Alapon

ওয়াজ মাহফিল এবং কিছু কথা...


আমাদের দেশে এখন ওয়াজের মওসুম চলছে।
সারাদেশের আনাচে কানাচে ওয়াজ মাহফিল অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
গত কয়েকদিন ইউটিউবে আমি কিছু হুজুরদের অনেক ওয়াজ শুনলাম।
সেসব নিয়ে কিছু কথা লেখা জরুরী মনে করছি।

আমার জন্ম ও বেড়ে উঠা একটা রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে। আমার দাদাভাই মাওলানা আব্দুল মান্নান ওয়াজেদী ছিলেন আমাদের এলাকার বিখ্যাত আলেমে দ্বীন, হাজারো আলেমের উস্তাদ, সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব ও উনার চাচা মৌলভী আব্দুর রহমানের হাতে গড়া বোয়ালিয়া বাতেনিয়া ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল।

দাদাভাই তার মেধা,নিরলস শ্রম,যোগ্য পরিচালনা ও নিষ্ঠা দিয়ে মাদ্রাসাটাকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন। একটানা ৪০ বছর তিনি মাদ্রাসাকে আগলে রেখেছিলেন পরম মমতায় সন্তান স্নেহে। আমাদের পুরো উপজেলায় এই মাদ্রাসা আলো ছড়িয়েছে। ছোটবেলা থেকেই দেখতাম দাদাভাই বিভিন্ন ইসলামী জলসায় ওয়াজ করতে যেতেন। তিনি বিখ্যাত ছিলেন মোনাজাতের জন্য।
উনার আবেগঘন দীর্ঘ মোনাজাতে মানুষ হু হু করে কেঁদে উঠত।

আমাদের মাদ্রাসাতে ও বার্ষিক ওয়াজ হতো। ওয়াজের দিনটা ছিল আমাদের কাছে ঈদের দিনের মতো। বাড়িতে মজাদার খাবার রান্না হতো। দূর-দূরান্তের আত্মীয়রা সেদিন ওয়াজ শুনতে আসতেন।একটা আনন্দ-হিল্লোল পরিবেশ বিরাজ করত।

ওয়াজের আকর্ষণ থাকত ভারতের জৈনপুর থেকে আগত পীর সাহেব হুজুররা। উনারা যখন পালকিতে চড়ে আসতেন তখন আমাদের গ্রামের বাচ্চা-বুড়ো সবাই পালকির পিছু পিছু যেতেন। আমাদের মনে আনন্দ বিরাজ করতো।তাছাড়া ওয়াজ কে কেন্দ্র করে বাজার বসতো। মুরালি,চানাচুর চটপটি সহ নানা ধরনের খাবার ও নানা রকমের খেলনা পেয়ে আমাদের ছোট মন আনন্দে ভরে যেত।

আসরের পর ওয়াজ শুরু হলেও মূল বক্তারা ওয়াজ করতেন সন্ধ্যার পর।ওয়াজ চলত গভীর রাত পর্যন্ত।বাড়ির মহিলারা বিকালের মধ্যেই সব কাজ শেষ করে মাগরিবের পরপরই ওয়াজ শোনার প্রস্তুতি নিতেন। পুরো এলাকায় একটা শান্ত ও পবিত্রভাব ছড়িয়ে পড়ত।

হুজুররা ওয়াজ করতেন। মানুষকে শুনাতেন ইসলামের মর্মবাণী। ওয়াজে থাকত নবী-রাসূলদের জীবনীভিত্তিক শিক্ষণীয় ঘটনা।
সাহাবাদের জীবনকাহিনী ও ত্যাগের কথা,আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ভালোবাসার কথা,আল্লাহর মাহাত্ম্য, নামাজ, রোজা, হজ-যাকাত, ঈমান-আমল , কেয়ামত, কবরের আজাব, বেহেশত ও দোজখের কথা, হারাম, হালাল নিয়ে কোরআন ও হাদিসভিত্তিক শিক্ষণীয় আলোচনা। সমাজে চলা নানা অনিয়ম ও অসঙ্গতি নিয়েও হুজুররা কথা বলতেন। পর্দা নিয়ে ওয়াজ করতেন।বিভিন্ন মাসলা-মাসায়েল আলোচিত হতো ওয়াজে।

মানুষ মুগ্ধ হয়ে ওয়াজ শুনতেন। নিজেকে পরিবর্তনের একটা চেষ্টা করতেন সেই সব ওয়াজ শুনে। ওয়াজ শুনতে গিয়ে মানুষ অশ্রুসিক্ত হতো। ওয়াজ শেষ হয়ে গেলেও কয়েক সপ্তাহ মানুষের আলোচনায় থাকত বিভিন্ন হুজুরের করে যাওয়া বয়ান। সেই সব দিন গত হয়েছে। তবে ওয়াজের সংস্কৃতি এখনও বিদ্যমান।

তবে সেখানে এসেছে নানা রঙ ও বৈচিত্র্য।এখন হুজুররা ওয়াজকে ব্যবসায় পরিণত করেছেন। হেলিকপ্টার হুজুররা হেলিকপ্টারে চড়ে ওয়াজে আসেন।লাখ টাকা হাদিয়া নেন। আগে বুকিং দিতে হয় লাখ টাকা দিয়ে। ওয়াজের মঞ্চে আমাদের নানা কিচ্ছা-কাহিনী সুরেলা কণ্ঠে শুনান। কোরআন- হাদিসের আলোচনা ও শিক্ষা নিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বক্তব্য না রেখে আজকের দিনে হুজুরদের বক্তব্য বিষোদগারে ভরপুর।

কে সুন্নী, কে ওয়াহাবী, কে মাজহাবী, কে লা-মাজহাবী,কে আহলে হাদিস- এ সব নিয়ে কথাবার্তা।

আমাদের রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর মাধ্যমে আল্লাহ ইসলামকে পরিপূর্ণ জীবন বিধান হিসেবে মনোনীত করে দিয়েছেন।
সেই ইসলামকে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাস্ট্র জীবনে মানার মাধ্যমে কিভাবে একজন ধর্মপ্রান মুসলমানের দুনিয়াবী কল্যান ও পরকালীন মুক্তি কিভাবে নিশ্চিত হতে পারে তা নিয়ে ওয়াজ না করে কিছু হুজুর স্টেজ গরম করে ফেলেন আলতু ফালতু বিষয়ে কথা বলে।

কিছু হুজুর জীবন ঘনিষ্ট ও কুরআন সুন্নাহ ভিত্তিক আলোচনা না করে একি টপিকসে ঘুরে ফিরে ওয়াজ করেন এবং বিদ্বেষ ছড়ান।

নবী নূরের তৈরী না মাটির তৈরী,নবী গায়েব জানেন কিনা,নবী হাজির নাজির কিনা,মিলাদ কিয়াম, মিলাদুন্নবী পালন এসব ঠুনকো বিষয় উনাদের ওয়াজের মূল প্রতিপাদ্য।।
অথচ নবী (সাঃ) যেই জন্য দুনিয়ায় আসলেন, যা শিখিয়ে গেলেন তা যে আমল করা দরকার তা নিয়ে উনাদের ওয়াজ নেই।।

একদল ওয়াজে নেমেই অন্যদল কে কাফের ফতোয়া দিয়ে মরিয়া হয়ে উঠেন। এক হুজুর তো দেখি কাফেরের ঠিকাদারী নিয়ে বসেছেন। তিনি কথায় কথায় উনার সঙ্গে না মিললেই কাফের ফতোয়া দিয়ে দেন। অন্যদল একে অপরকে ইহুদি ও নাসারাদের দালাল বলে গালাগাল করেন। পীর ও মাজার পূজারীরা অন্যদের গালাগালি দেন, উনাদের পীরদের কি কি অলৌকিক ক্ষমতা তা মানুষকে শুনান।

ওয়াজ নয়, যেন যুদ্ধ ক্ষেত্র। ওনাদের চিৎকার ও হুংকারে চারপাশ প্রকম্পিত হয়ে উঠে। একদল অন্য দলের বিরুদ্ধে ফতোয়া দিতে দিতে ক্লান্ত। গত কয়েক বছরে কিছু হুজুর ডা. জাকির নায়েককে কাফের ও ইহুদিদের দালাল প্রতিষ্ঠা করতে অনেক গলদগর্ম পরিশ্রম করেছেন।

এর মধ্যে কিছু হুজুর অন্য ধর্মাবলম্বী বিশেষ করে হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন দেব দেবী, তাদের বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান ও পূজা নিয়ে এমন সব ব্যাঙ্গাত্মক কথাবার্তা বলেন যা শুনতে প্রচণ্ড শ্রুতিকটু।
অথচ ইসলাম বিশ্বাস করে " লা ইকরা হাফিদ্দিন"
দ্বীনে বাড়াবাড়ি বা জবরদস্তি নেই।

ইদানিং দেখা যাচ্ছে কিছু কিছু বক্তা ওয়াজে গান গেয়ে শুনান, নানা অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করেন। বসেন বসেন বসে যান।ঢেলে দিতে চান চা। এক বক্তা সিগারেট খাওয়ার বিভিন্ন স্টাইল দেখান।আরেক বক্তা বিড়ি খাওয়ার দোয়া শেখান।
এক একজন নাট্যমঞ্চের ভাঁড়ের মতো আচরণ করেন।

ব্যতিক্রমী আলোচকও আছেন যারা ইসলামী ও আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত, তাদের আলোচনায় জ্ঞানগর্ব, প্রাঞ্জল ও যৌক্তিক ভাষায় ইসলামের নান্দনিক সৌন্দর্য্য উঠে আসে।

যেমন মাওলানা মিজানুর রহমান আযহারী একজন উচ্চ শিক্ষিত প্রখন জ্ঞানের অধিকারী বক্তা যার ওয়াজ শুনে লাখ লাখ তরুণ আলোর দিশা পাচ্ছে এবং অল্প দিনেই যিনি সারাদেশের ইসলাম প্রিয় মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন।
আরেকজন মাওলানা আব্দুল হাই মু্হাম্মদ সাইফুল্লাহ যিনি মসজিদের মিম্বার থেকে এমন সুন্দর ও প্রাঞ্জল ভাষায় সমকালীন বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেন যা অনেক মানুষের অন্তর চক্ষু খুলে দিচ্ছে।
মুফতি আহমাদুল্লাহ, মাওলানা ড.মনজুরে ইলাহী,মাওলানা আব্দুল্লাহ আল আমিন সহ বেশ কিছু হুজুর এর ওয়াজ শুনে মুগ্ধ হয়েছি।।
যাদের ওয়াজ শুনে তাদেরকে ধর্ম ব্যবসায়ী মনে হয়নি।

ওয়াজ এখন ইসলামী জ্ঞান সমৃদ্ধ করার জন্য হয় না।
লোক দেখানো ওয়াজ এখন। কাদের ওয়াজে কত মানুষ জমায়েত হল তার প্রতিযোগিতা চলে সমাজে। বেশি লোক জমাতে এন্তেজামিয়া কমিটি লাখ লাখ টাকা দিয়ে হেলিকপ্টার হুজুর ও হুজুর নামধারী ভাঁড়দের ভাড়া করে নিয়ে আসেন।

হুজুররা ওয়াজে কত টাকা নিবেন তার জন্য কোনো নীতিমালা নেই দেশে।
অথচ এসব হুজুর লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন এ সব ভাঁড়ামি করে।

আরেকটা অন্যতম ব্যাপার হলো সারারাত ধরে চলা এসব ওয়াজে উচ্চস্বরে মাইক বাজানো হয়।
ঘরে অনেক অসুস্থ বৃদ্ধ লোক থাকেন, শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা ও পড়াশুনা থাকে,হিন্দু ধর্মাবলম্বী লোকজন আছেন তাদের যে ডিস্টার্ব হয় এই ওয়াজের সাউন্ডে তা নিয়ে একটা নীতিমালা থাকার দরকার।
অনেক হুজুররা এসব পাত্তাই দেননা।

আরেকটা ব্যাপার খেয়াল রাখা উচিত ওয়াজের আয়োজন এন্তেজামিয়া কমিটির।
তাদের আমন্ত্রিত হুজুরদের বিষয় নির্ধারণ করে দেওয়া, নির্দিষ্ট বিষয়ের বাইরে হুজুরদের কথা না বলতে নিষেধ করা।।

সেদিন তাহেরী সাহেবের একটা ওয়াজে দেখলাম গর্ব করে তিনি বলছেন, চট্টগ্রামের এক জায়গায় দুই ঘণ্ট ওয়াজের জন্য দেড় লাখ টাকার অফার পেয়েও প্রত্যাখ্যান করেছেন কারণ তার শিডিউল নেই। দুই কোটি টাকার জমি কিনেছেন মাদ্রাসা করবেন সে জন্য। কথা হল ২ কোটি টাকার ইনকাম টেক্স কি উনি দিয়েছেন?
হুজুররা ওয়াজ মাহফিল থেকে যেই ইনকাম করেন তার উপর টেক্স আরোপ করা জরুরী।

দেশে ইসলামিক ফাউন্ডেশন আছে,ধর্ম মন্ত্রণালয় আছে। তাদের কি দায়িত্ব নেই ওয়াজে যারা এসব ভাঁড়ামি করে যাচ্ছেন তার লাগাম টেনে ধরা।
যে সব হুজুররা উদ্ভট আচরণের মাধ্যমে ওয়াজকে হাস্যকর একটি বিষয়ে পরিণত করছেন, বিষোদগার করে সমাজে ফিতনা ছড়াচ্ছেন তাদের উপর নজরদারি ও তাদের নিয়ন্ত্রন করা দরকার।

দেশে অনেক ভালো মেধাবী ও জ্ঞানী আলেম আছেন, তাদের এ বিষয়ে এগিয়ে আসতে হবে। এ সব ভাঁড়ামি বন্ধে তাদের ভূমিকা রাখা জরুরি।।

ডাঃ জোবায়ের আহমেদ।।

পঠিত : ১৫৪৭ বার

মন্তব্য: ০