Alapon

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহার বন্ধ হবে কবে?


সবেমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি। ফার্স্ট সেমিস্টার তখন। হলে উঠলাম।

হলে ওঠার সাথে সাথেই সারা দুনিয়ার উপর বীতশ্রদ্ধা জেগে উঠলো। সারাদিন বিশেষ একটি রাজনৈতিক সংগঠনের প্রোগ্রাম। রাতে দুই/তিন ঘন্টা "গেস্টরুম"। মাঝে মাঝে এই গেস্টরুম দিনে দুই/তিন বারও হয়। মাঝে মাঝে ঘুম থেকে ডেকে তুলে গেস্টরুম হয়। কি ক্লাস, কি পরীক্ষা কোনকিছুই মাফ নাই। এই গেস্টরুম মূলত এমন একটা ব্যাপার যেখানে ফার্স্ট ইয়ারের ছেলেদের সবাইকে বাধ্যতামূলকভাবে হাজিরা দিতে হতো একসাথে। ইমিডিয়েট সিনিয়র ব্যাচরা সারদিন কি কি প্রোগ্রাম হয়েছে, কে কে প্রোগ্রাম করে নাই, পরদিন কি কি প্রোগ্রাম আছে এইসবের ফিরিস্তি দিতো। মারধর, গালিগালাজ চলতো অকথ্য। এখানে নাকি ম্যানার শেখানো হয়। হাস্যকর। যারা নিজেরাই ম্যানার জানেনা তারা জুনিয়রদের ম্যানার শিখিয়ে নাকি ভদ্র করবে!

প্রতিদিন গেস্টরুমের পর ৪০/৫০ জন ছেলে কেউ কারো মুখের দিকে তাকাতে পারতাম না। অসম্ভব ভয়, ঘৃণা আর বিষ্ময় কাজ করতো আমাদের। "ইমিডিয়েট সিনিয়র"-রা যেভাবে অসভ্য, অভদ্র, অমানবিক, অশ্রাব্য অসামাজিক আচরণ করতো আমাদের সাথে তাতে আমরা প্রশ্ন তুলতাম এরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পায় কেমন করে।

কিছু কিছু বন্ধুবান্ধব তো গালিগালাজ শুরু করে বলতো, এই কুত্তার বাচ্চারা কেমন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়!
যাই হোক, দুঃখজনকভাবে আমাদের অনেক ব্যাচমেটই এখন সেই "কুত্তার বাচ্চা" হয়ে গেছে। অনেকের কাছে শুনি তারা নাকি সেই বিশেষ দলের অনেক বড় নেতা হয়ে গেছে। জুনিয়রদের ত্রাস!

সাথে আছে গণরুম নামক যন্ত্রণা। একরুমে গাদাগাদি করে ফ্লোরিং করি ৫০ জন। অথচ সেটা ৪ জনের রুম!

জীবন অনেক সুন্দর। চলছে আমাদের অসাধারণ অস্বাভাবিক বিশ্ববিদ্যালয় জীবন!

মার্চ মাসের কথা। আমার একটা ক্লাস টেস্ট (CT) হওয়ার কথা। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম পরীক্ষা বলে কথা। একটা চাপা উত্তেজনা কাজ করছে।

কিন্তু সারাদিন প্রোগ্রাম আর রাতে তো গেস্টরুম আছে। কি করা যায়। একজন "ইমিডিয়েট সিনিয়র"-কে ফোন করে "ছুটি" নিলাম! ব্যাস! মহা অপরাধ হয়ে গেলো।

পড়ছিলাম। কয়েকজন ব্যাচমেট ডেকে নিয়ে গেলো গেস্টরুমে আমাকে। বুকে পানি নাই। এরপর যা ঘটলো সেটা জীবনেও আমার সাথে কেউ করে নাই। অকল্পনাতীত আমার জীবনে। একজন সিনিয়র এসে আমার গলা চেপে ধরে মারতে লাগলো। আরো কয়েকজন চড়-থাপ্পড় দিলো। এরপর রুম থেকে বের করে দিলো।

প্রচন্ড কান্নাকাটি করছিলাম সেদিন রাতে অপমান আর লজ্জায়। এরপর পরের কয়েক মাস আমাকে গেস্টরুমে এই "ছুটি" চাওয়ার জন্য অপমান করা হয়েছে নিয়মিত।

আমার এক ব্যাচমেটের কান ফাটিয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে কয়েকজনকে মেরে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়ার রেকর্ড আছে এই সিনিয়রদের।

একবার নাকি বিশেষ অন্য একটি সংগঠনের কেউ একজন "ধরা" পড়লো হলে। সারারাত অমানবিক নির্যাতন করে সকালে পুলিশে দেয়া হলো তাদের। ক্যাম্পাসে কারো গায়ে সেই ট্যাগ পড়লেই প্রতি ইঞ্চি মাটি কেনো জানি তার শত্রু হয়ে যায়।

প্রতিবার হলে আসার সময় মাকে বলি, মা দোয়া করিও। এই ট্যাগ দিয়ে যেনো আমাকে কেউ না মারে। কারন এই ট্যাগ খেলে কেউ এগিয়ে আসবেনা। আর মারার সময় কিছু জানোয়ার কিভাবে পশু হয়ে যায় নিজের চোখে দেখেছি। আমি হয়তো সহ্য করতে পারবোনা। মরে যাবো।

আবরার ফাহাদের হত্যা নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। কিন্তু আমার কেনো জানি মনে হয়েছিলো শুধুমাত্র আবরার হত্যার বিচার করলেই সবকিছুর সমাধান হয়ে যাবেনা। যুগ যুগ ধরে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেদের যেভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে তার একটা বিহীত হওয়া দরকার।

আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে ছেলেটা আজ "মুজিব সেনা" হয়ে, মুজিব আদর্শের বিশাল সৈনিক সেজে কাউকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করছে সেই ছেলেই হয়তো ক্ষমতার পট পরিবর্তন হলে "জিয়ার একনিষ্ট সৈনিক" সেজে একই কাজ করতো। কাউকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করতো।

আবরার হত্যার পর আরো অনেক ঘটনা ঘটেছে। সম্প্রতি ডাকসুর ভিপিসহ কয়েকজনকে মেরে ICU তে পাঠানো হয়েছে। সবাই পড়াশুনা করে। সবাই বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্র। অথচ অদ্ভুতভাবে এক পক্ষকে অন্য পক্ষের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়েছে।

হলে থেকে দেখেছি কিভাবে "প্যাট্রন-ক্লায়েন্ট" সম্পর্কের মাধ্যমে একটা ছেলে বিপথে চলে যায়। বন্ধুর মাথায় লাঠি ধরে। ছাদ থেকে জুনিয়র অথবা জুনিয়রকে ফেলে দেয়।

ছাত্র রাজনীতি বন্ধ কিংবা আরো বিভিন্ন আলোচনার সাথে এই আলোচনাও জরুরী যে, ছেলেগুলো কেনো এমন হচ্ছে? কি সেই সব ক্যাটালিস্ট? সেই সব বন্ধ করে ছাত্র অধিকার বান্ধব রাজনীতি কিভাবে সম্ভব। সারা বিশ্ব যেখানে এগিয়ে যাচ্ছে সেখানে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেরা কেনো মারামারি করবে?

বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদেরকে রাজনৈতিক হীন স্বার্থে ব্যবহারের এই ঘৃণ্য সংস্কৃতির অবসান চাই। নতুবা অন্ধকার আরো বাড়বে।

Saimum Mahmud

পঠিত : ৪০৩ বার

মন্তব্য: ০