Alapon

ইতিহাসকে ইতিহাসের মত জানার চেষ্টা থাকাটা জরুরী।


আমি যখন অটোমান সিরিজটা শুরু করি,তখন ভেবেছিলাম একশো পোস্টের ভেতর শেষ করে দেবো এই সিরিজ,পরবর্তীতে তাদের বিশাল,আকর্ষনীয় ইতিহাসের ব্যাপকতা,ও কলোনিয়াল শক্তিগুলোর সাথে তাদের সংঘাত,উম্মাহর জন্য তাদের ত্যাগ এবং পতন যুগে বিলাসী জীবন ও ইউরোপীয় রেনেসাঁ পরবর্তী দর্শনের আধিপত্যের শিকার হয়ে পড়ার মাধ্যমে ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যাওয়া অটোমানদদের আমার কাছে মনে হয়েছিল মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস নিয়ে পর্যালোচনার একটা চমৎকার স্পেসিমেন।

অটোমানদের ইতিহাস পড়তে গিয়ে আমার কাছে প্রথমেই যা প্রতিভাত হয় তা হল নিরপেক্ষ ইতিহাস বলে পৃথিবীতে কিছু নেই।
এমনকি যে নিরপেক্ষ ইতিহাস তৈরির চেষ্টা করে, শেষমেশ তার নির্মান করা ইতিহাসও পরিনত হয় তার আদর্শ,সময় ও উৎসগুলো দিয়ে প্রভাবিত এক প্রতিরুপ।

তাই,তথাকথিত ঢোল পেটানো নিরপেক্ষতার ধার কখনোই ধারতে যাই নি। আমার চেষ্টা ছিল শুধুমাত্র যা সত্য,তা তুলে ধরা,এখনো এটাই অব্যাহত আছে।

ইউরোপীয় ঐতিহাসিকরা নানা কারনে ইসলামের শুরু থেকেই ভয়ানক ইসলামবিদ্বেষ বজায় রেখেছেন,তাদের জারি রাখা এই ঘৃণা উঠে এসেছে তাদের লেখনীতে, যেখানে সবক্ষেত্রেই ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহকে যথাসম্ভব খারাপভাবে চিত্রিত করার একটা প্রচেষ্টা বর্তমান ছিল। তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে তা অস্বাভাবিকও নয়।
এই কারনেই ইউরোপীয় সুত্রগুলোর বেশিরভাগ অতিরঞ্জিত বর্ননাগুলো থেকে যুক্তিসঙ্গত অংশগুলো গ্রহনের চেষ্টা করেছি। একইভাবে তুর্কী ও মুসলিম সুত্রগুলোকে ব্যবহার করেছি ভিত্তি হিসেবে, এটাই স্বাভাবিক,কারন যার ইতিহাস,তারই ভাল জানার কথা সে কি করেছে।
আধুনিক ইউরোপীয় পন্ডিতদের বস্তুনিষ্ঠ আলোচনাকে পাশ কাটিয়ে যাবার মত ভুল করি নি সেজন্য,তবে মূল তথ্যভান্ডারে প্রবেশের অক্ষমতার কারনে অনেক জায়গাতেই ঘাটতি রয়ে গেছে।

এখন সুলতান সুলেইমানের শাসনকাল নিয়ে লিখছি।
পাঠকদের একটা অংশ সুলেইমানের ইতিহাসকে তাদের দেখা 'মুহতেসিম ইয়ুজেঈল' সিরিয়ালের সাথে গুবলেট পাকিয়ে ফেলছেন। সিরিয়াল বা মুভি ইতিহাস নির্ভর হতে পারে,কিন্তু তা কখনোই ইতিহাস হয়ে ওঠে না,কেননা দর্শকের কাছে আকর্ষণীয় করার জন্য তাতে নানাভাবে ইতিহাসকে নির্মাতারা বিকৃত করেন।

মুহতেসিম ইয়ুজেঈল বা সুলতান সুলেমান সিরিয়ালে যে সুলেমানকে দেখানো হয়,তিনি প্রায় সারাবছর হেরেমেই কাটান,অথচ বাস্তবতা হল তিনি তার ৪৬ বছরের শাসনকালে সাড়ে দশ বছর কাটিয়েছেন যুদ্ধের ময়দানে সরাসরি উপস্থিত থেকে।
প্রায় আট বছর তিনি নিরলস পরিশ্রম করে তৈরি করেছিলেন উসমানী সালতানাতের সংবিধান,কানুন ই উসমানী।
তার অসাধারন ন্যায়পরায়ণতা গল্পের মত ছড়িয়ে আছে মানুষের মুখে। কিন্তু সেই সাথে তার জীবনে আছে কিছু কালো দাগও।

নবীরাসুলরা ছাড়া কেউই নিষ্পাপ নয়।

তার সবচাইতে কঠোর সমালোচনা করা হয় খুররাম সুলতানের প্রতি তার আসক্তির কারনে।
ইউরোপীয় ঐতিহাসিকদের কিছু অংশ এবং কিছু মুসলিম ঐতিহাসিক দেখাতে চেষ্টা করেন খুররামের প্রতি অতি আসক্তির কারনেই তিনি একে একে ইব্রাহীম পাশা,মুস্তাফা ও কারা আহমেদ পাশাকে হত্যা করেন।
অথচ যদি আপনি সেই সময়ের হোলি রোমান এম্পায়ারের রাষ্ট্রদুত বুসবেকের লেখা Turkish Letters ও ভেনেশিয়ান বাইলো আলভিসে গ্রীতি,ফ্রেঞ্চ দুত ডি আরামনের বর্ননাগুলো পড়েন,সেই সাথে তাশলিজ আলী ইয়াহইয়া বে,নাসুহ এফেন্দী সহ তৎকালীন লেখকদের বর্ননাগুলো বিশ্লেষন করেন তাহলে দেখবেন,এত বড় সাম্রাজ্যের এই ধরনের একজন শাসক শুধুমাত্র স্ত্রীর কানপড়াতে এত বড় সব সিদ্ধান্ত নেন নি। প্রতিটি হত্যার পেছনে ছিল যথেষ্ট যৌক্তিক কারন ও অটোমানদের প্রথার প্রভাব।

সুলেইমানকে দোষ দেয়া যায় মূলত তার দূরদৃষ্টির অভাবের কারনে।
কিন্তু তার দুরদৃষ্টির অভাব থাকার পরেও তিনি এমন এক শাসন কাঠামো স্থাপন করে যেতে পেরেছিলেন যা তার মৃত্যুর পরে চতুর্দিক থেকে ধেয়ে আসা বিপদের মুখেও তিনশো বছরের বেশি স্থায়ী হয়েছিল।
আলেকজান্ডার বা চেঙ্গিস খান বা আমির তাইমুর অথবা সম্রাট আকবর বা শাহ আব্বাস,কারো পক্ষে এধরনের দীর্ঘমেয়াদী কনসলিডেশন সম্ভব হয় নি।
১৫৫৫ সালে তিনি যে সীমানা নির্ধারন করে গেছেন তা এখনো অনেকাংশে ইরাক-ইরানের সাথে তুরস্কের সীমানা হিসেবে স্বীকৃত হয়ে আছে,তার সামরিক দুরদৃষ্টি ছিল না,এই কথার একটা বড় ভ্রান্তি এর মাধ্যমে পরিষ্কার হয়।
ইউরোপে ফ্রান্স ও নেদারল্যান্ডসের স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকা অনেকটাই সুলেইমানের কূটনৈতিক অবদানের ফলাফল।

সেই সাথে পর্তুগীজ স্প্যানিশদের আক্রমন থেকে তিনি হারামাইন শারীফাইন ও গোটা উত্তর আফ্রিকার মুসলিমদের রক্ষা করেছিলেন,ভূমধ্যসাগরে স্প্যানিশ আর ভারত মহাসাগরে পর্তুগীজদের দমন করায় তার ভুমিকা ছিল অবিস্মরণীয়।

সিরিয়াল ইতিহাস না।
সিরিয়ালের কাহিনী থেকে বের হোন। মুসলিমদের ইতিহাস জানতে হলে সেই ইতিহাস নিজে পড়ে জানার চেষ্টা করতে হবে,কেউ আপনাকে এসে মুখে তুলে গিলিয়ে দিয়ে যাবে না।
সেক্যুলার বা ক্রিশ্চিয়ানরা আপনাকে ইতিহাসের সেক্যুলার বা ক্রিশ্চিয়ান ভার্সন গেলাতে চাইবে।
তাদের ভার্সনকে প্রকৃত ইতিহাস ভাবার কোন কারন নেই। আমাদের ইতিহাস নির্মানের কাজ আমাদেরই।

Muhammad Sajal

পঠিত : ৬২৪ বার

মন্তব্য: ০