হুমায়ুন সৌধ। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সৃষ্ট ভারতীয় উপমহাদেশে কবরের উপর নির্মিত এটাই প্রথম সৌধ ও দরগাহ। এর পর থেকে এই উপমহাদেশে কবরের উপর ঘর বানিয়ে ঝাঁক জমকের সহিত দিবস পালনের রীতি চালু হয়। পারস্য সাংস্কৃতির প্রভাবে এই রীতি সারা ভারতের আনাকে কানাচে ছড়িয়ে পড়ে।

লিখেছেন: নজরুল ইসলাম টিপু

পঠিত : ৬৪০ বার

মন্তব্য: ০