Alapon

তুর্কি রাজনীতির অন্তর্দহন ও ভবিষ্যৎ


তুরস্ক!! সভ্যতার সূচনাস্থল হিসেবে চিহ্নিত যে দেশ, পৃথিবীর প্রথম সভ্যতা হিসেবে দাবীকৃত মেসোপটেমিয়া সভ্যতার আবাসস্থল যে দুটি নদীর কারণে গড়ে উঠেছিল সেই দজলা ও ফোরাত নদীর উৎপত্তি স্থল এবং বর্তমান দুনিয়ার মুসলিমদের কল্পনা রাজ্যের নতুন খিলাফত।
নব্য তুরস্কের শিল্প-বিপ্লবের নায়ক প্রফেসর. ড. নাজমুদ্দিন এরবাকানের হাত ধরে যে তুর্কি অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে নতুন এক ভিত্তি পেয়েছিল তা আজ এক প্রকার ভঙ্গুর অবস্থায় নিপতিত। কারণ একটাই, দুর্বল শাসনব্যবস্থা ও স্বৈরাচারী মনোভাব সম্পন্ন চলমান রাজনীতি। উৎপাদনমুখী রপ্তানি নির্ভর অর্থনীতি থেকে আমদানী নির্ভর অর্থনীতিতে রূপান্তরিত হওয়ায় অনিচ্ছা সত্ত্বেও ডলারের কাছে পরাজিত হতে বাধ্য হচ্ছে তুরস্কের অর্থনীতি। ২০০২ সালের পর থেকে কৃষিব্যবস্থা অবনতি, আমদানী নির্ভর অর্থনীতির কারণে বহির্বিশ্বের উপর নির্ভরশীলতা, স্বৈরাচারী মনোভাবের দরুণ সুশাসন ও ন্যায়বিচারে দুস্প্রাপ্যতায় বিনিয়োগের পথ এক প্রকার রুদ্ধ। ফলাফল অর্থনীতির বর্তমান এই নাজুক অবস্থা।
বহির্বিশ্বের কাছে বর্তমান তুরস্ককে যে রূপে দেখা যায় তার কতটুকুই বা বাস্তব। বিগত কয়েক বছরেই তুরস্কের বেকারত্ব যেহারে বৃদ্ধি পেয়েছে তা কল্পনাতীত। তুরস্কের ইতিহাসে যা রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। তুরস্কের সংবাদসংস্থার মতে, দেশটির বর্তমান বেকারত্বের পরিমাণ ১৪% শতাংশ, যেখানে ১৯৯৮ সালে দেশটির বেকারত্ব ছিল মাত্র ৫.৯% শতাংশ। যুব বেকারত্বে হারও বৃদ্ধি পেয়ে ২৭.৪% শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে।
তাছাড়াও বৈদেশীক ঋণে জর্জরিত তুরস্কের অর্থনীতি। যেখানে ১৯৯৮ সালে তুরস্কের বৈদেশীক ঋণ ছিল সর্বসাকুল্যে ৯৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আজ ২০১৯ এ এসে সেই ঋণ দাঁড়িয়েছে শুধুমাত্র সরকারী হিসাব অনুযায়ী ৪৫৭ বিলিয়ন ডলার!!! যার দরুণ প্রত্যেক বছর সেই ঋণের সুদ পরিশোধ করতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে বর্তমান সরকারকে। বছরকে বছর সেই সুদের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সমাধান যেন সরকারের হাতের নাগালের বাইরে।
অর্থনীতির এই ক্রান্তিকালে বর্তমান সরকারী দল AKP তে দেখা দিয়েছে বৃহৎ এক ভাঙ্গন। বর্তমান তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রেজেপ তাইয়্যিপ এরদোয়ানের দীর্ঘদিনের সহকর্মী আহমেদ দাউদওলু, আব্দুল্লাহ গুল এবং আলী বাবাজানের মধ্যকার দ্বন্দ্ব এখন পরিণতি নিয়েছে ভাঙ্গনে। দীর্ঘ ১৭ বছর ক্ষমতার আসনে সমাসীন একটি দলের এরকম বৃহৎ এক ভাঙ্গন তুরস্কের রাজনীতির ইতিহাসে এই প্রথম।
দেশের অর্থনীতির এই নাজুক পরিস্থিতিতে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল AK পার্টির ভবিষ্যত পরিণতি যে করুণ হতে যাচ্ছে তা দেশের জনগণ খুব ভালোভাবেই অনুধাবন করতে পারছেন। একই সাথে এক ব্যক্তির শাসন দেশটির রাজনীতির ময়দানে এক ধরণের ভীতির সৃষ্টি করেছে। বর্তমানের সরকারের আচরণ এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, “একজন নাগরিককে দুটি পক্ষ থেকে একটিকে বেছে নিতে হবে। সরকারী দল বেছে নিলে নাগরিকটি দেশপ্রেমিক কিন্তু যদি সরকার বিরোধী হয় তাহলে দেশদ্রোহী”।
ফলশ্রুতিতে সরকারী দলের অভ্যন্তরেই দেখা দিয়েছে ভাঙ্গন। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের দীর্ঘদিনের সহকর্মী ও ২০১৪ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বপালনকারী আহমেদ দাউদওলু সরকারী দল AK পার্টি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নতুন এক দল গঠন করেছেন গত সপ্তাহে এবং পার্টির নাম দিয়েছেন “Gelecek Partisi” (Future Party)। যা বর্তমান তুরস্কের রাজনীতিতে নতুন এক মাত্রা যোগ করেছে। তার দলের প্রতীক হচ্ছে "গাছের পাতা" যা কিনা উসমানী খিলাফতের কয়েকটি প্রতীকের মধ্যে একটি হিসেবে গণ্য করা হয় বলে দাবী তার সমর্থকদের। নতুন এই দলের প্রতিষ্ঠাতা ১৫৪ জন সদস্যের মধ্যে ৩০ জন মহিলা রয়েছেন যা সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে৷ এতো সংখ্যক মহিলা প্রতিষ্ঠাতা সদস্য অন্য কোন দলে নেই যা হয়তো মহিলা ভোটারদের আকৃষ্ট করবে আগামী নির্বাচনে।
অন্যদিকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্ট আব্দুল্লাহ গুল ও আলী বাবাজানের নেতৃত্বাধীন দলের ঘোষণা সম্প্রতি দেওয়ার কথা থাকলেও জানুয়ারীর প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত ঘোষণাকে স্থগিত করা হয়েছে বলে জানা গিয়েছে।

নতুন Gelecek Partisi (Future Party) এর প্রতিষ্ঠাতা তুরস্কের সাবেক প্রধানমন্ত্রী আহমদ দাউদওলু তার নতুন দল গঠন সম্পর্কে বলেন- "যত দিন যাচ্ছে আমাদের মূল্যবোধসমূহ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, বিগত কয়েক বছরে অর্থনীতি, সুশাসন, ন্যায়বিচার সহ প্রতিটি ক্ষেত্র আজ ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন, অর্থনৈতিক মন্দার কারণে দেশের অর্থনীতি আজ খুবই নাজুক অবস্থায়। দেশ যেন আজ একজনের হাতে বন্দী হয়ে পড়েছে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্যই আমরা নতুন দলের ঘোষণা দিয়েছি"।
নতুন এই দল গঠনকে কেন্দ্র করে বর্তমান প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান ও তার সাবেক প্রধানমন্ত্রী আহমেদ দাউদওলুর মধ্যকার দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করেছে। সমস্যার শুরু ২০১৬ সাল থেকে। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের স্বৈরাচারী স্বভাবের খাতিরে জোরপূর্বক পদত্যাগে বাধ্য হয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী আহমেদ দাউদওলু। একই সাথে তিনি ২০১৪ সালে সরকারী দল AK পার্টির অভ্যন্তরীন নির্বাচনে বর্তমান প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানকে পরাজিত করে সরকারী দলটির সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন যা প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের ভবিষ্যত ক্ষমতার জন্য হুমকি হয়ে পড়ে। এরপর থেকেই প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান মাইনাস টু নীতিতে এগিয়ে চলেন এবং আহমেদ দাউভতুগলু ও আব্দুল্লাহ গুলকে AK পার্টিতে প্রায় নিস্ক্রিয় করে তুলেন। আবার তাদেরকে নিজের হাতের বাইরেও যেতে দিচ্ছিলেন না। স্বাধীনভাবে চলাচলেও ছিল একধরণের নিষেধাজ্ঞা। আহমেদ দাউদওলু একজন প্রফেসর। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তার লেকচার ও সেমিনারের জন্য উদ্গ্রীব হয়ে অপেক্ষা করে ছাত্রছাত্রীরা। সেক্ষেত্রেও নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হন তিনি। পরবর্তীতে নতুন এই দল গঠনের জের ধরে সাবেক প্রধানমন্ত্রী আহমেদ দাউদওলু কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ইস্তাম্বুল শেহির ইউনিভার্সিটিকে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান কর্তৃক বন্ধ করে দেয়ার পায়তারা করা হচ্ছে বলে দাবী করেন Gelecek Partisi (Future Party) এর প্রতিষ্ঠাতা। জবাবে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান তারই সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে ‘রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাৎকারী, প্রতারক, এতীমের সম্পদ আত্মসাৎকারী’ হিসেবে আখ্যা দেন। প্রতিউত্তরে আহমেদ দাউদওলু বর্তমান প্রেসিডেন্ট সহ সাবেক সকল প্রধানমন্ত্রীর সম্পদের হিসাব জাতির সম্মুখে প্রকাশ করার চ্যালেঞ্জ ঘোষণা করেন। একসময়ের পরম বন্ধুর সাথের এরকমই তিক্ত সম্পর্কে উপনীত হয়েছেন বর্তমান তুরস্কের প্রেসিডেন্ট।
বর্তমানে প্রধান বিরোধীদল বামপন্থী CHP এর পরিবর্তে এরদোয়ানের সামনে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীয় হয়ে দাঁড়িয়েছেন তারই একসময়ের ঘনিষ্ঠ সহকর্মীরা। আহমদ দাউদওলু, আব্দুল্লাহ গুল, আলী বাবাজান ও আব্দুল লতিফ সেনের এর মতো হস্তীদের দল থেকে বের হয়ে যাওয়ায় আগামী নির্বাচনে সরকারী দলের ভোট তলানিতে পৌছার আশংকা করছেন বিশেষজ্ঞরা। এখন দেখার বিষয় হচ্ছে রাজনীতির মাঠের পাকা খেলোয়াড় প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান তার দলের বৃহৎ এই ভাঙনের ধাক্কা কীভাবে সামাল দেন এবং বিশেষজ্ঞদের ধারণা কতটুকু ভুল প্রমাণ করতে পারেন।
আহমদ দাউদওলু ও আব্দুল্লাহ গুল-আলী বাবাজানকে সরকারী দল থেকে বেরিয়ে নতুন দল ঘোষণার কারণ জিজ্ঞেস করলে সকলের উত্তর ভিন্ন আঙ্গিকে হলেও ভাবার্থ ছিল একই। তারা যেসকল বিষয়ের কারণে নতুন দল গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন তা হল-
১। মূলত প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের স্বেচ্ছাচারিতার কারণেই তারা দল ছেড়েছেন।
২। অর্থনৈতিক মন্দা ও দেশটির অর্থনীতিকে একটি গোষ্ঠীর হাতে তুলে দেওয়ার পায়তারা চলছে। এমতাবস্থায় সাবেক রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে চুপ করে দেখা তাদের পক্ষে বেমানান, তাই তারা এই উদ্যোগ নিয়েছেন।
৩। দেশটিতে বর্তমানে আইনের শাসন দুর্লভ এক বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে, এমতাবস্থায় দেশকে চলতে দেওয়া যায় না। ইত্যাদি ……

সরকারী দল AK পার্টির প্রথম সারির নেতাদের দল থেকে বের হয়ে যাওয়া এবং নতুন নতুন দল গঠনের ঘোষণা তুরস্কের রাজনীতির অন্তর্দহনেরই বহিঃপ্রকাশ এবং এর ফলে ভবিষ্যৎ তুরস্কের রাজনীতির গতিপথ কেমন পরিবর্তন হয় তা এখন গবেষণার বিষয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, মূলত এবছরের ৩১ শে মার্চের নির্বাচনে এরদোয়ানের দল AK পার্টির ইস্তাম্বুল, আনকারার মতো বড় কয়েকটি শহরে ব্যাপক ব্যাবধানে পরাজয় বরণ করার ফলেই তারা এত দ্রুততার সাথে দল গঠনের সিধান্ত নিয়েছেন। সেই সাথে দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অস্থিতিশীল অবস্থায় প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান তার মেয়াদ পূর্ণ করতে পারবেন কিনা তা নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি হয়ে হয়েছে। যার দরূন ২০২০ এর শেষের দিকে অথবা ২০২১ এর শুরুতে আগাম নির্বাচনের ঘোষণা আসতে পারে প্রেসিডেন্টের পক্ষ থেকে। বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন যে- নতুন এই দল গঠনের প্রক্রিয়া তুরস্কের ভবিষ্যৎ গণতন্ত্রের পথকে মসৃণ করে তুলবে এবং ৯০ এর দশকে তুরস্কের রাজনীতিতে যে বহুদলীয় গণতন্ত্রের চর্চা হতো সেদিকে ফিরে যাচ্ছে বলে মনে করছেন তারা। বর্তমানের মতো মাত্র ৩ টি দলের পরিবর্তে ৯০ এর দশকের মতো ভবিষ্যতে জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলের সংখ্যা ৮ থেকে ১০ পর্যন্ত হতে পারে যা গণতান্ত্রিক একটি সাম্যাবস্থার সৃষ্টি করবে বলে অভিমত সকলের।

পঠিত : ৬৬৮ বার

মন্তব্য: ০