Alapon

তাকদির কী...?


তাকদির অত্যন্ত জটিল একটি বিষয়, এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু এর জটিলতা বা অন্য কোনো কারণে এ বিষয়ে আলোচনা থেকে একদম দূরে থাকতে হবে, এটি একটি ভুল ধারণা। তাকদির ইমানের ছয়টি বিষয়ের অন্যতম একটি বিষয়, যেই ছয়টি বিষয়ের কোন একটির উপর ইমান না এনে বাকি পাঁচটির উপর ইমান আনলেও কেউ আল্লাহর কাছে মুমিন হিসেবে গৃহীত হবেনা। কেউ যদি না জানে তাকদির বিষয়টি কী এবং তার উপর মানুষের ইমান কেমন হবে, তাহলে তার উপর কিভাবে ইমান আনবে? অন্তত এতটুকুর জন্য হলেও যারা জানে তাদের তাকদির বিষয়ে আলোচনা করা আবশ্যক।

তাকদির সম্পর্কিত অসংখ্য আয়াত ও হাদিস রয়েছে। রাসূলের সাহাবীদের কাছ থেকেও তাকদির সম্পর্কিত অনেক বক্তব্য পাওয়া যায়। আমাদের আলেমরাও ইসলামের প্রথম যুগ থেকে এ পর্যন্ত তাকদির বিষয়ে অনেক লেখালেখি করেছেন। কিন্তু যারা তাকদিরের আলোচনা একদম নিষিদ্ধ মনে করেন, তাদেরও কিছু দলিল ও যুক্তি রয়েছে। তাকদিরের আলোচনা নিষিদ্ধের পক্ষে কুরআনের কোন বক্তব্য পাওয়া না গেলেও রাসূলের কিছু হাদিস পাওয়া যায়। তেমনই একটি প্রসিদ্ধ হাদিস- " রাসূল (স.) বলেন, আমার সাহাবীদের কথা উঠলে তোমরা আলোচনায় প্রবৃত্ত হবেনা। তারকারাজির বিধিবিধান প্রভাব ইত্যাদির ব্যাপারে কথা উঠলে তোমরা আলোচনায় প্রবৃত্ত হবেনা। অনুরূপভাবে তাকদির সম্পর্কে কথা উঠলে তোমরা আলোচনায় প্রবৃত্ত হবেনা।" (ত্ববারানী, আল মুজামুল কাবীর)
হাদিসটিতে তাকদিরের পাশাপাশি সাহাবীদের কথা উঠলেও তাতে প্রবৃত্ত হতে নিষেধ করা হয়েছে। তার মানে কি এই যে, তাদের মর্যাদা মাহাত্মের কথা বর্ণনা করা যাবেনা? নিশ্চয়ই তা নয়। বরং এখানে তাদের মাঝে সৃষ্ট মতানৈক্য, দন্দ্ব-কলহ নিয়ে অপ্রয়োজনীয় আলোচনা করতে নিষেধ করা হয়েছে। এখানে তাকদির বিষয়ক আলোচনায় প্রবৃত্ত না হওয়ার নির্দেশও এমনই। এটা বলার উদ্দেশ্য হলো, তাকদির নিয়ে বিনা দলিলে বা বিনা জ্ঞানে অহেতুক ও বিভ্রান্তিকর আলোচনা করা যাবেনা। এ বিষয়ে চিন্তা-গবেষণার ক্ষেত্রেও একই রকম বিধান। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন, "এমন কোন জিনিসের পিছনে লেগে যেওনা, যার সম্পর্কে তোমার কোন জ্ঞান নেই।" (সূরা বানী ঈসরইল- ৩৬)
তথাপি তাকদিরের আলোচনায় বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। কারণ যদি কেউ চুপ থাকে, তাহলে সে পার পেয়ে যাবে। কিন্তু যদি অহেতুক বা অনুমান নির্ভর আলোচনায় লিপ্ত হয়, সে ভুল বা সঠিক যাই বলুক, তার জন্য তাকে আল্লাহর কাছে জবাব দিতে হবে।

এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য কুরআন-হাদিসের ভিত্তিতে তাকদিরের এমন একটি আলোচনা উপস্থাপন করা, যার মাধ্যমে মুমিন ব্যক্তি তার মনের সংশয় দূর করে প্রশান্তি লাভ করতে পারেন এবং এ বিষয়ে সকল ভ্রান্ত মতবাদ ও কুসংস্কারের প্রভাব থেকে নিজেকে মুক্ত রেখে এ বিষয়ে বিশুদ্ধ আকিদার অধিকারী হতে পারেন।

তাকদির বলতে আমরা বুঝি 'নির্ধারিত ভাগ্য'। আর এর প্রতি ইমান হলো, আল্লাহর অনাদি, অনন্ত ও সর্বব্যাপী জ্ঞান, তার ইচ্ছা এবং তার নির্ধারণে বিশ্বাস করা। এটি এমন একটি বিষয়, যার আলোচনা পৃথিবীর কোন ধর্ম ও মতবাদ এড়িয়ে যেতে পারেনি। ভাগ্য কি আগে থেকে নির্ধারিত নাকি তা মানুষের ইচ্ছা ও কর্মের উপর নির্ভরশীল, মানুষ কি তার স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি ব্যবহার করে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে বাস্তবায়ন করতে পারে কি পারেনা-এই গোলক ধাঁধা থেকে কেউ রক্ষা পায়নি। তাকদিরে বিশ্বাস মানুষের প্রতিটি চিন্তা ও পদক্ষেপকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করে। যার কারণে বিষয়টি পরিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত চিন্তাশীল ব্যক্তির পক্ষে মনের অস্থিরতা দূর করা সম্ভব হয়না।
দৃশ্যমান বিষয়ে ইমান হয় না। তাকদির যেহেতু ইমানের ছয়টি বিষয়ের একটি, এটাও অদৃশ্য জগতের বিষয়। আর অদৃশ্য বিষয়াবলি জানার একমাত্র মাধ্যম হলো 'ওহী'। তাকদিরের বিষয়ে তাদের বিভ্রান্তিতে পতিত হওয়ার কারণ হলো, সংশয় সমাধানে ওহীর সাহায্য না নেয়া। আর তারাও বিভ্রান্তিতে পতিত হয়, যারা ওহীকে অন্যান্য মতবাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখেছে বা এ বিষয়ে অন্যান্য মতবাদের ওপর উত্থাপিত প্রশ্নের আলোকে চিন্তা করেছে। তাকদির নিয়ে মুসলিমদের মধ্যেও বিতর্ক শুরু হয় গ্রিক, পারসিক ও ভারতীয় সহ আরো কিছু দর্শনের সংস্পর্শে তাদের আসার পর। ইসলামের প্রথম যুগে তাকদির বিষয়ে মানুষের মনকে প্রশান্ত করার জন্য কুরআন ও হাদিসই যথেষ্ঠ ছিল। তার মানে এটা নয় যে, বর্তমানে কুরআন-হাদিস তাকদির বিষয়ক সংশয় দূর করে মানুষের মনকে প্রশান্ত করতে যথেষ্ট নয়–অবশ্যই যথেষ্ট। কিন্তু তার জন্য ইসলামের তাকদির বিষয়ক বক্তব্যকে মনুষ্য সৃষ্ট সকল দর্শনের প্রভাব থেকে মস্তিষ্ককে মুক্ত করে তাদের দৃষ্টিকোণে দেখা থেকে বিরত থাকতে হবে।

কুরআন-হাদিস তাকদিরের যে পরিচয় দেয়, তা বুঝতে হলে এবং তা থেকে উপকৃত হতে হলে আপনাকে এগুলো পড়তে হবে একজন মুমিনের অন্তর দিয়ে, যার অন্তরে ওহীর ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই, যে ওহীকে "শুনলাম এবং আনুগত্য করলাম" দৃষ্টিভঙ্গিতে অধ্যয়ন করে, যে এর থেকে সাধ্যের মধ্যে সর্বোচ্চ কল্যান হাসিল করতে এবং সবকিছুর উপর এর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে গবেষণায় লিপ্ত হয়। সমালোচকদের বক্তব্যের ভিত্তিতে এগুলো যাচাই করতে নয়। আমি আবারো বলছি, যা আমি 'কুরআন' প্রবন্ধে বলেছিলাম, "কুরআন থেকে শুধু ঐ ব্যক্তিই উপকৃত হতে পারবে, যে এর থেকে উপকৃত হতে চায়।"

তাকদিরকে বুঝতে হলে, প্রথমে আমাদেরকে তাকদিরের এ দুটি ভাগের সাথে পরিচিত হতে হবে।
১. ঐসব তাকদির যা বাস্তবায়নে মানুষের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির অবদান আছে।
২. ঐসব তাকদির যাতে মানুষের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির কোন অবদান নেই।
এ দুটি প্রকার আরো ভালোভাবে বুঝতে হলে, আমাদেরকে তাকদির নির্ধারনের স্তরগুলো সম্পর্কে কিছু ধারণা রাখতে হবে। তাকদির বা নির্ধারিত ভাগ্য শুধু মানুষের জন্য—ব্যাপারটি আসলে তা নয়। আল্লাহর এ পুরো সৃষ্টিজগতের জন্যই তাকদির বা নির্ধারিত ভাগ্য রয়েছে। যেমন–মহাবিশ্ব আল্লাহর তৈরি একটি বিধানের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে। আল্লাহ কর্তৃক তার জন্য রয়েছে নির্ধারিত তাকদির। পৃথিবীও আল্লাহর নির্ধারিত একটি বিধানের অধীন পরিচালিত হচ্ছে এবং আল্লাহ কর্তৃক তার জন্যও রয়েছে নির্ধারিত তাকদির। পৃথিবীর জাতি ও সভ্যতা গুলোর অবস্থাও তদ্রুপ। আল্লাহ কতৃক তাদের প্রত্যেকের জন্য রয়েছে নির্ধারিত ভাগ্য। এভাবে আসতে আসতে একদম ব্যক্তি পর্যায় পর্যন্ত আসবে।

মহাবিশ্বের তুলনায় মানুষের অস্তিত্ব অতি নগন্য। যদিও মানুষই আল্লাহর কাছে এই মহাবিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি মহাবিশ্বের সবকিছু সৃষ্টি করাই হয়েছে মানুষের জন্য। যেমন- সূরা বাকারার ২৯ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন- "তিনি সেই সত্ত্বা যিনি তোমাদের জন্য যমিনে যা আছে সবকিছু সৃষ্টি করেছেন।" শুধু সৃষ্টি করেই তিনি ছেড়ে দেন নি। তাদের ইমান ও চরিত্র ঠিক করার জন্য কিতাব ও নবী-রাসূলদের প্রেরণ করেছেন। প্রতিটি জাতির জন্য দিয়েছেন শারিয়াত। যাতে সৎ কাজের নির্দেশ ও অসৎ কাজের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। সৎ কাজের জন্য তিনি তার কিতাবসমূহে উৎসাহ প্রদান করেছেন এবং অসৎ কাজের জন্য করেছেন নিন্দা। আমরাও আমাদের দৃষ্টিতে সৎকর্মশীলদের প্রশংসা ও অসৎকর্মশীলদের নিন্দা করি। রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠানগুলোও তার অধীনস্তদের ভালো কাজের জন্য পুরস্কার ও মন্দ কাজের জন্য শাস্তি দেয়। আদালতগুলোকে প্রতিষ্ঠা করা হয়, যেন দোষী ব্যক্তি উপযুক্ত শাস্তি পায় ও নিরপরাধ ব্যক্তি মুক্তি পায়। এই এত কিছুর পিছনে আমাদের অন্তরের একটি প্রতিষ্ঠিত বিশ্বাস রয়েছে। আর তা হলো, মানুষ স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির অধিকারী। মানুষ তার নিজ ইচ্ছাতেই ভালো ও খারাপ কাজে লিপ্ত হয়। মানুষের কাজে যদি তার স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির কোন অবদান না থাকে তাহলে ভালো কাজের জন্য তার প্রশংসা ও মন্দ কাজের জন্য তার নিন্দা করাটা অযৌক্তিক। আর মানুষের কাজে তার ইচ্ছাশক্তির কোন অবদান না থাকলে আল্লাহর দেয়া এই শারিয়াত, তার কিতাবে ভালো কাজের নির্দেশ ও খারাপ কাজের নিন্দা, সৎ কাজের পুরস্কার ও অসৎ কাজের শাস্তি এগুলো কি অযৌক্তিক হয়ে যায় না? একটা অক্ষম সৃষ্টিকে তো তার কাজের প্রতিদান দেয়ার কোন মানেই হয়না, যে তার নিজ ইচ্ছাতে কিছু করতে সক্ষম নয়। অতএব বুঝা গেল মানুষ স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির অধিকারী, যেই রায়ের পক্ষে সবচেয়ে বড় দলিল হলো আল-কুরআন। যেমন-
"আমি মানুষকে পথ দেখিয়ে দিয়েছি। এখন সে ইচ্ছা হয় কৃতজ্ঞ হোক, ইচ্ছা হয় অকৃতজ্ঞ হোক।" ( সূরা আদ্-দাহর-৩)
"যারা আমার জন্য চেষ্টা-সাধনা করে আমি তাদেরকে আমার পথ দেখাই।" (সূরা আনকাবুত-৬৯)
"যার ইচ্ছা হয় ইমান আনুক, যার ইচ্ছা হয় কুফরী করুক।" (সূরা কাহ্ফ-২৯)
আমাদের বিবেকের স্বাভাবিক চিন্তাও এর পক্ষেই রায় দেয়।

সকল কিছুর সৃষ্টিকর্তা, রক্ষাকর্তা, পালনকর্তা মহান আল্লাহর জ্ঞানের বিস্তৃতি সম্পর্কে আমরা কুরআন থেকে যে ধারণা পাই তা হলো, তিনি এমন মহাজ্ঞানী; যিনি সবকিছু জানেন। অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যতের কোন কিছুই তার কাছে গোপন নেই। তিনি সকল অস্তিত্ববান বস্তুর অবস্থা সম্পর্কে তার অস্তিত্ব লাভের আগ থেকেই জানেন। এমনকি তার অস্তিত্ব লাভের পূর্ব থেকেই তিনি তার শেষ পরিণতি সম্পর্কে জানেন। এই মহাবিশ্বে যা ঘটে সবকিছু শুধুমাত্র তার ইচ্ছাতেই ঘটে। তার অনিচ্ছাতে গাছের একটি পাতাও ঝরে পড়েনা। তিনি তার সকল জ্ঞান লিখে রাখেন। তার জ্ঞানে কখনো কোন পরিবর্তন আসেনা। গণক, দার্শনিক, বিজ্ঞানীদের মত এগুলো তার অনুমান নির্ভর জ্ঞান নয়। এগুলো সেই প্রভুর নিশ্চিত জ্ঞান–যা অবশ্যই ঘটবে এবং সেগুলো ঘটবে তার ইচ্ছাতেই। তার ইচ্ছার বিরূদ্ধে তার সৃষ্টি জগতে কোন কিছু ঘটবে, এটা তার মর্যাদার পরিপন্থী। প্রতিটি ব্যক্তির জীবনের কোন সময়ে তার রিজিকের পরিমাণ কতটুকু থাকবে তার সূক্ষ্ম হিসেব আল্লাহ তায়ালা আগ থেকেই জানেন। এটাও জানেন, কতটুকু রিজিক কোন পন্থায় কোন সময়ে কার হস্তগত হবে। মহান আল্লাহ জানেন, তার কোন বান্দা পৃথিবীতে তার নির্দিষ্ট সময়ের জীবনে কতটুকু নেকি ও গুনাহ অর্জন করবে। তার শেষ পরিণতি জান্নাত হবে নাকি জাহান্নাম হবে, তাও তিনি জানেন। মহান আল্লাহ যা জানেন, তা তিনি একটি কিতাবে লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন। সেগুলো অবশ্যই ঘটবে। আর সেগুলো তার ইচ্ছাতেই ঘটবে। আল্লাহর সেই কিতাবে যা লিপিবদ্ধ আছে, তাকেই তাকদির বলে। এমন কিছু নেই, যা সেই কিতাবে লিপিবদ্ধ নেই। নৈকট্যপ্রাপ্ত বিশেষ ফিরিশতারাও তার সম্পর্কে জ্ঞান রাখেনা। তারা ততটুকুই জানে, যতটুকু আল্লাহ তাদের জানাতে চান। যেমন-
"তুমি কি লক্ষ্য করনি যে, আসমানসমূহ ও জমিনে যা কিছু আছে আল্লাহ তা জানেন? তিনজনের কোনো গোপন পরামর্শ হয় না, যাতে তাদের চতুর্থজন হিসেবে আল্লাহ থাকেন না; আর পাঁচজনেরও হয় না, যাতে তাদের ষষ্ঠজন হিসেবে তিনি থাকেন না। এরচেয়ে কম হোক কিংবা বেশি হোক, তিনি তো তাদের সঙ্গেই আছেন, তারা যেখানেই থাকুক না কেন। (সূরা আল মুজাদালাহ-৭)
"তিনি জানেন, জমিনে যা কিছু প্রবেশ করে এবং তা থেকে যা কিছু বের হয়। আর আসমান থেকে যা কিছু অবতীর্ণ হয় এবং তাতে যা কিছু উত্থিত হয়। আর তোমরা যেখানেই থাকো না কেন, তিনি তোমাদের সাথেই আছেন। আর তোমরা যা করো, আল্লাহ তার সবকিছু দেখেন।" (সূরা আল হাদিদ-৪)
"অদৃশ্য জগতের চাবি তার কাছেই রয়েছে, এগুলো তিনি ব্যতীত অন্য কেউ জানেন না। স্থলে ও জলে যা কিছু আছে, তা তিনি জানেন। তার অজ্ঞাতসারে একটি পাতাও ঝরে পড়ে না। মাটির অন্ধকারে এমন কোনো শস্যকণাও অঙ্কুরিত হয় না, অথবা আর্দ্র ও শুষ্ক এমন কোনো বস্তু নেই, যা সুস্পষ্ট কিতাবে নেই।" (সূরা আন’আম-৫৯)
"তিনি অদৃশ্য বিষয় ও প্রত্যক্ষ বিষয়ে জ্ঞাত। তিনিই প্রজ্ঞাময়, সর্বজ্ঞ।" (সুরা আন‘আম-৭৩)
“নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছেই কিয়ামতের জ্ঞান রয়েছে। তিনিই বৃষ্টি বর্ষণ করেন এবং গর্ভাশয়ে যা থাকে, তিনি তা জানেন। কেউ জানে না, আগামীকাল সে কী উপার্জন করবে এবং কেউ জানে না, কোন স্থানে সে মৃত্যুবরণ করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ মহাজ্ঞানী, সর্ববিষয়ে সম্যক জ্ঞাত।” (সুরা লুকমান-৩৪)
"কখনই আপনি কোন বিষয়ে বলবেন না যে, 'আমি তা আগামীকাল করব'। তবে (এ বলা ছাড়া) ‘আল্লাহ যদি চান’।" (সূরা আল কাহফ- ২৩-২৪)
"আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া তোমরা ইচ্ছাও করে থাকোনা" (সূরা তাকভীর-২৯)
"আসমান-যমিন সৃষ্টির ৫০ হাজার বৎসর পূর্বে আল্লাহ তা'আলা সৃষ্টজীবের তাকদিরসমূহ লিখে রেখেছেন।" (সহীহ মুসলিম-৬৬৪১, iHadis.com)

একদিকে আল্লাহর জ্ঞান, ইচ্ছা ও নির্ধারণ। আর অপরদিকে মানুষের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি। কুরআনের আয়াতগুলোতে আমরা উভয়দিকের অস্তিত্বের ব্যাপারে জানতে পারি। তাকদির নির্ধারণের স্তরগুলো সম্পর্কে জানার পর যে কোন চিন্তাশীল ব্যক্তি স্বীকার করবে যে, মানুষের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির অবদান তার ব্যক্তি জীবন বা তার ব্যক্তির সাথে সম্পর্কিত বিষয়াবলি ছাড়া খুবই সীমিত। আর আল্লাহর জ্ঞান, ইচ্ছা ও নির্ধারণের পরিচয় জানার পর চিন্তাশীল বুদ্ধিমান ব্যক্তি স্বাভাবিকভাবে এটা বুঝে যান যে, কোন কিছুই আল্লাহর জ্ঞান, ইচ্ছা ও নির্ধারণের বাহিরে সংঘটিত হয়না। তখনই প্রশ্ন তৈরি হয়, আল্লাহর জ্ঞান, ইচ্ছা ও নির্ধারণের সামনে প্রকৃতপক্ষে মানুষের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি কতটুকু কার্যকর?
স্বাভাবিকভাবে আমাদের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির অধিকারী হওয়া এবং আল্লাহর সবকিছু জানা, তার ইচ্ছা ও নির্ধারণ অনুযায়ী সবকিছু সংঘটিত হওয়াকে সাংঘর্ষিক মনে হয়। কিন্তু আরেকটু গভীরে গিয়ে চিন্তা করলে এগুলোকে সাংঘর্ষিক মনে হবেনা। আল্লাহর সবকিছুর ব্যাপারে জ্ঞান, যা আল্লাহ আগ থেকে জানেন, আমাদেরকে কিভাবে তা করতে বাধ্য করতে পারে? তিনি নিশ্চিতভাবে জানেন, তার মানে এই নয় যে, তিনি এটা করতে মানুষকে বাধ্য করছেন। যেখানে সকল দিক থেকে অতি ক্ষুদ্র মানুষও তার খুবই সামান্য জ্ঞানের ভিত্তিতে অনেক সময় অনুমান করে ভবিষ্যতের নিখুঁত তথ্য দিয়ে দেয়। আমরা তখন সেই মানুষকে তার বলার কারণে কোন অপরাধমূলক কাজ সংঘটিত হয়েছে বলে অভিযুক্ত করিনা। আল্লাহর জ্ঞান ও মানুষের জ্ঞানের মাঝে পার্থক্য হলো, মানুষের জ্ঞান ভুল হয়, কিন্তু আল্লাহর জ্ঞান কখনো ভুল হয়না।
যা কিছু ঘটে সবকিছু আল্লাহ আগ থেকেই জানেন এবং যা কিছু ঘটে তা তার ইচ্ছাতেই ঘটে। আর আল্লাহর ইচ্ছা-অনিচ্ছা ও পছন্দ-অপছন্দ ভিন্ন ভিন্ন জিনিস। তাঁর ইচ্ছাতে কোন কিছু সংঘটিত হওয়ার মানে শুধু এটা নয় যে, সেখানে তার পছন্দ ছিল। দুনিয়াতে ভালো-খারাপ যা কিছুই ঘটে সবকিছুই আল্লাহর ইচ্ছা বা অনুমতিতেই সংঘটিত হয়।

কোন বুদ্ধিমান লোকের পক্ষে এটা বলা সম্ভব নয় যে, মহাবিশ্ব থেকে ব্যক্তিপর্যায় পর্যন্ত সকল স্তরে যত বিধান বলবৎ আছে তা মানুষের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। এই মহা কর্মযজ্ঞে মানুষের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির অবদান খুবই সীমিত, এটা যে কোন চিন্তাশীল ব্যক্তিই ধরতে পারবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি কতটুকু পর্যন্ত অবদান রাখতে পারে? এই প্রশ্নের সুনির্দিষ্ট উত্তর বের করা সম্ভব না হলেও এতটকু বলা যেতে পারে যে, আমাদের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির অবদান তুলনামূলক আমাদের ব্যক্তি জীবনের সাথে সম্পর্কিত বিষয়াবলির উপর বেশি। তারপর পরিবার, সমাজ, দল, রাষ্ট্র এভাবে অন্তর্জাতিক পর্যায় পর্যন্তও আমাদের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির অবদান থেকে থাকে। কিন্তু কোন পর্যায়ে আমাদের ইচ্ছাশক্তির অবদান কতটুকু তা আমরা জানি না। এটা একেক ব্যক্তির ক্ষেত্রে একেক রকম। সবার সব স্তরে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির অবদান সমান হয়না, তাই এ বিষয়ে পরিষ্কার কোন সিদ্ধান্ত দেয়া সম্ভব নয়। আর এটা পরিমাপ করতে চিন্তা-গবেষণায় লিপ্ত হওয়াও উচিত নয়। কারণ এর ফলে এত এত বেশি মত বেরিয়ে আসবে যে, তা ফেতনা তৈরি করা ছাড়া আর কোন উপকারেই আসবেনা। এখন প্রশ্ন হলো, কিয়ামাত দিবসে আমাদের কি ঐসবের জন্যও পাকরাও করা হবে, যাতে আমাদের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির কোন অবদান ছিল না? এই প্রশ্নের উত্তরে দয়াময় আল্লাহর উপরই ভরসা করার পরামর্শ দিবো, যিনি কারো উপর জুলুম না করার ওয়াদা দিয়েছেন। আর তার দয়া সবসময় তার শাস্তি প্রদানের উপর প্রাধান্য পায়।
এখন প্রশ্ন হলো, যেসব কাজে মানুষের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির অবদান আছে, সেগুলোতে আল্লাহর জ্ঞান ও ইচ্ছার কোন অবদান নেই? আমরা কোন কাজের ইচ্ছা করলেই সবসময় তা করতে পারিনা। কারণ একটা কাজ সংঘটিত হওয়ার জন্য শুধু আমাদের ইচ্ছাই যথেষ্ট হয়না। তার সাথে এমন কিছু উপকরণও থাকতে হয়, যেগুলো ছাড়া সেই কাজের বাস্তবায়ন অসম্ভব। এজন্য আমি এই প্রবন্ধে সবজায়গায় স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির সাথে অবদান শব্দটা ব্যবহার করেছি। কারণ, একক কোন কারণে পৃথিবীর কোন কিছু সংঘটিত হয়না(আল্লাহর জ্ঞান ও ইচ্ছা বাদ দিলেও পৃথিবীর কোন কিছু একক কোন কারণে সংঘটিত হয়না)। যে কোন কিছু সংঘটিত হওয়ার পিছনে আল্লাহর জ্ঞান, ইচ্ছা প্রথম ও প্রধান কারণ। তার মাঝে কিছু কিছু বিষয় আছে, যেগুলোতে আল্লাহর জ্ঞান ও ইচ্ছার সাথে মানুষের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তিরও অবদান আছে।

মানুষকে আল্লাহর পৃথিবীতে পাঠানোর উদ্দেশ্য জীবিকা উপার্জন না হলেও পৃথিবীর জীবনের সাথে জীবিকা উপার্জনের ব্যাপারটি অঙ্গাঅঙ্গীভাবে জড়িত। তাকদিরের আলোচনায় জীবিকা উপার্জনের বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া অসম্ভব। অধিকাংশ মানুষের মস্তিষ্কে পূণ্য অর্জনের চিন্তার উপর জীবিকা উপার্জনের চিন্তা প্রাধান্য পায়। আল্লাহই মানুষকে এ দূর্বলতা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন যে, সে দূরবর্তী ফলাফলের চেয়ে নিকটবর্তী ফলাফল নিয়ে বেশি চিন্তিত থাকে। যদিও আল্লাহ মানুষকে সবসময় দূরবর্তী ফলাফলের দিকে মনযোগী হওয়ারই নির্দেশ দিয়ে থাকেন। কারণ, তাতেই প্রকৃত লাভ। জীবিকা প্রত্যেক মানুষের জন্য আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত হলেও তা মানুষকে তার তদবির দ্বারাই উপার্জন করতে হয়। কিন্তু তার তদবির তা বাড়াতে বা কমাতে পারেনা। আল্লাহ সবকিছু আগ থেকে জানা সত্ত্বেও মানুষকে পূণ্য অর্জনের জন্য যেমন তদবির করতে হয়, তেমনি জীবিকা অর্জনের ক্ষেত্রেও তাই করতে হয়। সকল জীবিকার মালিক আল্লাহই এবং সকল জীবিকা আল্লাহর পক্ষ থেকেই আসে। আরেকটু পরিষ্কার করার জন্য একটি পাখির উদাহরণ দেয়া যেতে পারে, যে খাবারের খোঁজে তার বাসা থেকে বের হয়। আর দিন শেষে খালি পেটে ফেরত আসে না। আল্লাহই তার জীবিকার ব্যবস্থা করে দেন। আর তার এ জীবিকা উপার্জনের বিষয়টি আল্লাহ আগ থেকেই অবগত ছিলেন। তাই মানুষকেও জীবিকার জন্য সৎপথে তদবির করতে হবে। তার এ জীবিকা উপার্জনের কারণ আল্লাহর জ্ঞান, ইচ্ছা ও নির্ধারণের পাশাপাশি মানুষের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির অবদানও রয়েছে।

এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, যদি ঐসব কিছুই ঘটে থাকে, যা লিখিত আছে, তাহলে আমাদের এ স্বাধীন ইচ্ছা শক্তির ব্যবহার করার প্রয়োজন কী? যদি আমরা জানতে পারতাম, আমাদের তাকদিরে কী লেখা আছে, তাহলে এর সমাধান সহজ হতো। কিন্তু যেহেতু আমরা আমাদের তাকদির জানি না, এমনও তো হতে পারে, আমার তাকদিরে লেখা আছে, আমি তাকদিরের অযুহাত দিয়ে পূণ্য অর্জনের কোন চেষ্টা করবো না এবং পাপ থেকে নিজেকে দূরে রাখার জন্য কোন ব্যবস্থা নিবো না। যার পরিণতি আমাকে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যাবে। এমনও তো হতে পারে, আমার তাকদিরে লেখা আছে, আমি হবো উদাসীন ও অকর্মণ্য। চরম দারিদ্রতার ভিতর, খেয়ে-না খেয়ে জীবন-যাপন করবো। কেউ কখনো আমার অর্থনৈতিক সাহায্যে এগিয়ে আসবে না। উপরের প্রশ্নের উত্তরটা হলো, আল্লাহ যেহেতু আমাদের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি দিয়েছেন এবং তার কিতাবে এর ঘোষণা দিয়েছেন, তাই বুঝতে হবে, এটা আমাদের ব্যবহারের জন্যই দেয়া হয়েছে। আমাদের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি আল্লাহর সৃষ্টি। আর অনর্থক সৃষ্টি আল্লাহর মর্যাদার পরিপন্থী। সবকিছু নির্ধারিত হওয়ার পরও কেন আল্লাহ মানুষকে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি দিয়ে তার ব্যবহারের ইচ্ছা মানুষের কাছে পোষণ করেন, এটা আল্লাহর হেকমতের অংশ। কোন বান্দার পক্ষে আল্লাহর ততটুকু হিকমাহ পর্যন্তই পৌঁছানো সম্ভব, যতটুকু আল্লাহ তার ব্যাপারে চান।
আল্লাহ আমাদের কাছে চান, বান্দা নিজের অবস্থার প্রতি এবং তার ররের প্রতি সন্তুষ্ট থাকুক। অপরদিকে শয়তান চায়, বান্দা তার নিজের অবস্থার প্রতি এবং তার রবের প্রতি অসন্তুষ্ট থাকুক। আল্লাহ চান, তার বান্দার মন প্রশান্ত থাকুক। আর অপরদিকে শয়তান চায়, বান্দার মন অশান্ত অস্থির থাকুক। কেউ যখন তার নিজের অবস্থার প্রতি ও তার রবের প্রতি অসন্তুষ্ট থাকে এবং তার মন অশান্ত অস্থির থাকে, তখন এটা ভাবার কোন সুযোগ নেই যে, শয়তান আল্লাহর উপর বিজয়ী হয়েছে। (এই উদাহরনের মাধ্যমে এটা বুঝানো যেতে পারে- শিক্ষক জানেন যে, ছাত্ররা পড়াশুনায় অবহেলা করবে। এটা জেনেই তিনি তার ছাত্রদের পড়াশুনায় অবহেলা না করতে নির্দেশ দেন এবং তিনি তার ছাত্রদের কাছে পড়াশুনায় পুরোপুরি মনযোগ আশা করেন। তাছাড়া শয়তানের লড়াইটা মূলত আমাদের নফসের সাথে, আল্লাহর সাথে নয়।) জীবিকার জন্য তদবির করার ক্ষেত্রে আমাদের সবসময় লক্ষ্য রাখতে হবে, আল্লাহ আমাদের কাছে যা চান, আমরা কি তা হতে পারছি? কারণ জীবিকার জন্য তদবির করতে গিয়ে যদি আমাদের অন্তরের অবস্থা তেমন হয়ে যায় যেমন শয়তান চায়, তাহলে তা আমাদেরকে জীবনের আসল উদ্দেশ্য থেকে গাফিল করে ফেলবে।

তাকদিরে বিশ্বাস মানুষকে হিংসা, অহংকার, হতাশা, কৃপনতার মত দোষগুলো থেকে বাঁচিয়ে রাখে।তাকদিরে বিশ্বাস কখনো আমাদের কর্মস্পৃহা নষ্ট করে না। বরং দ্বিধাহীন চিত্তে সামনে অগ্রসর হতে সাহস দেয়। আমাদের মনে বিপদে ধৈর্য ধরার শক্তি তৈরি করে। আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছানোর ঝুঁকিপূর্ণ পথে মনকে গাইরুল্লাহর ভয় থেকে মুক্ত রাখে। কতই না নির্বোধ সে ব্যক্তি, যে তাকদিরে বিশ্বাসের এসব ভালো দিকের দ্বারা উপকৃত না হয়ে তাকদির নিয়ে বিভ্রান্তিকর অহেতুক আলোচনায় লিপ্ত হয়।

সহায়ক গ্রন্থসমূহ-
১. শুআবুল ইমান (ইমাম বাইহাকী)
২. তাকদির কি? (আশরাফ আলী থানভী)
৩. তাকদিরের হাকিকত (আবুল আলা মওদূদী)
৪. তাকদিরঃ আল্লাহর এক গোপন রহস্য (আব্দুল আলীম ইবনে কাউসার)
৫. ইসলামি আকিদা(খন্দোকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর)

সংগৃহিত...

পঠিত : ৯৬১ বার

মন্তব্য: ০