Alapon

উত্তম শিষ্টাচার ও পরিবেশ সেরা সন্তান তৈরির মূল উপাদান...


বন্ধুর বাবা প্রশ্ন করেছিলেন ছেলের নাম কি রেখেছি,
বললাম ‘আবদুল্লাহ’।

চেহারায় আভিজাত্যের ভাব এনে বললেন এটা তো বহু পুরানা নাম।
বললাম, জ্বি এটা পুরানো নাম এবং বর্তমানে গরীব মানুষেরাই এই নাম বেশী রাখে। তবে নামটি জগতের বিখ্যাত কয়েকটি নামের একটি। তা আপনার নাতির নাম কি রেখেছেন?

সগৌরবে বললেন, ‘সালমান’! দেশের সেরা চিত্র নায়ক সালমান শাহের মত হবে আমার নাতি তাছাড়া নাতনীর নামও রেখেছি দেশ সেরা নায়িকার নামের সাথে মিলিয়ে! দেড় যুগ আগের তার চেহারার চিকচিক হাসি আমার আজো নজরে ভাসে।

ভদ্রলোকের নাতি-নাতনির জন্মের বহু বছর আগে থেকেই তাদেরকে চিনি। পরিবারের সবাই শিক্ষিত এবং শিক্ষার প্রতি তাদের সতর্কতা পদে পদে পরিলক্ষিত হত। তাদের দেখেছি ঘরোয়া পরিবেশে সবাইকে মিলে ছায়াছবি দেখতে। তারা নিজেদেরকে শিক্ষিত ও অভিজাত ভাবতে খুবই পারঙ্গম। কারো সন্তানের নাম শুনে তাদের পারিবারিক রুচি, অভিরুচি এবং অভিভাবকদের আভিজাত্যের প্রশংসা করতেন।

নাতি-নাতনিরা এখন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি ধরার সময়। সুবিধা মত পেয়ে প্রশ্ন করেছিলাম কেমন আছে আপনার নাতি-নাতনিরা?
হতাশ হয়ে বললেন, নাতনির জন্য তো কোন ভাল গৃহস্থ পাচ্ছিনা আর নাতিটা বাউন্ডেলে প্রকৃতির হয়ে পড়েছে। লেখাপড়ায় মন নাই, রেজাল্ট বরাবরই খারাপ করে।

কেন নাতি নামাজ-কালাম পড়েনা? প্রশ্ন করলাম!

নামাজ কালাম কোত্থেকে পড়বে! হুজুর-মুরুব্বীদেরই সালাম দেয় না। অধিকন্তু তার চলাচল দেখেই বরপক্ষ আমার নাতিন দেখার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। সারাদিন গান আর গল্প শোনায় ব্যস্ত সময় পার করে?

লাফায়-টাপায় না? মানে নাচানাচির অভ্যাস নাই? বর্তমানের ছেলেরা তো এসব খুবই পছন্দ করে? প্রশ্ন করলাম!

লাফায় মানে! আমি প্রেশারের রোগী, সামান্য শব্দেই প্রেশার বেড়ে যায়। সে কানে ফোন লাগিয়ে গান শুনে আর হেলে-দুলে চলে। দেখলেই মাথার মেজাজ চরমে উঠে!

আপনি নাতির কেমন খাসিয়ত আশা করেন, আবারো প্রশ্ন করলাম?

বললেন, তোমার ছেলেটা কেমন আমি বিস্তারিত জানিনা, তবে মসজিদে যেতে দেখলে মনটা জুড়িয়ে যায়। তাকে একটু বলো সে যাতে করে আমার নাতিকে বন্ধু বানিয়ে নেয়।

পুরানা স্মৃতির কথা আমার মনে ছিল, তাই বললাম, দেখুন কাউকে বলে-কয়ে বন্ধুত্ব জুড়িয়ে দেয়া যায়না। বন্ধুত্ব মন ও চিন্তার মিলের কারণেই সৃষ্টি হয়। তাছাড়া আপনি দেড় যুগ আগে বলেছিলেন যে, নাতি সালমান শাহের মত হবে। আপনার নাতি তো সালমান শাহ হতে না পারলেও তার মতই হচ্ছে! আপনি নিয়ত তথা পরিকল্পনা যেভাবে করেছিলেন সেভাবেই ফল পাচ্ছেন। নাতির নাম যাই হোক, নিয়ত ছিল নাতি চিত্রনায়কের মত হবে আর পরিণত বয়সে তার কাছে পয়গম্বরের খাসিয়ত আশা করছেন। এটা তো বৃথা আশা, মানুষের সকল কাজ তার নিয়ত অনুসারেই আবর্তিত হয়।

বেচারা স্তম্ভিত ও লজ্জিত হলেন! শুধু এতটুকু বললেন, সে সময় তো বুঝি নি, কেউ বুঝিয়েও বলে নাই। তা নাহলে এমন ভুল কি করতাম!

মনে মনে বললাম, আপনাকে কে বুঝাবে উল্টো আমাকেই আহাম্মক ঠাওরিয়েছেন। দাঁত খিলাল করার মত করে দেঁতো হাসি দিয়েছেন!

ভুলের অপরাধের ক্ষমা চাইলে ক্ষমা পাওয়া যায় কখনও ঋণের টাকাও মাফ হয়ে যায় কিন্তু কিছু ভুলের মাশুল হয়না, তা তিলে তিলে নিজেকেই পোহাতেই হয়। সন্তান পরি-গঠনের ভুল সে ধরনেরই একটি ব্যাপার। সন্তানের তারুণ্যকে একভাবে তৈরি করে পরিণত বয়সে যদি বলে এই পথ ছাড়, তাহলে সেটা কোনদিনই সম্ভব হবেনা। সন্তানের জীবনের শুরুতেই ভেবে নিতে হবে, পরিকল্পনা করতে হবে, সন্তানকে কোন পরিবেশ, কোন শিক্ষায় মানুষ করা লাগবে। সন্তানের জীবনের শুরুর পরিবেশ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই বয়সে যদিও সে স্কুলে যায়না কিন্তু পরিবেশ, পিতা-মাতা, ভাই-বোন, দাদা-দাদী, চাচা-চাচী থেকে গুরুত্বপূর্ণ দীক্ষা পায়। আবার এই পরিবেশ একমুখো হলেও হবেনা। মোটামুটি উত্তম ও সং-মিশ্রিত পরিবেশ সন্তানের শেখার জন্য উত্তম হয়। যেখানে ভাল-খারাপ দুটোরই উপাদান থাকে। যাতে করে সন্তানকে হাতে আঙ্গুল দিয়ে দেখানো যায় এটা খারাপ, ওটা ভাল; এরা খারাপ, ওরা ভাল। এমন পরিবেশ না পেলে সন্তান ভাল-মন্দ, সৎবন্ধু-ক্ষতিকর বন্ধু পৃথক করতে পারবে না। উল্টো গোঁয়ার, দাম্ভিক হয়ে উঠতে পারে। সে কেবল গরীব মানুষ গুলোকেই খারাপ মানুষ হিসেবে ভাবতে অভ্যস্ত হবে।

সন্তানের মানসিক বিকাশের জন্য পরিবেশের গুরুত্ব কত অপরিসীম সেটা আমরা নিচের ঘটনা থেকেই বুঝতে পারব।

পৃথিবীর সকল নবীদের কোন গৃহশিক্ষক ছিল না। তারা কোন প্রতিষ্ঠানে পড়ে শিক্ষিতও হন নাই। এমন কি তাদের পিতা-মাতাদের কেউ কোন নবীর শিক্ষক হবার সুযোগ পান নাই।

এ ধরনের পরিস্থিতিতে নবীরা বেড়ে উঠার পরও, জগতের শ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মদ (সাঃ) এর বেড়ে উঠার জন্য মহান আল্লাহ এমন এক স্থানকে বাছাই করেছিলেন; যেখানে বিশুদ্ধ, সাহিত্য সমৃদ্ধ আরবিতে মানুষেরা কথা বলত। হুনায়নের এই অঞ্চলের মানুষের আচরণ, রুচি-বোধ তদানীন্তন মক্কা নগরীর চেয়েও উত্তম ছিল। আল্লাহ শিশু মোহাম্মদ (সাঃ) এর শিশুকাল কাটানোর জন্য সে অঞ্চলটা বাছাই করেছিলেন। দুধ মা হালিমার হাতে তুলে দিয়ে মানবজাতিকে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, সন্তান মানুষ করার জন্য এটাই উত্তম, সঠিক সিদ্ধান্ত। টিভি, নাটক আর সুন্দর বই কিনে দিয়ে সেটা কখনও করা যায়না। ঘরে দলে দলে গৃহশিক্ষক রাখার চেয়ে, বাবা-মা যদি নিজেদের শিষ্টাচার পরিবর্তন করে, তার প্রভাব সন্তানের উপর অনেক বেশী পড়ে; যদিও পিতা-মাতা অশিক্ষিত হয়। সন্তানের বিকাশের জন্য শিষ্টাচারের প্রভাব মহাকাশের পরিধির চেয়েও বড় ও ব্যাপক।

লিখেছেন: নজরুল ইসলাম টিপু

পঠিত : ৭০৯ বার

মন্তব্য: ০