Alapon

গাজী খান জাহানের খলিফাতাবাদে একদিন



বন্ধুবর মঈন সাহেবের বিয়ে। খুলনায় যেতেই হবে। তার একদিন পর আবার আরেক কলিগের বিয়ে সাতক্ষীরায়। সেখানেও যেতে হবে। এদিকে পকেট প্রায় ফাঁকা। কী যে করি! সুন্দরবনে যাবো অনেক দিন ধরেই ভাবছি। তবে নানান প্রতিবন্ধকতায় সুন্দরবনে যাওয়া হয়নি। যাই হোক পকেটের অংকের সাথে জরুরী প্রয়োজনের হিসেব কোনদিনেই মিলে না।

অবশেষে প্ল্যান করলাম খুলনা-সাতক্ষীরা থেকে ঘুরে আসে। সাথে বাগেরহাট ও সুন্দরবনও একনজর দেখে আসি।

একজন দুজন করে সাতজন জুটে গেলো। এদিকে আবহাওয়া অধিদপ্তর ফোরকাস্ট করলো আগামী কয়েকদিন শীত বেড়ে যাবে, কুয়াশা হবে প্রচুর, শৈত্যপ্রবাহ সাথে বৃষ্টিও থাকবে।

রাতে রওনা হলাম। পরদিন দুপুরে বিয়ে। যেহেতু আবহাওয়া সুবিধের না, ভেবেছি আমাদের পৌঁছাতে সকাল গড়িয়ে যাবে। বাসে উঠে গল্প-গুজব শেষ করে যেই চোখটা একটু লেগে আসলো তখনই মাওয়া ঘাটে আমাদের বাস থকে নামিয়ে ফেরিতে উঠানো হলো। ফেরিতে বসা পরের কথা দাঁড়ানোরও পর্যাপ্ত জায়গা নেই। অবশেষে পদ্মা নদীর ঐ পাড়ে পৌঁছলাম।

ভোগান্তি ছাড়াই ঐ পাড়ে দাঁড়ানো কানেক্টিং বাস পেয়ে গেলাম। বাসে উঠেই ঘুমিয়ে পড়লাম। এই সময় এক সহযাত্রীর হাঁক ডাকে ঘুম টুটে গেলো। সে আমাদের সবাইকে চিৎকার করে জানালো গাড়ি খুলনা শহর পার হয়ে চলে যাচ্ছে। তখনো সুবহে সাদিকও হয়নি। শিরোমনি বাজারে নামলাম। সেখান থেকে আবার সোনাডাঙায় ফেরত এলাম। ঘুমে থাকার কারণে কিছু টাকা খরচ হলো। কিন্তু খরচেই চাইতেই যেটা বেশি গায়ে লেগেছে তা হলো ঠান্ডা। সোনাডাঙা বাস স্টেশনে ফেরত আসতে গিয়ে জমে গেছি।

নামাজ ও নাস্তা শেষ করে রওনা হলাম বাগেরহাট ষাট গম্বুজ মসজিদের উদ্দেশ্যে। প্রথমে গেলাম গাজী খান জাহান আলীর মাজারে।

বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারের ক্ষেত্রে যেসকল ওলী-আউলিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন, তাঁদের মধ্যে স্মরণীয় একটি নাম হযরত খান জাহান আলী (র)। একাধারে তিনি ছিলেন একজন যোদ্ধা, সাধক, ধর্ম প্রচারক ও সুশাসক। জীবনের একটা বিশাল সময় তিনি ব্যয় করেন ইসলামের সেবায়। দক্ষিণবঙ্গে খান জাহান আলী খলিফাতাবাদ নামে ইসলামী শাসন চালু করেন। খান জাহান আলীর প্রকৃত জন্ম তারিখ জানা যায় না। তিনি প্রায় ৪০ বছর দক্ষিণবঙ্গে ইসলাম প্রচার ও শাসনকার্য পরিচালনা করেন।

হজরত খান জাহান আলী (রহ.) ১৩৬৯ খ্রিস্টাব্দে দিল্লির এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম আকবর খাঁ এবং মাতার নাম আম্বিয়া বিবি। খান জাহান আলীর প্রাথমিক শিক্ষা তার পিতার কাছে শুরু হলেও তিনি তার মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন দিল্লির বিখ্যাত অলি ও কামেল পীর শাহ নেয়ামত উল্লাহর কাছে। তিনি কোরআন, হাদিস, সুন্নাহ ও ফিকহ শাস্ত্রের ওপর গভীর জ্ঞানার্জন করেন।

খান জাহান আলী ১৩৮৯ খ্রিস্টাব্দে তুঘলক সেনাবাহিনীতে সেনাপতির পদে কর্মজীবন আরম্ভ করেন। অতি অল্প সময়ের মধ্যেই প্রধান সেনাপতি পদে উন্নীত হন। ১৩৯৪ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ২৭ বছর বয়সে তিনি জৈনপুর প্রদেশের গভর্ণর পদে যোগ দেন। পরবর্তী জীবনে নানা ধাপ পেরিয়ে জৈনপুর থেকে প্রচুর অর্থসম্পদ এবং প্রায় চল্লিশ হাজার সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী নিয়ে বাংলাদেশে আগমন করেন। তার এই বাহিনীতে কয়েকজন সূফি ও প্রকৌশলী ছিল। তিনি তদানীন্তন বাংলার রাজধানীর দিকে না যেয়ে সুন্দরবন অঞ্চলের দিকে আসেন এবং এখানে ইসলামী শাসন কায়েম করেন।

তিনি এই বৃহৎ অঞ্চলে কৃষি বিপ্লবের সূচনা করেন। নোনা পানির এই অঞ্চলে মিঠা পানির ব্যবস্থা করেন অসংখ্য বিশাল বিশাল দীঘি খনন করে, যার অনেকই খাঞ্জালির দীঘি নামে পরিচিত। অনেক রাস্তা-ঘাট, বাজার, সরাইখানা (হোটেল) নির্মাণ করেন। তার নির্মিত রাস্তা খাঞ্জালির জাঙ্গাল নামে অভিহিত। তিনি এই অঞ্চলে শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে বিভিন্ন স্থানে মাদরাসা ও খানকাহ স্থাপন করেন।
খান জাহান আলী (রহ.) এই অঞ্চলে পাথরের তৈরি মসজিদ নির্মাণ করেন। দূর-দূরান্ত থেকে পাথর নিয়ে আসাকে কেন্দ্র করে অনেক কিংবদন্তি এই অঞ্চলের মানুষের মুখে মুখে এখনও শোনা যায়।

খান জাহান আলীর আগমনকালে দক্ষিণবঙ্গের বেশিরভাগ জায়গা ছিল বনাঞ্চল। বন-জঙ্গল সাফ করে তিনি ও তার অনুসারীরা দক্ষিণবঙ্গকে বসবাসের উপযোগী করে তোলেন। পুরো দক্ষিণাঞ্চল একরকম তার রাজ্য ছিল। কোনো বাধা ছাড়াই এই এলাকা তিনি শাসন করতে থাকেন। জনগণও তার নেতৃত্ব মেনে নেয়। তবে আঞ্চলিক শাসক হলেও প্রকট শাসকসুলভ জীবনযাপন কখনোই করেননি খান জাহান আলী। স্বাধীন বাদশাহদের মতো তিনি চলতেন না। এমনকি নিজের নামে কোনো মুদ্রার প্রচলনও তিনি করেননি। এছাড়া গৌড়ের সুলতান নাসিরুদ্দিন মাহমুদ শাহের সময় তার সনদ নিয়ে দক্ষিণবঙ্গ শাসন করেছেন তিনি। খান জাহান আলীর মৃত্যুর পরে তার প্রতিষ্ঠিত খলিফাতাবাদেই গড়ে ওঠে ঐতিহাসিক টাকশাল। পরবর্তী ৪০/৫০ বছর এই টাকশাল থেকেই বাংলার স্বাধীন সুলতানদের মুদ্রা তৈরি হতো। বিখ্যাত ষাট গম্বুজ মসজিদ ছিল তার দরবারগৃহ। ষাট গম্বুজ মসজিদ হতে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে ছিল খান জাহান আলীর বসতবাড়ি। এখন সেটির কোনো অস্তিত্বই নেই, সেটি আসলেই দুর্বল স্থাপনা ছিলো অথচ তার পাবলিক স্থাপনাগুলোর ভিত ছিলো শক্তিশালী। যেগুলো এখনো বর্তমান।

খান জাহান আলী তার দীর্ঘ শাসনামলে এই অঞ্চলের ব্যাপক উন্নতি সাধন করেন। প্রায় ২০/২৫টি গ্রাম নিয়ে তার রাজধানী খলিফাতাবাদ গড়ে উঠেছিল। এখানে তিনি থানা, কাচারি, বিভিন্ন সরকারী দফতর, বিচারালয়, সেনানিবাস ইত্যাদি নির্মাণ করেন। প্রশাসনিক সুবিধার্থে দক্ষিণবঙ্গকে তিনি ভাগ করেন কয়েকটি ভাগে, ঘরে ঘরে পৌঁছে দেন সুশাসন। তার এই ছোটখাট রাজ্যে তিনি কায়েম করেন ইসলামী হুকুমত। খলিফাতাবাদ বা বাগেরহাট এলাকায় ইসলাম প্রচারের সময় স্থানীয় প্রভাবশালী হিন্দুদের বাধার সম্মুখীন হন খান জাহান আলী। তাদের বিরোধিতার কারণে ঐ এলাকার রণবিজয়পুর, ফতেহপুর, পিলঙ্গজ প্রভৃতি স্থানে হিন্দুদের সাথে যুদ্ধ হয় মুসলিমদের। খান জাহান আলী তাদের পর্যুদস্ত করে নিজের শাসনক্ষমতা কায়েম করতে সমর্থ হন।

প্রায় ৪০ বছর স্বাচ্ছন্দ্যে দক্ষিণবঙ্গে রাজত্ব করেন খান জাহান আলী। এই পুরো এলাকায় ইসলামের আলো ছড়িয়ে দেন এই মহান সাধক। তাঁর সুশাসন ও বিনয়ী স্বভাবে আকৃষ্ট হয়ে দলে দলে এই এলাকার মানুষ ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নেয়। জীবনের শেষ দিনগুলো দরগায় বসে আল্লাহর ধ্যানে কাটিয়ে দিতেন তিনি। অনেক মূল্যবান বাণী তিনি দিয়ে যান নিজের প্রজ্ঞা ও সাধনালব্ধ জ্ঞান থেকে। এই মহান শাসক ও ধর্ম প্রচারক ৮৬৩ হিজরীর ২৬ জিলহজ্জ, ইংরেজি ১৪৫৯ খ্রিস্টাব্দের ২৩ অক্টোবর মৃত্যুবরণ করেন।

খান জাহান আলীর মাজার একটি পবিত্র স্থান। কিন্তু অন্যান্য মাজারের মতো একেও লোকজন সিজদার স্থান বানিয়ে ফেলেছে। কথিত মারেফতপন্থী সাধু-সন্নাসী ও ফকিরগণই মূলত এই সিজদা প্রথার প্রবর্তক। মাজার জুড়ে চলে একাধিক শিরকি কাজ-কারবার। মাজারের দিঘীতে থাকা কালাপাহাড় ও ধলাপাহাড় নামক দুটি কুমীরের বংশধরেরা যুগ যুগ ধরে এখনও বাস করছে। লোকে মানত করার নামে এদের কাছে মুরগী-ছাগল ইত্যাদি খেতে দিয়ে যায়। এসব মানতের সামগ্রী নিয়ে মাজার সংশ্লিষ্ট কিছু অসাধু মানুষ করে চলেছে ব্যবসা। তবে এসব ব্যবসার পরিমাণ কমেছে। আগে আরো বেশি নোংরামি ছিলো।

খান জাহান আলীর মাজার সংশ্লিষ্ট বিশাল দিঘী যা ঠাকুরদিঘী নামে পরিচিত সেখানে খান জাহান একজোড়া কুমির ছেড়েছিলেন। কথিত আছে এই কুমির জোড়া তার বাহন হিসেবে ব্যবহৃত হতো। সেই কুমিরের বংশধররা সাতশ বছর ধরে কালাপাহাড় এবং ধলাপাহাড় নামে ছিল। তাদের সর্বশেষ বংশধর ২০১৫ সালে মারা গিয়েছে। এই কুমিরগুলোর ব্যতিক্রম হলো এরা কখনোই হিংস্রতা দেখায়নি। একেবারেই শান্ত ছিলো। মানুষ তাদের গায়ে হাত বুলিয়ে দিতো। এখনো সেই দিঘীতে কুমির আছে। তাদের পরে এনে ছাড়া হয়েছে এখানে। এরা শুরুতে কিছুটা হিংস্র থাকলেও এখন শান্ত আচরণ করে। তবে তারা আগের কুমিরদের মতো মানুষবান্ধব নয়।

পঠিত : ৮৭৪ বার

মন্তব্য: ০