Alapon

বাংলা ভাষায় পদ্য রীতির প্রাধান্য ও ওয়াজে সুরের প্রভাব...


ওয়াজ-নসিহতে সুর কেন? এই প্রশ্ন নতুন করে দেখা দিয়েছে! যদিও বিষয়টি নূতন কোন ঘটনা নয় এর পিছনে পেঁচিয়ে আছে শত বছরের ইতিহাস। বাংলা সাহিত্যের জ্ঞানী ও আলেমদের কাছে এ সম্পর্কিত পরিষ্কার জ্ঞান থাকলেও বেশীর ভাগ জনগোষ্ঠীর কাছে ব্যাপারটি অপরিষ্কার।

কথার ভিতরে যাবার আগে, বাংলা সাহিত্যের কিছু গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট তুলে ধরাটা জরুরী মনে করছি। আমরা বর্তমানে যেভাবে গদ্য রীতিতে পড়ি, লিখি কিংবা বলি। তা পূর্নাঙ্গ পদ্ধতিতে সৃষ্টি হয়েছে মাত্র দুইশত বছর আগে। আগে বাংলা ভাষার লিখনিতে শুধুমাত্র দাড়ির ব্যবহার ছিল। বিদ্যাসাগর (',' ';' ':') এসব যতিচিহ্ন ইংরেজি থেকে হাওলাত করে বাংলায় ব্যবহার করেন। এখন আমরা তাই করছি। বাংলা ভাষায় আমরা যে প্রাঞ্জল পদ্ধতিতে ভাষণ দিচ্ছি এটাতে মুসলমানদের সাথে অমুসলিমদের অবদানও অনেক। অতীতে বাংলা ভাষায় পদ্য রীতি তথা কবিতার প্রাধান্য ছিল ব্যাপক। দ্বাদশ শতাব্দী থেকে সেরা সেরা সকল সাহিত্যই সৃষ্টি হয়েছে কবিতা দিয়ে। বর্তমানে আমাদের দেশে গান ও কবিতা দুটো আলাদা জিনিষ। এখন "গান গাওয়া হয়, কবিতা পাঠ করা হয়"। কিন্তু প্রাচীন কালের প্রতিটি পদ্যই গানের সুরে গাওয়া হত। মানুষের রক্তে, মাংসে, চিন্তা, চেতনায়, আচার, আচরণ ও প্রকাশ ভঙ্গিতে কবিতার ছন্দ ও সুর মিলে-মিশে একাকার হয়ে যেত।

আবদুল হাকিম, শাহ মোহাম্মদ সগির, আলাওল সহ বহু সাহিত্যিকেরা সেরা সেরা গ্রন্থগুলো কবিতার ছন্দে লিখেছেন এসব পড়তে সুর লাগে। শুধু মুসলমান কেন এই অঞ্চলের সকল ধর্মের লিপি ও রাজ্য বিজেতা গন কবিতা গ্রন্থকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন। অন্যতম মহাকাব্য শাহনামা, ফার্সি ভাষার ছন্দে রচয়িত। বৌদ্ধদের চর্যাপদ কবিতার মত লিখিত। হিন্দুদের রামায়ণ-মহাভারত কবিতার ছন্দে রচয়িত। সুলতানি আমলে মুসলিম শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় এই গ্রন্থ দুটোকে অনুবাদ করা হয়; সেগুলোও কবিতার ভাষায় অনুবাদকৃত। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, ড. আবদুল করিম পুরানো লোক কথার পাণ্ডুলিপি উদ্ধার করেছেন সবই কবিতার ছন্দে লিখিত।

চিঠিপত্র ও দলীল দস্তাবেজ লিখার গরজে গদ্য রীতির চালু হয়। এসব লিখতে হত তাল পাতায়। আমাদের জলবায়ু আর্দ্র বলে এসব লিখা নষ্ট হয়ে যেত। অষ্টাদশ শতকে যখন মুদ্রণ যন্ত্র ভারতে আসে তখন থেকে গদ্য রীতিতে লিখা ও সংরক্ষণ করার বিরাট সুযোগ এসে যায়। এ কাজে ব্রিটিশ ও পর্তুগীজদের ভূমিকাও উল্লেখযোগ্য।

ইতিহাস গবেষকেরা চিন্তা করেছেন, এই অঞ্চলের মানুষের কাছে পদ্যরীতি, সুর, গান এগুলো পছন্দ কেন! তারা দেখতে পেয়েছেন, সুর, পদ্য, ছন্দ রীতিতে, লম্বা ঘটনা সহজে রপ্ত করা যায়। মুখস্থ করা যায় অনায়াসে। অন্যকেও শিখানোর জন্য সহজসাধ্য। কাগজ দুর্লভ, তাল পাতার লিখা ক্ষণস্থায়ী, দীর্ঘদিন রক্ষণাবেক্ষণে অনুপযোগী জলবায়ুর এই অঞ্চলে জ্ঞানকে মুখস্থ রাখাই হল উত্তম ব্যবস্থা। মানুষ কোরআন মুখস্থ রাখে, এটাতে আল্লাহর কুদরতি হাত থাকে। কিন্তু মানুষের বানানো সাহিত্য সুর-ছন্দ বিহীন হলে তা মুখস্থ রাখা মোটেও সহজ নয়। এই কারণেই এই অঞ্চলে কথার মাঝে সুরের যোগসূত্র সৃষ্টি হয়েছে। যুগে যুগে কবিদের ব্যাপক কবিদের জন্ম হয়েছে।

বাংলা পিডিয়ার মতে, অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রারম্ভে সৃষ্টি হয় পুথি সাহিত্য। এই সাহিত্য শতভাগ সুর ও ছন্দ নির্ভর। আরবি, ফার্সি, তুর্কি, উর্দুর সংমিশ্রণে এক নতুন বাংলা সাহিত্য! এই সাহিত্য সব মানুষ বুঝত না। একজন পাঠ করতেন। তাকে 'শায়ের' বলা হত। শায়ের অর্থ কবি, এটি আরবি শব্দ। অন্যজন বিদেশী শব্দ ও ছন্দের ব্যাখ্যা করতেন। তিনি দোভাষী। এজন্য এসব সাহিত্যকে দোভাষী পুথি বলা হত। কলিকাতার বটতলার প্রেসে এগুলো ছাপানো হত বলে, বটতলার পুথি হিসেবে চিত্রিত করা হত। এসব পুথি সর্বসাধারণের কাছে সমাদৃত ছিল। এর স্রোতা ছিল মুসলমানেরা। তাই এই পুথি সাহিত্যকে আবার মুসলমানি সাহিত্য বলা হয়।

নিম্নবিত্ত চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী ও শ্রমজীবী মানুষের কাছে পুথির জনপ্রিয়তা ছিল আকাশচুম্বী। মানুষ অনেক অর্থ ব্যয় করে পুথির মাহফিল করত। বিয়ে-শাদী, মেজবানে পুথির আসর বসত। এসব পুথির কাহিনী মানুষ বিশ্বাস করত, কান্নায় বুক ভাসিয়ে ফেলত। সারা দেশে পুথির কদর বাড়ে, পৃষ্ঠপোষকতা পায়। যে মৌলভী এসবের বিরুদ্ধে যেত তিনি গ্রহণযোগ্যতা হারাতেন। আবার যে মৌলভীর সুরেলা কণ্ঠ না থাকত, তার কোন গুরুত্বই থাকত না।

ইউসুফ-জুলেখা, লায়লী-মজনু, শিরি-ফরহাদের মত প্রেমের পুঁথিকে বলা হত পবিত্র প্রেমের কাহিনী। জঙ্গনামা, আমীর হামজা, সোনাভান, জৈগুনের পুথি, হাতেম তাইয়ের মত পুঁথিকে বলা হত মুসলমানদের হারানো ঐতিহ্যের ধারক-বাহক। কাসাসুল আম্বিয়া, তাজকিরাতুল আউলিয়া, হাজার মসলা সহ অগণিত পুঁথিকে ভাবা হত ইসলামের ইতিহাস। এসব পুঁথি পড়ত সমাজের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য শিক্ষিত মানুষেরা। তাদের মধ্যে আলেমের সংখ্যাও কম ছিলনা, যারা মসজিদ কিংবা দরগাহে সম্মানিত ছিলেন।

এর পরে মুসলমানদের সমাজে ঝাঁকিয়ে বসল শরীয়ত-মারফত, শ্যামা, জারি গান আর সারি গান। শরীয়ত-মারফত, জারি গান, ওরসের গান আজকের এই দিন পর্যন্ত বাংলাদেশের সর্বত্র সমাদৃত। অনেক মানুষ এসব গানকে ধর্মীয় গান মনে করে। যার কণ্ঠে যত সুর, মানুষ তার দিকেই ঝুঁকে পড়ে। সর্বোপরি এদেশের মানুষেরা খুবই ধার্মিক কিন্তু দেখা গেছে যার কণ্ঠ সুন্দর তার কথা মনদিয়ে শুনে। তার কদর বেশী, গ্রহণযোগ্যতা বেশী, প্রচার-প্রসার, পরিচিতি বেশী। বেসুরো গলার মানুষ জ্ঞানী হলেও উপেক্ষিত হয়। ফলে কিছু শ্রেণীর আলেমেরা মানুষের এই আকর্ষণকেও আঁকড়ে ধরার প্রত্যয়ে হালকায়ে জিকির, সুর করে রাসুল (সা) কে সালাম দেবার নিয়ম সৃষ্টি করেছেন। মানুষ এতে খুব তৃপ্তি পায়, সময় ব্যয় ও অর্থকড়ি খরচ করে।

প্রবন্ধ লম্বা হবার ভয়ে তথ্য উপস্থাপন সংক্ষিপ্ত করতে বাধ্য হলাম। তবে যে কথাগুলো পয়েন্ট আকারে উল্লেখ করা যায়, তা হল, আমাদের জাতি সুন্দর কণ্ঠের প্রতি দুর্বল, কবিতার ছন্দের প্রতি দুর্বল। এটা হাজার বছর ধরে তাদের ডিএন এর মধ্যে সেট হয়ে গেছে। হ্যাঁ, এটা ঠিক করা যাবে। সরাসরি কোরআন-হাদিসের প্রচারের মাধ্যমেই তা সম্ভব। তবে, মানুষের ফিতরাত তথা বংশগত এই চরিত্রের বিরোধিতা করলে, কিংবা রুক্ষতা, কঠোরতা প্রদর্শন করা হলে, উল্টো নিজেরা বদমেজাজি হিসেবে চিহ্নিত হওয়া কিংবা মাঠ সংকুচিত হওয়ার কারণ ঘটবে। বৈশিষ্ট্য হিসেবে কিছু আলেম হয়ত সুরের সহযোগিতা নিয়ে থাকে কিন্তু সেটার পর্যায় চূড়ান্ত হারাম না পর্যন্ত তাদের পিছনে লেগে থাকারও কোন যৌক্তিকতা নেই। কেননা ক্ষতি তো নিজেদেরই; ধন্ধ ও বিভ্রান্তি তো মুসলমানদের মাঝেই বাড়তে থাকবে।

কিছু জ্ঞানী মানুষদের কথায়, আত্মবিশ্বাসের অভাব পরিলক্ষিত হয়। তাদের কথায় বুঝা যায় যে, "ঐ আলেমের সুরেলা কণ্ঠের কারণেই ওয়াজ মাহফিলে মানুষ বেশী হয়! ওসব মাহফিলে কোরআন হাদিসের আলোচনার কিছুই নেই"। এসব কথায় অন্যের গীবত গাওয়া হয় এবং আল্লাহর উপর নিজের ক্ষুদ্র আস্থাহীনতার প্রকাশ ঘটায়। প্রতিটি মুমিন মুসলমানের কাজ হল পরিচ্ছন্ন হৃদয়ে কোরআনের দাওয়াত প্রচার করা। সেখানে কারা আসল, কতজন আসল, অন্যজনের মাহফিলে অত-জন গেল কেন? সে চিন্তা কোন প্রকৃত দায়ীর হতে পারেনা! এটা আল্লাহর চিন্তার বিষয়, বান্দার নয়! আল্লাহ বলেছেন, “অতএব তুমি যে বিষয়ে আদিষ্ট হয়েছ তা প্রকাশ্যে প্রচার কর” - হিজর'৯৪।

রাসুল (সা) বলেছেন, "আমার পক্ষ থেকে একটি আয়াত হলেও পৌঁছে দাও" বুখারী'৩৪৬১। বেশীর ভাগ মানুষের কাছে কোরআন-হাদিসের সঠিক বানী পৌঁছে গেলে এমনিতেই মানুষের মন থেকে কবিতা, সূর, ছন্দের আকর্ষণ হারিয়ে যাবে। সিরিয়ার মানুষেরা মুসলমানদের চরিত্র দেখেই দলে দলে মুসলমান হয়েছিল। ওয়াজ-নসিহতে নয়। অন্তরে বিদ্বেষ পোষণ করে যতই দাওয়াতি কাজ করা হউক না কেন, কোন আশাপ্রদ কাজ কখনও হবে না।

Nazrul Islam Tipu

পঠিত : ৬৮৭ বার

মন্তব্য: ০